Crss colum

Tuesday, November 21, 2017

গল্পঃ - দেহহীন।

কিছুক্ষণ আগে আমার মৃত্যু হয়েছে। প্রথমে বুঝতে পারি নি। কর্মক্ষেত্রে একা থাকি। স্ত্রী ও কন্যা আগে আমার সঙ্গেই থাকত। কিন্তু কিছুদিন আগে আমি নতুন বাড়ি করার পর ,সেখানেই থাকে। আমি পুরানো অফিস কোয়ার্টারে একাকী দিন যাপন করি। সপ্তাহে একদিন বা কখনো দুই দিন বাড়ি যাই। বাড়ি বেশি দূরে নয়। ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা। কিন্তু প্রতিদিন ভোরবেলা অফিসে আস্তে অসুবিধা তাই এখানেই থাকি।
গতকাল সন্ধ্যা থেকেই শরীরটা একটু গড়বড়  করছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম এসিডিটি হয়েছে। ঘরে একটা এন্টাসিড ছিল সেটাই খেয়েছিলাম। রাত ন'টা নাগাদ আমার স্ত্রী মিনতি ফোন করেছিল । এটা-ওটা কথা বলার পর, আমি বলেছিলাম’ “শরীরটা ভালো নেই”। মিনতি  শুনে ই আমায় একগাদা কথা শুনিয়ে দিল। আমি নাকি লোভ সামলাতে না পেরে এটা-ওটা খাই, তাই আমার এত শরীর খারাপ করে। রাগে আমি তৎক্ষণাৎ ফোনটা কেটে দিয়েছিলাম। রাত্রে তেমন কিছু আর না খেয়ে , শুধু  একগ্লাস দুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম । রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি। ভোর চারটে নাগাদ একবার বাথরুমে গিয়েছিলাম। বাথরুম থেকে এসে সবে  বিছানায় শুয়েছি এমন সময় বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে উঠলো। প্রথমে খুব একটা পাত্তা দিইনি। তারপর ক্রমশ যন্ত্রণাটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মনে হয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম।
পুনরায় যখন আমার অস্তিত্বে ফিরে এলাম দেখলাম আমি আমার ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। ঘরে নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। নাইটল্যাম্পের মৃদু আলোয় মনে হল বিছানায় কেউ একজন শুয়ে আছে। প্রথম নজরে মনে হল আমার চেনা কেউ। হঠাৎ আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম ,” “ ঐ লোকটা তো আমি”।
তবে কি আমি  , অনির্বাণ চ‍্যাটার্জ্জী কি আর বেঁচে নেই ??
আমার এবার সত্যি খুব ভয় পাচ্ছে।
এখনো যে আমার অনেক কাজ বাকি আছে।
না, যে করেই হোক আমাকে বাঁচতেই  হবে। আমি বারবার চেষ্টা করলাম শরীরের মধ্যে পুনরায় প্রবেশ  করতে ।।
না কিছুতেই পারছি না।
এখনো যে আমার অনেক কাজ বাকি। মেয়ে টার পড়াশোনা বাকি। ইচ্ছা ছিলো মেয়ে টার  বিয়ে ভালো ঘরে ধুমধাম করে দেবো।
কিছুই শেষ পর্যন্ত হলোনা।
আমার মৃতদেহের দিকে চেয়ে এত কথা ভাবছিলাম ।
একটা ফাঁকা ঘরে, একটা মৃতদেহ র সাথে এতক্ষন আছি বেশ ভয় ভয় লাগছে। হলেও বা নিজের মৃতদেহ। পাশের ঘরে গেলাম। পাশের ঘরটি ঠাকুরঘর। বহুদিন থেকে আমি মা কালীর একনিষ্ঠ ভক্ত। বছরে বছরে আমার ঘরে কালীপুজোর দিন বড় করে পুজো হয়। মা কালীর মূর্তি র দিকে চেয়ে মনে মনে বললাম “মাগো, তুই একি করলি ? এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। এর মধ্যেই টেনে নিলি।”

এখনই ভোর হবে। হরিপদ ঘর পরিষ্কার করতে আসবে।
হঠাৎ ইচ্ছা হল মিনতিকে দেখবার। মূহুর্তের মধ্যেই দেখি আমি আমার ঘরে পৌঁছিয়ে গিয়েছি। নতুন কেনা বক্স খাটের উপর মিনতি ও লেখা শুয়ে আছে। মিনতি বাচ্চাদের মত  জড়সড় হয়ে শুয়ে থাকে। আর আমার মেয়ে লেখা এখনো মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। দু'জনেই এখনো জানেনা, আমি আর নেই।
হঠাৎ মনে হল হরিপদ ডাকছে “বাবু, ও বাবু, দরজাটা খুলুন।”
তৎক্ষণাৎ আমি আবার আমার ঘরে পৌঁছে গিয়েছি।
ওরে হরিপদো, আমি আর কখনই দরজা খুলব না।
বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর, পাশাপাশি কোয়ার্টারের কয়েকজন চলে এলো। হরিপদো তাদের উদ্দেশ্যে বলল, “অনেকক্ষণ ধরে ডাকছি, বাবু সাড়া দিচ্ছে না।”
অবিলম্বে কিছুক্ষণের মধ্যে ই অফিসের সিকিউরিটি অফিসার চলে এলেন। সবাই মিলে দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল। দরজা ভেঙ্গে ফেলা মাত্র হরিপদো ছিটকে  ঘরের ভিতরে ঢুকল। আমাকে দেখামাত্রই “বাবু  গো” বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমি জানি হরিপদো আমায় খুবই ভালবাসতো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর চলে গেল সর্বত্র।
আমার স্ত্রী ,মেয়ে ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন , সহকর্মীরা ও অধীনস্ত লোকেরা সবাই এসে ভিড় করলো।
আমি ছিলাম অফিসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জুনিয়ার ম‍্যানেজার । তাই লোকের ভীড় তো হবেই।
আমি সবকিছুই দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কেউ আমায় দেখতে পাচ্ছে না। আমার কোয়ার্টারের সামনের ফাঁকা জায়গায় আমার মৃতদেহ ছোট মৃতদেহ বহন কারি খাটের উপর রাখা হয়েছে। গলায় অফিসের সহকর্মীদের দেয়া ফুলের মালা। চড়া গন্ধের ধূপ জ্বলছে। একদিকে দেখলাম আমার সহকর্মী সুশান্ত খুব কাঁদছে। দেবুকে দেখলাম তার কাছে গিয়ে  সান্তনা দিচ্ছে। সুশান্ত কাঁদতে কাঁদতে বলল, “অনির্বাণ দার সাথে আমার মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু আমি তাকে বড় দাদার চোখে দেখতাম। আজ মানুষটি চলে গেছে ন , আমার মনে হচ্ছে যেন প্রিয়জন হারালাম।”
এক কোণে দেখলাম আমার মেয়ে লেখা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আমি জানি ওর কাছে আমি ই সব ছিলাম।
ক্রমশ মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল। মেয়ে মুখাগ্নি করল । আমি একধারে দাঁড়িয়ে দেখছি আমার নশ্বর শরীরটাকে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করছে।
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ আমাকে ‘খোকা’ বলে ডাকলো। চেয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছেন। মা বহুদিন আগে গত হয়েছেন। মা বললেন “খোকা এখানে আর থাকতে হবে না। চল তোকে তোর নিজের জায়গায় পৌঁছে দিই।”
আমি বললাম “কোথায় মা”?
মা বললেন “মৃত্যু র পর পুনরায় জন্ম না নেওয়া পর্যন্ত প্রত‍্যেক আত্মার কর্ম অনুযায়ী নিজের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে জ্ঞান অর্জন এর জন্য অবস্থান করতে হয় । তারপর আবার জন্ম নিতে হয় , এই চক্র ই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আমার পুনঃ জন্মের নির্দেশ এসেছে। শুধু তোর সাথে দেখা করবো বলে এতদিন অপেক্ষা করছি।চল যাওয়া যাক।”
মায়ের হাত ধরে এক অজানা সুন্দর স্থানে হাজির হলাম। একটি খরস্রোতা নদী বয়ে চলেছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম।
আমি মাকে প্রশ্ন করলাম “মা এটা ই কি স্বর্গ ?”
মা উত্তরে বললেন “হতে পারে। আসলে তোর কর্ম তোর অবচেতন মনের ইচ্ছা অনুযায়ী সূক্ষ্ম জগতে  এই জায়গাটা সৃষ্টি করেছে। প্রত‍্যেক মানুষ এর  কর্ম অনুযায়ী তাদের থাকার স্থান ভিন্ন ধরনের হয়। আমার থাকার স্থান ভিন্ন। আমি শুধু তোকে এখানে পৌঁছে দিতে এসেছি। এবার চলি”।
আমি বললাম “মা আমি কি এখানে একা থাকবো ?”
মা বললেন “সেটা তোর ইচ্ছে র উপর নির্ভর করছে। তবে তোর চেয়ে নিম্ন স্তরের কেউ তোর এখানে আসতে পারবে না ।”
মা চলে গেলেন।
আমি নতুন জায়গা টা ভালো করে দেখতে লাগলাম। হ‍্যাঁ , আমি ঠিক এই ধরনের জায়গা র কথাই স্বপ্নে দেখেছি। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আমার জায়গা টা ভালো লেগে গেলো। এখানে  দিন রাত নেই।  সব সময় যেন ঊষা কাল। সব সময় কোন কাজ করার চেষ্টা করি । এখানে যে কোন কাজ  সহজেই হয়ে যায়। কোন কিছু জানার চেষ্টা করলে বা জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করলে সেই জ্ঞান আপনা আপনি অন্তরে অনুভব হয়। [ কৃতজ্ঞতা স্বীকার ঃ অনেক দিন আগে বিভূতিভূষণ এর দেবযান পড়ে ছিলাম। এই লেখাটি তে তার ছায়া আছে ,বিশেষত পরলোকের বর্ণনায় ।]
এক দিন নদীর ধারে ঘুরছি ,দেখি  আধপাগলা মতো   মধ‍্য বয়স্ক  একটা লোক নদীর ধারে বসে আছে। কাছে গিয়ে বললাম “আপনি কে ?”
তিনি উত্তর দিলেন , “আমি মায়ের ছেলে। বসে বসে মায়ের লীলা খেলা দেখছি।”
আমি প্রশ্ন করলাম, “আপনার মা কোথায়?”
তিনি বললেন “যা দেখছি সবই তো আমার মা । এই বিশ্ব প্রকৃতি ই তো আমার মা । এমনকি এই স্থূল শরীর, সুক্ষ্ম শরীর  ,কারণ শরীর, সবকিছুই আমার মা। মা নিজেই বিশ্ব প্রকৃতি।”
ভাল করে তাকিয়ে ওনাকে আমার খুব চেনা মনে হল।
আরে ;! ইনিই তো সেই বিখ্যাত…...।
ওনাকে সেই কথা বলতে , উনি বললেন  “জানি না , হয়তো হবেও বা….”
এই বলে গভীর জঙ্গলের দিকে চলে গেলেন।
হঠাৎ মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো লেখার কথা ভেবে। ভাবা মাত্রই পৌঁছে গেলাম লেখা র কাছে। দেখলাম লেখা  আমার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে টসটস করে চোখের জল ফেলছে। আমিও কেঁদে ফেললাম। “ মাগো তোকে ছেড়ে আমিও সুখে নেই।”
আবার ফিরে এলাম নিজের জায়গায়। এমনি করেই দিন কাটতে লাগলো। মাঝে মাঝে যাই লেখা ও মিনতি কেমন আছে দেখতে। হঠাৎ শুনলাম লেখার বিয়ে। আমি মারা যাওয়ার পর আমাদের বাড়ির আর্থিক অবস্থা নিন্মগামী হয়েছে। তাই লেখার বিয়ে কোন রকমে এক বেসরকারি চাকুরী জীবির  সাথে হচ্ছে। আমি চেয়েছিলাম লেখার বিয়ে আরো উন্নত ঘরে হোক। কিন্তু আমার কিই বা করার আছে। যাই হোক বিয়ের মন্ডপে সূক্ষ্মরূপে উপস্থিত হয়ে আমি লেখাকে প্রাণ ভরে আর্শীবাদ  করলাম ।
“মাগো যে ঘরে যাবি , সেই ঘরকে আলোকিত করে রাখবি।”
দিন যায় এক এক করে। এখানে এক দিন মানে পার্থিব এক চান্দ্র মাসের সমান। অনেক জ্ঞান অর্জন হচ্ছে।আল্টিমেট ট্রুথ বলে কিছু নেই। ঈশ্বর ই একমাত্র সত্য। এই জগতে তার শরীর স্বরূপ।
তবুও  সব কিছু র মাঝে  মনটা বড়ই উচাটন করে লেখা র জন্য। লেখার অভাব অনটন আমায় বড়ই পীড়া দেয়। হয়তো আমার কৃত  পাপের এটাই নরকভোগ ।
একদিন দেখা হয়ে গেল সেই পাগলা ঠাকুরের সাথে । তিনি বললেন ,”তোকে যেতে হবে। এখানে তোর থাকার দিন শেষ হয়ে গেছে।”
আমি বললাম “কোথায় যাবো ?”
তিনি উত্তর দিলেন “যেখানে তোর মন যেতে চাইছে, তোর মেয়ের কাছে”।  “বাবা হয়ে মেয়ের দুঃখ দূর করতে পারিস নি , যা এবার  পুত্র হয়ে মেয়ের প্রতি কর্তব্য পালন কর। মায়ের দুঃখ দুর কর।”
আমি বললাম  “ঠাকুর মনে মনে আমি হয়তো এটাই চাইছিলাম। তুমি আমায় আশীর্বাদ করো আমি যেন নিজের কর্তব্য পালন করতে পারি।”

সেই পাগলা ঠাকুর আর্শীবাদ করলেন। আমি অনুভব করলাম আমি যেন ছোট হয়ে যাচ্ছি। ক্রমশ সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্ম তর হচ্ছি। একসময় বিন্দু তে পরিণত হলাম। সেই বিন্দু আমি পৃথিবী তে এসে ঘুরতে ঘুরতে কোন এক আশ্চর্য উপায়ে হয়তো বা ঈশ্বরের আশীর্বাদে এক অন্ধকারে আশ্রয় পেলাম। আমি জানি এটাই মাতৃগর্ভ।
“ মাগো আর কিছু দিন অপেক্ষা করো , আমি আসছি তোমার কোলে শিশু রূপে তোমার সব দুঃখ ঘোচাতে।” (শেষ)।








No comments:

Post a Comment