Crss colum

Friday, April 9, 2021

খুশীর ঈদ

এই ভর দুপুরে একটা বৃদ্ধ মুসলিম ভদ্রলোককে ভবঘুরের মতো টোটো করে ঘুরতে দেখলে যে কোনো মানুষই একটু অবাক হবে। প্রথমত এটা হিন্দু পাড়া। আশেপাশে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোন মুসলিম প্রধান অঞ্চল নেই। আজ ঈদ। কিন্তু এই অঞ্চলে ঈদের কোনো প্রভাব নেই। তবুও সেই বৃদ্ধ মুসলিম ভদ্রলোকটি এই গলি ঐ গলি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আসলে বৃদ্ধ ভদ্রলোক টি একটি বিশেষ বাড়ি খুঁজে চলেছে। কিন্তু এই প্রখর দুপুরে শুনশান গলি গুলিতে তে এমন কেউ নেই যাকে উনি জিজ্ঞাসা করে গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন।
এমন সময় গলির মধ্যে একটা ছোট্ট মুদিখানার দোকান খোলা পেয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন " আমি অশোক ভট্টাচার্যের বাড়ি যেতে চাই। শুনেছিলাম এখানেই তার বাড়ি। কিন্তু ঠিক কোন বাড়িটা তার সেটাই জানিনা। যদি দয়া করে একটু ঠিকানাটা বলেন তবে খুবই উপকৃত হই।"
মুদিখানার দোকানদার যথেষ্ট প্রবীণ মানুষ। তিনি এই এলাকার প্রায় প্রত্যেকটি মানুষকে চেনেন। শুধু চেনেন বললে ভুল হবে তিনি তাদের নাড়ী নক্ষত্রের খবর রাখেন। মুদিখানা দোকান দার বললেন " দেখুন এটা বাউন পাড়া। ভট্টাচার্য্য ফ্যামিলির অনেকেই এই পাড়াতে থাকেন। তাদের কোনো একজনের ভালো নাম অশোক হতেই পারে। কিন্তু আমরা হয়তো অন্য নামে চিনি। যদি ডাক নামটা বলেন তাহলে বুঝতে সুবিধা হয়।"
বৃদ্ধ মুসলিম ভদ্রলোকটির নাম রমজান সেখ। রমজান বললেন " ডাক নাম তো আমি জানিনা। তবে এটুকু বলতে পারি বছর চারেক আগে তিনি একজন মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন।"
এবারে মুদিখানার দোকানদার বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে বললেন " ও আপনি পরিতোষ দার ছেলে অশোকের কথা বলছেন। হ্যাঁ কয়েক বছর আগে সে একজন মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করে এনেছিল। সেই জন্য অনেক গোলমাল হয়েছিল। আপনি তার খোঁজ নিচ্ছেন কেন?"
রমজান বললো " যে মেয়েটিকে সে বিয়ে করেছিল সেটা আমার মেয়ে। মেয়েকে বড়ই দেখতে ইচ্ছা করছে। সেই জন্য এসেছি।"
  মুদিখানার দোকানদার বললেন " সবই বুঝি । এই দেখুন না আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে সেই পশ্চিম মেদিনীপুর এর একটা প্রত্যন্ত গ্রামে। যদিও দেখাশোনা করেই বিয়ে। তবে কি জানেন জামাই হলো সেখানকার হাইস্কুলের মাষ্টার। মেয়ে আমার বছরে একবারের বেশি আসতেই পারে না। এদিকে দুটো যমজ নাতি হয়েছে মারাত্মক ছটফটে। তাদের জ্বালায় মেয়ে আমার রোগাকাঠি হয়ে গেছে। কয়েকদিন যে এসে থেকে যাবে সেই উপায় নেই। জামাই এর আবার গ্যাস অম্বলের ব্যামো।মেয়ের হাতের রান্না ছাড়া অন্য কারো রান্না মুখে রোচে না।"
মুদির দোকানদার যা খোশগল্প জুড়েছে তাতে মনে হচ্ছে না সহজে থামবে। রমজান একটু অধৈর্যের সুরে বলল " একটু যদি বাড়িটা দেখিয়ে দেন  তাহলে খুব উপকার হয়।"
দোকানদার একটু চটে গিয়ে উত্তর দিলো " ওই যে দূরে ডানদিকে সাদা রংয়ের তিন তলা বাড়িটা দেখছেন ওটাই  ওদের বাড়ি। দুপুর বেলায় যত ঝামেলা।"
বৃদ্ধ রমজান আর কথা বাড়ালো না। সাদা তিন তলা বাড়িটার সামনে গিয়ে দরজা বন্ধ দেখে একটু দোটানায় পরলো। তারপর যা থাকে কপালে এই ভেবে কলিং বেল টিপে দিল।
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে ভিতর থেকে কেউ একটা বলে উঠলো " বৌমা দেখো তো মনে হয় কেউ এসেছে।" 
রেশমি দরজা খুলে বৃদ্ধ রমজানকে দেখে অবাক হয়ে বললো " আব্বু তুমি! , এস এস ভিতরে এসো। ওগো শুনছো দেখে যাও কে এসেছে।" 
অশোক  রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের লেকচারার। আজ ঈদের ছুটি বলে ঘরেতেই ছিল। বউয়ের ডাকে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে যাকে দেখলো তাকে চিনতে একটু সময় নিলো। শেষবার এই মানুষটিকে দেখেছে থানায় মীমাংসা টেবিলে। কিন্তু তখন এত বৃদ্ধ ছিলেন না।
অশোক তাড়াতাড়ি বলে উঠলো  " আসুন আসুন ভিতরে আসুন। এটা আপনার মেয়ের বাড়ি। সেই এলেন কিন্তু অনেক দেরি করে।"
রমজান ঘরে ঢুকে একটা সোফার ওপর বসে বললো " তুমি ঠিকই বলেছো বাবা, বড় দেরি হয়ে গেছে।"
ইতিমধ্যে অশোকের মা বাবা ঘরে এসেছেন। অশোকের মা বৃদ্ধ রমজান মিঞা কে বললেন " মেয়ের ওপর রাগ করে এতদিন সবাইকে দূরে সরিয়ে রাখা আপনার ঠিক হয়নি দাদা। আপনার মেয়ে যেমন রূপে লক্ষ্মী তেমনি গুণে সরস্বতী।  এমন মেয়ে থাকা ভাগ্যের কথা।"

ইতিমধ্যে রেশমি কোলে করে একটি ছোট্ট দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে এসে বলল " আব্বু দেখো এটা তোমার নাতনি দিয়া।"
রমজান নাতনিকে কোলে নিয়ে কেঁদে ফেললো।
অশোকের মা রেশমিকে উদ্দেশ্য করে বলল " বৌমা তোমার বাবাকে  আগে কিছু খেতে দাও। খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিতে দাও  তারপর বাপ মেয়ে যত পারো গল্প করবে।"
খাওয়া দাওয়া র পর  আব্বুকে তিন তলার একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে রেশমি বললো " আব্বু তুমি এখন একটু শুয়ে পরো । আমি বিকালে চা করে  নিয়ে  এসে তারপর  তোমার সঙ্গে বসে অনেক গল্প করবো।"
রমজান বললো " রেশমা, তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে ।"
রেশমি উত্তর দিলো " সে সব বিকালে এসে শুনবো। তুমি এখন একটু ঘুমিয়ে নাও।"
ছুটির দিনে খেতে খেতে একটু দেরি হয়ে যায়। অশোকের আবার ছুটির দিনে দুপুর বেলায় একটু ঘুমানো চাই-ই-চাই। রেশমি দুপুরে ঘুমায় না। সে দুপুর বেলায় মোবাইলে হট ষ্টার চালিয়ে সিরিয়াল দেখে। বাংলা মহাভারত সিরিয়াল টার বেশ কয়েকটি এপিসোড ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছে। আজ আর সিরিয়াল দেখতে ইচ্ছা করলো না। অশোকের পাশে এসে শুয়ে পড়লো। অশোকের  নাক ডাকছে।  শুয়ে শুয়ে রেশমির কতো কথা মনে পরছে। রেশমি আসল নাম রেশমা। রেশমা খাতুন।বাড়ির কাছেই বিধুমুখী বালিকা বিদ্যালয় ক্লাস ওয়ান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে দাদা আব্দুল  আব্বুকে বলেছিল রেশমাকে পড়াশোনা ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দিতে। যদিও রেশমার ইচ্ছা ছিল আরো পড়াশোনা করার। শেষ পর্যন্ত আব্বুর জেদেই  দাদার মত না থাকা সত্ত্বেও রেশমা কলেজে বিজ্ঞান শাখায় গ্রাজুয়েশন করবার জন্য ভর্তি হয়েছিল। আসলে মা হারা এই মেয়েটাকে রহমান খুব ভালোবাসতেন। মেয়ের সব ইচ্ছা সাধ্যের মধ্যে হলে পূরণ করতে চেষ্টা করতেন।
কলেজের প্রথম ছয় মাস পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোন দিকে মন যায়নি। তারপর আলাপ হলো অশোকের সঙ্গে। এক শনিবার রেশমা কলেজে গিয়ে দেখল খুব কম সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী কলেজ এসেছে। দুটো ক্লাস এর পরেই অনেকক্ষণ গ্যাপ ছিল। রেশমা ভাবলো কলেজ লাইব্রেরীতে কয়েকদিন আগে বায়োলজির উপর যে বইটা খোঁজ করেও পায়নি, সেটা আরেকবার খোঁজ নিয়ে দেখা যায় এসেছে কিনা। লাইব্রেরীতে গিয়ে দেখলো একদম ভিড় নেই। পুরো ফাঁকা। লাইব্রেরিয়ান কে বইটার কথা জিজ্ঞাসা করতে উত্তর এলো " ওটা রেয়ার কালেকশন। এখানে বসে পড়তে হবে।"
অগত্যা রেশমা বইটা নিয়ে  দোতলায় স্টাডি রুমে বসে পড়তে লাগলো। স্টাডি রুমে তখন আরেকটি ছাত্র বসে বই পড়ছিল। এমন সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। আর বৃষ্টির সঙ্গে চলছিল ঝড়ো হাওয়া। পাশের রুম থেকে লাইব্রেরিয়ান হাঁক পাড়লো " জানালা গুলো বন্ধ করে দাও নাহলে বৃষ্টির ছাঁট এসে সব ভিজে যাবে।"
রেশমা আর সেই ছাত্রটি তাড়াহুড়ো করে স্টাডি রুমের জানালা গুলি বন্ধ করতে লাগলো। একটা জানালার ছিটকিনি ঠিকমতো দেওয়া যাচ্ছিলো না।বার বার খুলে যাচ্ছিলো। বেশ কয়েকবার জানালা এঁটে দেওয়ার পরেও যখন খুলে গেল তখন সেই ছাত্রটি বলল " সরুন। আমি এঁটে দিচ্ছি।"
জানালার পাল্লা গুলি শক্ত করেই এঁটে ছিটকিনি দিয়ে , ছেলেটি ফিরে এসো রেশমার পাশের বেঞ্চের উপর ধপ করে বসে পরলো। তারপর রেশমার দিকে চেয়ে বলল " আপনি কি ফার্স্ট ইয়ারে পড়েন?"
রেশমা বলল "হ্যাঁ , আপনি ?"।
ছেলেটি উত্তর দিল " আমি সায়েন্স থার্ড ইয়ার" ।
তারপর দুজনে কিছুক্ষন চুপচাপ বইয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু আচমকা ঝড় বৃষ্টিতে মনটা কোন অচিন দেশে পালিয়ে গেছে। এদিকে ঝমঝম করে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। থামার বিন্দুমাত্র লক্ষণ পর্যন্ত নেই। বিকাল চারটের পরে লাইব্রেরীয়ান এসে বলল এবারে লাইব্রেরী বন্ধ করবো। অগত্যা দুজনকে উঠতেই হলো।   এদিকে বৃষ্টি বেস্ট জোরালোভাবেই হচ্ছে।   লাইব্রেরীর সামনে টা  দোতলার ঝুল বারান্দার কারণে বৃষ্টির জল পড়ছে না। সেই খানে দুজনে দাঁড়িয়ে রইলো। লাইব্রেরিয়ানের ঘর কাছেই । তিনি লাইব্রেরী রুম বন্ধ করে ছাতা খুলে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। এমনিতেই শনিবার ছাত্র-ছাত্রী কম। তার ওপর আচমকা বৃষ্টি আসার জন্য কলেজ পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু লাইব্রেরীর ঝুলবারান্দার নিচে রেশমা ও সেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে রইলো। রেশমার একটা অচেনা ছেলের সঙ্গে একা দাঁড়িয়ে থাকতে একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। আচমকা ছেলেটি বলল " আপনার নামটা একটু বলবেন।" রেশমা উত্তর দিল " আমার নাম রেশমা। আপনার নাম কি?"
মনে মনে ভাবলো নামটা জেনে রাখাই ভালো।
ছেলেটি উত্তর দিল " আমার নাম অশোক। তবে কলেজে আমাকে সবাই 'হকিং' বলে ডাকে।"
রেশমা অবাক হয়ে বলল " হকিং। সে তো একজন বিজ্ঞানীর নাম।"
অশোক উত্তর দিল " সে অনেক বড় কাহিনী। মনে হচ্ছে দেবুদার ক্যান্টিন এখনো খোলা আছে। চলুন না  কফি খেতে খেতে কথা বলা যাবে। আশাকরি ততক্ষণে আমাদের আলাপটা হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে বৃষ্টিটাও থেমে যাবে।"
রেশমার যদিও আগে কখনো কোনো ছেলের সঙ্গে আলাপ করে নি। তবুও এই ছেলেটিকে দেখে রেশমার মনে হল এর কাছ থেকে ভয়ের কিছু নেই । সুতরাং ঝোঁকের মাথায় রেশমা বলল " কিন্তু ক্যান্টিন তো অনেক দূর। অতোটা জেতে জেতে পুরো ভিজে যাব।"
অশোক বলল " এক ছুটে গেলে খুব বেশি ভিজবো না। চলুন তো।"
তারপর একছুটে দুজনে ক্যান্টিনে গিয়ে যখন ঢুকলো ততক্ষণে দুজনেই বেশ খানিকটা ভিজে গেছে।
ক্যান্টিনে আর কেউ নেই। ক্যান্টিনের মালিক দেবুদা ততক্ষণে জিনিসপত্র গোছগাছ করছে। অশোক বলল  " দেবুদা দুকাপ কফি হবে ? সেই সঙ্গে খাবার মত কিছু হবে? খুব জোর খিদে পেয়েছে।" দেবুদা উত্তর দিল " কফি শেষ। একটু বোসো বানিয়ে দিচ্ছি। হট ভেজিটেবিল চপ আছে। গরম করে দিচ্ছি।"
কিছুক্ষণ বাদে দেবুদা দুকাপ কফি আর  দুটি প্লেটে দুটো করে ভেজিটেবিল চপ এনে দিল। রেশমা বলল " আবার এসব কেন? শুধু তো কফি খাওয়ার কথা হয়েছিল।"
অশোক বলল  " খান তো। সেই কখন খেয়ে এসেছি। খুব জোর খিদে পেয়েছে।"
রেশমা একটা ভেজিটেবিল খেয়ে কফিতে এক কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলো " তাহলে বলুন আপনাকে বন্ধুরা 'হকিং' বলে ডাকে কেন?"
অশোক ধীরেসুস্থে দুটো ভেজিটেবিল চপ খেয়ে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল " আসলে কি জানেন আমি সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকি। খুব বেশি বন্ধু বান্ধব নেই।   একবার প্রফেসার রায়ের ক্লাসে উনি একটা জটিল অংক দিয়ে বলেন 'যে এটার  সলভ করতে পারবে  তাকে আমি একটা বিশেষ উপহার দেব।' "
ক্লাসের অনেকজন চেষ্টা করার পর ব্যর্থ হওয়ায় আমি উঠে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে প্রবলেম টি সলভ করে দিই। শুধু তাই নয় আরও একটি পদ্ধতিতে এই অংকটি সলভ করে দেখাই।"
প্রফেসর রায় অবাক হয়ে বলেন " তুমি তো দেখছি ভবিষ্যতে স্টিফেন হকিং কেও ছাড়িয়ে যাবে।
ব্যাস আর যায় কোথা। বন্ধুরা হকিং কথাটা  লুফে নিল। সেই থেকে কলেজে সবাই আমাকে হকিং বলে ডাকে। এগুলো অবশ্য ফার্স্ট ইয়ারের ঘটনা।"
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। অশোক বলল " চলুন আপনাকে কলেজ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে তুলে দিই।"
সেই শুরু। তারপর প্রতিদিন দুটো বাজলেই রেশমা চলে যেত লাইব্রেরী রুমে। আর অশোক এমনিতেই বইয়ের পোকা। ক্লাশ না থাকলেই তাকে লাইব্রেরীতেই পাওয়া যায়।
ছয় মাস বাদে রেশমা নিজেই একদিন অশোককে জানালো সে তাকে ভালবেসে ফেলেছে। কথাটা শোনার পর অশোক অনেকক্ষণ কিছু কথা বললোনা। তারপর রেশমার দিকে তাকিয়ে তার চোখে চোখ রেখে উত্তর দিল " এটা সম্ভব নয়।  আমি হিন্দু ব্রাহ্মন বাড়ির ছেলে। আর তুমি ধর্মে মুসলিম। তোমার আমার প্রেম এই সমাজ মেনে নেবে না। আমার আর তোমার মধ্যে  মেলামেশা না করাই মঙ্গলজনক।"
কথা শেষ করে অশোক চলে গেল। তারপর টানা পনের দিন সে কলেজ এলোনা।
রেশমা রোজ আশা নিয়ে কলেজে আসে।নিয়ম করে ক্লাস না থাকলে লাইব্রেরী তে যায়। কিন্তু অশোকের কোনো পাত্তা নেই। অবশেষে ষোলো দিনের মাথায় লাইব্রেরী তে গিয়ে দেখলো অশোক বসে আছে। রেশমা অশোকের পাশে বসে চাপাস্বরে প্রশ্ন করলো " এতদিন কলেজে আসনি কেন? আমি কি তোমার কাছে কোনো অন্যায় করেছি?"
অশোক উত্তর দিলো " না তুমি কোন অন্যায় করোনি। আমি তোমাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তুমি মুসলিম ধর্মের আর আমি হিন্দু ধর্মের। তোমার আমার প্রেম সমাজ মেনে নাও নিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের উভয়ের পরিবারের লোকজন মেনে নেবে বলে মনে হয় না। অনেক সাহস করে শেষ পর্যন্ত মাকে সব কিছু খুলে বলেছি। তিনি তোমাকে দেখতে চেয়েছেন। তুমি যাবে আমাদের বাড়িতে?"
রেশমা বললো " যাবো।"
অশোক বললো " তবে আজকেই চলো।"
অতঃপর সেই দিন দুপুর বেলায় অশোকের বাইকে চড়ে তাদের বাড়িতে যাওয়া।
অশোকের বাবা মা উভয়েই বাড়িতে ছিলেন। অশোকের বাবা ইতিমধ্যে অশোকের মায়ের কাছ থেকে ছেলের মনে ব্যাথার কারণ জেনেছিলেন।
রেশমা কে প্রথমবার দেখেই  অশোকের মা বলেছিলেন " ওমা এতো খুব সুন্দর মিষ্টি মেয়ে। তোমার নাম কি?"
রেশমা অশোকের মা বাবা কে প্রণাম করে বলেছিল " আমার নাম রেশমা।"
অশোকের মা বলেছিলেন " আমি কিন্তু তোমাকে রেশমি বলে ডাকবো। তা  আমরা তো ইন্টার রিলিজিয়ন বিয়ে দিতে রাজি কিন্তু তোমাদের বাড়ি মানবে তো ?"
রেশমা বলেছিল " আব্বু আমাকে খুব ভালোবাসে। আশা করি তার মত হয়ে যাবে। তবে আমার  দাদাকে নিয়ে ভয় আছে।"
তবে রেশমার কথা পুরোপুরি সত্যি হয় নি।যখন অশোকের বাবা ফোনে রেশমার সঙ্গে অশোকের বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন শুধু রেশমার দাদা নয় বাড়ির সবাই বেঁকে বসে। রেশমার  দাদা আব্দুল   রাগের চোটে রেশমাকে ধরে মারধর পর্যন্ত করে। তারপর রেশমার কলেজ বন্ধ করে  দিয়ে দ্রুত রেশমার বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়ে গেল।
ঠিক এমনি সময়  একদিন ফাঁকতাল পেয়ে রেশমা পালিয়ে গিয়ে অশোকের বাড়িতে পৌছায় । রেশমার বাড়ি থেকে পুলিশে কেস করে রেশমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু রেশমা পালিয়ে যাওয়ার সময় তার বার্থ সার্টিফিকেট ও অন্যান্য সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছিল। পুলিশের কাছে প্রমাণ হয় রেশমা সাবালিকা। এবং তার নিজের ইচ্ছায় সে অশোকের কাছে চলে এসেছে বলে সে লিখিত বয়ান দেয়। ইতিমধ্যে একদিন অল্প সংখ্যক শুভানুধ্যায়ীদের উপস্থিতি তে রেশমার অশোকের সঙ্গে রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ হয়। সেই দিন থেকে রেশমার বদলে রেশমির পথ চলা শুরু।
আজ শুয়ে শুয়ে সেই সব দিন গুলোর কথা মনে আসছিল রেশমির।
ঘড়িতে দেখলো বিকাল চারটে বাজে। বিছানা থেকে উঠে পড়লো রেশমি। রান্না ঘরে গিয়ে চায়ের জল চাপিয়ে দিলো। চা করে  ট্রেতে সাজিয়ে  অশোককে ডেকে বললো " এই ওঠো, চা খাবে তো?" অশোক  ঘুম থেকে উঠে বললো " হুঁ খাবো, এক কাজ করো।চা টা নিয়ে তিন তলায় তোমার বাবার কাছে চলো।মা বাবা কেও ডেকে নাও। ওখানে বসে গল্প করতে করতে  সবাই একসাথে বসে চা খাবো।
অতঃপর শশুর শাশুড়ি কে একসাথে চা খাওয়ার প্রস্তাব দিতে তারাও রাজি। শাশুড়ি তো বলেই ফেললেন " মানুষটার সঙ্গে তো এখনো ভালো করে আলাপ ই হয়নি। চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে।"
তারপর সবাই মিলে হৈ হৈ করে তিন তলায় এসে দেখলো রহমান তখন বিছানায় বসে কাঁদছেন।
রেশমি দৌড়ে গিয়ে টেবিলের ওপর চা টা রেখে আব্বুর কাছে এসে বললো " আব্বু তুমি কাঁদছো কেন? কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো। তুমি আগে চোখের জল মোছো।" এই বলে রেশমি নিজেই আব্বু র চোখের জল মুছিয়ে দিল। তারপর চায়ের কাপ আব্বু র হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো " তুমি চা খেতে খেতে বলো তো কি হয়েছে।"
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আব্দুল বললো " মা তুই কি কিছুই খবর পাসনি?"
রেশমি বললো " আমি কিছুই জানি না। কেন কি হয়েছে? "
রহমান অস্ফুট স্বরে বলল " তোর দাদা..." রহমান চুপ করে গেল।
রেশমি উদগ্রীব হয়ে বললো " কি হয়েছে দাদার ? দাদা ভালো আছে তো ?"
রহমান পুনরায়  ডুকরে কেঁদে উঠলো। অশোকের মা , বাবা সান্ত্বনা দিয়ে বললো " দাদা আপনি কাঁদবেন না। কি হয়েছে বলুন।"
একটু পরে রহমান শান্ত হয়ে বললো  " তোর দাদা আর বেঁচে নেই। এক মাস আগে ব্রেন টিউমার অপারেশন এর সময় মারা গেছে।"
এইটা শুনেই রেশমি কেঁদে উঠলো।বাপ মেয়ে  উভয়েই কাঁদতে লাগলো।
রেশমি বললো " আব্বু তুমি এতো নিষ্ঠুর কি করে হলে? আমাকে একটিবার দাদাকে চোখের দেখা দেখতে দিলে না। "
একটু শান্ত হওয়ার পর রহমান বলতে লাগলো " মাস ছয়েক আগে তোর দাদার প্রথম লক্ষণ ধরা পড়ে। মাথায় সারাক্ষণ যন্ত্রণা । সেই সঙ্গে শরীরের এক দিক অবশ হয়ে যায়। প্রথমে লোকাল ডাক্তার দেখানো হয়। তারপর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ভেলোর এ চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাই। তুই বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর আমরা দুজন প্রাণী বাড়িতে বড় একা হয়ে পরেছিলাম।  আমি যে কোনো মূল্যে আমার সবে ধন নীলমণি ছেলেটিকে সুস্থ করে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহর মনে বোধহয় অন্য ইচ্ছা ছিলো। ডাক্তার সব রকম পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বলেন ব্রেইনে টিউমার হয়েছে।ইমিডিয়েট অপারেশন করতে হবে। সেজন্য প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। আমি টাকার যোগাড় করবার অনেক চেষ্টা করি। শেষ পর্যন্ত বাড়িটা একটা প্রোমোটারের কাছে বন্ধক রেখে চড়া সুদে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ধার নিই।  কিন্তু আমি  তোর দাদাকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। অপারেশন হওয়ার পর ২৪ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসে। পরের দিন ইশারায় আমাকে বলে সে তোকে দেখতে চায়। আমি বলি তুই ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে চ। আমি তোর বোন কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তোর কাছে দেখা করার জন্য নিয়ে আসবো। কিন্তু আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ দিলো না। সেই রাতেই তোর দাদা আব্দুল আল্লাহের দরবারে পৌঁছে যায়।"
রহমান কাঁদতে লাগলো। তার দেখাদেখি   রেশমিও পুনরায় কাঁদতে লাগলো।
অশোক বললো " বাবা আপনি কাঁদবেন না। আপনার এক ছেলে চলে গেলেও আর এক ছেলে আছে।"
রহমান বললো " আর একটা কথা বলা বাকি আছে। গত পরশু যে প্রোমোটার এর কাছে  বাড়িটা  বন্ধক রেখেছিলাম সে  গুন্ডা পাঠিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বাড়িটা দখল করেছে। গত রাত টুকু মসজিদে কাটিয়ে ছিলাম।আজ তোকে শেষ বারের মতো দেখতে এসেছি। আমি সব হারিয়ে ফকির হয়ে গেছি। তোকে দেখে নিয়েছি। এবার আল্লাহ যেদিকে টানবেন সেদিকে চলে যাবো।"
রহমান চুপ করে কাঁদতে লাগলো।
অশোকের মা প্রথমে কথা বললেন " চলে যাবেন মানে ? আপনাকে যেতে দিলে তো।আজ থেকে আপনি আমাদের পরিবারের সদস্য।  আপনি এখানেই থাকবেন। হয়তো সব কিছু মানিয়ে নিতে আপনার একটু অসুবিধা হবে। তবে দেখবেন সেসব ঠিক হয়ে যাবে।"
অশোকের বাবা বললো " আপনি থাকবেন নিজের অধিকারে। এতো সুন্দর গুণের মেয়ে আমাদের দিয়েছেন সেই অধিকারে। আপনার মেয়ে আমাদের ঘরের লক্ষী।  সেই মা লক্ষ্মী র বাবা আপনি। আজ থেকে আপনার সব কিছুর দায়ভার আমাদের।"
রহমান বললেন " কিন্তু আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী।"
অশোকের মা বললেন " তাতে অসুবিধা কিছু নেই। এই তিনতলায় দুটি ঘর রয়েছে। একটা এই ঘর আর অন্যটি ঠাকুর ঘর। আর ঘর সংলগ্ন অনেকটা জায়গা জুড়ে খোলা ছাদ। আপনি সেখানে মনের সুখে নামাজ আদায় করুন। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই দাদা। "
তারপর বৌমার দিকে ফিরে বললেন " বৌমা সন্ধ্যা হয়েছে। তুমি কাপড় ছেড়ে প্রদীপ জ্বেলে সন্ধ্যা দিয়ে দাও।"
তারপর সবাই নিচে চলে গেলে শুধু রইলো বাবা আর মেয়ে।
রহমান বললো " মা রেশমা , মাগরিব এর নামাজ আদায় এর সময় হয়েছে। একটি শতরঞ্জি পেতে দে।"
রেশমি শতরঞ্জি পেতে দিতে রহমান ছাদের একপাশের কলে গিয়ে অজু করে নামাজ শুরু করলেন।
রেশমি কাপড় ছেড়ে সন্ধ্যা প্রদীপ হাতে নিয়ে পুনরায় ঠাকুর ঘরে এসে দেখলো তার আব্বু তখনো নামাজ পড়ছেন। সে ঠাকুর ঘরে ঠাকুর কে প্রদীপ দেখিয়ে  শাঁখ বাজিয়ে প্রণাম করে প্রার্থনা করলো " সকলের মঙ্গল করুন।" ( শেষ)