Crss colum

Thursday, April 27, 2017

ভৌতিক

ভূত আছে কি নেই এই তর্কটা বহু কাল থেকেই চলে আসছে .এক পক্ষ একটা যুক্তি দিলে অন্য পক্ষ আরেকটা যুক্তি নিয়ে হাজির . আজ তর্কটা বেধেছিলো  রমেন  আর অনীকের মধ্যে  . রমেন বলছিলো  ‘ভূত আছে , আলবাত আছে .ভগবান যদি আছে মানিস তবে ভূত ও আছে .’ অনীক হারবার ছেলে নয়  সেও বললো ‘তোরা যারা ভূত মানিস একটা উদাহরণ দেখা যে নিজের চোখে ভূত দেখেছে .’ রমেন বললো ‘রবীন্দ্রনাথ  ভূতে বিশ্বাস করতেন.’সাথে সাথে অনীক বললো ‘বিশ্বাস কারো থাকতেই পারে .কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজে ভূত দেখেছেন একথা লিখে জাননি .’
এমন সময় মৃগেনদা  ক্লাব ঘরে ঢুকলো . বাইরে বৃষ্টি পড়ছে .মৃগেনদা এসে ছাতাটা খোলা অবস্থায় পাশের ছোটো ঘরটায় রেখে এলো .তারপর  এই ঘরে এসে একটা চেয়ার টেনে  ধপ করে বসেই বললো ‘কিসের গল্প হচ্ছে রে ?’ রমেন বললো ‘ভূতের মৃগেনদা .আমি বলছি ভূত আছে ,অনীক মানতে চাইছে না .’ মৃগেনদা অনীকের দিকে চেয়ে বললো ‘তা তোর মানতে আপত্তি কিসের ?’ অনীক বললো  ‘আপত্তি কিছু নেই ,শুধু এমন কাউকে হাজির করুক যে নিজের চোখে ভূত দেখেছে .’ 
মৃগেন দা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো  ‘যদি বলি আমি ভূত দেখেছি ,তোরা কি বিশ্বাস করবি  ?’
গল্পের গন্ধ পেয়ে সকলেই একসাথে বলে উঠলাম ‘একশো বার বিশ্বাস করবো ,’
রমেন তাড়াতাড়ি ফ্লাস্ক থেকে চা বের করে  একটা প্লাস্টিক কাপে করে মৃগেনদা কে দিলো .আমরা সকলে  মৃগেনদা কে ঘিরে চেয়ার টেনে বসলাম . চায়ে চুমুক দিয়ে মৃগেনদা শুরু করলো .. “
তোরা তো জানিস আমার বিয়ে হয়েছে বাঁকুড়া জেলার এক  অজ গ্রামে . বিষ্ণুপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে বাসে করে পুরন্দরপুর যেতে হয় সেখান থেকে  হেঁটে পাঁচ কিলোমিটার গেলে তবেই আমার শশুরবাড়ী . 
বিয়ের কিছুদিন পরের ঘটনা .সেবারে আমার বড় শালাবাবু এসে  তোদের বৌদিকে নিয়ে গেছে .কথা ছিলো কিছুদিন বাদে আমি গিয়ে তোদের বৌদিকে নিয়ে আসবো .
সেইমতো একদিন দুপুরের ট্রেনে চেপে বসলাম .  সময়ে পৌঁছলে সন্ধ্যার আগে শশুর বাড়ী পৌঁছে যেতাম.কিন্তু মাঝপথে ট্রেন অবরোধ হওয়ায় ট্রেন বিষ্ণুপুর পৌঁছল রাত সাড়ে আটটা .কোনো রকমে ছুটতে ছুটতে গিয়ে লাস্ট বাস ধরলাম .তখন বর্ষা কাল .শেষ বাসে তেমন লোক নেই . বাস চলতে শুরু করতেই পুনরায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো .  যখন পুরন্দরপুরে নামলাম তখন রাত দশটা .বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে .ঝির ঝির করে পড়ছে .দেখলাম বাস স্টান্ডে কোনো জনপ্রাণী নেই .  এখান   থেকে নদীর পাড় ধরে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা গেলে তবেই শশুরবাড়ী র গ্রাম .দেখলাম আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে.ভাবলাম এটুকু রাস্তা হেঁটেই চলে যাবো .  সুতরাং হাঁটা শুরু করে দিলাম . চাঁদের আলোয় হাঁটতে ভালোই লাগছিলো .হঠাত  লক্ষ্য করলাম কিছুটা দূরে একজন হেঁটে যাচ্ছে . চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি. আমি চেঁচিয়ে ডাকলাম‘ও দাদা শুনছেন  ,ও দাদা.’কয়েকবার ডাকাডাকির পর লোকটি দাঁড়িয়ে পড়লো .আমি কাছে গিয়ে বললাম  'আমি জীবনপুর যাবো .রাত হয়ে গেছে .একলাই যাচ্ছিলাম .আপনাকে দেখতে পেয়ে   ভাবলাম তবু একজন সঙ্গী পাওয়া গেলো .' লোকটি বললো ‘চলুন.’ কেমন একটা খসখসে গলার আওয়াজ .লোকটি বললো  'জীবনপুরে কোথায়  যাবেন ? ' আমি শশুরের নাম বললাম.তারপরে প্রশ্ন করলাম ‘চেনেন নাকি ?
' লোকটি বললো ‘কতজনই  চেনাজানা ছিলো.’ নদীর পাড় ধরে প্রায় চার কিলোমিটার হাঁটার পর এক টা বাঁশের সাঁকো.সাঁকো পেরিয়ে আরো খানিকটা হাঁটার পর  জীবনপুর গ্রাম.
আমরা দুজনে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম . লোকটা নিজের নাম বললো বিবেক .কোথায় থাকে জিজ্ঞাসা করায় বললো বাঁশের সাঁকোর কাছে বামদিকে ঘর . সাঁকোর কাছে গিয়ে দেখি হড়কা বানে সাঁকো ভেঙে গেছে .এবারে একটু চিন্তায় পড়লাম .নদী এমন কিছু চওড়া ও গভীর নয় .এমনি সময় হেঁটেই পার হওয়া যায় . কিন্তু এখন বর্ষাকাল .প্রবল বেগে জল বয়ে চলেছে . আমার এরকম হতম্ভব অবস্থা দেখে বিবেকবাবু বললেন ‘আজ রাতটা আমার ঘরে কাটিয়ে দিন কাল সকালে  না হয় যা হোক ব্যবস্থা করা যাবে .ওপারে একজনের নৌকা আছে .মাঝে মাঝেই সাঁকো ভেঙে যায় .তখন সবাই নৌকায় পার হয় .কিন্তু এত রাতে নৌকা পাওয়া যাবে না .’ অগত্যা  বিবেকের বাড়ী এসে উপস্থিত হলাম . দেখলাম ভাঙাচোরা একটা টিনের চাল ওলা বাড়ী .  একটু খোলা বারান্দা আর একটা বড় ঘর . বারান্দায় উঠে বিবেক এক কোণ থেকে বাঁকুড়ার বিখ্যাত টিনের টিমটিমে লনঠন বার করে জ্বাললো .তার অল্প আলোয় দেখলাম বিবেককে এতক্ষণ ভাবছিলাম মধ্যবয়সী যুবক .কিন্তু না দেখলাম সে প্রৌঢ় .বয়স কমপক্ষে পঞ্চাশ হবে .লনঠন ধরে ঘরে ঢুকতে দেখলাম ,ঘরের এখানে ওখানে অযত্নের ছাপ .অনেকদিন যেন ঝাড়া পোঁছা  পরিস্কার হয়নি .   ঘরের একদিকে জানালার দিকে একটা তক্তোপোশ .তাতে একটা মাদুরি পাতা একপাশে দুটি বালিশ জড় করা . বিবেক বললো ‘আপনি আজ আমার অতিথি .কিন্তু ঘরে আপনাকে খেতে দেবার মতো কিছুই নেই .’ আমি বললাম ‘তাতে কি ?একটাই তো রাত .ও কোনোরকমে কেটে যাবে .’ আমি তক্তোপোশের একপাশে জানালার দিকে শুয়ে পড়লাম .বিবেক লনঠনটা কমিয়ে দিয়ে আমার পাশে শুয়ে পড়লো .আমি বললাম ‘বিবেকবাবু আপনি কি কাজ করেন ?  ’ বিবেক উত্তর দিলো ‘আমি এখানকার প্রাইমারী স্কুলে পড়াতাম  ' .
কিছুক্ষণের মধ্যেই  ঘুমিয়ে পড়লাম .
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না .  হঠাত একটা গুমোট গরমে ঘুম ভেঙে গেলো . জানালার বাইরে চাঁদ মেঘে ঢাকা পড়েছে .বিদ্যুত্ চমকাচ্ছে . আমার মনে হলো বিছানায় আমি একা .একটু গা ছমছম করে উঠলো .কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলাম ‘বিবেকবাবু .’কেউ সাড়া দিলো না .ঘরের লনঠনটা নিভে গেছে .কিছু দেখতে পাচ্ছি না . আবার ডাকলাম ‘বিবেকবাবু’. এবারে ঘরের মাঝখান থেকে উত্তর এলো   'বলুন.' আমি বললাম ‘আপনি শোবেন না ?’. বিবেকবাবু  উত্তর দিলো ‘না .’আমি পুনরায় প্রশ্ন করলাম 'কেন ?' বিবেকবাবু উত্তর দিলো ‘শোয়ার চেয়ে ঝুলে থাকতেই আমার ভালো লাগে .’এই বলে বিবেকবাবু খিঃ খিঃ করে বিশ্রী ভাবে হেসে উঠলেন .ঠিক এই সময় একেবারে ঘরের কাছে কড়কড় শব্দে বিরাট বাজ পড়লো .সেই প্রায় একমিনিট ব্যাপি বিদ্যুতের চমকে দেখলাম ঘরের মাঝখানে কড়িকাঠ থেকে বিবেকবাবু গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে .এবং ঐ ঝুলে থাকা অবস্থায় তিনি তখনো খিঃ খিঃ করে হেসে চলেছেন .
আমি তড়াক করে এক লাফ মেরে ঘরের দরজা খুলে দৌড়ালাম .পেছন থেকে বিবেকবাবুর কনঠস্বর শুনতে পেলাম ‘যাবেন না ,আপনি আমার অতিথি.’ আমি দিকবিদিগ  জ্ঞান হারিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম .সামনে নদী .আমি জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম .কেমন করে ওপারে পৌঁছলাম জানি না .নদীর ওপারে গিয়ে  পাড়ে উঠে জ্ঞান হারিয়ে  ফেললাম .পরের দিন লোকজন আমাকে পড়ে থাকতে দেখে আমার শশুরবাড়ী খবর দেয় .সেখান থেকে সবাই এসে আমায় ধরা ধরি করে শশুরবাড়ী নিয়ে যায় .পরে তাদের মুখে শুনেছি বিবেক মাস্টার স্থানীয় স্কুলে মাস্টারি করতেন .পরে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যান .একদিন  উন্মাদ অবস্থায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন .  ”
বাইরে বৃষ্টিটা ধরে এসেছে .মৃগেনদা গল্প বন্ধ করে পাশের ঘর থেকে ছাতা এনে বললো ‘চলি রে .’ (শেষ).

No comments:

Post a Comment