Crss colum

Tuesday, January 30, 2018

ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প - পূর্ণিমার রাতে।

ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প - পূর্ণিমার রাতে।
ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প - পূর্ণিমার রাতে

শেষ বাস টা মোহন কে যখন গোপালগঞ্জ মোড়ে নামিয়ে দিলো ঘড়িতে তখন রাত পৌনে বারোটা।

এখানে থেকে তাদের গ্রাম তেনিয়া  হাঁটাপথে  প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা। আসলে দেরীটা করেছে ঐ মিলন সংঘ ক্লাব কর্তৃপক্ষ। মোহন শ‍্যামা সঙ্গীত গায় । টুকটাক এদিকে ওদিকে গান গাওয়ার ডাক আসে।টু পাইস ইনকাম হলো ,তার সাথে অল্প নামডাক । তবে এটা মোহনের পেশা নয় বরং নেশা ।তবে নেশাটা প্রবল।এক সময় সারাদিন গান নিয়েই মেতে থাকতো। বাবা প্রতিষ্ঠিত হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। পড়াশোনায় মোহন ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো না হলেও খারাপ ছিল না। কিন্তু ঐ গানের ভূত পড়াশোনা বেশি দূর হতে দিলো না। উচ্চ মাধ্যমিকের পর কলেজে ভর্তি হয়েও একদিনের জন্য কলেজ মূখো হয়নি। সারা দিন পড়ে থাকতো হরিশংকর বৈরাগী র কাছে। তবে সেটা যে শুধু গানের কারণে তা নয় , কারণ আরো একটা ছিলো। কিন্তু সে সব কথা মোহন মনে রাখতে চায় না। মনে পড়লে শুধু ই কষ্ট হয়।
আজ মোহনের ষ্টেজ পাওয়ার কথা ছিল সাতটায়। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হতে হতে ই সাতটা বেজে গিয়েছিল। উদ্ধোধনী সংগীত, সভাপতির ভাষণ,হ‍্যানাত‍্যানা ইত‍্যাদীর শেষে মোহন ষ্টেজে পেলো তখন ঘড়িতে আটটা পনেরো। টানা ছটা গান শোনানোর পরেও দর্শকদের অনুরোধে আরো দুটি গান গাইতেই হলো। টিফিনের প‍্যাকেট আর সাম্মানিকের খাম হাতে নিয়ে সোজা রেল ষ্টেশনে। শেষ ট্রেন ধরে যখন আসানসোলে নামল তখন রাত সাড়ে দশটা। একটা রিক্সা নিয়ে বাসষ্ট্যান্ডে এসে দেখলো শেষ বাসটা চলে যাবার উপক্রম করছে। শেষ বাসটা ধরে মোহন নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করলো।



বাস থেকে নামার পর ,চলে যাওয়া বাসের লাল টেইল লাইট টার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে লাইটটা ছোট হতে হতে বাঁকের মুখে গিয়ে মিলিয়ে গেল।
মোহন এখন একা।তেনিয়া গ্রাম এখান হতে  পাকা রাস্তা ধরে প্রায় এক ঘন্টার পথ।তবে দামোদর নদীর পাড় ধরে হাঁটাপথে চল্লিশ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায়।
মোহন আজ নদীর পাড় বরাবর রাস্তাটাই ধরলো। দামোদর এখন সরু রেখায় বইছে। মাঝে মাঝে মাইথন থেকে জল ছাড়লে হরকা বান আসে । কিন্তু সে জল বেশী দিন স্থায়ী হয়না। পুরোদমে বর্ষা এলেই দামোদর কানায় কানায় ভরে যায়।

আজ পূর্ণিমা। চারিদিক ভরা চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত।
হাঁটতে হাঁটতে মোহন গুনগুনিয়ে একটা শ‍্যামা সঙ্গীত ধরলো। কিছুক্ষণপর বেশ গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলো।
 'সকলি তোমারি ইচ্ছা,
              ইচ্ছা ময়ী তারা তুমি ….’
দামোদরের পাড় ঘেঁষে একটা বটগাছ আছে।যার একটা ডাল নদীর দিকে ঝুঁকে আছে। মোহন দূর হতে গাছটা দেখতে পেয়ে থমকে একবার দাঁড়িয়ে গেল। মনে পড়ে গেল রাধার কথা । হরিশংকর বৈরাগী র একমাত্র মেয়ে রাধা। হরিশংকর বৈরাগী ছিল মস্ত তান্ত্রিক।আর খুব ভালো শ‍্যামা সঙ্গীত গাইতে পারতেন। মোহন তার কাছে গান শেখার নেশায় পড়ে থাকতো। মাঝে মাঝে যেতো নদীর ধারে তারা ক্ষ‍্যাপার আশ্রমে।তারাক্ষ‍্যাপা হরিশংকর কে একদম দেখতে পারতো না।বলতো হরিশংকরের অনেক ক্ষমতা। কিন্তু ও সেই ক্ষমতা র সাহায্যে মানুষের ক্ষতি করে। তুই ওর কাছে যাসনে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা।
তখন যে মোহন আর এক নেশায় পড়েছে।এ নেশা যে গানের থেকে ও প্রবল।
হরিশংকরের কাছে যেতে যেতে মোহন কবে যে রাধা র প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেল তা মোহন নিজেও বলতে পারবে না। তবে এই প্রেম পরিণতি পাওয়ার আগেই অকালে ঝরে গেল। মোহনের বাবা একদিন তাদের দুজনকে নদীর ধারে একসাথে দেখে সোজা হরিশংকর বৈরাগী র কাছে গিয়ে ভয়ানক অপমান করে এলো। বলে এলো বাপ মেয়ে দুজনে বড় লোকের ছেলে দেখে প্রেমের ফাঁদে আটকে সব কিছু কবজা করে নেওয়ার চক্রান্ত করছে।বাবার অপমান সবচেয়ে বেশি আঘাত করলো রাধাকে।
সেই রাত্রে গঙ্গার ধারে ঐ বটগাছের হেলে পড়া ডাল থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে ছিল রাধা।
পরের দিন সকালে  লোকের মুখে খবর শুনে দৌড়ে গিয়ছিলো মোহন। গিয়ে দেখলো রাধার লাশ   গাছ থেকে নামানো হয়েছে । মোহন অনেক কেঁদেছিল।
হরিশংকর বৈরাগী মোহন কে দেখে ডুকরে কেঁদে বলে উঠেছিল, “আমার মেয়ে ছাড়া কেউ ছিল না,আজ আমার মেয়ে যেমন অপঘাতে মারা গেলো তেমনি তোর জীবন আমি ছিনিয়ে নেবই।”
তারপর দিন থেকে হরিশংকর বৈরাগী কে কেউ আর এই অঞ্চলে দেখতে পায়নি।
তারাক্ষ‍্যাপা মোহন কে বলেছিলো , দুঃখ করিসনা। এই জগতে যা ঘটবার তা ঘটবেই। এতে তোর কোন দোষ নেই। তুই তো রাধাকে নিঃসার্থ ভাবে ভালো বেসেছিলি। উভয়ের কপালে ই মিলন ছিল না তাই ভাগ্য হয়তো এই ভাবে দুজনকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। তবে হরিশংকর মোটেই ভালো নয়।ও তোর কিছু ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। তবে আমি থাকতে ভয়ের কিছু নেই।
মোহন এখনো তারাক্ষ‍্যাপার আশ্রমে যায়।তারাক্ষ‍্যাপা খুব সুন্দর বাঁশি বাজায়। আশ্রমে গেলেই মোহনকে শ‍্যামা সঙ্গীত শোনাতে হয়,আর তারাক্ষ‍্যাপা বাঁশি তে সঙ্গত দেয়। কয়েকদিন আগে মোহন আশ্রমে গিয়েছে, সেদিন হঠাৎ তারাক্ষ‍্যাপা বললো , তোর সামনে খুব বড় বিপদ আসছে। তুই তাকে রুখতে পারবিনা।কাল আমাবস্যা, ভালো দিন সকালে স্নান করে পাঁচ রকমের ফল, ফুল নিয়ে ও একটি ধুতি পরে আমার কাছে আসবি। কাল তোকে দীক্ষিত করবো। তুই আমার শিষ্যত্ব নিলে তোর যে কোন বিপদ হলে আমি জানতে  পারবো। সেক্ষেত্রে আমি তোকে বাঁচাবো।
মোহন এমনিতেই তারাক্ষ‍্যাপাকে মনে মনে গুরু বলে মানতো।আজ এমন প্রস্তাবে যেন আকাশের চাঁদ হাতে চলে এলো। পরদিন সেই মতো তারাক্ষ‍্যাপার কাছে গিয়ে দীক্ষা নিলো। দীক্ষা র পর গুরুদেব বললেন,আজ হতে তোর সব কিছুর ভার আমি নিলাম।
আজ দূর হতে বটগাছ টা দেখেই মোহনের কেমন গা ছমছম করতে লাগলো। মোহন এমনিতেই খুব সাহসী ছেলে। কতবার রাত দূপুরে এই দামোদরের চর দিয়ে একা বাড়ি ফিরেছে।
কিন্তু আগে তো কখনো এমন হয় নি। কিন্তু এত রাতে  এতটা এসে সামনে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
বটগাছ টা পেরিয়ে আরো একটু এগোলেই গুরুদেবের আশ্রম। মোহন ঠিক করলো আজ আর বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। রাতটুকু না হয় আশ্রমেই রয়ে যাবে।
বটগাছের কাছে চলে এলো মোহন।
না কেউ কোথাও নেই। শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিল মোহন। দ্রুত বটগাছ টিকে পেরিয়ে চলে এলো মোহন।
ঠিক সেই মুহূর্তে গাছ থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠ বলে উঠলো , “মোহনদা ।”
মোহন চমকে উঠলো। গলাটা তার চেনা।
গলার স্বর টা রাধার
মোহন ঘুরে তাকালো।দেখলো বটগাছের যে ডালে  রাধা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেছিলো, সেই ডালটিতে বসে রাধা পা দোলাচ্ছে। মোহন তার দিকে তাকাতে সে সরসর করে টিকটিকির মতো গাছ থেকে নেমে এলো।
নেমে এসে রাধা মোহনের সামনে এসে দাঁড়ালো।
ফটফটে চাঁদের আলোয় রাধাকে আরো রূপসী লাগছে।যে রাধাকে মোহন নিজের চোখে আগুনে পুড়ে যেতে দেখেছে, সেই রাধা আবার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এ রাধা নয়, রাধার প্রেত। এই বিপদের কথাই কি গুরুদেব বলেছিলো?
রাধা বললো,কি হলো মোহনদা? একদিন আমাকে না দেখে থাকতে পারতে না,আজ আমায় দেখে মনে হচ্ছে খুব খুশি হওনি। এই কথা বলে রাধা বীভৎস ভাবে খিলখিল শব্দ করে হাসতে লাগলো। পূর্ণিমা রাতে নির্জন দামোদরের চরে  সেই অপার্থিব হাঁসি এক ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি করলো।
হাঁসি থামিয়ে রাধা বললো , “আমার সাথে এস । আজ থেকেই আমার একা থাকার দিন শেষ। আমরা চিরকালের জন্য এক হয়ে যাবো।”
মোহন মন্ত্রমুগ্ধের মতো রাধার পিছন পিছন দামোদরের চরে নামলো। মোহনের বুদ্ধি তাকে পালিয়ে যেতে বলছে, কিন্তু পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। মোহনের শরীর তার বশে নেই। শেষ গ্রীষ্মের দামোদরের চর। একপাশ দিয়ে জল বইছে। রাধার পিছু পিছু একেবারে জলের কিনারায় এলো মোহন।দেখলো একজন দাঁড়িয়ে আছে।মোহন তাকে চিনতে পারলো।
সে হরিশংকর বৈরাগী। হরিশংকর মোহনকে দেখে একটা বীশ্রী হেসে হিসহিসে গলার স্বরে বললো , বলেছিলাম প্রতিশোধ নেবোই। আজ সেই রাত।রাধার প্রেতকে জাগ্রত করেছি। কিন্তু তার প্রেতের মধ্যে ও এখনো তোমার প্রতি প্রেম আছে। এবারে তোমায় সামনে রেখে যজ্ঞে বসবো।এ যজ্ঞ  ভূতডামর তন্ত্রের  অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে ।সব জোগাড় আমি তিলতিল করে করেছি। এই যজ্ঞের শেষে রাধার প্রেতাত্মা প্রতিশোধ স্পৃহায় পাগল হয়ে উঠবে। তখন সে আমার আদেশে তোমার মুন্ডিটা ছিঁড়ে এই যজ্ঞের আগুনে পূর্ণাহুতি দেবে।
হরিশংকর এরপর সামনে রাখা যজ্ঞ কুন্ডের  সামনে বসলো। উল্টো দিকে রাধার প্রেতাত্মা ও মোহন বসলো।
হরিশংকর ইশারা করতেই রাধার প্রেতাত্মা যজ্ঞের কুন্ডে ফুঁ দিলো। ফুঁ দিতেই দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো।
সেই লেলিহান আগুনের শিখার সামনে মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছে হরিশংকর।প্রতি মূহুর্তে মোহন লক্ষ্য করলো রাধার প্রেতাত্মা র মুখটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। কিছু একটা করতেই হবে। বাঁচতেই হবে। একথা ঠিক রাধার , হরিশংকরের সাথে যা ঘটেছে তা ঠিক নয়। কিন্তু তাতে মোহনের কোন দোষ নেই।মোহন তো রাধাকে সত্যি ই ভালোবেসেছিলো। কিন্তু এই সংকটময় মুহুর্তে মোহন কিই বা করবে। মোহন একমনে গুরুদেব কে ডাকতে লাগলো।
হঠাৎ কানে গুণগুণ করে একটা শব্দ ভেসে এলো।ক্রমশ  শব্দটা জোরে হতে লাগলো। শব্দ টা বাঁশির শব্দ। গুরুদেবের বাঁশির শব্দ।বাঁশির শব্দ ক্রমশ তীব্র হতে তীব্র তর হতে লাগলো। আশ্চর্য শব্দের তীব্রতা র সাথে মোহনের শরীরের জোর ফিরে আসতে লাগলো। হঠাৎ মনে হলো গুরুদেব মোহনকে বলছে, “দৌড় মোহন, দৌড়।”
মোহন উঠে দাঁড়ালো। তারপর পাড়ের দিকে দৌড় লাগালো।
হরিশংকর চিৎকার করে উঠলো , “ধর রাধা,ধর।তোর শিকার পালাচ্ছে,ধর ওকে।”
মোহন তখন অনেক টাই এগিয়ে গেছে। কিন্তু দ্রুত পিছনে একটা নুপুরের  শব্দ  এগিয়ে আসছে। কিন্তু তার আওয়াজ কে ছাপিয়ে একটা জলদগম্ভীর শব্দ ভেসে আসছে।মাইথন থেকে জল ছেড়েছে। এখুনি পুরো দামোদর জলে ভেসে যাবে।মোহন আরো তাড়াতাড়ি দৌড়তে লাগলো।ঐ তো আর একটু গেলেই পাড়। পিছনে নুপুরের শব্দটা এখনো এগিয়ে আসছে।
সামনে হঠাৎ একটা মূর্তি কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। মূর্তি টি বলে উঠলো, “আয় আমার কাছে আয়।”মূর্তি টি গুরুদেব স্বয়ং।শিষ‍্যর বিপদ বুঝতে পেরে নিজে রক্ষা করতে এসেছেন।
মোহন দৌড়ে এসে গুরুদেবের পায়ের কাছে বসে পড়লো। পিছনে পিছনে রাধা এসে দাঁড়ালো। গুরুদেব তার দিকে কিছু একটা ছুঁড়ে দিয়ে বললো, “তুমি মা, নিজের জায়গায় ফিরে যাও ।পরজন্মে তোমাদের দুজনের মিলন হবে।”
পরের মূহুর্তে বিশাল জলস্রোত পুরো দামোদর কে ভাসিয়ে দিলো।

পরের দিন গুরুদেবের আশ্রমে বসে দুজনের কথা হচ্ছিল।তারাক্ষ‍্যাপা বললেন, “যা , তোর আর ভয় নেই। তবে এ জন্মে কখনো সংসার করার চেষ্টা করবি না। তাহলে রাধার প্রেতাত্মা র হাত হতে তোর নিস্তার নাই।”
মোহন বললো, “কিন্তু হরিশংকর?”
তারাক্ষ‍্যাপা হেসে বললো, “সে বাণের জলে ভেসে গেছে।সে সম্ভবতঃ আর বেঁচে নেই।আর বেঁচে থাকলেও পুনরায় প্রেতাত্মা জাগাবার ক্ষমতা আর নেই।সে তার সব ক্ষমতাই ব‍্যবহার করে রাধাকে জাগিয়েছিল। কোন ক্ষমতা ই তার আর অবশিষ্ট নেই।”
গুরুদেব কে প্রণাম করে মোহন গ্রামের পথ ধরলো। দূরে বটগাছটির দিকে তাকিয়ে বড়ই রাধার কথা মনে পড়তেই চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠলো।(শেষ)

Thursday, January 25, 2018

বাংলা কল্পবিজ্ঞান - মহাশূন্যের পথিক (অন্তিম পর্ব)।

বাংলা অনলাইন কল্প বিজ্ঞান - মহাশূন্যের পথিক (অন্তিম পর্ব ) - ঐ কৃষ্ণ গহ্বর দেখা যায়।সব কিছু সেই রাক্ষস অবিরত গিলে চলেছে।  রাহুল ও রোশনি অবাক বিস্ময়ে সেই অনন্ত অনন্ত ব‍্যাপি বিশ্বের কেন্দ্র স্থলে অবস্থিত কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর কয়েকটা মূহুর্ত । হঠাৎ 'আই’ বলে উঠলো “কমান্ডার, একটা ব‍্যাপার লক্ষ্য করুন। আমরা যে গোলকের মধ্যে অবস্থান করছি সেটা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।”
রাহুল ও রোশনি দুজনেই লক্ষ্য করলো তাদের ঘিরে থাকা বুদবুদ টি বা গোলকটি ক্রমেই ছোট হচ্ছে। দেখতে দেখতে বিরাট গোলকটি ছোট হয়ে হয়ে শুধু ই তাদের ঘিরে থাকা ছোট্ট গোলকে পরিণত হলো। এরপর সেই গোলকটি সোজা মরণ ঝাঁপ দিলো কৃষ্ণ গহ্বরের অভ‍্যন্তরে।

বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী কৃষ্ণ গহ্বরের আকর্ষণের মধ্যে পড়া মাত্রই তাদের একটি বিন্দু মাত্র হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু চরম আশ্চর্য এই যে ,সেসব কিছুই হলো না ।  গোলকটি তাদের রক্ষা কবচ হয়ে দিব‍্যি এগিয়ে চলেছে কৃষ্ণ গহ্বরের কেন্দ্রের দিকে।এ এক অত‍্যাশ্চর্য ঘটনা। রাহুল , রোশনি, 'আই’, তিনজনেই নিজেরা আলোচনা করে বুঝতে পারছিলো না কিভাবে এই ঘটনা সম্ভব ? তবে কি আরো বিস্ময়কর কোন কিছু অপেক্ষা করছে তাদের জন্য ।
কৃষ্ণ গহ্বরের ভিতরে সময় ,আলো সব কিছুই আটকা পড়ে যায়।তাই কত সময় ধরে তারা এগিয়ে চলেছে তারা নিজেরাই জানেনা।
তাদের মনে হতে লাগলো অনন্ত অনন্ত কাল ধরে তারা এগিয়ে চলেছে ।
তাদের বুদবুদের পাশ দিয়ে হু হু করে এগিয়ে চলেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় ম‍্যাটার । মনে হচ্ছে এক ক্ষুধার্ত রাক্ষস অবিরত গিলে চলেছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।
দূরে যেন মনে হচ্ছে একটি বিন্দু তে গিয়ে সব কিছুই মিশে যাচ্ছে।ঐ টি কি কৃষ্ণ গহ্বরের কেন্দ্র ?
ক্রমেই বিন্দুটি এগিয়ে আসছে।
বুদবুদ টি কৃষ্ণ গহ্বরের কেন্দ্র সেই বিন্দুটি র কাছে গিয়ে স্থির হয়ে গেল ।

ঘন কালো অন্ধকারে র মধ্যে একটি অতীব উজ্জ্বল আলোর কণা।


কৃষ্ণ গহ্বর প্রতি মূহুর্তে যে কোটি কোটি নক্ষত্রের সময় পরিমাণ ম‍্যাটার গিলে চলেছে তা এতটা পথ আসতে আসতে বিশুদ্ধ এনার্জি তে পরিণত হয়ে  এই বিন্দুতে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু বড়ই আশ্চর্য রাহুল, রোশনি, 'আই’, সকলেই বুদবুদের মধ্যে নিরাপদ ভাবে কৃষ্ণ গহ্বরের কেন্দ্রে আসতে পেরেছে।
“স্বাগতম”
হঠাৎ রাহুল ও রোশনি, 'আই’  এই  কথা টি শুনতে পেলো।
না ঠিক শুনতে পায়নি। বরং বলা চলে মস্তিষ্কের মধ্যে এই সম্ভাষণ টি অনুভব করলো।
পৃথিবীর কোন ভাষায় এই সম্ভাষণ টি করা হয় নি।  
আসলে তারা নিজেদের আপন ভাষাতেই এই কথা টি অনুভব করলো। 'আই’ কথাটি অনুভব করলো কম্পিউটারের ভাষায়।
রাহুল বললো , “কে আপনি ?”

উত্তর এলো , “আমি বিন্দু।”

রোশনি বললো, “দয়া করে বুঝিয়ে বলুন আপনি কে ?”
উত্তর এলো, “ তোমাদের  ভাষায় সিংগুলারিটি।”
রাহুল বললো, “আমরা এখানে জীবিত অবস্থায় কি ভাবে ও কেন এসেছি ?”
বিন্দু হতে উত্তর এলো , “তোমরা আমার ইচ্ছায় এখানে এসেছো। এই ভয়ানক স্থানে (space - এ) কোনো কিছুই জীবিত অবস্থায় থাকতে পারে না। এখানে কেবলমাত্র আমি একক সত্ত্বা নিয়ে উপস্থিত থাকি। আমি -ই সব কিছুর স্রষ্টা। এই জগতের সব কিছুই আমার প্রত‍্যক্ষ বা পরোক্ষ ইচ্ছায় পরিচালিত হয়। তোমরা কোথায় থেকে এসেছো এবং কি উদ্দেশ্যে এসেছো ,তার আমি জানি। যেখানে তোমাদের প্রেরণ করা হচ্ছিল , সেখানে পৌঁছতে পারলে তোমাদের বিপদ হতো। তোমরা যে নভেরীয় জাতির সাথে সম্পর্ক তৈরী করতে চেয়েছিলে , তারা জন্মগত ভাবেই বড় কুটীল প্রকৃতির।ছলনার আশ্রয় নিয়ে তারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব প্রাণীদের আমন্ত্রণ করে তাদের বন্দী করে এক বৃহৎ সংগ্রহশালা তৈরি করতে চায় ।
সেই উদ্দেশ্যে তোমাদের আমন্ত্রণ জানানো।”
এই ব্রহ্মান্ডের সব ঘটনা আমি জানি, কিন্তু বিশেষ উদ্দেশ্য ভিন্ন কখনো কোন  ব‍্যাপারে আমি সরাসরি অংশগ্রহণ করি না।”

রোশনি বললো, “তবে আমাদের কেন রক্ষা করলেন  ?”
পুনরায় উত্তর অনুভব হলো, “এই সৃষ্টি র রচনা থেকেই আমি সৃষ্টি র প্রতিটি সম্ভাবনা (probability) কে   উপযুক্ত ভাবে বিচার করে  তবেই বাস্তবায়ন করি। আমি তোমাদের জন্য নির্ধারিত সম্ভাবনা কে বাতিল করে আরো উপযুক্ত বিকল্প ভবিষ্যৎ রচনা করেছি ।
 ।
তোমরা যে সামান্য ক্ষণ আমার নিকটে রয়েছো , সেই টুকু সময়ের মধ্যেই তোমাদের নির্দিষ্ট সময় মানের কোটি কোটি বৎসর অতীত হয়ে গেছে। তোমাদের জানা পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
আমি তোমাদের গ্রহকে নতুন ভাবে গড়ে তোলার জন্য তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছি।
এই কাজে তোমাদের সহায়তা করার জন্য তোমাদের ই সৃষ্ট এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন  'আই’ সহায়ক হবে। আমি তার জ্ঞান ভান্ডার এ আরো প্রয়োজনীয় সংযোজন(software upgrade)করেছি। এছাড়া  তোমাদের পৃথিবীর একটি বিশেষ স্থানে পৃথিবীর সব প্রাণী , উদ্ভিদ,  ইত‍্যাদীর বীজ(DNA) ইতিমধ্যেই সংরক্ষিত করে রেখেছি ।তার সকল তথ্য ও তার বিকশিত করার পদ্ধতি তোমাদের এই 'আই’ এর বুদ্ধিমত্তায় সংযোজিত করেছি। এই সংরক্ষিত বীজের মধ্যে কিছু বিশেষ মানুষ এর বীজ (DNA) রয়েছে। তোমাদের সন্তান ও ঐ সব বীজ হতে উদ্ভব মানব সন্তানের দ্বারা নতুন পৃথিবীর মানব জাতি গড়ে উঠবে।
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো কি উদ্দেশ্যে তোমাদের রক্ষা করেছি।”

রাহুল বললো, “আপনি কি ঈশ্বর ?”

উত্তর অনুভব হলো, “আমি ই ওংকার।।
এই যা কিছু দেখতে , শুনতে, অনুভব করতে পারছো তা আমি।
আমি ই এই জগৎ। দৃশ্য অদৃশ্য সব কিছুই আমার শরীর। আমি ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আমি একা। নিজেকে বহুতে বিভক্ত করেছি। এ সবই করেছি নিজের লীলা হিসেবে। মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম দিন হতে যে যে ধর্মের উদ্ভব হয়েছে তার মূল আরাধ্য হিসেবে আমাকেই অর্চনা করেছে।
কেউ সাকার আবার কেউ নিরাকার হিসেবে আমার অর্চনা করেছে। আমি ই কখনো কৃষ্ণ, কখনো কালি, কখনো গড, কখনো আল্লাহ, কখনো জিহোবা, এইসব রূপে পূজিত হয়েছি। আসলে আমি এক ও অভিন্ন। আমি অতি সূক্ষ্ম, আবার অতি বিরাট। আমি আকার যুক্ত, আবার আমি নিরাকার। এই জগতে র সব কিছুই আমার আকার , কারণ আমি ছাড়া দ্বিতীয় কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আবার আমি নিরাকার বটে কারণ ঐ আকার যুক্ত সব কিছুই প্রকৃত আমি নই।
আমি আসলে বিশুদ্ধ শক্তি (Energy)। নিরাকার রূপে আমি নিস্ক্রিয়।তাই সৃষ্টি র প্রয়োজনে আমি আকার যুক্ত হয়ে সক্রিয় হই।
হে নতুন পৃথিবীর রূপকার, তোমরা যাও তোমাদের লালিত বিশ্বে এই জ্ঞান ছড়িয়ে দাও। বিভেদের শিক্ষা র বদলে এক হয়ে থাকার জ্ঞান সকল কে প্রদান কর।”

আস্তে আস্তে গোলকটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র স্থল থেকে দূরে যেতে লাগলো  ।অতি দ্রুত কৃষ্ণ গহ্বরের বাইরে চলে এলো তারা। তারপর দ্রুত বেগে এগিয়ে চললো তাদের পরিচিত জগতে র উদ্দেশ্যে। যেখানে অপেক্ষা করে আছে তাদের পৃথিবী, নতুন অঙ্কুরোদগমের জন্য।(শেষ)

Thursday, January 18, 2018

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রাধা বিনোদ পাল, টোকিওর সামরিক আদালত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রাধা বিনোদ পাল, টোকিওর সাম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও রাধা বিনোদ পাল।
রিক আদালত:
১৯৪৫সালের  জুলাই মাসে পটাসডামের ঘোষণা পত্র অনুযায়ী ১৫ই আগষ্ট জাপান আত্মসমর্পণের জন্য রাজী হলো। এবং সেই অনুযায়ী ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলো।
আত্মসমর্পণের শর্তাবলী অনুযায়ী জেনারেল ডগলাস ম‍্যাক আর্থার জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এর উদ্দেশ্যে টোকিওতে আন্তর্জাতিক মিলিটারী ট্রাইব্যুনাল গঠন করলো।
ন‍্যুরেমবার্গের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধীদের জন্য তৈরি আদালতে র থেকে এই আদালতে র ব‍্যাতিক্রম হলো  এখানে রাষ্ট্র প্রধান বা জাপ সম্রাট কে বিচার প্রক্রিয়ার থেকে নিস্কৃতি দেওয়া হয়েছিল।
এই আদালতে বিভিন্ন দেশের বিচারক মন্ডলীর সাথে ভারতের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন বিচারপতি ডাঃ রাধা বিনোদ পাল।
আজ ও জাপানী রা অত‍্যন্ত শ্রদ্ধা র সহিত তার নাম স্মরণ করে থাকেন ।

কেন জানেন ?
অন্যান্য বিচারক মন্ডলীর সাথে তার রায়ে ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য।
আইন শাস্ত্রে তার পান্ডিত্য আন্তর্জাতিক খ‍্যাতি অর্জন করেছিল।

ন‍্যুরেমবার্গের অভিযুক্ত জার্মানদের মতো জাপানী দের বিরুদ্ধে ও শান্তি ভঙ্গ ও যুদ্ধের চক্রান্ত, যুদ্ধাপরাধের ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ অনুষ্ঠানে র মতো নানা বিষয়ে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছিল।
কয়েক মাস বিচার চলার পর  জেনারেল তোজো ও তার ছয় সঙ্গী র ফাঁসি র আদেশ দেওয়া হয়েছিল। যা ২২ শে ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে কার্যকর হয়।


এই মামলায়  ডাঃ রাধা বিনোদ পাল সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে তার রায় দেন।
বিচারপতি মিঃ পাল বিশুদ্ধ আইনের প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন ,এক জাতি কর্তৃক অন‍্য জাতির উপর সামরিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভূত্ব আন্তর্জাতিক জগতে অপরাধ বলে বিবেচিত ছিল কিনা ?

দ্বিতীয়ত, অভিযোগে বর্ণিত  যে সময়ে এই সমস্ত  যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল , সেই সময়ে আন্তর্জাতিক আইনে এগুলি অপরাধ জনক ছিল কিনা ? যদি না হয়ে থাকে তবে পরবর্তী কালে আইন প্রণয়ন করে ঐ সব যুদ্ধ কে অপরাধ জনক বলিয়া অভিযুক্ত করা যায় কিনা ?

কিংবা আগ্রাসী বলে বর্ণিত কোন রাষ্ট্রের কোন ব‍্যাক্তিকে সরকারী ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করার জন্য অপরাধী বলা যায় কিনা ?

ডাঃ পাল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন অতীতে বৃহৎ রাষ্ট্র গুলো যে কাজ করেছে , জাপান তার চেয়ে বেশী কিছু করে নি।

চুক্তি ও সন্ধির শর্তাবলী ভঙ্গ,অন‍্য দেশকে রক্ষার নামে নিজের তাঁবে আনা, অর্থনৈতিক প্রভূত্বস্থাপন , যুদ্ধবন্দী নারী ও শিশুদের উপর অত‍্যাচার ও বর্বরতা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছে(এগুলি এখনো হয়ে চলেছে )।
জাপান ও সোভিয়েত রাশিয়া বন্ধু থাকা কালীন কমিউনিস্ট রাশিয়া র ডিক্টেটর ষ্ট‍্যালিন মিত্র শক্তি র সাথে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার চুক্তি করে।যা একই প্রকার অপরাধ।

ডাঃ পাল তার রায়ে লেখেন ,পার্ল হারবার আক্রমণের আগে জাপানী রাষ্ট্র দূত নমূরা  চীন ও অন্যান্য প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি পূর্ণ আলোচনা দ্বারা মীমাংসা করার চেষ্টা করেন। সেই চেষ্টা ব‍্যার্থ হয়েছিল। এবং ঐ একই সময়ে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের পক্ষ থেকে ই যুদ্ধের তোড়জোড় চলছিলো।



বিচারপতি ডাঃ রাধা বিনোদ পাল তার সুদীর্ঘ রায়ে যুক্তিসহকারে আন্তর্জাতিক মিলিটারী ট্রাইব্যুনাল এ অভিযুক্ত সব জাপানী নেতাকে নির্দোষ বলে সাব‍্যস্ত করেন ও মুক্তি দেওয়ার সুপারিশ করেন। কিন্তু এটা ছিল মাইনরিটি বা একক রায়। মেজরিটি বিচারক মন্ডলীর রায়ে আসামীরা দোষী সাব্যস্ত হন। এবং বিভিন্ন প্রকার দন্ডে দন্ডিত হন।

ডাঃ রাধা বিনোদ পাল মন্তব্য করেছেন যা আজও যুগোপযোগী , “বিজয়ী পক্ষ কখনো বিজিতকে ন‍্যায় বিচার দিতে পারে না। কারণ আদালত যদি রাজনীতির মধ্যে শিকড় গেড়ে বসে , তবে ন‍্যায় বিচারের যতই মুখোস পরানো হোক না কেন, 'তখন ন‍্যায় বিচার শুধুই বলশালী পক্ষের স্বার্থ সিদ্ধির ব‍্যাপারে পরিণত হয় মাত্র।’  ”

Sunday, January 14, 2018

বাংলা অনলাইন কল্পবিজ্ঞান - মহাশূন্যের পথিক (মধ‍্যম পর্ব)।

আর কয়েকটা মূহুর্ত। তারপর সব শেষ। মহাকাশ যান “নিউটন 2350”এই অজানা অচেনা মহাকাশে এক আশ্চর্য চকচকে গোলকের আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
রোশনি সজল চোখে রাহুলের দিকে তাকালো।যতই নিজেকে দৃঢ় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করুক, আসলে সে একজন মেয়ে।তাই আবেগ অনুভূতি গুলি পুরো পুরি চেপে রাখতে পারেনি।
রাহুল বললো, “দুঃখ পেয়োনা ।এ আমাদের গর্বের মূহুর্ত। বিজ্ঞানের সাধনায় জীবন উৎসর্গ করছি আমরা। এই কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মহাকাশযানটির  অগ্রভাগ গোলকটি কে স্পর্শ করলো।

এরপর …….


যেমন করে এক টুকরো পাথর জলের মধ্যে ডুবে যায় তেমনি মহাকাশযান  ‘নিউটন2350’ গোলকটি র অভ‍্যন্তরে ঢুকে গেলো।
কোন ক্ষতি হলো না। গোলকটি র অভ‍্যন্তরে  ঠিক মধ‍্যস্থলে মহাকাশ যানটি স্থিতিশীল হয়ে গেল।
রাহুল ও রোশনি দুজনেই অবাক হয়ে গেলো।এ কেমন আশ্চর্য রহস্য। মহাকাশ যান ‘নিউটন 2350’ এর গণকযন্ত্র বলছে  এই মুহূর্তে যানটির গতিবেগ শূন্য।অথচ মহাকাশ যানের জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে গোলকটি র  চতুর্দিকে র মহাকাশের পটভূমি অতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে।এর অর্থ একটাই । গোলকটি গতিশীল। এবং মহাকাশযানটি কোনো অজানা কারণে গোলকটি র অভ‍্যন্তরে স্থির হয়ে আছে।
যদিও মহাকাশ যানটি র পরমাণু চালিত ইঞ্জিনটি চালু আছে। ইতিমধ্যে 'আই’ একটা জরুরী  ইনফরমেশন দিলো। গোলকটি র অভ‍্যন্তরে পৃথিবীর মতো বায়ুমণ্ডল আছে যা কিনা অক্সিজেন সমৃদ্ধ ও মানুষের বসবাস এর জন্য উপযুক্ত।
রাহুল রোশনি কে বললো ,”তুমি যানের ভিতরে থাকো। আমি একবার যানের বাইরে যাচ্ছি।  রোশনি বললো , “না , তোমার একা মহাকাশ যানের বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। আমার মনে হয় তোমার সঙ্গে আমার যাওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে 'আই’ কেও নিয়ে যাওয়া উচিত।কারণ কখন কি বিপদ আসবে,তা জানি না।  'আই’ সঙ্গে থাকলে যে কোন বিপদের মোকাবিলা করা সহজ হবে ।”
রাহুল রোশনি র যুক্তি এড়িয়ে যেতে পারলো না।
যদিও 'আই’  এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী গোলকটি র ভিতরের আবহাওয়া মানুষের পক্ষে অনুকূল, তবুও সাবধানতা হিসাবে স্পেস শুট পরে নিলো।
রোশনি ও রাহুল 'আই’ এর সাথে মহাকাশ যান  ‘নিউটন2350’এর বাইরে এলো।
সবাই বাইরে আসার পর ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা।
যে মূহুর্তে সবাই মহাকাশ যানের বাইরে এলো , মহাকাশযানটি র কম্পিউটার চালিত স্বনিয়ন্ত্রিত  দরজাটি ভিতর হতে  বন্ধ হয়ে গেলো। মহাকাশ যানটি এখন দূর নিয়ন্ত্রিত ব‍্যবস্থা দ্বারা মহাকাশ চারীদের সাথে যুক্ত।আর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে , 'আই’ এর অধীনে।
কিন্তু সবাই কে আশ্চর্য করে মহাকাশ যানটি হঠাৎ গতিশীল হলো। রাহুল বিপদের সংকেত বুঝতে পেরে , 'আই’ কে বললো , “'আই’ মহাকাশ যানটির হঠাৎ গতি বেড়ে যাচ্ছে কেন ? এখনি ওটাকে থামানোর ব‍্যবস্থা করো।”
'আই’ উত্তর দিলো , “কমান্ডার , আমি কিছু ই করছি না, আমি  থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা  করছি। কিন্তু ভিতরে র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আমার কমান্ড রিসিভ করছে না । আমার সন্দেহ হচ্ছে কোন শক্তি আমাদের মহাকাশ যানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। এবং তারা আমার কমান্ড রিসিভ করার যন্ত্র টি বন্ধ করে দিয়েছে।”
এরপর সকলের চোখের সামনে মহাকাশ যানটি গোলকটি র বাইরে ছিটকে গেলো।
পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার শেষ সম্ভাবনা টুকুও রইলো না।



একটা গোলকের ভিতরে তিনজন। দুটি জীবিত প্রাণী,আর একটি অতীব বুদ্ধিমান রোবট। কোন এক অজানা লক্ষ্য বস্তু র দিকে গোলকটি ছুটে চলেছে।সময় যেন থমকে গেছে। অভিযাত্রী যা বিস্ময়ে চেয়ে রইলো বাহির পানে। রাহুল স্পেস শ‍্যুটের হেলমেট খুলে ফেললো। না , বাইরের বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস প্রশ্বাসের কোন কষ্ট হচ্ছে না। রাহুলের দেখাদেখি রোশনি ও  হেলমেট খুলে ফেললো।
এরপর শুধুই অপেক্ষা । অপেক্ষা গন্তব্যে পৌঁছবার।
কতক্ষন বা কতদিন গোলকটি তাদের নিয়ে চললো অজানা র উদ্দেশ্যে জানা নেই। সময়ের হিসাব নেই। নেই ক্ষুধা ,তৃষ্ণা ,ঘুম বোধ। শুধু ই এগিয়ে চলা ।
'আই’ বললো , “নক্ষত্রের পজিশন দেখে অনুমান করছি , আমরা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র স্থলের দিকে এগিয়ে চলেছি।”
রোশনি 'আই’কে জিজ্ঞেস করলো “বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র স্থলে কি আছে ?”
'আই’ উত্তর দিলো “বিজ্ঞানী রা এখনো জানেন না। তবে কিছু বিজ্ঞানী বলেন কেন্দ্রীয় অংশ পুরো ফাঁকা, আবার কেউ বলেন বিশ্বের কেন্দ্র স্থলে এক বিশাল ব্ল‍্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর আছে। আমি এপর্যন্ত যেটুকু তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং সেগুলো অ‍্যানালিসিস করে নিশ্চিত হয়েছি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে এক কোটি কোটি আলোকবর্ষ ব‍্যাপী কৃষ্ণ গহ্বর বিদ‍্যমান রয়েছে। আমার সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত কিনা আপনারা কিছু ক্ষণের মধ্যে ই বুঝতে পারবেন। এই মূহুর্তে গোলকটি অতি আলোক গতি'তে ছুটে চলেছে। আমরা সময়কে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি।কারণ সময় আলোকের গতি সম্পন্ন।আর আমরা আলোর চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ বেশি গতিতে এগিয়ে চলেছি।
ঐ দেখুন আমার অনুমান সঠিক। দূরে দেখুন কৃষ্ণ গহ্বর দেখা যাচ্ছে। যদিও ঐ কৃষ্ণ গহ্বর টি প্রায় একশো আলোকবর্ষ দূরে আছে ।”

দেখতে দেখতে কৃষ্ণ গহ্বর টি গোলকটি র আরো কাছে চলে এলো।
আর কয়েকটা মূহুর্ত পর গোলকটি সোজা কৃষ্ণ গহ্বরের মধ্যে ঝাঁপ দেবে।যেখান থেকে আলোও ফিরতে পারে না।(মহাশূন্যের পথিক - মধ‍্যম পর্ব শেষ)
[পরবর্তী পর্বে র জন্য এখনি ইমেইল দিয়ে সাবস্ক্রাইব করুন আমার অশ্বডিম্ব ব্লগ]

Friday, January 5, 2018

জন্মান্তরবাদ

হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বৈপ্লবিক ধারণা হলো  জন্মান্তরবাদ।
কিছু ধর্ম যেমন ইসলাম, খ্রীষ্টান,ইত‍্যাদী ধর্মে জন্মান্তরবাদ স্বীকার করে না।
আবার হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু ধর্মের হতে সৃষ্ট ধর্ম যেমন বৌদ্ধ,জৈন ইত‍্যাদী গুলিতে জন্মান্তরবাদ মেনে নিয়েছে।

ধরা যাক জন্মান্তরবাদ মিথ্যা। মানুষ একবারই জন্মায় এবং তারপরে মৃত্যুর পর তার জীবন কালের কর্মের ভিত্তিতে ঈশ্বরের বিচারে স্বর্গ বা নরক ভোগ হয়।
বেশ ভালো কথা।
কিন্তু প্রশ্ন টা এখানে। ঈশ্বর কে সব ধর্মেই  বলা আছে ,ঈশ্বর নিরপেক্ষ। অর্থাৎ ঈশ্বর তার সন্তান দের মানে আমাদের সবাইকে সমান সুযোগ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন। কিন্তু সত্যি ই কি তাই ?
আমরা প্রতিনিয়ত দেখি কিছু মানুষ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়।তারা জন্মসূত্রে শুধুই সুখ সুবিধা ভোগ করেন।
আর আমরা প্রতিনিয়ত দুঃখ কষ্টের জীবন ভোগ করি। আমাদের সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়।আর বড়লোকেদের টাকা বাচ্চা পাড়তেই থাকে।
এমন তো হবার কথা নয়। ঈশ্বর তো সবাই কে প্রথম বার তথা একবারের জন‍্যই পৃথিবীতে কর্ম করার জন্য পাঠিয়েছেন। তাহলে ঐ বড় লোকের বাচ্চা গুলো কেন ফেভার পাবে ?
কোন জবাব কি আছে ইসলাম ও খ্রীষ্টান ধর্মের কাছে ?
না , কোন উত্তর নেই। উত্তর যদিও দেয় সেটা যুক্তিতর্কে ধোপে টিকবে না।
এখানেই শেষ নয় ,যারা হিন্দু ধর্মের জন্মান্তরবাদ মানেন না তারা উত্তর দিন, কেন কিছু মানুষ পঙ্গুত্ব নিয়ে জন্মায় ?
তারা যদি প্রথম বার পৃথিবীতে জন্ম নিচ্ছে, তবে ঈশ্বর কেন তাদের সুস্থ সবল করে পাঠাতে পারেন না? তাদেরো তো পৃথিবীতে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে পাঠানো উচিত,যাতে তারা ঈশ্বর নির্দেশিত পথে জীবন অতিবাহিত করতে পারে।
আসলে মানুষ একবারই জন্মায় এই ধারণা টাই ভুল।
আচ্ছা কিছু মানুষ কে আপনি প্রতিদিন দেখেন খুব খারাপ কাজে লিপ্ত থাকেন। আপনি মনে মনে ভাবতে থাকেন , একদিন নিশ্চয়ই সে তার কর্মের উপযুক্ত প্রতিফল পাবেন। আপনার ভাবনা টাই সার। অনেক সময় দেখা যায় জীবদ্দশায় তাদের কোন রূপ ঈশ্বরীয় শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় না। বরং তারা আপনার আমার চেয়ে বেশী সুখ ভোগ করে থাকেন। তাহলে কি তারা তাদের কর্মের কোন শাস্তি পাবে না ?
হিন্দু ধর্ম এক্ষেত্রে বলেছে প্রতিটি মানুষ তার কৃতকর্মের ফল অনুযায়ী পরের জন্মে ফল লাভ করে।
আচ্ছা আরো একটা প্রশ্ন আছে।
যেসব ধর্ম গুলো জন্মান্তরবাদ স্বীকার করে না, তারা উত্তর দিন।
মনে করুন এক জন তার কর্মের ঊনপঞ্চাশ শতাংশ খুবই খারাপ কাজ করলো। তার কাজের জন্য হাজার হাজার পরিবার পথে বসলো , অজস্র মানুষ মৃত্যুবরণ করলো, তার পর সে তার জীবনের বাকি একান্ন অংশ কর্ম খুব ভালো করলো।দান ধ‍্যান , লোকের সেবা এইসব করলো।
লোকটি মৃত্যুর পর ঈশ্বরের সামনে বিচারের জন্য হাজির হলো। যেহেতু লোকটি র পূণ‍্যকর্ম পাপকর্মের চেয়ে দুই শতাংশ বেশি,তাই সে ঐসব ধর্মীয় যুক্তি অনুযায়ী অনন্ত স্বর্গের অধীকারী হবে।
কিন্তু আপনার মতে কি সেটা ঈশ্বরের সঠিক বিচার হবে ?তার পাপকর্মের ফল কি সে লাভ করবে না ? যেসব মানুষ গুলির সর্বনাশ ও পাপী লোকটি করেছে, তারা কি ঈশ্বরের ন‍্যায় বিচার হিসেবে দেখবে। নিশ্চয়ই না।

সেই সব ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মের জন্মান্তরবাদ বলে , আমাদের আত্মার কখনো বিনাশ হয় না। মৃত্যু শুধুই এক জন্ম হতে পরের জন্মে র প্রবেশ পথ।

হিন্দু রাই পৃথিবীতে কিছু অসাধারণ দার্শনিক সত‍্যের সাথে মানুষের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো।

হিন্দু ধর্মের মতে আমরা প্রতিটি মানুষ সাধনা করে চলেছি। শুধু কেউ সাধনার পথে এগিয়ে গেছে। আবার কেউ একটু পিছিয়ে আছে।
অন্তিমে আমরা সবাই আমাদের আকাঙ্খিত মোক্ষ লাভ করবো।

আপনি এইবার ভাবতে বসেছেন , আমি ছাপোষা মানুষ, দিন আনি দিন খাই, কোনো দিন মন্দির বা মসজিদে গিয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা পর্যন্ত করি না, তাহলে আমি কিভাবে সাধনা করছি ?
হিন্দু ধর্মের দর্শন বলছে,আমরা এই যে জীবন অতিবাহিত করছি ,তা আসলে আমাদের আগের কৃত কর্মক্ষয়। আমরা সুখ বা দুঃখ যাই লাভ করি না কেন তা আসলে আমাদের পূর্ব জন্ম কৃত কর্মের ফল।
এই ভাবে কর্মক্ষয় করতে করতে একদিন কোন না কোন জন্মে আমরা ঈশ্বরীয় অনুভব লাভ করবো।

যারা যোগ সাধনা করেন ,তারা জানেন পাপ বা পূণ‍্য উভয় প্রকার কর্মানুষ্ঠান আমাদের পূনরায় জন্মের কারণ।
তাই যোগ অভ‍্যাসীদের বলা হয় উভয় প্রকার কর্মানুষ্ঠান থেকে বিরত থাকার। সেই জন্য ই রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছেন ,"সংসারে থাকবি পাঁকাল মাছের মতো,গায়ে যেন একটুও পাঁক না লাগে।"
হিন্দু ধর্ম বলেছে ,"আমরা সবাই অমৃতের সন্তান।"এখানে অমৃতের বলতে ঈশ্বরের কথা ই বোঝানো হয়েছে।

যাই হোক ধান ভাঙতে গিয়ে শিবের গীত গাওয়া হচ্ছে।
বরং জন্মান্তরবাদ নিয়ে কিছু  কথা আরো বলি।
কিছু শিশু দেখবেন সহজেই সব কিছু শিখে নেয়।যেন তারা আগে থেকেই এগুলো জানতো। হিন্দু ধর্মের মতে, এগুলো তাদের পূর্ব জন্মের অভিজ্ঞতার ফল।তারা পূর্ব জন্মে হয়তো ঐ সব অভ‍্যাস করেছিলো , সেজন্য এই জন্মে অল্প চেষ্টাতেই এগুলী জেনে ফেলছে।কারণ আমাদের শিক্ষা আমাদের চৈতন্যে স্থায়ী ছাপ ফেলে।

হিন্দু ধর্মের বিষয়ে আরো অনেক কিছু জানতে চোখ রাখুন এই ব্লগে।
সবচেয়ে ভালো ব্লগে র ডেস্কটপ সাইটে গিয়ে ইমেইল ঠিকানা দিয়ে সাবস্ক্রাইব করুন। সেক্ষেত্রে আমার প্রতিটি পোস্টের ইমেইল নোটিফিকেশন পাবেন।
  ধন্যবাদ,জয় হিন্দ, বন্দেমাতরম।

Tuesday, January 2, 2018

বাংলা অনলাইন কল্প বিজ্ঞান - মহাশূন্যের পথিক।

প্রথমে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। আমি স্লিপিং চেম্বারের বাইরে আসতে , একটা যান্ত্রিক গলায় শুনতে পেলাম “ওয়েলকাম , কমান্ডার রাহুল বসু।”
যার কাছ থেকে আওয়াজ টি এলো , এবারে সে এগিয়ে এলো । অবশ্য এগিয়ে এলো ঠিকই, কিন্তু হেঁটে নয়, বরং অ‍্যান্টিগ্র‍্যাভিটি রশ্মির সাহায্যে উড়ে।
সে মানুষ নয় ।সে এই 'নিউটন 2350’ মহাকাশ যানের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মচারী ,এক রোবট।নাম 'আইনষ্টাইন’ ওরফে 'আই’।
'আই’  এগিয়ে এসে আমায় রিপোর্ট করলো “এভরিথিং ওকে। মহাকাশযান 'নিউটন 2350’ এখনো অতি আলোক গতিতে লক্ষ্যবস্তু 'নোভা’র দিকে এগিয়ে চলেছে। লক্ষ্য বস্তু এখনো 0.5 আলোকবর্ষ দূরে। অবিলম্বে মহাকাশযানের গতি কমিয়ে  আলোর নব্বই শতাংশ গতিতে আনা উচিত।”
আমি বললাম “ধন্যবাদ তোমায় ‘আই’। এবারে অটোমেটিক কন্ট্রোল থেকে ম‍্যানুয়াল কন্ট্রোল নেব । তবে সবার আগে তুমি জানাও  ক‍্যাপটেন রোশনি তার স্লিপিং চেম্বার থেকে উঠেছেন কিনা।”
এবারে ‘আই’ পুনরায় বলল , “ক‍্যাপটেন রোশনির ঘুম ভেঙেছে। তিনি অতি শীঘ্রই আপনার সাথে যোগ দেবেন।”
এই সব কথা বলতে বলতে দেখি ক‍্যাপটেন রোশনি  আমার দিকে এগিয়ে আসছে। টানা ছয় মাস ঘুমোবার পর তাকে আগের চেয়ে বেশি ফ্রেশ ও সুন্দরী লাগছে। মহাকাশযান সৌর জগৎ ছাড়িয়ে যাওয়ার পরই আমরা ‘অতি আলোক গতি’ সেট করে দিয়ে , পূর্ব নির্ধারিত ব‍্যাবস্থা অনুযায়ী স্লিপিং চেম্বারে ঘুমোতে চলে গিয়েছিলাম।
কারণ আমাদের লক্ষ্য বস্তু 'নোভা’ গ্রহ 432 আলোকবর্ষ দূরে ছিলো।
ক‍্যাপটেন রোশনি কাছে এসে বললো “সুপ্রভাত, কমান্ডার রাহুল।”
আমি ও প্রত্যুত্তরে বললাম “ওয়েলকাম”।
যদিও দুজনেই জানি এই মহাশূন্যে , কোন দিন বা রাত নেই। তবুও পৃথিবীর অভ‍্যাস মতো দেখা হলে সাদর সম্ভাষণ জানানো।
রোশনি বললো , “কমান্ডার , বর্তমান পরিস্থিতি কি যদি একটু বলেন , ভালো হয়।”
আমি বললাম “সব কিছু পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে।আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা 'ছয় মাস ঘুমোবার পর তোমায় আরো সুন্দর লাগছে’ ।”
রোশনি হেসে ফেললো। আসলে ও জানে আমি যতই ইয়ার্কি করি , আসলে কাজের ব‍্যাপারে আমি খুবই সিরিয়াস।
এই মিশনটি  শুধু আমাদের জন্য নয় মানবজাতির পক্ষে ও  গুরুত্বপূর্ণ।
বেশ কয়েক বছর আগে এই 'পোলারিস ৯১৩’  সৌরমণ্ডলের একটি গ্রহ থেকে একটি বার্তা আমাদের বিজ্ঞানী রা পাচ্ছিল।  বিজ্ঞানী রা বার্তাটি ডিকোডিং করার পর অ‍্যানালিসিস করে দেখা যায় এটি অতি উন্নত বুদ্ধিমান কোন জীবের তৈরী। বার্তা টি তে   জানানো হয়েছে  “এটি  ‘নভেরীয়’ নামে এক জাতির পক্ষ থেকে  ব্রহ্মাণ্ডের অন্যান্য উন্নত জীবদের উদ্দেশ্য প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের জানানো হচ্ছে তারা যেন তাদের প্রতিনিধি যত শীঘ্র সম্ভব তাদের গ্রহে প্রেরণ করে। বর্তমানে নভেরীয় জাতি তাদের জ্ঞান ভান্ডার অন‍্য বুদ্ধি মান প্রাণীদের সাথে ভাগ করে নিতে আগ্রহী। যদি উন্নত জীবজগৎ গুলি তাদের প্রকৃত ইতিহাস জানতে চায় তবে অবিলম্বে তাদের কাছে আসা একান্ত জরুরী।”
বার্তাটি এখানেই শেষ হয় নি ।এর পরের অংশ জুড়ে  রয়েছে বিজ্ঞানের কচকচি।  এতদিনে মানুষ অনেক উন্নত হলেও ‘অতি আলোক গতি’ করায়ত্ত করতে পারে নি । সেই কারণে   বহু দূরের আলোকবর্ষে প্রাণ আছে একথা নিশ্চিত রূপে প্রমাণ পেলেও  যোগাযোগ করে উঠতে পারে নি ।
এই বার্তা টি থেকে বিজ্ঞানীরা প্রথম বার 'অতি আলোক গতি’   কিভাবে লাভ করা যায় তার সুত্র খুঁজে পেল।
অবশেষে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী দের সমবেত চেষ্টায় ‘অতি আলোক গতি’  লাভ করলো।
তার পর এই বর্হিঃমহাকাশে এই অভিযান।যার পোশাকি নাম 'নিউটন ২৩৫০’।নভেরীয় জাতি র পক্ষ থেকে বার্তা এসে ছিল তাই ঐ সৌরমণ্ডলের পঞ্চম গ্রহ টি র নাম রাখা হয়েছে 'নোভা’। বার্তা টি নোভা থেকে ই এসেছিল।
এই মহাকাশ কর্মসূচি তে  অংশ নেওয়ার জন্য  সব নভশ্চর দের কাছ থেকেই ঐচ্ছিক আবেদন পত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল। ঐচ্ছিক কারণ , এই মিশনটি বহু দূরের উদ্দেশ্যে  । এবং এই যুগে আর কখনো ফিরে আসা যাবে না । কারণ মহাকাশযান ‘অতি আলোক গতিতে’ যাবার জন্য আইনষ্টাইনের ‘জেনারেল রিলেটিভিটি’সুত্র অনুযায়ী সেখানকার সময় ধীর গতিতে চলবে। এবং মহাকাশচারী দের সাপেক্ষে পৃথিবীর সময় অতি দ্রুত চলবে ।ফলে মহাকাশচারী দের সময় যদি মাত্র এক বছর বৃদ্ধি পায় তবে পৃথিবীতে কয়েক শো বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাবে।
রাহুল ও রোশনি একই অ‍্যাকাডেমি তে নভশ্চর হওয়ার ট্রেনিং নিয়ে ছিলো। যদিও রোশনি রাহুলের চেয়ে এক বছরের জুনিয়র ছিলো।
অন্যান্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় রোশনি রাহুলের কাছে বেশী আকর্ষণীয় ছিলো। রোশনি র সৌন্দর্য ,ব‍্যাক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা,সব কিছুই রাহুলের কাছে ভালো লাগতো।
রাহুল নিজে সব শিক্ষার্থী দের মধ্যে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিলো। অন্যান্য কম বয়সী মহিলা শিক্ষার্থী রা রাহুলের সান্নিধ্য পেতে আগ্রহী থাকলে​ও রাহুল খুব বেশী তাদের পাত্তা দিতো না।
কিন্তু যখন রোশনি এই মহাকাশ অ‍্যাকাডেমী তে ট্রেনিং এর জন্য এলো তখন যেন  মহাদেবের ধ‍্যান ভঙ্গ হলো।
যে রাহুল মহিলা দের পাত্তা দিতো না ,সে নিজের কাজের ফাঁকে সময় পেলেই রোশনি র মন পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলো।
কিন্তু বিধি বাম।
রোশনি একদিন মিষ্টি মিষ্টি কথায় রাহুল কে বুঝিয়ে দিলো ,সে এই মহাকাশ অ‍্যাকাডেমিতে মহাকাশচারী হওয়ার উদ্দেশ্যে এসেছে।আর রাহুল নিজে ও সেই উদ্দেশ্যে এসেছে। সুতরাং তাদের দুজনের ই উচিত এই সব সেন্টিমেন্ট কে পাত্তা না দিয়ে নিজের শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হওয়া।
এরপর থেকে রাহুল বুঝে যায় এ বড়ো কঠিন ঠাঁই।
মন থেকে রোশনি র আশা ত‍্যাগ না করলেও,আর কখনো রোশনি কে ডিস্টার্ব করে নি রাহুল।
এক সময় মহাকাশ অ‍্যাকাডেমি তে সফল ভাবে উত্তীর্ণ হয়ে  একের পর এক মহাকাশ অভিযানে অংশ গ্রহণ । এবং এই মুহূর্তে রাহুল একমাত্র মহাকাশচারী , যে প্রত‍্যেকটি অভিযানে একশো শতাংশ সফল।
রোশনি মহাকাশে প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে দীর্ঘ দিন গবেষণা করেছে।তার গবেষণা বিজ্ঞানী মহলে উচ্চ প্রশংসা পেয়েছে।
প্রথমে ঠিক হয়ে ছিলো  এই নোভা গ্রহের অভিযান মানুষ বিহীন রকেটের সাহায্যে হবে ।
পরে মত পাল্টে ঠিক হয় , পুরো অভিযান টা আংশিক ভাবে যন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে । এবং অভিযানে র  শুরু ও শেষ  অংশ টুকু মনুষ্যচালিত হবে  ।
এই প্রথম বার মানুষ 'অতি আলোক গতি'তে অভিযান চালাবে। বিজ্ঞানী রা চিন্তায়​ ছিলেন মানুষের মস্তিষ্ক আদৌ এই গতি সহ্য করতে পারবে কিনা। অবশেষে তারা একটি উপায় বার করলো।
অভিযানে র মধ‍্যবর্তী অংশ , যখন ‘অতি আলোক গতি'তে মহাকাশ যান ছুটবে , সেই সময় মহাকাশ যানের নিয়ন্ত্রণ রোবট করবে । এবং ঐ সময় মহাকাশচারী​দের রকেটের অভ‍্যন্তরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে। তাতে এই গতি র তীব্র এফেক্ট যেমন কম অনুভূত হবে , তেমনি দীর্ঘ যাত্রার রসদ বাঁচবে।
কিছু দিন আগেই এক প্রাণী বিজ্ঞানী যে কোন প্রাণীকে দীর্ঘ কাল ঘুম পাড়িয়ে রাখার উপায় আবিষ্কার করেছেন।এই ঘুমন্ত অবস্থায় প্রাণীটির মেটাবোলিজম প্রায় শূন‍্যে নেমে যায় । এবং প্রাণী টির বয়স বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
অতঃপর রোশনি ও রাহুল দুজনের নাম একই সাথে এই অভিযানে র সাথে যুক্ত হওয়া।
এখনো পর্যন্ত সবকিছুই নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে।
রাহুল পৃথিবীর কমান্ড সেন্টারের উদ্দেশ্যে একটা ভিডিও বার্তা ছেড়ে দিলো । বার্তা য় দুজনের বর্তমান অবস্থা থেকে সবকিছুর বিবরণ ছিলো।
যদিও এই বার্তা যদি আলোর বেগেও যায় , তবু 432 বছর পরে পৃথিবীতে পৌঁছবে।আদৌ জানা নেই তাদের সেই বার্তা গ্রহণ করার জন্য পৃথীবিতে কেউ অপেক্ষা করবে কিনা।
নোভা গ্রহটি যত কাছে আসছে মহাকাশ যানের গতিবেগ তত কম করা হচ্ছে। মহাকাশ যান এখন ম‍্যানুয়াল কন্ট্রোলে চলছে। মহাকাশ যানের গতিবেগ এখন  আলোর তিরিশ শতাংশ। লক্ষ্য বস্তু নোভা গ্রহের দূরত্ব মাত্র আশী লক্ষ কিলোমিটার দূরে। প্রতি মূহুর্তে দূরত্ব কমছে।
অকস্মাৎ রোশনি বলে উঠলো , “রাহুল দেখতো , একটা চকচকে কিছু আমাদের যানের দিকে এগিয়ে আসছে।”
রাহুল প্রথমে ব‍্যাপারটা লক্ষ করে নি।
রোশনি বলার পর মহাকাশ যানের বিশাল স্ক্রীনে র দিকে তাকিয়ে দেখলো দূরে ছোট মতো একটা কিছু দ্রুত মহাকাশ যান লক্ষ করে এগিয়ে আসছে। এখনি যানের গতিপথ না পাল্টে ফেললে মহাকাশ যান চুরমার হয়ে যাবে।
রাহুল দ্রুত কন্ট্রোল প্যানেলে নির্দেশ পাঠালো গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য।
কিন্তু প্রত্যুত্তরে কন্ট্রোল প্যানেল থেকে মেসেজ এলো 'কমান্ড ডিনায়েড’।
রাহুল রোশনি কে বললো , “গতিপথ পরিবর্তন করতে পারছি না । তুমি একবার চেষ্টা করো।”
রোশনি ও চেষ্টা করলো গতিপথ পরিবর্তন করতে। কিন্তু ফল কিছুই হলো না। মহাকাশ যান একই গতিতে ঐ আজব চকচকে বস্তু টির দিকে এগিয়ে চলেছে। কম্পিউটার বলছে আর কুড়ি মিনিট পর ঐ চকচকে বস্তু টির সাথে মহাকাশ যানের ধাক্কা নিশ্চিত।
রাহুল প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেল।
লক্ষ্য বস্তু র এতো কাছে এসে এই পরিণতি।
রাহুল বুঝে উঠতে পারছিলো না ,কি করা উচিত।
হঠাৎ রোশনি রাহুলের দিকে ফিরে বললো , “রাহুল শান্ত হও। জানি মৃত্যু নিশ্চিত। তবু ও  আমরা দুজন অভিযাত্রী। মৃত্যু র আগের মূহূর্ত পর্যন্ত আমাদের উচিত সবকিছুর রেকর্ড রাখা। এবং সেই রেকর্ড পৃথিবীর উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা।যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অভিযাত্রীরা সেই সব বিপদের মোকাবিলা করতে পারে।
আরো একটা কথা রাহুল , যেটা তুমি এতদিন শুনতে চাইলেও , আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি।আজ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই কথাটি তোমার কাছে প্রকাশ করছি। তোমার সান্নিধ্যে থাকতে থাকতে কবে যে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি জানি না।আই লাভ ইউ।”
কথা গুলো শুনতে শুনতে রাহুলের মুখে খুশি ও দুঃখের মিশ্রিত ভাব ফুটে উঠলো।
রাহুল বললো , “আজ আমার জীবন সার্থক মনে হচ্ছে। মৃত্যুর সময় তোমার পাশে থাকতে পারবো। তোমার কাছে একটা শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করছি। তুমি না বলো না।তোমায় প্রথম ও শেষ বারের মতো একটা চুম্বন করতে চাই ।”
এই কথা শেষ হওয়ার পর দু'জনের ওষ্ঠ মিশে গেলো।
কিন্তু না কর্তব্য আগে । মূহুর্ত পরে  বিচ্ছিন্ন হয়ে  নিজের নিজের আসনে বসে সব কিছুই রেকর্ড করতে ও একই সাথে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে প্রেরণ করতে লাগলো।
যে বস্তু টি এগিয়ে আসছে সেটা এখন অনেক কাছে চলে এসেছে।
প্রায় এক কিলোমিটার ব‍্যাসার্ধ বিশিষ্ট একটি গোলক।
রাহুল গোলক টির উদ্দেশ্যে লেসার বিম ছুঁড়ে মারলো। লেসার গোলক টিকে এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল।এ কেমন বস্তু ? তবে কি এটা কঠিন নয়। রাহুল মহাকাশ যানের যাবতীয় অস্ত্র গোলকটি কে লক্ষ্য করে ছুঁড়তে লাগলো। কিন্তু কোন অস্ত্র গোলকটি র কিছু মাত্র ক্ষতি করতে পারলো না। মহাকাশযানটির পথ পরিবর্তন করার পুনরায় চেষ্টা করলো। না কিছুতেই কিছু হবার নয়। মহাকাশ যানটি যেন কোন অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।আর কয়েক মূহুর্তের অপেক্ষা । তারপর মহাকাশ যানটি আছড়ে পড়বে গোলকটি র অভ‍্যন্তরে।
(মহাশূন্যে র পথিক - প্রথম পর্ব সমাপ্ত)