Crss colum

Monday, December 24, 2018

অমৃত ঝর্না র সন্ধানে

অরূপ নগরের রাজা ভীষণ অসুস্থ। রাজ্যের সব কবিরাজ বৈদ্যরা জবাব দিয়ে গেছে।
পাত্র , মিত্র, কোটাল , মন্ত্রী সবাই চিন্তিত রাজার অসুখ নিয়ে। তবে সবচেয়ে বেশি চিন্তা রাজকন্যা মেঘবতী র।
মেঘবতী র পিতা মহারাজা মেঘবর্মণ এর কিছু দিন আগে পর্যন্ত কোনো অসুখের লেশ মাত্র ছিলো না। কয়েক মাস আগে রাজসভায় খবর আসে এক মহাতান্ত্রিকের আবির্ভাব হয়েছে। সেই মহা তান্ত্রিকের উপদ্রবে রাজ্যের নিরীহ প্রজাকুল আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
এই তান্ত্রিক নাকি প্রতি আমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে একটি করে শিশুকে নরবলি দিচ্ছে।
মহারাজা মেঘবর্মণ সিদ্ধান্ত নিলেন যে এই অন্যায় কোনো ভাবেই বরদাস্ত করা যায় না।
রাজা অবিলম্বে তার সৈন্য দের আদেশ দিলেন সেই তান্ত্রিক কে বন্দী করে তার সামনে হাজির করার।
যথারীতি সৈন্যরা তান্ত্রিক কে রজ্জু দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে রাজদরবারে হাজির করলো।
অতঃপর তান্ত্রিকের বিচার শুরু হলো।যত  সন্তান হীন পিতা মাতার দল তান্ত্রিকের বিচার চেয়ে রাজদরবারে সাক্ষী দিলো।
অবশেষে মহারাজ মেঘবর্মণ ঐ তান্ত্রিক কে অপরাধী ঘোষণা করে প্রাণদন্ডের আদেশ দিলেন।
তান্ত্রিক এতক্ষণ নীরব ছিলেন। এবার মহারাজ যখন শাস্তি ঘোষণা করলেন তখন সে তার নীরবতা ভেঙে বললো , "মহারাজ , আমি কিছু বলতে চাই।"
মহারাজ বললো ," বেশ আপনি আপনার যা  বক্তব্য আছে তা বলুন ।  "
তখন তান্ত্রিক বললো , "একথা সত্য যে শিশু হত্যা র মতো অপরাধ আমার হাতে হয়েছে। কিন্তু আমি এই কাজ রাজ্যের উন্নতি সাধনের জন্য বিশেষ তান্ত্রিক ক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবে সংঘটিত করেছি। নরহত্যা র মতো অপরাধে আমি অপরাধী। আপনি আমার বিচার করে যে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন তাতে আমি বিন্দুমাত্র ভীত নই। আমার উচিত হয় নি এই ধরনের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়া। কিন্তু রাজ্যের বাকি প্রজাবর্গ সহিত স্বয়ং মহারাজের সুস্থতা কামনায় এই তান্ত্রিক ক্রিয়া আমি শুরু করেছিলাম। কিন্তু এখন আমার মৃত্যুতে এই  অসমাপ্ত তান্ত্রিক ক্রিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া প্রদান  করবে। আপনি রাজ্যের প্রধান হিসেবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। কোনো ঔষধ আপনাকে সুস্থ করে তুলতে পারবে না।  মৃত্যু আপনার নিশ্চিত। আমার মৃত্যুর পরবর্তী ছয়টি পূর্ণিমা পর্যন্ত আপনার আয়ু।

এখন আপনি ভেবে দেখুন আমার প্রাণদণ্ড কার্যকর করবেন কিনা ?

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মহারাজ মেঘবর্মণ বললেন ,"বুঝতে পারছি আপনি ভ্রম বশত এই ধরনের তান্ত্রিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু আপনি নরহত্যা র অপরাধ করেছেন। সেজন্য শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে।আর আমার জীবন আমার কাছে বেশি মূল্যবান নয়। সবচেয়ে মূল্যবান আমার প্রজাবর্গ। তাদের হিতের জন্য যদি আমার মৃত্যু হয় তবে তা শ্রেয়।"

তখন তান্ত্রিক বললেন , "ধন্য আপনি। নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আপনি আপনার কর্তব্যে অবিচল। সেজন্য আমি মৃত্যুর আগে আপনার বাঁচার উপায় বলে যাবো।
এই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে আপনাকে অমৃত ঝর্না র জল পান করতে হবে। সেই অমৃত ঝর্না র জল যে কোন রোগ হরণ করে। একবার সেই জল পান করলে কখনো অসুস্থ হবে না। কিন্তু সেই অমৃত ঝর্না র জল সংগ্রহ করা সহজ নয়।
প্রথমে আপনাকে যেতে হবে দক্ষিণ দিকে। সেদিকে রয়েছে সমুদ্র। সমুদ্রের মাঝখানে অসংখ্য দ্বীপের মধ্যে আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে রামধনু দ্বীপ। এই দ্বীপটির অধিবাসী মানুষ ভক্ষণ কারী ভয়াবহ রাক্ষসের দল। ঐ দ্বীপের রাজপ্রাসাদের ভিতরে রয়েছে এক সরোবর। সেই সরোবরের জলে রয়েছে আশ্চর্য গুণ। কেউ যে কোন স্থানে যাওয়ার মনস্থির করে অবগাহন করলে তৎক্ষনাৎ সেই আকাঙ্খিত স্থানে  অবস্থিত কোনো সরোবরে নিজেকে দেখতে পাবে।
এখন যে কোনো উপায়ে ঐ সরোবরের কাছে পৌঁছে  অমৃত ঝর্না র কাছে পৌঁছবার মানস নিয়ে অবগাহন করতে হবে। তৎক্ষনাৎ নিজেকে অমৃত ঝর্না র কাছে আবিষ্কার করবে। এবার ঐ অমৃত ঝর্না র জল পাত্রে ভরে নিতে হবে। ঐ অমৃত ঝর্ণার দ্বীপে কোনো মানুষ বসবাস করে না।ঐ দ্বীপের অধিবাসী পক্ষীরাজ ঘোড়ার দল। এই পক্ষীরাজ ঘোড়ার দল মানুষের ভাষায় কথা বলে। কোনো ভাবে তাদের বশ করে  নিজের রাজ্যে ফিরতে হবে।
আর এই সব কিছুই করতে হবে আমার মৃত্যুর পরবর্তী ছয়টি পূর্ণিমা র চন্দ্রোদয়ের মধ্যে।কারণ ঐ টুকু সময় আপনার বাকী থাকা আয়ু।"

মহারাজ মেঘবর্মণ বললেন ,"আপনাকে ধন্যবাদ । মৃত্যু মুখে দাঁড়িয়ে আপনি আমার ও রাজ্যের হিতের জন্য চিন্তা করছেন এজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।"

অতঃপর তান্ত্রিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো। সেই দিন সন্ধ্যা থেকে আচমকা মহারাজ অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হলেন।বৈদ্য কবিরাজ একে একে জবাব দিয়ে গেলো।
রাজ্যের সব বীর যুবকদের আহ্বান জানানো হলো অমৃত ঝর্ণার জল সংগ্রহ করে আনার জন্য।
কিন্তু পথের বিবরণ শুনে কেউ রাজী হলো না।
সবচেয়ে চিন্তায় পড়লো রাজকন্যা মেঘবতী। পিতা তার কাছে সবকিছু।মাতার ছোট্ট বেলায় মৃত্যু হয়েছে। পিতা তাকে উভয়ের স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন। পুত্রসন্তান নেই বলে কখনো দুঃখ করেন নি। বরং কন্যা কে পুত্রের ন্যায় মানুষ করেছেন।সব অস্ত্র শিক্ষায় পারদর্শী করে তুলেছেন। সেই পিতা আজ মৃত্যু শয্যায়।
রাজকন্যা ভাবলেন , তাকে পিতা পুত্রের ন্যায় শিক্ষা প্রদান করেছেন।আজ যখন রাজ্যের যুবক গণ পিতার জন্য অমৃত ঝর্ণার জল সংগ্রহ করতে যেতে উদ্যোগী নয় , তখন মেঘবতী নিজেই পিতার জন্য সেই অমৃত ঝর্ণার জল আনতে যাবে।

এদিকে আরো একজন অমৃত ঝর্না র জল সংগ্রহ করতে যাবে ঠিক করলো।সে হলো রাজ্যের সেনাপতি র পুত্র  মাণিক্য দেব।
যখন সব যুবকদের রাজসভায় আহ্বান করা হয়েছিল তখন মাণিক্য সেখানে উপস্থিত ছিল না।সে রাজ্যের অন্য প্রান্তে শিকারে গিয়েছিল। দীর্ঘ কয়েক মাস যাবত সেখানে থাকা কালীন কোনো খবর পায় নি।
বাড়িতে ফিরে যখন মাণিক্য মহারাজা র অসুখ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে সব শুনলো তখনই সে ঠিক করলো সে মহারাজের সুস্থতা র জন্য অমৃত ঝর্না র সন্ধানে যাবে। ছোট বেলা থেকেই অমৃত ডানপিটে ও বেপরোয়া স্বভাবের। দুঃসাহসী কাজে তার ঝোঁক।মাণিক্য ঠিক করলো পরের দিন পূর্ণিমার রাতে সে সবার অগোচরে রওনা দেবে। বাড়িতে জানানো ঠিক হবে না।

এদিকে মেঘবতী ও ঠিক করলো  পূর্ণিমা র রাতে মহারাজের অগোচরে অমৃত ঝর্না র সন্ধানে রওনা দেবে। শুধু রাজ্যের বৃদ্ধ মহামন্ত্রী শুকদেব কে রাজকন্যা তার গোপন অভিযানের কথা জানিয়ে রাখলেন। তিনি ও রাজকন্যা কে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু রাজকন্যার জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত তাকে হার মানতেই হলো।

পরের দিন পূর্ণিমা র রাত । আকাশে মেঘের আড়ালে চাঁদ লুকোচুরি খেলা খেলছে।মাণিক্য ঘোড়াশাল থেকে  ঘোড়া নিয়ে ধীরে ধীরে গৃহ হতে বের হলো। ঘোড়ার খুরের আওয়াজে কারো নিদ্রা ভঙ্গ যাতে না হয় সেজন্য অনেকটা পথ ঘোড়াকে নিয়ে হেঁটে চললো।যখন নিরাপদ মনে হলো তখন ঘোড়ায় আরোহণ করে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো।
রাজধানী থেকে একটি পথ সোজা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। বহু বণিক ঐ পথে বাণিজ্য করতে যায়। তবে তারা দলবেঁধে যায়। পথে হিংস্র জন্তু ও দস্যুদের ভয় ।মাণিক্য ঐ পথেই চললো।
ইতিমধ্যেই চাঁদ উঠেছে।অনেকটা পথ  চাঁদের আলোয় পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
মাণিক্য লক্ষ্য করলো সামনে অনেক টা দূরে  এক ঘোড়সওয়ার যাচ্ছে।মাণিক্য ঠিক করলো ঐ ঘোড়সওয়ারের সঙ্গ নেওয়া যাক।সে আরো দ্রুততর ঘোড়া ছোটালো।
ঐ ঘোড়সওয়ার আর কেউ নয় সে হলো রাজকন্যা মেঘবতী।
মেঘবতী পুরুষ বেশ ধারণ করে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছে। নিজের মাথার লম্বা চুল লুকানোর জন্য মাথায় পাগড়ি পরেছে।
মাণিক্য দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে মেঘবতী র কাছে পৌঁছে তাকে প্রশ্ন করলো ,"কে তুমি? কোথায় যাবে ?"
মেঘবতী উত্তর দিলো "আমি পথিক । ভ্রমণে বেরিয়েছি। দক্ষিণ দিকে সমুদ্র তীরে যাবো। আমার নাম মন্মথ। তুমি কে?"
মাণিক্য উত্তর দিলো "আমি মাণিক্য। আমিও ভ্রমণে বেরিয়েছি। তোমার মতোই সমুদ্র তীরে যাবো।চলো একসাথে যাওয়া যাক।"
এরপর দুজনে একসাথে চলতে লাগলো।
মাণিক্য বললো "মন্মথ তোমার গলার স্বর নারীদের মতো কোমল। এই ভ্রমণ পথে অনেক অজানা বিপদ আছে জানো তো। প্রয়োজনে অস্ত্র ধারণ করতে হবে। তুমি অস্ত্র ধারণ করতে জানো তো?"
মেঘবতী বললো"আমার গলার স্বর কোমল বলে ভেবোনা যে আমি অস্ত্র ধারণে অক্ষম। সময় এলে দেখতে পাবে আমার অস্ত্র চালানোর দক্ষতা।"
দুজনে একসাথে চলতে চলতে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো।

পথে এক জায়গায় ওরা দুজনে থামলো। সামনে এক খরস্রোতা নদী। ঘোড়া নিয়ে পেরিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। দুজনে নদীর পাড় বরাবর হাঁটতে লাগলো পেরিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত জায়গার সন্ধানে।

এক জায়গায় এসে দেখলো  জলের স্রোত একটু কম। দুজনে ঠিক করলো এইখান দিয়ে নদী পেরিয়ে যাওয়া ঠিক হবে।
কিন্তু ওরা জানতোই না সেখানে এক ভয়ঙ্কর  এক রাক্ষস ও রাক্ষসী থাকতো। তারা দুজনেই বৃদ্ধ  হয়ে গিয়েছিল। দৌড়ে গিয়ে শিকার ধরার ক্ষমতা তাদের ছিল না।তারা দুজনেই একটি করে মন্ত্রপূত  কবচের অধিকারী ছিলো না।ঐ কবচ গলায় পরে থাকলে তারা অদৃশ্য হয়ে যেতো।যেসব পথিক ঐ পথ দিয়ে যেতো তারা অদৃশ্য হওয়ার সুযোগ নিয়ে সেই সব পথিকদের ধরে খেয়ে নিতো।
এদিকে মাণিক্য ও মেঘবতী র ঘোড়ার আওয়াজে  রাক্ষস ও  রাক্ষসী দুজনের ঘুম ভেঙে গেল।আর ঘুম ভাঙলেই তাদের খিদে পায়। এদিকে মাণিক্য ও মেঘবতী র খুব খিদে পেয়েছিল। নদীর ধারে ই ছিলো একটি আম গাছ। সুন্দর রসালো পাকা আমে ভরা।মাণিক্য বললো ,"এসো মন্মথ আম গাছে উঠে আগে আম খাওয়া যাক। তারপর নদী পেরিয়ে যাওয়া যাবে।"
মেঘবতী বললো "আমি গাছে উঠতে জানি না। তুমি গাছে উঠে আম পেড়ে নিয়ে এসো। "
মাণিক্য বললো "সত্যি তুমি নারী দের মতো কোমল স্বভাবের। ঠিক আছে আমি গাছে উঠে আম পেড়ে নিয়ে আসছি।"
এই বলে দুজন ঘোড়া দুটিকে একটি অন্য গাছের সঙ্গে বেঁধে দিলো। ঘোড়া দুটো কচি কচি ঘাস খেতে লাগল।মাণিক্য আম গাছে উঠে আম সংগ্রহ করতে লাগলো।
এদিকে দুজন রাক্ষস রাক্ষসী অদৃশ্য হওয়ার কবচ গলায় পরে খাবারের সন্ধানে বের হলো। সামনে পড়লো মাণিক্য ও মেঘবতী র ঘোড়া। প্রথমেই মেঘবতী র ঘোড়াটি কে তাদের ধারালো নখ ও দাঁতের সাহায্যে হত্যা করলো। এদিকে মাণিক্যর ঘোড়া অন্য সাথীর মৃত্যু দেখে ভয় পেয়ে চিঁহিঁ চিঁহিঁ করে চিৎকার জুড়ে দিলো। ঘোড়ার আওয়াজে সচকিত হয়ে মেঘবতী এগিয়ে গিয়ে দেখলো ভয়াবহ দৃশ্য। কোনো অদৃশ্য শক্তি ঘোড়াকে হত্যা করে ভক্ষণ রত। মেঘবতী সেই অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্যে বললো, "তোমরা যেই হও সাহস থাকলে দৃশ্যমান হয়ে আমার সাথে লড়াই করো। " 
রাক্ষস ও রাক্ষসী দুজন দেখলো একজন মাত্র মানুষ।তারা দুজন তখন তাদের অদৃশ্য হওয়ার কবচ দুটো গলা থেকে খুলে এক জায়গায় রেখে বললো ,"বেশ এই আমাদের অদৃশ্য হওয়ার কবচ খুলে রেখে দিলাম। অনেক দিন মানুষের মাংস খাওয়া হয় নি।আজ মানুষের মাংস খাবো।
ইতিমধ্যেই বিপদ বুঝতে পেরে মাণিক্য গাছ থেকে নেমে এসে মেঘবতী র পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখে রাক্ষস টা বললো "দুটো মানুষ। আজকের ভোজন দারুন উপাদেয় হবে।"
অতঃপর যুদ্ধ শুরু হলো।মাণিক্য ও মেঘবতী দুজনেই অস্ত্র চালানোয় নিপুণ। এদিকে রাক্ষস ও রাক্ষুসী মানুষের দ্বিগুণ আকৃতি সম্পন্ন ভীষণ বলশালী। কিন্তু অস্ত্র নৈপুণ্য ও কুশলতার র কাছে বল  হার মানলো।রাক্ষস ও রাক্ষুসী উভয়ের মৃত্যু হলো। এদিকে মেঘবতী র লড়াই করতে করতে কখন পাগড়ী মাথা থেকে খুলে পরে গেছে। লম্বা একরাশ ঘন কালো চুল বলে দিচ্ছে মেঘবতী একজন নারী।
মাণিক্য মেঘবতী র লম্বা চুল দেখে মুচকি হেসে বললো "আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম যে তুমি একজন নারী। এখন তোমার আসল পরিচয় দাও।"
মেঘবতী একটু লজ্জিত হয়ে বললো ,"আমি অরূপ নগরের রাজকন্যা মেঘবতী। পিতার জন্য অমৃত ঝর্না র জল সংগ্রহ করতে চলেছি। কিন্তু তুমিও কোন সাধারণ পথিক নয়।এমন অস্ত্র নৈপুণ্য কোনো যোদ্ধা ছাড়া অন্য কারো হওয়ার কথা নয়।"
মাণিক্য বললো ,"আমি অরূপ নগরের সেনাপতি র পুত্র। আমিও মহারাজের জন্য অমৃত ঝর্না র জল সংগ্রহ করতে বেরিয়েছি।"

উভয় উভয়ের কথা শুনে হেসে উঠলো।রাক্ষস রাক্ষসী র কবচ দুটো তারা সংগ্রহ করে রাখলো। কখন কি প্রয়োজন হবে তা তো আগে থেকে বলা যায় না।

 যাইহোক এখন একটাই ঘোড়া। দুজনে একটা ঘোড়ায় চড়ে ই যাত্রা শুরু করলো। সামনে মেঘবতী তার পিছনে মাণিক্য বসলো।
কতো পথ জঙ্গল পাহাড় পেরিয়ে গেলো। কতো কথা হলো দুজনের।মাণিক্য শোনালো তার শিকারের গল্প , যুদ্ধে র গল্প।আর মেঘবতী শোনালো তার রাজপ্রাসাদে র কাহিনী, তার পিতার স্নেহের গল্প, তার সখীদের কাহিনী। দুজনের বন্ধুত্বটা আরো গাঢ় হলো।

এই ভাবে একদিন তারা পৌঁছে গেলো সমূদ্রের তীরে। জনহীন সমূদ্র তীর ।ঐ সমূদ্রের মাঝখানে কোনো জায়গায় আছে সেই রামধনু দ্বীপ। কিন্তু কয়েকটি দিন থেকেও তারা বুঝতে পারলো না কিভাবে সেখানে পৌঁছে যাবে।

এদিকে হয়েছে কি সমূদ্রের তীরে ছিল বিশাল বিশাল বৃক্ষ‌। সেই রকম একটা বিশাল বৃক্ষে থাকতো এক ঈগল দম্পতি। এই ঈগল দুইটি ছিল এলাকার সব পাখিদের রাজা।তারা অন্য সব পাখিদের ভাষা বুঝতো ও তাদের ভাষায় কথা বলতে পারতো। সেই সাথে তারা মানুষের ভাষাও বুঝতো ও কথা বলতে পারতো। তারা তাদের বাচ্ছা দুটো ঈগল কে বাসায় রেখে প্রতিদিন খাবারের সন্ধানে যেতো।
এখন হয়েছে কি ঈগল দম্পতি খাবারের সন্ধানে বের হয়েছে। একটা অজগর সাপ কাছেই থাকতো। অজগর সাপ টার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিলো ঈগলের বাচ্ছাদুটিকে খাওয়ার। কিন্তু ভয়ে সাহস পায় না। কিন্তু আজ সাহস করে গাছে চড়তে লাগলো। ঈগলের বাচ্ছা দুটি অজগর সাপটিকে গাছে চড়তে দেখে ভয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিলো।মাণিক্য তাদের চেঁচামেচি তে আকৃষ্ট হয়ে কাছে গিয়ে দেখলো একটা অজগর সাপ গাছ বেয়ে উপরে উঠছে।আর ওপরে থাকা ঈগলের বাচ্ছা দুটি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে।

মাণিক্য তক্ষুনি তরবারি বের করে অজগর সাপটিকে দ্বিখণ্ডিত করে মেরে ফেললো।
সন্ধ্যায় ঈগল দম্পতি বাসায় ফিরে এলো।এসে বাচ্ছাদের মুখে পুরো কাহিনী শুনলো। ঈগল দম্পতি ঠিক করলো এই দুজন ভালো মানুষ কে ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজন।
তারা দুজন মাণিক্য ও মেঘবতী র কাছে গিয়ে উড়ে বসলো।মাণিক্য ও মেঘবতী বিশালাকার দুটো ঈগলকে উড়ে এসে বসতে দেখে ঘাবড়ে গেলো।
ঈগল দুটি মানুষের ভাষায় তাদের বললো ,"ভয় পেয়োনা। তোমরা দুজনে আমার সন্তান দের রক্ষা করে অনেক উপকার করেছো।এর প্রতিদানে  আমরা তোমাদের কিছু উপকার করতে ইচ্ছুক।বলো আমি তোমাদের  কি উপকার করতে পারি ?"
মাণিক্য বললো ,"আমরা যা করেছি তা আমাদের কর্তব্য মনে করেই করেছি। আপনারা যদি সত্যিই আমাদের সাহায্য করতে চান তবে আমাদের সমূদ্রের মাঝখানে রামধনু দ্বীপে পৌঁছে দিন।"
পুরুষ ঈগল টি বললো ,"বেশ কাল সকালে আমরা তোমাদের দুজনকেই পিঠে করে রামধনু দ্বীপে পৌঁছে দেবো। কিন্তু মনে রাখবে সেখানকার অধিবাসীরা ভয়ঙ্কর রাক্ষস।তারা তোমাদের দেখতে পেলেই খেয়ে নেবে।"
মাণিক্য বললো ,"তারা আমাদের দেখতে পাবে না। আমাদের কাছে অদৃশ্য হওয়ার কবচ আছে।"

পরের দিন সকালে মাণিক্য ও মেঘবতী ঈগলের পিঠে চড়ে রামধনু দ্বীপের দিকে যাত্রা করলো। কতো দ্বীপ তারা পেরিয়ে গেলো। কোনো দ্বীপে দৈত্য আকৃতির মানুষ। কোথাও আবার খর্বাকৃতি মানুষ। কোথাও আবার কোনো জনপ্রাণী নেই। কোথাও আবার ভয়ঙ্কর জীবজন্তুর আবাস। এমনি করে তারা রামধনু দ্বীপের কাছে চলে এলো। দ্বীপটির নাম রামধনু।কারণ এখানকার মাটি বিভিন্ন রঙের।উপর থেকেই মনে হচ্ছে একমুঠো করে বিভিন্ন রঙ পুরো দ্বীপের গায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।


ঈগল দুটি তাদের দ্বীপের এক প্রান্তে নামিয়ে দিলো। রাজা ঈগলটি বললো ,"একটি গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ কথা তোমরা শুনে রাখো। এই রাক্ষসদের প্রাণভোমরা মন্ত্রবলে একটি পায়রার জীবনের সাথে জড়িত করে রাখা হয়েছে। পায়রার প্রতি ফোঁটা রক্ত হাজার রাক্ষসের প্রাণ। তাই ঐ পায়রার মৃত্যু রক্তপাত না ঘটিয়ে যদি করা যায় তাহলে সব রাক্ষস মারা পড়বে ।আর যদি একফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়ে তবে নতুন হাজার টি রাক্ষস জন্ম হবে।

আর ঐ পায়রা টি রয়েছে ওদের মহারানী র ঘরে খাঁচায় বন্দী। আমি পাখিদের রাজা।তাই আমি এই গোপন বিষয়গুলো জানি।"
 ওরা ঈগল দুটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্বীপের মধ্যভাগের দিকে যাত্রা শুরু করলো।
বিরাট প্রাচীর দিয়ে ঘেরা রাক্ষস নগরী। প্রাচীরের গায়ে বিরাট সিংহদ্বার।আর সেই সিংহদ্বার পাহারা দিচ্ছে যতো ভয়ানক রাক্ষসের দল।মাণিক্য ও মেঘবতী সেই রাক্ষস দুটির কাছ থেকে সংগ্রহ করা  অদৃশ্য হওয়ার কবচ দুটি গলায় পরে নিলো।

রাক্ষস নগরীর ভিতরে প্রবেশ করে মাণিক্য ও মেঘবতী অবাক হয়ে গেল।কি বিশাল বিশাল প্রাসাদ।কি সুন্দর বাগান। রাস্তাঘাট কি সুন্দর পাথর দিয়ে তৈরি। সুন্দর সুসজ্জিত চারিদিক।এক জায়গায় দেখলো অনেক মানুষ একটা ঘেরা জায়গায় বন্দী।ঘেরা জায়গাটা একটি ভয়ঙ্কর রাক্ষস পাহারা দিচ্ছে।মাণিক্য বললো ,"রাজকন্যা এই লোকগুলো কে বন্দী করে রাখা হয়েছে খাওয়ার জন্য। আমরা এই লোকগুলো কে এই ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারিনা।যে করেই হোক এদের মুক্তি দিতে হবে।"
মেঘবতী বললো,"আমি আপনার সাথে একমত। কিন্তু কি উপায়ে এটা করা সম্ভব ?"
মাণিক্য বললো আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছে।
আমি অদৃশ্য ভাবে রাজপ্রাসাদের ভিতরে রানীর ঘরে যাবো। সেখান থেকে ঐ রাক্ষসদের প্রাণভোমরা পায়রা টিকে সংগ্রহ করে মেরে ফেলবো। তাহলে রাক্ষস কুল ধ্বংস হবে। এদিকে তুমি যখন সুযোগ পাবে তখনি এই পাহারাদার রাক্ষস টিকে ফাঁকি দিয়ে সব মানুষ গুলো কে নিয়ে   রাজপ্রাসাদের ভিতরের সরোবরের কাছে নিয়ে যাবে। সেখানে সবাই কে নিজের নিজের বাড়িতে যাওয়ার মনস্থির করে অবগাহন করতে বলবে। ইতিমধ্যে আমি আশা করি কার্যোদ্ধার করে তোমার সাথে যোগ দিতে পারবো।"

এই বলে মাণিক্য, মেঘবতী কে শুভকামনা জানিয়ে নিজের  গন্তব্যে এগিয়ে চললো।
এদিকে মেঘবতী অনেকক্ষণ ধরে অদৃশ্য হয়ে পাহারায় থাকা রাক্ষস টিকে নজরে রাখলো।
কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলো পাহারাদার রাক্ষসটা একটা বিরাট গাছের ছাওয়ায় রোদ্দুর থেকে বাঁচতে গিয়ে বসলো।আর বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝিমুতে লাগলো। শেষে শুয়ে পরে নাক ডাকাতে লাগলো।
মেঘবতী দেখলো এই সুযোগ। সে চুপিচুপি ঘেরা জায়গায় এলো। বিরাট দরজা। কোনো মানুষের একার পক্ষে সেই দরজা খোলা প্রায় অসম্ভব।
মেঘবতী তার সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। বেশ কিছু ক্ষণ বাদে একটা মানুষ গলে ভিতরে যাওয়ার মতো ফাঁক তৈরী হলো।ঐ ফাঁক দিয়ে মেঘবতী ভিতরে প্রবেশ করলো। ভিতরে প্রবেশ করে নিজেকে অদৃশ্য হওয়ার কবচ টি গলা থেকে খুলে আত্মপ্রকাশ করতে সেখানকার মানুষ জন হকচকিয়ে গেল।
মেঘবতী তাদের বললো ,"ভয় নেই। আমি তোমাদের বাঁচাতে এসেছি।"

একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বললো "এই রাক্ষস পুরীতে তুমি কিভাবে এলে?আর আমাদের বাঁচাবে কিভাবে ?"
মেঘবতী তাদের আশ্বস্ত করে বললো,  "আপনাদের পাহারায় থাকা রাক্ষস টি এখন ঘুমোচ্ছে। এই সুযোগে সবাই মিলে দরজা খুলে  পালিয়ে যেতে হবে।সামনেই রাজপ্রাসাদের সরোবর। এই সরোবরের এক আশ্চর্য গুণ আছে।যে কেউ এই সরোবরের জলে নেমে কোনো জায়গায় যাওয়ার মনস্থির করে ডুব দেয় তবে সেই স্থানের নিকটবর্তী কোনো সরোবরে পৌঁছে যাবে। এখন সব রাক্ষস দুপুরের ঘুম দিতে ব্যাস্ত। এই সময় পালিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত সময়। বিলম্ব না করে চুপচাপ সকলে আমার সাথে চলুন।"

তারপর সকলের প্রচেষ্টায় দরজাটা সামান্য ফাঁক করে সকলে বেরিয়ে পড়লো। রাক্ষসটা তখনো নাক ডাকাচ্ছে।সকলে দৌড় দিল সরোবরের   দিকে। আশেপাশে কোন রাক্ষস নেই।সকলে একে একে সরোবরে নেমে নিজের নিজের বাড়িতে যাওয়ার মনস্থির করে ডুব দিতে লাগলো। বেশ কয়েকজন তখনো বাকি এমন সময় একটা হট্টগোল ভেসে এলো।
মেঘবতী দেখলো মাণিক্য একটা পায়রা হাতে নিয়ে দৌড়ে আসছে।আর তাকে তাড়া করে আসছে এক বিশাল রাক্ষস বাহিনী। মেঘবতী বাকি সবাই কে তাড়াতাড়ি সরোবরে নেমে ডুব দিতে বললো।নিজে খোলা তরবারি নিয়ে একা দাঁড়িয়ে রইলো মাণিক্য কে সাহায্য করবার জন্য।
সব বন্দী মানুষ নিজের নিজের ঘরে ফিরে গেছে দেখে মেঘবতী নিশ্চিন্ত হলো। নিজের প্রাণের ভয় সে করে না।মাণিক্য কে ছেড়ে সে একা যাবে না।
মাণিক্য দৌড়ে এসে হাঁফাতে লাগলো। হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে বললো ,"পায়রাটা নিয়েছি এমন সময় রাক্ষস গুলো টের পেয়ে গেলো। অদৃশ্য হওয়ার কবচটা গলা থেকে খুলে পরে গেছে বুঝতে পারিনি। তাড়াতাড়ি দৌড়ে পালিয়ে এসেছি। পায়রা টিকে মেরে ফেলার সময় পাই নি।
মেঘবতী বললো "ঐ রাক্ষস গুলো আসছে। তাড়াতাড়ি পায়রা টিকে শ্বাস রূদ্ধ করে মেরে ফেলো।"
তৎক্ষনাৎ মাণিক্য পায়রাটার গলা মুচড়ে শ্বাস রূদ্ধ করে মেরে ফেললো। সাথেই যেখানে যতো রাক্ষস ছিল শ্বাস রূদ্ধ হয়ে ছটফট করতে করতে মারা গেলো।

রাক্ষসকুল ধ্বংস হলো।

এরপর  মাণিক্য ও মেঘবতী  হাত ধরাধরি করে সরোবরের জলে নেমে অমৃত ঝর্ণার কাছে পৌঁছবার মনস্থির করে ডুব দিলো।

জল থেকে মাথা তুলে তারা আশ্চর্য হয়ে গেলো।

সামনে বিরাট এক পাহাড় শীর্ষ থেকে জলধারা ঝর্ণা হয়ে পড়ছে। সূর্যের আলোয় ঝর্ণা র জল চকমক করছে।
এই তবে সেই অমৃত ঝর্না। জলধারা জমে একটা ছোট জলাশয় সৃষ্টি হয়েছে। সেই জলাশয়ে মেঘবতী ও মাণিক্য এসে পৌঁছেছে।

মাণিক্য ও মেঘবতী প্রাণভরে সেই ঝর্ণার জল পান করলো। এই জল যে কোন রোগ হরণ করে। একবার এই জল পান করলে সারাজীবন কখনো অসুস্থ হবে না।
মাণিক্য তার পোশাকের ভিতর হতে একটি ছোট পাত্র বের করে ঝর্ণার জল ভরে নিল। এবার পাত্রের মুখ ভালো করে বন্ধ করে পুনরায় পোশাকের ভিতরে ঢুকিয়ে রাখলো। মেঘবতী ও পোশাকের ভিতরে একটা ছোট পাত্র এনেছিলো।সেও নিজের পাত্রে জল ভরে ,পাত্র বন্ধ করে নিজের পোশাকের ভিতরে রেখে দিলো।

এবার ঘরে ফেরার পালা। দুজনে হাত ধরাধরি করে ঘুরে দেখতে লাগলো। এটা একটা দ্বীপ। চারিদিকে ফুল ফলের গাছে ভরা। দুজনে দ্বীপের অভ্যন্তরে এক পাল পক্ষীরাজ ঘোড়াকে ঘুরে বেড়াতে দেখলো। কিন্তু ওরা ঘোড়ার কাছে গেলেই ঘোড়াগুলি দৌড়ে পালায় নয়তো উড়ে পালায়। কয়েকটি দিন কেটে গেলো। একটা ঘোড়াকেও বশ করা গেলো না।
কিন্তু একদিন ভাগ্য তাদের সহায় হলো। একটা শিশু পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়তে গিয়ে হাওয়ার বেগ সামলাতে না পেরে ওদের সামনে ধপাস করে পড়ে গিয়ে আহত হলো। মেঘবতী ও মাণিক্য দৌড়ে গিয়ে আহত ঘোড়াটি কে সুশ্রূষা করতে লাগলো।মাণিক্য একটা পাতায় করে অমৃত ঝর্ণার জল নিয়ে এলো। মেঘবতী সেই জল আহত পক্ষীরাজ ঘোড়াটিকে পান করিয়ে দিলো।অতি অল্প সময়ের মধ্যে আহত ঘোড়াটি সুস্থ সবল হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ঘোড়াটির মাতা পিতা সন্তানের সন্ধানে হাজির হয়েছে।
পিতা পক্ষীরাজ ঘোড়াটি ওদের দুজনের উদ্দেশ্যে বললো ,"কয়েক দিন হলো তোমরা এই দ্বীপে কোনো আশ্চর্য উপায়ে উপস্থিত হয়েছো। আমরা মানুষ দের বিশ্বাস করি না। মানুষরা সুযোগ পেলেই আমাদের বন্দী করার চেষ্টা করে। কিন্তু তোমরা আমার সন্তান কে সেবা করলে। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। তোমরা ভালো মানুষ। আমি কিভাবে তোমাদের এই ঋণ শোধ করবো।
মেঘবতী বললো ,"আমার পিতা অরূপ নগরের  রাজা । তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। আমরা দুজন তার সুস্থতা র জন্য এই অমৃত ঝর্ণা র জল সংগ্রহ করতে এসেছি। পিতার অসুস্থতার পর হতে ছয়টি চন্দ্রোদয়ের মধ্যে পিতাকে এই অমৃত ঝর্না র জল পান করাতে হবে। নয়তো পিতার মৃত্যু হবে। আগামী কাল সেই ষষ্ঠ চন্দ্রোদয়ের দিন। আপনি যদি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করে আমাদের গৃহে পৌঁছে দেন তবে আমরা দুজন আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।"

পক্ষীরাজ ঘোড়াটি বললো "তোমাদের সেবাপরায়ণতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমরা দুজনে আমার পিঠে উঠে বস। কাল চন্দ্র উদয়ের পূর্বেই আমি তোমাদের গৃহে পৌঁছে দেবো।"
অতঃপর দুজনে পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে চড়ে অরূপ নগরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলো।

এদিকে আজ ষষ্ঠ চন্দ্র উদয়ের দিন।আজ মহারাজা র শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। মহারাজ কেবল মেঘবতী কে দেখতে চাইছে। মহামন্ত্রী শুকদেব খালি মহারাজা কে এটা ওটা কথায় ভুলিয়ে রেখেছে। দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।সকলে অপেক্ষা করছে।এমন সময় হৈচৈ। বহু দূর থেকে দেখা যাচ্ছে একটা বিশাল পাখি উড়ে আসছে। কাছে আসতে সকলে দেখলো এক পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাজকন্যা মেঘবতী ও সেনাপতি পুত্র মাণিক্য আসছে।মাণিক্য নিরুদ্দেশ হয়েছিল সকলেই জানতো। কিন্তু সে যে রাজকন্যা র সাথে অমৃত ঝর্না র সন্ধানে গিয়েছে সেটা কেউ আন্দাজ করতে পারে নি।
পক্ষীরাজ ঘোড়াটি   ওদের দুজনকে রাজপ্রাসাদের সামনে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো।
ওরা দুজনে দ্রুত রাজপ্রাসাদের ভিতরে গিয়ে মহারাজ কে অমৃত ঝর্না র জল পান করালো। এই জলের এমন গুণ যে মানুষ টি কিছু ক্ষণ আগে উঠে বসতে পারছিলো না , সেই মানুষটি অতি অল্প সময়ের মধ্যে উঠে হাঁটা চলা শুরু করলো।
মহারাজ সুস্থ হলো।
মহারাজ মেয়ের কাছে তাদের দুজনের অমৃত ঝর্না র জল সংগ্রহ করার জন্য যে যে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে সব শুনলেন।
তারপর একটা শুভ দিন দেখে সেনাপতি র সাথে কথা বলে মাণিক্য ও মেঘবতী র বিবাহ দিলেন।
সুখে দিন কাটতে লাগলো। একদিন কালের নিয়মে মহারাজের মৃত্যু হলো।
মেঘবতী ও মাণিক্য রাজা রানী হলো।


আমার গল্প ফুরালো
নটে গাছটি মুড়ালো
কেন রে নটে মুড়ালি?
চাষী কেন জল দেয়নি……..


 


Tuesday, December 11, 2018

আটলান্টিসের পাথর (চতুর্থ পর্ব)

 বেশ কয়েকটি দিন কেটে গেলো পাশপোর্ট ও ভিসা ইত্যাদির চক্করে।
অর্জুনের বাবা অয়ন বাবুর এক বন্ধু স্বরাষ্ট্র দফতরের এক আমলা । অয়ন বাবু তাকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে ওদের দুজনের পাশপোর্ট ও ভিসা পাওয়ার জন্য দ্রুত বন্দোবস্ত করা যায়।তার চেষ্টায় সব কিছুই খুব তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হলো। একটা ভালো ট্রাভেলস এজেন্সি র সন্ধান অর্জুন ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করলো। তাদের কোলকাতাতে একটা শাখা অফিস আছে। তাদের মধ্যমে যাওয়া টাই ঠিক হলো।মানস কৈলাস যাওয়ার অনেক গুলো পথ আছে। কিন্তু কাঠমান্ডু হয়ে লাসা সেখান থেকে জীপে কৈলাস ,এটাই সবচেয়ে সহজ রাস্তা। এই পথে কষ্ট অন্যান্য পথের চেয়ে অনেক কম। আর মাত্র সাত জনের গ্রুপ হলেই ট্রাভেল এজেন্সি যাওয়ার বন্দোবস্ত করে।
অবশেষে এক রবিবার দুই বন্ধু কাঠমান্ডু গামী প্লেনে চেপে বসলো।
কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে যখন প্লেন ল্যান্ড করলো তখন নেপালের ঘড়িতে বিকাল চারটে।
ট্রাভেল এজেন্সির একটা লোক হাতে সুমন ও অর্জুনের ইংরেজি তে নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনে তার কাছে গিয়ে পরিচয় দিতে তিনি তাদের নিয়ে ট্যাক্সি ডেকে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। ভদ্রলোক বললেন তার নাম প্রেম দোরজি। তাদের পুরো ভ্রমণ পথ তিনি গাইড করবেন।
সুমন এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল যাওয়ার রাস্তার দৃশ্যাবলী দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ট্যাক্সিতে বসা থেকে অর্জুন কেমন আনমনা হয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ পর অর্জুন সুমনের কানে কানে বললো ,"আমাদের মনে হয় কেউ ফলো করছে"।
সুমন বললো ,"কে ফলো করছে ?"
অর্জুন বললো "পেছনে তাকিয়ে দেখ একটা কালো রঙের ট্যাক্সি আমাদের ট্যাক্সিকে ফলো করছে"।
সুমন চেয়ে দেখলো সত্যিই একটা কালো  রঙের ট্যাক্সি তাদের ট্যাক্সির পেছনে পেছনে আসছে।
সুমন অর্জুনকে বললো "দূর, তোর যতো আজব ভাবনা। হয়তো ওরাও আমরা যে হোটেলে যাবো , সেই হোটেলেই উঠবে"।
অর্জুনদের হোটেল চলে এলো । রাস্তার পাশেই ।নাম 'হিমালয় কন্যা'।
ওদের পিছু আসা গাড়ী টা কিন্তু ওদের হোটেলে থামলো না। সোজা বেরিয়ে গেল।
সেই রাতে হোটেলে থেকে পরের দিন ওরা কাঠমান্ডু শহরটা ঘুরতে বেরোল। এটা ওদের প্যাকেজ ট্যুরের অঙ্গ। সঙ্গে প্রেম দোরজি গাইড হিসাবে আছে।
প্রেম বললো "কাঠমান্ডু শহরের নামকরণ হয়েছে কাষ্ঠমন্ডপ নামের দরবার স্কোয়ার এর এক মন্দির থেকে।
কাঠমান্ডু শহরের দ্রষ্টব্য স্থান অনেক। পুরো টা ভালো করে ঘুরতে কয়েক দিন লেগে যাবে। কিন্তু ওদের প্যাকেজ ট্যুরের মধ্যে রয়েছে কাঠমান্ডু ঘোরার জন্য মোটে একদিন।
যাইহোক ওরা বিখ্যাত পশুপতিনাথ মন্দির ,রাজপ্রাসাদ, সিংহ দরবার, দরবার স্কোয়ার এই গুলো বুড়িছোঁয়া গোছের ঘুরে এলো।
হোটেলে ফেরার পর ওদের রুমের দরজা খুলে দেখে আক্কেল গুড়ুম। সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ওদের জিনিস পত্র।
হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়ে কিছু হলো না।তারা কিছুই বলতে পারলোনা। হোটেল ম্যানেজার বারবার ক্ষমা চাইলেন। দেখা গেল ওদের কোনো কিছুই খোয়া যায়নি। শুধু কেউ তন্নতন্ন করে বিশেষ কিছুর খোঁজে এসেছিলো।
যাই হোক সব কিছুই আবার গোছগাছ করা হলো।
কাঠমান্ডুতে আসান বাজার বলে একটা দারুন মার্কেট আছে। সেখান থেকে অর্জুন একটা  থার্মাল হিট সিকার  কিনেছে। সুমন অর্জুনকে বললো "এটা কি করবি" ?
অর্জুন বললো "দেখ না কাজে লাগবে"।

আর কোনো ঝামেলা হলো না।
পরের দিন সকাল নয়টায় ফের ফ্লাইটে করে লাসা র উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু।
নিষিদ্ধ নগরী বলে খ্যাত লাসা ।
লাসা শব্দটি র অর্থ 'দেবতাদের আবাস'।
প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষের বাস এই শহরে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে 12000ফুট উচ্চতা য় এই শহর।
এখানে ওরা এক দিন থাকবে।
ওরা যে মানস সরোবর ও কৈলাসে যাবে সেখানে উচ্চতা ও শীতের প্রকোপ আরো বেশি।
জলবায়ুর সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য এখানে দুই থাকার ব্যবস্থা। ভালোই হলো।লাসা শহরটা খুব সুন্দর। চাইনিজ গভর্নমেন্ট খুব সুন্দর ভাবে এই শহরটাকে সাজিয়ে তুলেছে পর্যটকদের জন্য।
পরের দিন ওরা দেখতে গেল পোতালা প্রাসাদ।
1645সালে পঞ্চম দলাই লামা এটি তৈরি করেন । তেরটি তলা, এক হাজার কক্ষ,ও দুই লক্ষ মূর্তি র সমন্বয়ে  গঠিত বিরাট অট্টালিকা।
অর্জুন সুমন রা সকলের সঙ্গে প্রাসাদ দেখতে গেলো।

বিরাট প্রাসাদের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। অসংখ্য শিল্প কলা দেখতে দেখতে নিজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া।
ঘুরতে ঘুরতে সুমন একবার দলটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আসলে একটা মূর্তি তাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল।বুদ্ধ মূর্তি। সোনালী রঙের অসাধারণ স্বর্গীয় হাসি মুখে ধ্যান মগ্ন বোধীসত্ত্ব ।
হঠাৎ হুঁশ ফিরে পেয়ে দেখলো সে একা। এগোতে যেতেই একটা পিছন থেকে আঘাতে সুমন লুটিয়ে পড়লো। এদিকে অর্জুন এগিয়ে গিয়ে ছিলো। কিছুক্ষণ পর সুমন কে না দেখতে পেয়ে তাদের গাইড প্রেম কে বলে আগের দেখে আসা ঘর গুলোতে সুমন কে খুঁজতে গেল। কয়েকটি ঘর পেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ একটা ফাঁকা ঘরে সুমন কে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখলো।আর তার পাশে উবু হয়ে কালো জ্যাকেট পরা একটা লোক তার পোশাক সার্চ করছে।
অর্জুন পিছন থেকে আসছে বুঝতে পেরেই লোকটা দ্রুত দৌড়ে পালালো।
অর্জুন চিৎকার করে সাহায্য চাইলো। তার চিৎকারে আশপাশের বিভিন্ন ঘর থেকে পর্যটকরা এসে ভিড় জমালো। এদিকে তার নিজের গ্রুপের লোকজন এসে পড়েছে।
মুখে চোখে জল ছিটানোর পর সুমনের জ্ঞান ফিরলো।সে বললো পিছন থেকে একটা আঘাত লাগার পর তার আর কিছুই মনে নেই।

হোটেলে ফিরে এসে অর্জুন বললো " মনে হচ্ছে কেউ একজন আমাদের এই অভিযানের উদ্দেশ্য জানে।"
"সে আমাদের কোলকাতা থেকেই ফলো করছে। কাঠমান্ডুতে হোটেলে হানা দিয়েছিল পুঁথির অনুবাদ হাতানোর জন্য । ওখানে না পেয়ে তোর ওপর হামলা চালিয়েছে এই ভেবে যে তুই অনুবাদটি সঙ্গে করে ঘুরছিস।
 "
সুমন বললো "কিন্তু অনুবাদ টা তো তোর কাছে রাখতে দিয়েছি। আমি নিজেও জানিনা তুই সেটা কোথায় রেখেছিস।"
অর্জুন বললো "সেটা আমি সঙ্গে করে আনিনি। ওটা আমাদের বাড়িতে সুরক্ষিত রয়েছে।ওটার একটা পিডিএফ করে আমার মোবাইল ফোনের বিশেষ ফোল্ডারে রেখে দিয়েছি।সেটার ব্যাক আপ আমার ইমেইল এ নেওয়া আছে। আমার ফোন বিশেষ পাশওয়ার্ড দিয়ে সুরক্ষিত।আর যদি  ফোনটি হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায় তবুও আমি আমার ইমেইল এড্রেস থেকে ব্যাক আপ নিতে পারবো।বুঝলি ?"
এখন ঘুমো কাল ব্রেক ফাস্ট করে জীপে করে মানস সরোবরের দিকে যাত্রা শুরু হবে।জয় আমাদের হবেই।(ক্রমশ)




Tuesday, November 27, 2018

অলৌকিক তরবারি (অখন্ড)


অলৌকিক তরবারি

          প্রথম পর্ব (ভীল গ্রাম)


অনেক আদিবাসী  ভীল কিশোর এর মধ্যে যদি একটা গৌর বর্ণের কিশোর থাকে তবে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক।

কিন্তু এই জঙ্গলে ঘেরা আদিবাসী গ্রামে এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা।সবাই সেই ছোট্ট বেলা থেকেই আদিত্য কে দেখে আসছে।
এই গ্রামের তথা আশেপাশের দশটা গ্রামের সবেধন নীলমণি বৈদ‍্য বলতে একজন। সে হলো আদিত্য র  পিতা শ‍্যামজী ।
সেই কোন যুগে শ‍্যামজী ছোট্ট আদিত্য কে  কোলে করে এই সভ‍্যতা বিবর্জিত আদিবাসী ভীল অধ‍্যুসিত  গ্রামে এসেছিল। তারপর থেকে তিনি এই জঙ্গলে ঘেরা আদিবাসী ভীল জাতির  গ্রাম গুলির কাছে ভগবানের মতো।রাত বিরাতে আপদে বিপদে তিনিই এই আদিবাসী ভীল  গ্রাম গুলির একমাত্র ভরসা।
আদিত্য অন‍্য সব আদিবাসী ভীল   বন্ধু র থেকে একটু আলাদা প্রকৃতির। স্বভাবে গম্ভীর।  হৈ চৈ করা একদম পছন্দ নয়।কিন্তু ভীষন শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান।
শ‍্যামজী সারাদিন মানুষের সেবায় লেগে থাকেন। সন্ধ্যায় প্রতিদিন প্রদীপের আলোয় আদিত্য কে নিয়ে পড়াতে বসেন। তার কাছেই আদিত্য ব‍্যাকরণ, গণিত ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেছে। পড়ালেখা য় আদিত্য খুবই মেধাবী।যে কোন পাঠ একবার বুঝিয়ে দিলে দ্বিতীয় বার বোঝাবার প্রয়োজন হয় না। আদিত্য র কাছে শ‍্যামজী একাধারে মা, বাবা,ও গুরু।
ছোট বেলায় আদিত্য মাঝে মধ্যে তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতো। কিন্তু শ‍্যামজী কখনো তার সরাসরি উত্তর দিতেন না। সেই থেকে আদিত্য এই সব কথা আর বলে না। ভাবে পিতা হয়তো বিশেষ কোনো কারণবশত নিরব থাকে। সময় হলে তিনি নিজের থেকেই সব বলবেন।
ভীল রা  জন্মগত খুব ভালো তীরন্দাজ। প্রতিটি ভীল কিশোর ছোট থেকেই তীর ধনুক নিয়ে শিকার অভ‍্যাস করে থাকে। আদিত্য ও এদের সাথে থাকতে থাকতে খুব ভালো তীরন্দাজ হয়ে উঠেছে। এই বিষয়ে তার দক্ষতা অর্জন অন‍্যান‍্য ভীল কিশোর দের ঈর্ষা র বিষয়।
মাঝে মাঝে  লক্ষ্যভেদ এর পরীক্ষা হয় , ভীলেরা জন্মগত সহজাত তীরন্দাজ হওয়া স্বত্বেও আজ পর্যন্ত কোন ভীল আদিত্য কে হারাতে পারে নি।
একদিন সন্ধ্যায় আদিত্য বাড়ি ফিরে দেখলো পিতার সাথে একজন বসে আছে।শ‍্যামজী নিজেই আদিত্য কে বললেন ,‘ইনি পন্ডিত রঘুবর। এনাকে প্রণাম করো।ইনি এই বিশাল সুন্দর গড় রাজ‍্যের সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্রশিক্ষক।আজ হতে আগামী এক বৎসর ইনি আমাদের সঙ্গেই থাকবেন ।আগামী  কাল হতে ইনি তোমায় ও তোমার যে সব বন্ধু অসি চালনা শিক্ষা করতে ইচ্ছুক তাদের ইনি শিক্ষা প্রদান করবেন।’
পরের দিন সকাল হতেই শুরু হলো অসি শিক্ষা। প্রথম কয়েক দিন আদিত্য একাই একমাত্র শিক্ষার্থী। তারপর দেখতে দেখতে আদিত্য র সব বন্ধুরাও যোগ দিলো। কিছুদিন পর দেখা গেলো অসি চালানোয় আদিত্য র ধারেকাছে কেউ নেই। তার বিদ্যুৎ বেগে অসি চালানো র ফলে অন‍্যান‍্য শিক্ষার্থীদের অসি হাত থেকে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে।
এমনিতেই আদিত্য কে সব ভীল বন্ধু রা তাদের নেতা রূপে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এখন তার এই অস্ত্র নৈপুণ্য তাকে বাকি সব বন্ধুদের চোখে ও গুরু রঘুবরের চোখে তাকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়ে দিল।
দেখতে দেখতে দিন কাটছিলো।
যখন আদিত্য ঊনিশ বছর পেরিয়ে বিশ বছরে পদার্পণ করলো সেই দিন সকালে তার পিতা শ‍্যামজী তাকে নিজের ঘরে ডাকলেন।
আদিত্য পিতার ঘরে এসে দেখলো তার অস্ত্রগুরু রঘুবর  আগে থেকেই পিতার ঘরে উপস্থিত।
আদিত্য দুজনকেই প্রণাম করলো।শ‍্যামজী আদিত্য কে বসতে বললেন।
উভয়ের সামনে রাখা আসনে আদিত্য বসলো।
শ‍্যামজী বললেন ,  ‘পুত্র , আজ তোমার সব কিছুই জানার সময় হয়েছে।সব কথা জানিয়ে আমি আজ দায়মুক্ত হতে চাই।আজ তুমি এমন সত‍্য র মুখোমুখি হতে চলেছো যা তোমার ভবিষ‍্যত জীবন কে  পরিবর্তিত করে দেবে।
এখানে সবাই জানে যে তুমি আমার সন্তান। কিন্তু তা সত‍্য নয় । আমি শুধু তোমায় পুত্র রূপে লালন পালন করেছি।
আসলে তুমি এই বিরাট সুন্দর গড় রাজ‍্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী। তোমার জন্মদাতা পিতা হলেন স্বর্গগত মহারাজ প্রতাপাদিত‍্য। তুমি আসলে এই রাজ‍্যের রাজপুত্র।’
আদিত্য সবটুকু শুনলো। তারপর অতি ধীর স্বরে বললো , ‘ পিতা , আমি জ্ঞান হওয়া থেকে আপনাকেই পিতা রূপে জানি। ভবিষ্যতে ও আপনি আমার পিতা রূপেই থাকবেন। কিন্তু আমি যদি রাজার সন্তান হয়ে থাকি তবে এই ভাবে এখানে কেন ?’
এবার গুরু রঘুবর বললেন ,‘ সেই কাহিনী আজ তোমায় শোনাবো বৎস।’
অনেক দিন আগের কথা …..
তোমার পিতা মহারাজ প্রতাপাদিত্য খুব ই প্রজাবৎসল ছিলেন। তিনি নিজেকে রাজা না ভেবে প্রজার সেবক রূপে ভাবতেন।প্রজারাও তাদের রাজা কে প্রাণ  ভরে ভালোবাসতেন। এই 'সুন্দর গড় ' রাজ‍্য কৃষিজ ও খনিজ সম্পদের অফুরন্ত ভান্ডার।তাই প্রতিবেশী রাজাদের লোভ এই স্বর্ণপ্রসু রাজ‍্যের উপর। মহারাজ প্রতাপাদিত্য বহু গুণে র অধীকারী হলেও তার একটি দোষ ছিলো। সেই দোষ টি হলো তিনি সবাইকে বিশ্বাস করতেন। তার এই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বহু মানুষ নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করেছে। তবু তিনি মানুষ কে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু এই দোষের কারণে তাকে একদিন চরম মূল্য দিতে হয়।
তিনি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস যার উপর করতেন , তিনি হলেন তার বাল‍্যবন্ধু সেনাপতি দুর্জন সিং এর উপর। দুর্জন সিং খুব দক্ষ সেনানায়ক ছিলেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি ছিলেন হিংসা প্রবণ ও লোভী । তার অপরিসীম লোভ ছিল রাজ সিংহাসনের উপর। পার্শ্ববর্তী রাজ‍্য 'মালব গড়' এর  রাজা প্রবাল নারায়ণ এর অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এই ' সুন্দর গড়' এর খনিজ সম্পদের উপর। সুন্দর গড় এর সোনার খনি ও লৌহ খনির আয় এই রাজ‍্যের প্রতিপত্তি র মূল। এই খনি দুটি র কতৃত্ব যার হাতে থাকবে সেই রাজ‍্য নিঃসন্দেহে বিশাল আর্থিক ক্ষমতা র অধিকারী হবে ।
সুন্দর গড় ও মালব গড় এর মাঝে ছিল এক বিশাল বনভূমি। এই বনভূমি তে উভয় রাজ‍্যের মানুষ শিকার করতো।
একদিন  'সুন্দর গড়' এর সেনাপতি দুর্জন সিং ও 'মালব গড়' এর রাজা প্রবাল নারায়ণ উভয়েই শিকার করতে গিয়ে সাক্ষাৎ  হলো।
উভয়ের উভয়কে চিনে নিতে বেশি ক্ষণ লাগলোনা।
তাদের মধ্যে গোপনে কি কথা হলো তা কাকপক্ষীও টের পেল না।
কয়েকদিন পর দেখা গেলো সেনাপতি দুর্জন বেশীরভাগ সৈন‍্যসামন্ত নিয়ে রাজ‍্যের উত্তর অংশে খনি অঞ্চলে চলেছে।কারণ হিসেবে রাজা প্রতাপাদিত্য জানলো যে কিছু খনি শ্রমিক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। সামান্য কিছু সৈন্য রাজধানী রক্ষার জন্য রইলো।
সেনাপতি দুর্জন সিং চলে যাওয়ার কয়েক দিন পর গুপ্তচর সন্দেশ বয়ে আনলো পার্শ্ববর্তী মালব গড়ের রাজা প্রবাল নারায়ণ সুন্দর গড় আক্রমণ করতে চলেছে। তৎক্ষণাৎ প্রতাপাদিত্য দূত পাঠালেন দুর্জন সিং এর কাছে অবিলম্বে সৈন্য বাহিনী নিয়ে রাজধানীতে ফিরে আসার জন্য। কিন্তু দুর্জন সিং রাজধানীতে ফিরে এলেন না।
কয়েকদিন এর মধ্যেই প্রবাল নারায়ণ প্রত‍্যাশিত ভাবেই সুন্দর গড় আক্রমণ করলেন। মহারাজ প্রতাপাদিত্য অল্প সৈন্য  নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে মৃত্যু বরণ করলেন। সেই নিদারুণ ক্ষণে মহারানী পদ্মাবতী রাজবৈদ‍্য শ‍্যামজী কে প্রাসাদে আহ্বান করলেন। আমি( রঘুবর ) তখন ছিলাম প্রাসাদ রক্ষা করার দায়িত্বে। তুমি তখন দুই বছরের বালক মাত্র। তোমার মা তোমায় শ‍্যামজী র হাতে তুলে দিয়ে বললেন ,‘আমি এক গুরুদায়িত্ব আপনাদের হাতে তুলে দিতে চাই। মহারাজ এর যুদ্ধক্ষেত্রে স্বর্গ  লাভ হয়েছে সংবাদ এসেছে।যে কোনো মুহূর্তে শত্রুরা রাজধানীর অধিকার নেবে। মহারাজ এর মৃত্যু র পর আমার সংসারে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। তাই ঠিক করেছি হিমালয়ের পাদদেশে আমার কুলগুরু র আশ্রমে শেষ জীবন টা অতিবাহিত করবো। আমি চাই আপনারা দুজনেই আমার পুত্র আদিত্য র ভার নিন।’
শ‍্যামজী বললেন ‘কিন্তু  মহারানী ,পিতামাতাহীন , রাজ‍্যহীন রাজপুত্রকে আমরা কিভাবে উপযুক্ত করে তুলবো ?’
মহারানী বললেন "আপনারাই তাকে উপযুক্ত ভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে মানুষ করে তুলবেন।তাকে শাস্ত্র  ও শস্ত্র উভয়েই পারদর্শী করে তুলবেন।যাতে সাবালক হয়ে সে তার পিতৃরাজ‍্য পুনরুদ্ধার করে উঠতে পারে। আপনারা জানেন এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহারাজা র প্রপিতামহ আদিত‍্যদেব। আমিও তার নামানুসারে পুত্রের নামকরণ করেছি আদিত্য।  মহারাজ আদিত্য দেব তার গুরু এক যোগীরাজ এর কাছ থেকে দুটি মহামূল্যবান সামগ্রী লাভ করেছিলেন। সামগ্রী দুটি র একটি হলো অলৌকিক তরবারি ও দ্বিতীয় টি হলো আমার এই পরিহীত মায়া আংটি।এই মায়া আংটি যার হাতে থাকবে সেই একমাত্র এই অলৌকিক তরবারি র মালিক হতে পারবে। এই অলৌকিক তরবারি তার মালিকের অসিচালন দক্ষতা বৃদ্ধি করে। শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে অসিচালনা করতে পারে। এই দ্রুত বেগে অসি চালনা অস্ত্রটির উত্তাপ বৃদ্ধি করে । এই উত্তাপ বৃদ্ধি এক পর্যায়ে শত হস্ত পর্যন্ত সব কিছুই অগ্নিদগ্ধ করে। কিন্তু মায়া আংটি ঐ সময় অসি চালককে নীলাভ রশ্মি দিয়ে ঘিরে রাখে এবং এই নীলাভ রশ্মি তার মালিক কে সুশীতল করে অগ্নিদগ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করে।
কিন্তু এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ আদিত্য দেব এর মৃত্যুর পর তার গুরু সেই যোগীরাজ অলৌকিক তরবারি টি লুকিয়ে রাখেন। শুধু বলে যান  মায়া আংটি এই বংশের রাজরানী রা পরম্পরায় হস্তে ধারণ করবে। যদি কখনো এই রাজবংশের বিপদ আসে, তবে এই বংশের উপযুক্ত সন্তান যেন মায়া আংটি পরে একাকী হিমালয়ের পাদদেশে শক্তি ক্ষেত্রে পদার্পণ করে । সেখানেই সে পাবে অলৌকিক তরবারির সন্ধান।"এই বলে তিনি তার হস্ত থেকে মায়া আংটি টি খুলে নিয়েএকটি ছোট্ট হাতির দাঁতের কৌটায় রেখে, সেই কৌটোটি আমাদের হাতে দিলেন। তারপর তোমার মুখে চুমু খেয়ে তোমায় আমাদের হাতে তুলে দিলেন।
তারপর আমার (রঘুবর)নিরাপত্তায় শ‍্যামজী তোমায় নিয়ে এই দূরবর্তী অঞ্চলে নিয়ে আসে। এখানে তিনি তোমায় সকলের অলক্ষ্যে বড় করে তুলতে লাগলেন।
এদিকে রাজধানীর পতনের পর দুর্জন সিং রাজধানীতে সসৈন্যে এলেন।মালব গড়ের রাজা প্রবাল নারায়নের সঙ্গে একটি লোকদেখানো সন্ধি হলো। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী দুর্জন সিং রাজা হলেন।আর প্রবাল নারায়ন পেলেন খনির অর্ধেক অধিকার।
’এই বলে রঘুবর থামলেন।
শ‍্যামজী এবার একটি হাতির দাঁতের কৌটো আদিত্য র হাতে দিয়ে বললেন ,‘ এই সেই মায়া আংটি। এটা তুমি ডান হাতে ধারণ করো।’
আদিত্য কৌটো খুলতেই একটা নীল পাথর খোদিত স্বর্ণাঙ্গুরীয় ঝলমল করে উঠলো।
আদিত্য সেটা  ডান হাতের অনামিকায় ধারণ করলো।
ধারণ করা মাত্রই কেউ যেন তার  কানে বলে উঠলো ‘উত্তরপানে শক্তিক্ষেত্রে এসো।’
আদিত্য শ‍্যামজীর দিকে তাকিয়ে বলল ‘পিতা এই আংটি ধারণ করা মাত্র কেউ যেন আমার কানে বলল ,"উত্তর পানে শক্তিক্ষেত্রে এসো।’
শ‍্যামজী মৃদু হেসে বললো , ‘তোমার মা মহারানী পদ্মাবতী বলেছিলেন এই মায়া আংটি তোমায় যে কোন প্রকার রোগ ও প্রাকৃতিক বিপত্তি থেকে  রক্ষা করবে। এছাড়া প্রয়োজনে পরম সুহৃদের মতো পথনির্দেশ করবে।
অতএব পুত্র তুমি দ্বিধা করবে না । আগামী কাল প্রভাতেই তুমি  উত্তর পানে যাত্রা শুরু করো। ঈশ্বর তোমার সহায়ক হোন।’

পরদিন সকালে আদিত্য গুরুদেব রঘুবর ও পিতাকে প্রণাম করে   যাত্রা শুরু করলো।সাথে রইলো তীর ধনুক , তরবারি ও সামান্য কিছু খাদ্য।
পথ অনেক দূর। কিছু ক্ষণের মধ্যে ই চেনা পরিবেশ অপরিচিত হয়ে গেল। কানে শুধু অনুরণন হতে লাগলো ‘উত্তরে এসো, উত্তরে এসো'।

দ্বিতীয় পর্ব (বিজয় গড় )

পথ আর ফুরায় না। আদিত্য এখন একা। পুরাতন পরিচিত বন্ধু গুলোর মুখ মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। তবে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে পিতার মুখ। এর আগে কখনো পিতাকে ছেড়ে এতদূরে আসেনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে পিতাই ছিল আদিত্য র একমাত্র আশ্রয়।
যত সময় যাচ্ছে জঙ্গল ততো ঘন হয়ে আসছে। এই জঙ্গল তাকে সূর্য ডোবার আগেই পেরিয়ে যেতে হবে। খিদে পেয়েছে , তৃষ্ণা ও পেয়েছে। সামনে কোন জলাশয় আছে কিনা আদিত্য জানে না। আদিত্য ভাবলো আরো কিছুক্ষন চলা যাক। সামনে কোন জলাশয় পেলে তবেই থামবে।
বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর আদিত্য র মনে হলো দুরে যেন অনেকটা জঙ্গল ফাঁকা লাগছে। আদিত্য র মনে হলো সামনে নিশ্চয়ই কোন জলাশয় আছে তাই ঐখানে জঙ্গল ফাঁকা।
আরো কিছুক্ষন হাঁটার পর দেখলো বিশাল একটা জলাশয়। অন‍্য পাড় ভালো করে দেখা পর্যন্ত যাচ্ছে না। তবে দুরে মনে হয় একটা মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে। মন্দির দেখা যাচ্ছে মানে নিশ্চিত মানুষ আছে।যাক এখন আগে পেটের আগুন নিভানো যাক।
আদিত্য তার ঝোলা থেকে খাবার বের করলো । চিঁড়ে ও কিছুটা গুড় আছে। আদিত্য সেটাই খুব তৃপ্তি করে খেলো। তারপর জলাশয়ে নেমে পেট ভরে জল খেলো। এবার ভাবলো কিছুক্ষন বিশ্রাম নেওয়া যাক। তারপর মন্দির লক্ষ্য করে এগিয়ে যাওয়া যাবে।  ভূমি র উপর অস্ত্রশস্ত্র গুলো রেখে আদিত্য জলাশয়ে র পাশে ই ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল।
খানিকটা তন্দ্রা মতো এসেছে এমন সময় একটা ক্ষীণ নারী কন্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো , "বাঁচাও ,বাঁচাও"।
আদিত্য তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়লো। অস্ত্র শস্ত্র গুলো মাটি থেকে তুলে নিলো।
একবার পরিস্থিতি বুঝে নিলো।আওয়াজ ভেসে আসছে মন্দিরে র দিক থেকে। আদিত্য দ্রুত এগিয়ে চললো মন্দিরের দিকে।
মন্দিরের কাছে গিয়ে দূর থেকেই পরিস্থিতি বিচার করে নিলো। দুইটি নারী মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে   সাহায‍্যের জন্য চিৎকার করছে। তাদের আড়াল করে দাঁড়িয়ে চার জন সৈন্য লড়াই করছে দস‍্যু দের সাথে। দস্যু রা সংখ‍্যায় প্রায় দশজন।
আদিত্য কর্তব্য স্থির করে নিলো। ধনুকে তীর যোজনা করে লক্ষ্য স্থির করে চালিয়ে দিলো। কেউ কিছুই বোঝার আগেই চার জন দস‍্যু আঘাত পেয়ে মাটি নিলো।
আচমকা পিছন থেকে আক্রান্ত হয়ে দস‍্যুরা হকচকিয়ে গেল। দুজন দস‍্যু আদিত্য কে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে আদিত্য কে একযোগে আক্রমণ করলো।
এবার শুরু হলো ভয়ঙ্কর তরবারি যুদ্ধ। একদিকে চারজন সৈন্য লড়ছে চার দস‍্যুর সাথে ,অন্য  প্রান্তে একা আদিত্য লড়ছে দুই জন দস‍্যুর সাথে।
ধন‍্য গুরু রঘুবরের শিক্ষা। কিছুক্ষণ পরেই দস‍্যুরা টের পেল যার সাথে তারা লড়ছে তার অসি চালনা অসাধারণ।অতি দ্রুত অসি চালনা কয়েক মুহূর্ত পরেই দুজন দস‍্যুর হাতের অসি ছিটকে ফেলে দিলো। দুজন দস‍্যুই আহত হয়ে ছুট লাগালো গভীর বনের দিকে। বাকি লড়াইয়ে রত দস‍্যুরা যখন দেখলো তারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে তারাও তখন লড়াই ফেলে বনের মধ্যে দৌড়ে পালিয়ে গেলো।
যে চারজন সৈন্য লড়াই করছিল তাদের মধ্যে থেকে একজন বয়স্ক সৈন্য এগিয়ে এলো।
আদিত্য র কাছে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বললো ,‘ ধন্যবাদ যুবক। আপনি যদি ঠিক সময়ে না এসে পড়তেন তবে বিপদ হতো।।আমি ‘বিজয়গড়ের’ সেনাধ‍্যক্ষ শূরসেন। আপনি আপনার পরিচয় দিন।’
আদিত্য বললো ‘আমি ‘সুন্দরগড়ের ’একজন নাগরিক। বিশেষ উদ্দেশ‍্য নিয়ে হিমালয় পাদদেশে চলেছি।’
শূরসেন বললো ,‘ এই জঙ্গল সামান্য কিছু দুরেই শেষ হয়েছে। তারপর ‘বিজয়গড়’ রাজ‍্য। এই স্থানে এক জাগ্রত শিব  মন্দির রয়েছে।আমাদের রাজকন‍্যা রত্নমালা এই শিব মন্দিরে পুজো দিতে এসেছেন। আমি অল্প কয়েকটি সৈন্য নিয়ে ওনার দেহরক্ষী হিসাবে এসেছি। এই স্থানে দস‍্যুর উপদ্রব আছে আগেই  রাজ দরবারে খবর এসেছিলো।আজ তা প্রত‍্যক্ষ করলাম। ভাগ্য ভালো তুমি এসেছিলে । না হলে হয়তো এতো অল্প সৈন্য নিয়ে ওদের সঙ্গে পেরে উঠতাম না। তুমি আমার সাথে রাজধানীতে চলো। আমাদের সাথে তিনটি রথ আছে একটি তে রাজকন্যা ও তার সঙ্গীনি অপর দুইটিতে আমরা বাকি সবাই উঠবো। ’
আদিত্য এতোক্ষণে মন্দিরের চাতালের দিকে তাকালো।দেখলো এক অপরূপ সৌন্দর্য তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এই তবে রাজকন্যা রত্নমালা।
আদিত্য কিছুক্ষন রাজকন্যা র দিকে তাকিয়ে তারপর চোখ নামিয়ে নিল। তারপর শূরসেন এর দিকে তাকিয়ে বলল , আপনার প্রস্তাবে আমি সম্মত।
আদিত্য স্থান পেলো শূরসেন এর রথে।সবার আগে রইলো রাজকন্যা র রথ , তারপর শূরসেন এর রথ , তারপর সৈন্য দের রথ।
কিছুক্ষণ যাওয়ার পর দৃশ্য পট পাল্টে যেতে লাগলো। আস্তে আস্তে জঙ্গল কমে আসছে। দুই একটা ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে। আদিত্যর নজরে এলো রাজকন্যা তার রথে আগে আগে যেতে যেতেই বারবার পিছন ফিরে তার দিকে তাকাচ্ছে। আদিত্যর অস্বস্তি হচ্ছিল। অস্বস্তি কাটাতে সে শূরসেন এর গল্প জুড়ে দিলো।
শূরসেন কে আদিত্য প্রশ্ন করলো তিনি কখনো ‘সুন্দরগড়’ গিয়েছিল কিনা?
শূরসেন লোকটি খুব মিশুকে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই এমন মনে হচ্ছে যেন তাদের পরিচয় কতো দিনের।
শূরসেন বললো ‘  বহুদিন আগে একবার তিনি রাজদূত হয়ে সুন্দর গড়ে গিয়েছিলেন। তিনি যখন গিয়েছিলেন তখন রাজা ছিলেন মহারাজ প্রতাপাদিত্য। সুন্দর গড় ,মালবগড় ,ও বিজয় গড়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রাজ্য হলো বিজয় গড়। তাই আমাদের মহারাজ চান যেন তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিবাদ না হয়।তাই তিনি শান্তি পূর্ণ সহাবস্থানের জন্য আমায়  বিজয় গড়ে দূত হিসেবে নিয়োগ করে ছিলেন। সুন্দর গড়ে আমি প্রায় এক বৎসর ছিলাম । মহারাজ প্রতাপাদিত্য ছিলেন উদার মনোভাবের । তিনি ও রানীমা আমায় নিজের ভাইয়ের মতোই দেখতেন। মহারাজ যেখানেই যেতেন আমায় সঙ্গে নিয়ে যেতেন। নতুন কিছু পদ রন্ধন হলেই রানীমা আমায় নিমন্ত্রণ করতেন।সত্যি বলতে কি মহারাজ আমায় নিজের ভাইয়ের চোখে দেখতেন।
কিন্তু কিছুদিনের জন্য আমি বিজয় গড়ে ফিরে এলাম পারিবারিক কারণে। এখানে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই খবর এলো মালব গড়ের রাজা প্রবাল নারায়ণ সুন্দর গড় আক্রমণ করেছিল। মহারাজ তাকে বাধা দিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন।আর রানীমা ও রাজপুত্রের কোন খবর নেই।আর সুন্দর গড় এর নতুন রাজা হয়েছেন সেনাপতি দুর্জন সিং। এই   দুর্জন সিং লোকটাকে মহারাজ বিশ্বাস করতেন। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে লোকটা আসলে লোভী বিশ্বাসঘাতক। এই লোকটি রাজা হওয়ার পর থেকেই সুন্দর গড়ের মানুষের দুর্দশা বেড়েছে।আর তার লোলুপ দৃষ্টি এবার এসে পড়েছে বিজয় গড়ের ওপর। যে কোন দিন বিজয় গড় আক্রান্ত হতে পারে। যদিও আমাদের মহারাজ উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছেন। সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবুও মহারাজ বৃদ্ধ হয়েছেন। এখন দরকার তরুণ রক্তের। আর মহারাজের  সন্তান বলতে ঐ রত্নমালা।’
এই বলে শূরসেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
ইতিমধ্যেই রথ বিজয়গড় নগরীতে প্রবেশ করেছে। রাজকন্যা র রথ পূর্বেই রাজবাড়ী তে পৌঁছে গেছে। শূরসেন আদিত্য কে নগর দেখানোর জন্য একটু ঘুরিয়ে তারপর যখন রাজবাড়ী তে পৌঁছলো তখন দেখলো স্বয়ং মহারাজ সূর্য সেন আদিত্য কে স্বাগত জানাতে প্রধান ফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে।

শূরসেন ও আদিত্য উভয়েই রথ থেকে নামার পর মহারাজ সূর্য সেন এগিয়ে এসে হাসি মুখে আদিত্য কে উদ্দেশ্য করে বললেন ,‘ হে বীর যোদ্ধা , সম্পূর্ণ বিজয় গড় আজ তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তুমি যদি না সময়ে এসে পড়তে তবে যে কি হতো তা ভাবলেই ভয় লাগছে।রত্নমালা ও তার সঙ্গীনি আমায় সব বলেছে। তুমি এখন আমার আতিথ্য গ্রহণ করো।’
এই বলে সকলে মিলে রাজপ্রাসাদের অতিথি শালায় প্রবেশ করলো। মহারাজ বললেন ‘বলো যুবক , তোমার সম্পূর্ণ পরিচয় দাও।’
আদিত্য মনে মনে স্থির করলো রাজাকে এখনি আসল পরিচয় দেওয়া ঠিক হবে না।
আদিত্য তাই মহারাজ কে উদ্দেশ্য করে বললো ,‘ মহারাজ  আমি জাতিতে ক্ষত্রিয়। পালক পিতার আদেশে আমি হিমালয় পাদদেশে শক্তি ক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছি। সেখানে গিয়ে আমার উদ্দেশ্য পূরণ হলে আমি আবার ফিরে আসবো। ’’
মহারাজ বললেন ,‘ তোমার পিতা কে ?’
আদিত্য উত্তর দিলো ,    ‘ মহারাজ আমার যাত্রা যেন সফল হয় সেই আশীর্বাদ করুন। সঠিক সময়ে আমি আপনার কাছে ফিরে আসবো। তখন আমি সব কিছুই আপনার কাছে বিবৃত করবো।’
মহারাজ বললেন ,     ‘বেশ , তুমি কিছুদিন আমার অতিথি শালায় থেকে যাও। তোমার যাত্রার জন্য আমার অশ্বশালা থেকে একটা উত্তম জাতির অশ্ব নাও।’
আদিত্য বললো ‘ মহারাজ , আমি অশ্বারোহণ জানি না।’
তখন শূরসেন বললেন , ‘ মহারাজ আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি আদিত্য কে আমার গৃহে রেখে দেওয়ার জন্য। আমি ওকে এই কয়েক দিনের মধ্যেই উত্তম অশ্বারোহী বানিয়ে দেব।   ’
মহারাজ বললেন , ‘ বেশ তোমার কাছেই আদিত্য থাক। তবে প্রতিদিন একবার রাজ দরবারে আশা চাই।’
আদিত্য ও শূরসেন মহারাজ এর কাছ থেকে বিদায় নিলো।
শূরসেনের গৃহ রাজপ্রাসাদে র চৌহদ্দির মধ্যেই।
শূরসেনে সন্তান হীন। তিনি আর তার স্ত্রী আদিত্য কে পেয়ে খুবই আনন্দিত হলেন। আদিত্য কে পেয়ে দুজনেই সন্তানহীনতার দুঃখ ভুলে গেলো।
এদিকে আদিত্য শূরসেনের মতো দক্ষ সেনানায়ক পেয়ে তার কাছে সৈন্য পরিচালনা ও অশ্বারোহণ শিখতে লাগলো। এবং কয়েকদিনের মধ্যেই উভয় ক্ষেত্রেই বিশেষ দক্ষতা অর্জন করলো।
একদিন অপরাহ্ণ বেলায় আদিত্য রাজপ্রাসাদের বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাগানের অদূরে এক শিব মন্দির। নির্জন পরিবেশ।এমন সময় এক মহিলা আদিত্য র কাছে এসে প্রণাম করলো। আদিত্য প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে বুঝতে পারলো ইনি সেই দিন রাজকন্যা র সঙ্গীনি হয়ে গিয়েছিলেন।
মহিলা আদিত্য কে বললেন , ‘ কুমার, রাজকন্যা রত্নমালা আপনার সাথে দেখা করতে চান।’
আদিত্য বললো ,‘ তিনি কোথায় ?’
মহিলা উত্তর দিলো , ‘ তিনি মন্দির প্রাঙ্গণে শিবের জন্য মালা গাঁথছেন।’
আদিত্য মন্দির প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখলেন রাজকন্যা রত্নমালা কিছু শিউলি ফুল সংগ্রহ করে মালা গেঁথে রাখছেন।
আদিত্য রাজকন্যা র সামনে গেলে রাজকন্যা হাত জোড় করে আদিত্য কে প্রণাম জানালো।
তারপর রাজকন্যা ভ্রু কুঁচকে আদিত্য কে প্রশ্ন করলো , 'এতদিন কোথায় ছিলেন ?
আমি ভাবছিলাম আপনার সাথে বোধহয় আর কখনো দেখাই হবে না।'
আদিত্য বললো , 'আমি এই মুহূর্তে আপনাদের আশ্রিত। আদেশ করলেই চলে আসতাম।'
রাজকন্যা একটা অপরূপ হাসি ছড়িয়ে বললো ,‘ বেশ আমি যা বলবো আপনি তাই করবেন তো ?  আমি আদেশ করলাম যে কয়দিন আপনি এখানে থাকবেন প্রতিদিন অপরাহ্ন বেলায় এই মন্দিরে আমার কাছে হাজিরা দেবেন।অনথ্যায় ভীষণ শাস্তি।’
আদিত্য ও ছদ্মভীত হয়ে বললো ,‘তাই হবে দেবী।’
তারপর দুজনে ই হেসে উঠলো।
এরপর দুজনের প্রতি দিন নির্জনে শিব মন্দিরের প্রাঙ্গণে দেখা হয় । দুই জন যুবক যুবতীর দেখা হলে কি কথা হবে তা আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। স্বয়ং শিব ঠাকুর তাদের মেলামেশা র সাক্ষী থাকেন।
একমাস কোথা দিয়ে কেটে গেল তা কেউই টের পেলো না।
একদিন আদিত্য রত্নমালা কে বললো ,‘ দেবী , এবার আমায় যেতে হবে। আমার কর্তব্য আমায় ডাকছে।আমায় বিদায় দিন।’
রত্নমালা আক্ষেপ করে বললো ‘ এমন কোন কর্তব্য আছে যা আমার চেয়ে বড় ?’
আদিত্য তখন বাধ্য হয়ে তার সত্যি কারের পরিচয় হতে মায়া আংটি ও অলৌকিক তরবারি ইত্যাদি সব কিছুই বললো।
শেষে বললো ‘ আমি নিজেও এখনো জানি না কোথায় কোনদিকে আছে শক্তিক্ষেত্র ।’
তখন রত্নমালা বললো , ‘ আমি এই ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে পারি। আমার ধাই মা একজন সিদ্ধা যোগিনী। চলুন তার কাছে যাওয়া যাক। তিনি   নিশ্চয়ই আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন। এই বিশাল বাগানের এক প্রান্তে এক কুটিরে তিনি বসবাস করেন। ’
বিশাল বাগানের এক প্রান্ত দিয়ে এক ছোট্ট নদী বয়ে চলে গেছে। তার ধারে এক পর্ণ কুটির।’
রত্নমালা সেই কুটির এর কাছে গিয়ে ‘মা,মা’ বলে ডাকলো।
রত্নমালার ডাকে সাড়া দিয়ে কুটির এর ভিতর থেকে এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন।এসে একগাল হেসে রত্নমালা কে দেখে বললেন ‘ রত্না মা , এতদিন বাদে বুঝি মাকে মনে পড়লো ?’
রত্নমালা বললো ‘ না মা , রোজ আসলে তোমার সাধনার বিঘ্ন হবে তাই রোজ আসি না।’
এবার বৃদ্ধার চোখ পড়লো আদিত্য র উপর।এক ঝলক দেখে বললো ,‘ কি রাজপুত্র ? পথ খুঁজে পাচ্ছ না ? রত্না তোমায় এখানে এনে ভালো কাজ করেছে। আমি তোমায় পথের সন্ধান দেবো। তবে আজ নয় । তুমি কাল অপরাহ্ন বেলায় রত্না কে সাথে নিয়ে আমার কাছে আসবে।’

সেই মতো পরের দিন আদিত্য ও রত্নমালা যোগিনী র কুটিরে আসলে যোগিনী আদিত্য র হাতে এক টুকরো লাল কাপড়ের টুকরো দিয়ে বললো ,‘ এই কাপড়ের টুকরো টি আমি মন্ত্রপূত করে দিয়েছি। তুমি এটা হাতে ধরে ‘ওম নম শিবায়’ এই মন্ত্র টি তিন বার জপ করবে। তারপর কাপড়ের টুকরো টি যেদিকে লক্ষ্য  করে উড়তে থাকবে জানব    সেই দিকেই আছে তোমার শক্তি ক্ষেত্র। আর এই চলার পথে কখনো যদি ভয়ঙ্কর কোন বিপদের সম্মুখীন হও তবে এই কাপড়ের টুকরো টি বুকে হৃদয়ের কাছে ধরে আমায় স্মরণ করবে , দেখবে আমি তোমার সাহায্যের জন্য সেখানে পৌঁছে যাবো। আগামী পরশু শুভ মূহুর্ত আছে। তুমি ঐ দিন  ভোরে যাত্রা শুরু করো। ’
সেই রাতে চাঁদ মাথার উপর ওঠা পর্যন্ত আদিত্য ও  রত্নমালার মধ্যে কথা হলো। শেষে আদিত্য কথা দিলো অলৌকিক তরবারি সংগ্রহ করার পর আদিত্য সবার প্রথমে বিজয়গড় আসবে।আর মহারাজ এর কাছে নিজের প্রকৃত আত্মপরিচয় দিয়ে রত্নমালাকে চেয়ে নেবে।
আরো কত কি যে কথা হলো তার সাক্ষী রইলো গাছপালা , নিশাচর পাখি , রাতের গন্ধরাজ ফুলের সুবাস ,আর পূর্ণিমার ঝকঝকে চাঁদ।
পরের দিন আদিত্য সকলের কাছ হতে বিদায় নিলো। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেলো শূরসেনের স্ত্রী। তিনি আদিত্য কে পেয়ে পুত্র স্নেহের পরশ পেয়েছিলেন। আদিত্য তাকে এই কয়দিন ‘মা’ বলেই ডাকছিলো।আজ চলে যাওয়ার সময় তার কাছে ও আদিত্য কথা দিলো কার্যসিদ্ধি হওয়ার পর আদিত্য তার কাছে ফিরে আসবে।
মহারাজ সূর্য সেন বললেন  , “তুমি আমার পুত্রের মতো । তুমি কার্যসিদ্ধি হলে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার এখানে আসবে। যে কোন সময় দুষ্ট শক্তি এই রাজ্য আক্রমণ করতে পারে। তাই তোমার মতো বীর যোদ্ধা আমার প্রয়োজন।  ”
সকলের কাছে বিদায় নেওয়ার পর সেই রাতে রাজপ্রাসাদের বাগানে আবার দেখা হলো রাজকন্যা রত্নমালার সাথে। রাজকন্যা বললো ‘ কুমার , আমি আমার স্বপ্নের বীর যোদ্ধা কে খুঁজে পেয়েছি। সেই বীর হলে তুমি। আমি তোমার পথ চেয়ে বসে থাকবো। প্রতিদিন তোমার মঙ্গলের জন্য শিব পূজা করবো। তুমি যত শীঘ্র সম্ভব এখানে ফিরে এসো।'
ধীরে ধীরে ভোর হলো ।
প্রভাতে শূরসেন ও তার স্ত্রী কে প্রণাম করে আদিত্য রওনা দিলো। শূরসেনের স্ত্রী ঘোড়ার পিঠে ঝোলায় কিছু খাদ্য দিয়ে দিয়েছেন।
আদিত্য ঘোড়ার পিঠে উঠে ঘোড়া চালিয়ে দিলো।শূরসেন ও তার স্ত্রী সজল চোখে তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।
কিছু ক্ষণ ঘোড়া ছোটাবার পর আদিত্য আবার এক গভীর জঙ্গলে উপস্থিত হলো । এখানে আদিত্য এবার একা। (ক্রমশ)

(শক্তিক্ষেত্রে প্রবেশ)

জঙ্গল কাল শেষ হয়ে গেছে।আজ আদিত্য যে জায়গা দিয়ে এগিয়ে চলেছে সেখানে শুধুই পাহাড়ের সারি। বিশাল বিশাল তুষার ধবল শৃঙ্গ গুলো যেন এই অঞ্চলের প্রহরী। রক্তচক্ষু মেলে পাহারা দিচ্ছে অবাঞ্ছিত অতিথি দের আটকে রাখার জন্য।
পথ বলে কিছু নেই। শুধু মন্ত্র পূত কাপড়ের নির্দেশিত দিকে এগিয়ে চলা।খাদ্য যা ছিল তা কাল শেষ হয়ে গেছে। এখন ঝর্ণা র জল ছাড়া খাওয়ার জন্য কিছু ই নেই।
হঠাৎ আদিত্য র মনে হলো বহু বহু দূরে কি যেন একটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। এতো দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না।ঐ দিকেই আদিত্য চলেছে। বেশ অনেকটা সময় যাওয়ার পর মনে হলো ওটা একটা মন্দিরের স্বর্ণ কলস ।পড়ন্ত বিকালের রৌদ্র কলসের গায়ে এসে পড়ছে বলে চকচক করছে। আদিত্য দ্রুত ঘোড়া ছোটালো।যে করেই হোক সন্ধ্যা র আগে ঐ মন্দিরে পৌঁছতে হবে।
সূর্যাস্তের ঠিক আগে আদিত্য মন্দিরের দোর গোড়ায় পৌঁছে গেলো।
বিশাল বিরাটকায় মন্দির। সম্পূর্ণ কালো পাথরের তৈরী। মাথায় স্বর্ণ কলস। কিন্তু কেউ কোথাও নেই।এত নির্জনতা আর এই বিশাল মন্দির । আদিত্য বিস্মিত হলো। এই নির্জনে এই বিরাট স্থাপত্য তৈরী করলো কে ? আর কেন ?
যাইহোক আদিত্য ঠিক করলো রাতটুকু এই মন্দিরে কাটিয়ে দেবে।  সামনে কিছুটা খোলা জায়গায় কচি কচি ঘাস জন্মেছে। আদিত্য ঘোড়াটাকে ঐ ঘাস জমিতে ছেড়ে দিল ঘোড়াটার খিদে পেয়েছে। শিক্ষিত ঘোড়া। প্রভুকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। মনের আনন্দে ঘোড়াটি ঘাস খেতে লাগলো।
আদিত্য মন্দিরে প্রবেশ করলো। পরপর তিনটি বিশালাকৃতির ঘর ফেলে একবারে শেষ ঘরটিতে প্রবেশ করলো। সামনে উচুঁ বেদীর উপর শিব লিঙ্গ ।
শিব লিঙ্গের সামনে একটি তেলের  প্রদীপ জ্বলছে।আর শিব লিঙ্গের সামনে একটি পাত্রে কিছু ফল রাখা আছে।
আদিত্য একটু এগোতেই একটা গুরু গম্ভীর স্বর ভেসে এলো ,‘ শিব লিঙ্গের সামনে রাখা প্রসাদ গ্রহণ করো।আর রাত্রে এখানেই বিশ্রাম করো। এই মন্দির শক্তি ক্ষেত্রের প্রবেশ দ্বার।কাল তোমায় শক্তি ক্ষেত্রে প্রবেশের উপায় বাতলে দেবো।’
আদিত্য বুঝতে পারলো না কে তাকে নির্দেশ দিলো। যাইহোক আপাতত নির্দেশ পালন করে একটা ঘুম দেওয়া যাক। এই বলে আদিত্য ফলের পাত্র টি নিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়লো।
পরের দিন খুব ভোরে আদিত্য র ঘুম ভাঙ্গলো।সবে একটু আলোর আভাস দেখা দিয়েছে। আদিত্য মন্দির থেকে বেরিয়ে তার ঘোড়ার কাছে গেল। শিক্ষিত ঘোড়া। প্রভুকে দেখে চিঁহি করে আওয়াজ করল। আদিত্য ঘোড়ার পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে বললো ‘ভালোই আছিস মনে হচ্ছে। আমি না ফেরা পর্যন্ত এই ক্ষুদ্র চারণক্ষেত্রেই অবস্থান কর।  ’
মন্দিরের পাশে ই একটা জলের কুন্ড। আদিত্য সেখানে মুখ  হাত ধুয়ে
আবার যখন আদিত্য মন্দিরে প্রবেশ করলো তখন  দেখলো মন্দির টি আক‌তিতে বিশাল ও নানাবিধ কারুকার্য সমন্বিত। এমন নির্জন পরিবেশে এমন বিশালাকৃতির মন্দির বড়ই বিস্ময়কর।  আদিত্য তন্ময় হয়ে মন্দিরের শোভা দেখছিলো। হঠাৎ কানে গেল কেউ যেন তাকে উদ্দেশ্য করে ডাকছে। সেই গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর বলছে ‘ এসো বৎস ,এসো।’
আওয়াজ টা ভেসে আসছে শিবলিঙ্গের দিক থেকে।  মন্দিরের শেষ প্রান্তে এক বিশাল বেদীর উপর এক বিরাটাকৃতি শিবলিঙ্গ। কালো কষ্টিপাথরের তৈরী।তার পিছন দিক থেকে কন্ঠস্বর টি ভেসে আসছে।
আদিত্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো দেখা যাক কে তাকে আহ্বান করছে। নিচের থেকে শিবলিঙ্গের বেদীর  উপর ওঠানামা করার জন্য সোপান রয়েছে। আদিত্য সোপান বেয়ে শিবলিঙ্গের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না যে কে তাকে ডাকছে। সেই কন্ঠস্বর তখনো বলছে ‘ এদিকে এসো বৎস। এদিকে এসো ।’আদিত্য  শিবলিঙ্গের সামনে দিকে কিছুই না দেখতে পেয়ে লিঙ্গের পিছনের দিকে গেলো। শিবলিঙ্গের পিছনের দিকে রয়েছে এক গুপ্ত কক্ষ।যার সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গেছে গুপ্ত কক্ষের ভেতরে। ভেতর নিকষ কালো অন্ধকার। সেই কালো অন্ধকার থেকে আওয়াজ আসছে ‘এদিকে এসো বৎস,এদিকে এসো।’
আদিত্য ভাবতে লাগলো এই অন্ধকার কক্ষের ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। এদিকে ওদিকে চেয়ে দেখতে চোখে পড়লো একটা মশাল গুপ্ত কক্ষের সিঁড়ি র পাশের দেয়ালে আটকানো রয়েছে।আর তার পাশেই এক কুলুঙ্গি তে রয়েছে আগুন জ্বালিয়ে নেওয়ার চকমকি পাথর  । আদিত্য মশালটা পেড়ে চকমকি পাথর ঠুকে সেটা জ্বালিয়ে নিলো। এবার চললো গুপ্ত কক্ষের ভিতর।
অনেকটা সিঁড়ি বেয়ে নামার পর একটা বিশাল কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করলো।
কক্ষের চারিদিকে মশালের আলোয় আলোকিত হতে আদিত্য চোখে যেটা পড়লো তা দেখে তার বুক হিম হয়ে গেলো। সেই কক্ষের একদিকে রয়েছে এক বিরাট ভীষণাকৃতির অজগর সাপ।
অজগর টি আদিত্য কে দেখতে পেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো। আদিত্য ইচ্ছা করলেই পিছিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বিপদে পিছিয়ে যাওয়া তার স্বভাবে নেই। কক্ষের একপাশে  পাথরের দেওয়ালে একটা গর্ত দেখে তার মধ্যে মশাল টি গুঁজে দিলো।এর পর খোলা তরবারি উচিঁয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ভয়ংকর অজগরের অপেক্ষায়।
বিশাল অজগর ও মানুষের যুদ্ধ চললো বেশ কিছুক্ষণ ধরে।
অজগরটি চেষ্টা করছিলো আদিত্য কে পেঁচিয়ে ধরার। কিন্তু আদিত্য দ্রুত গতিতে পাশ কাটিয়ে বারেবারে অজগর টিকে ফাঁকি দিতে লাগলো। অবশেষে একবার মূহুর্তের জন্য সুযোগ পেয়ে আদিত্য তলোয়ারের এক কোপে অজগর টিকে দুই আধখানা করে দিলো।
কিন্তু একি কাণ্ড। অজগরের মৃতদেহ টি ধীরে ধীরে পুরো অদৃশ্য হয়ে গেলো।আর তার বদলে সেখানে দৃশ্যমান হলো এক দেবকান্তি পুরুষ।
আদিত্য সব ব্যাপার স্যাপার দেখে হতচকিত হয়ে গেল।
সেই দেবকান্তি পুরুষ বললো ,‘ আমি তোমার জন্য ই অপেক্ষা করছি এতকাল।’
আদিত্য বললো ‘আপনি কে ?’
সেই পুরুষটি উত্তর দিলো ‘ আমি শক্তিক্ষেত্রের প্রবেশ দ্বারের রক্ষক।  ঐ অজগরের শরীর হলো আমার মায়াবী রূপ। আমাকে যে হারাতে পারে শুধুমাত্র তাকেই আমি শক্তিক্ষেত্রে প্রবেশের অধিকার দিই।শক্তিক্ষেত্র হলো এক অতি মায়াবী শক্তিশালী উন্নত জাতির নগরী। সেখানে যারা বাস করে তারা অতীব শক্তিধর।এসো তোমায় আমি সেই আশ্চর্য গোপন নগরীতে প্রবেশের পথ দেখিয়ে দিই। কিন্তু মনে রেখো যে পথ দিয়ে প্রবেশ করছো সেই পথে কিন্তু ফিরে আসতে পারবে না। ফেরার পথ তোমায় নিজেকে খুঁজে নিতে হবে।   ’
এই সব বলতে বলতে সেই আশ্চর্য পুরুষ টি আদিত্য কে নিয়ে গেলো কক্ষের এক প্রান্তে । সেখানে এক বিশাল প্রস্তর খন্ডের তৈরী দরজা। দরজাটি বন্ধ। পুরুষটি বললো ‘ শত হস্তির বল প্রয়োগ করলেও এই দরজা খুলবে না। এটা খোলে এক বিশেষ মন্ত্রের সাহায্যে।’
এই বলে তিনি বিড়বিড় করে একটি মন্ত্র বলে দরজার ওপর তিনটি টোকা মারলো।সাথে সাথেই বিশাল দরজা ঘরঘর আওয়াজ করে খুলে গেল। আদিত্য র নজরে এলো এক বিরাট আঁকা বাঁকা সুড়ঙ্গ। পুরুষ টি আদিত্য কে বললো ,‘এই পথ ধরে চলে যাও ।এর অপর প্রান্তে আছে তোমার আকাঙ্খিত নগরী শক্তিক্ষেত্র।’
আদিত্য বললো ‘ কিন্তু আপনি বলছেন যে আমি এই পথে ফিরবো না। সেক্ষেত্রে আমার বাহনের কি হবে?’
পুরুষ টি মৃদু হেসে উত্তর দিলো‘ চিন্তা করো না । তোমার বাহন আমার তত্ত্বাবধানে নিরাপদেই থাকবে। তুমি যখন শক্তি ক্ষেত্র ত্যাগ করবে তবে আমি ঠিকই জানতে পারবো। আমি তখন তোমার বাহন যোগবলে সেখানে পৌঁছে দেবো। তোমার মতো বীরশ্রেষ্ঠ র জন্য এটুকু তো আমার করা উচিত। এখন তুমি যাও।’
আদিত্য সেই অপরূপ দেবকান্তি পুরুষ কে প্রণাম করে সুড়ঙ্গ পথে প্রবেশ করলো।
কিছুটা এগোনোর পর  ঘড়ঘড় শব্দ করে সুড়ঙ্গের মুখটা বন্ধ হয়ে গেল।এখন এই সুড়ঙ্গে আদিত্য একা। সুড়ঙ্গ টা কিন্তু অন্ধকার নয়। হালকা একটা আলো রয়েছে। তবে আদিত্য বুঝতে পারলো না কোথা হতে এই আলো আসছে। আদিত্য এগিয়ে চললো। আঁকা বাঁকা সুড়ঙ্গ পথে এগোতে এগোতে এক জায়গায় গিয়ে দেখলো সুড়ঙ্গ শেষ। সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে এক রাশ আলো এসে পড়েছে।
কোথা হতে এতো আলো এসে পড়ছে  বোঝা যাচ্ছে না। শুধু একগাদা আলো এসে আলোর কুয়াশা সৃষ্টি করেছে। আদিত্য র মস্তিষ্কের মধ্যে কেউ যেন বলে দিলো যাও ‘ঐ কুয়াশার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াও।’
আদিত্য ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পনে ঐ আলোর তৈরী কুয়াশার মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো।
প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলো না।তার পর তার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো হাতের মায়া আংটির ওপর। আংটিটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আংটি হতে এক নীলাভ রশ্মি বের হয়ে আদিত্য র চারপাশে ঘুরতে লাগলো।অতি দ্রুত নীলাভ রশ্মির ঘুর্ণন আদিত্য র চারিদিকে এক বলয়ের সৃষ্টি করলো।বলয় টি আদিত্য সমেত  উর্ধ্ব দিকে উঠতে লাগলো। আদিত্য একটা কম্পন অনুভব করলো।
কম্পন টি বাড়তে লাগলো। আদিত্য আলোর ঝলকানি আর অস্বাভাবিক কম্পন সহ্য করতে পারলো না ।
চোখ বুজে ফেললো।(ক্রমশ)
(পরের পর্বে শক্তিক্ষেত্র নগরীতে)

 (শক্তিক্ষেত্র নগরী)
আদিত্য চোখ বুজে কম্পন ও আলোর ঝলকানি বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায় রইলো। কিছুক্ষণ পর কম্পন কমে গেলে আদিত্য চোখ খুললো।চোখ খুলে আদিত্য  অবাক হয়ে গেলো।এ কোথায় এসেছে। উঁচু খাড়াই পাহাড়ে ঘেরা এক উপত্যকা। চারিদিকে সাদার মধ্যে এক টুকরো সবুজ।
সামনে একটা বিশাল সোনালী রঙের দরজা। কোনো প্রহরী নেই। দরজার দুই পাশে দুটি ষাঁড়ের মূর্তি। সূর্যের আলোয় সোনালী ধাতুর তৈরি ষাঁড় দুটির গা চকচক করছিলো।
আদিত্য কে এগিয়ে আসতে দেখে তাকে অবাক করে  বসে থাকা ষাঁড়ের মূর্তি গুলো গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। যেন তারা এই দরজার প্রহরী। তবু আদিত্য ভয় পেলো না । হাতে খোলা তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো। পিছিয়ে যাওয়ার কথা আদিত্য চিন্তা ই করতে পারে না। ধাতব ষাঁড় দুটো বারবার পা গুলো মাটিতে ঠুকে রাগ প্রকাশ করতে লাগলো। তার পর দুটি ষাঁড় মাথা গুঁজে শিঙ বাগিয়ে আদিত্য র দিকে দৌড়ে আসতে লাগলো। প্রথম ঝটকাটা আদিত্য এক পাশে সরে গিয়ে আঘাত থেকে বেঁচে গেলো। তারপর ষাঁড় দুটো ঘুরে গিয়ে  দুজন দু পাশ থেকে আদিত্য র দিকে তেড়ে এলো। এবার মহাবিপদ। দুটো ষাঁড়ের সাথে ধাক্কা যখন নিশ্চিত ঠিক তখনই আদিত্য পুনরায় পাশের দিকে লাফ দিলো বাঁচার আশায়।ঠং করে আওয়াজ হলো যখন আদিত্য মাঝখান হতে সরে যাওয়ার জন্য দুটি ষাঁড় পরস্পর কে আঘাত করলো। দুজনের ধাতুর শিং চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো সেই সুযোগ নিয়ে আদিত্য দৌড়ে খোলা বিশাল দরজা টা পার হয়ে গেলো।
কিছুটা যাওয়ার পর একবার পিছন ফিরে তাকালো ষাঁড় দুটো পিছনে তাড়া করে আসছে কিনা। না ষাঁড় দুটো তাড়া করেনি। এবার নিশ্চিন্ত হয়ে আদিত্য এগিয়ে চললো শক্তিক্ষেত্র নগরীর মধ্যে। কিছু দুর যাবার পর একটা দুটো করে বাড়ি ঘর মানুষ জন নজরে পড়তে লাগলো। বাড়ি ঘর সবই সোনালী ধাতুর তৈরি। আদিত্য র মনে হলো ধাতুটা সোনা। অথবা সোনা দিয়ে তৈরি কোন সংকর ধাতু।
দুই একটা করে মানুষ দেখা যাচ্ছে।নর ও নারী উভয়ের শরীরে এক রকম চকচকে সুতো দিয়ে তৈরি পোশাক। আদিত্য র শরীরের অন্য রকম পোশাক যদিও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলো। কিন্তু তবুও আদিত্য কে তারা কোন বাধা দিচ্ছিলো না। বরং মৃদু হেসে মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে তারা তাকে অভিবাদন জানাচ্ছিল।
এতো সুন্দর নগরী আদিত্য আগে কখনো দেখেনি। রাস্তা ঘাট খুব পরিস্কার ও সুন্দর। কোনো হৈচৈ নেই।সবাই সুশৃঙ্খল ভাবে  বেচাকেনা করছে। দূরে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কৃষি জমি। আদিত্য র অবাক লাগছে এই ভেবে ঐ পাহাড়ের খাঁজে কৃষিজমি গুলোতে জল সেচের বন্দোবস্ত কিভাবে করা হয়েছে এই ভেবে।
আদিত্য কিছু টা এগোবার পর একজন লোক আদিত্য র সামনে এসে দাঁড়ালো। লোকটির পোশাক দেখে মনে হলো সে একজন সৈনিক। সৈনিক টি আদিত্য কে প্রশ্ন করলো ‘কে তুমি ?’
আদিত্য উত্তর দিলো ‘ আমি সুন্দর গড় থেকে আসছি।’
সৈনিক টি বললো ‘এই গোপন পুরী তে কেউ সহজে আসতে পারে না । তুমি এখানে এলে কি ভাবে ?আর কি তোমার আসার উদ্দেশ্য ?’
আদিত্য উত্তর দিলো ‘ আমি এই গোপন পুরীতে নাগরাজ এর সাহায্যে এসেছি। এখানে আমি   আমার পূর্বপুরুষের ব্যবহৃত বিশেষ অলৌকিক তরবারি লাভ করার জন্য এসেছি। ’
সৈনিক টি এবার বললো ‘ তোমার উদ্দেশ্য আমাদের নগরীর পক্ষে হানিকর।তোমায় আমার সাথে যেতে হবে।কাল রাজসভায় তোমার বিচার হবে। এই শক্তিক্ষেত্র নগরীর শাসক কালকেতু তোমার উদ্দেশ্য বিচার করে উপযুক্ত নির্ণয় নেবেন।তার আগে পর্যন্ত তুমি বন্দী হয়ে থাকবে।’
আদিত্য দেখলো এদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে তার অসুবিধা হবে। তার চেয়ে আপাতত বন্দী হওয়া মেনে নেওয়া যাক।কাল ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।
আদিত্য সৈনিক টিকে বললো ‘ আপনি যা সঠিক পদক্ষেপ মনে করবেন তাই করুন।’
সেই মতো সৈনিক টি মুখ দিয়ে শিস্ দেওয়ার শব্দ করলো অমনি আচমকা আদিত্য র চোখের সামনে এক সুদৃশ্য রথের আবির্ভাব হলো।
সৈনিকটি আদিত্য কে নিয়ে রথে চেপে রথ চালিয়ে দিলো।রথ চলেছে। আদিত্য এই সুন্দর নগরীর শোভা দেখতে দেখতে চলেছে।
পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তা ঘাট।সুরম্য প্রাসাদ। সুন্দর সুদৃশ্য বাগান।
অবিলম্বে রথ এসে থামলো এক বিশাল অট্টালিকা র সামনে। আদিত্য বুঝতে পারলো এটাই  রাজপ্রাসাদ।
সেই রাতে আদিত্য র স্থান হলো কারাগারে। যদিও এখানকার কারাগার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।
পরদিন সকালে আদিত্য ছটফট করতে লাগলো কখন মহারাজ কালকেতুর সঙ্গে দেখা হবে এই ভেবে।
মহারাজের দরবারে ডাক পড়লো অপরাহ্ন বেলায়।
কালকের সেই সৈনিকটি নিয়ে গেল মহারাজা র কাছে। আদিত্য মহারাজ কে প্রণাম করল।
মহারাজ কালকেতু বয়স্ক মানুষ। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন উভয়ের দিকে। প্রহরী সৈনিক টি বললো , 'মহারাজ এই যুবক টি ভিনদেশী।কাল নগরে উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে ঘুরছিল দেখে আমি একে আটক করে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। এখন আপনি এর ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নির্ণয় করুন।'
মহারাজ কালকেতু অভিজ্ঞ ব্যাক্তি। তিনি এক ঝলক আদিত্য র সরলতা মাখানো মুখ দেখে বুঝতে পারলেন এই যুবকের থেকে আশঙ্কার কিছু নেই। তিনি ইঙ্গিতে প্রহরী টিকে চলে যেতে বললেন।
প্রহরী চলে গেলে তিনি তার সামনে রাখা বসার আসন দেখিয়ে আদিত্য কে বসতে বললেন। আদিত্য বসলে তিনি বললেন ‘বলো তুমি কে ?আর তোমার আগমনের হেতু কি ?  ’
আদিত্য বললো  ‘আমি সুন্দর গড়ের রাজপুত্র আদিত্য। আমার এক পূর্ব পুরুষ তার গুরুদেবের কাছ থেকে দুইটি অমূল্য সম্পদ লাভ করেছিলেন। সেগুলির প্রথমটি হলো এক অলৌকিক তরবারি আর দ্বিতীয়টি হলো এক মায়া আংটি। ঐ দুটি বস্তুর সাহায্য নিয়ে তিনি বিশাল সুন্দর গড় রাজ্য স্থাপন করেন। ওনার মৃত্যুর পর ওনার গুরুদেব অলৌকিক তরবারি টি এই শক্তিক্ষেত্র নগরীতে লুকিয়ে রাখেন। এবং তিনি নির্দেশ দেন মায়া আংটি টি এই বংশের মহারানী রা বংশ পরম্পরায় ধারণ করবে। এবং যদি কখনো এই বংশের বিপদ উপস্থিত হয় তবে যেন এই বংশের উপযুক্ত সন্তান মায়া আংটি পরে শক্তিক্ষেত্র থেকে অলৌকিক তরবারি উদ্ধার করে। এবং তার সাহায্য নিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পায়। বর্তমানে আমি পিতৃহীন, রাজ্যহীন।মাতা আমার পালনের ভার এক বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী র হাতে দিয়ে বাণপ্রস্থ নিয়েছেন। সেই কর্মচারী আমায় পুত্র স্নেহে মানুষ করেছেন।তাকেই আমি পিতা রূপে জানতাম। কিছুদিন আগে তিনি আমার কাছে আমার প্রকৃত পরিচয় বিবৃত করেছেন। সেই সাথে জানিয়েছেন আমার মা বাণপ্রস্থে যাওয়ার সময় এই মায়া আংটি আমার জন্য দিয়ে আদেশ করেছেন আমি যেন শক্তিক্ষেত্র   হতে অলৌকিক তরবারি উদ্ধার করে পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করি।এটাই আমার আগমনের উদ্দেশ্য। ’
মহারাজ কালকেতু পুরো বক্তব্য মন দিয়ে শুনলেন।
তারপর বললেন , ‘ তুমি যে সত্য কথা বলছো এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। কারণ ঐ  মায়া আংটি না পরিহিত থাকলে তুমি কখনোই নাগরাজ কে হারিয়ে এই দূর্ভেদ্য নগরীতে প্রবেশ করতে পারতে না।কারণ ঐ নাগরাজ কে মায়া আংটি পরিহিত ব্যক্তি ছাড়া কখনো কেউ হারাতে পারবে না এমন আশীর্বাদ ছিল। যাইহোক আমি তোমায় সাহায্য করবো। এই নগরী বিদ্যাধর দের আবাসভূমি। তুমি বিভিন্ন গ্রন্থে ও প্রাচীন পুঁথি তে এই বিদ্যাধর দের কথা শুনে থাকবে। এই নগরীর সব অধিবাসী বিদ্যাধর। আমরা আসলে এই পৃথিবীর প্রাচীনতম অধিবাসী। আমরা জ্ঞান ও সৃজনশীলতায় বর্তমান মানবজাতির চেয়ে অনেক এগিয়ে।আমরাই মানবজাতিকে  ধর্ম , বিজ্ঞান, সংস্কৃতি,সব কিছু শিখিয়েছি। অলৌকিক তরবারি আমার রাজ্যে সুরক্ষিত রয়েছে। তোমার পূর্ব পুরুষের গুরুদেব এই রাজ্যের আমার পূর্ব পুরুষের গুরুদেব ছিলেন। তিনি এক বিশেষ গোপন স্থানে ঐ অসাধারণ ক্ষমতা শালী তরবারি লুকিয়ে রেখেছিলেন। এবং আদেশ দিয়েছেন যে কোনো দিন মায়া আংটি পরিহিত কেউ যদি নাগরাজ কে হারিয়ে এই রাজ্যে প্রবেশ করে তবে আমি যেন তার পূর্ণ সহযোগিতা করি। তুমি আজ বিশ্রাম করো। সেই অলৌকিক তরবারি অতি সুরক্ষিত ভাবে এক গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখা আছে।তা উদ্ধার করতে তোমায় বীরত্ব র সাথে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে।  ’
এই বলে তিনি তালি বাজালে এক অনুচর হাজির হলো। তিনি আদিত্য কে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘যাও এর সাথে ।রাতে রাজকীয় অতিথিশালায় থাকো।কাল খুব প্রভাতে তোমাকে নিয়ে আমি সেই গোপন স্থানে যাবো।’
সেই রাতে উত্তেজনা য় ঘুম আসতে  অনেক দেরি হলেও খুব প্রভাতে ঘুম ভাঙ্গলো আদিত্য র।
আদিত্য মহারাজা কালকেতুর অপেক্ষায় তৈরী হয়ে থাকলো।
কিঞ্চিৎ সময় বাদে মহারাজ এর ডাক এলো।
দুই টি সুন্দর অশ্বে দুজনে  রওয়ানা দিলো। (ক্রমশ)(পরের পর্বে অলৌকিক তরবারি লাভ)

মহারাজ কালকেতু ও আদিত্য উত্তর দিকে রওনা দিলো। মহারাজ কালকেতু আদিত্য কে বললেন ‘ আমি তোমার   থেকে বয়সে অনেক বড়ো।তাই তোমাকে একটা উপদেশ দিচ্ছি। যে মূল্যবান বস্তুটি তুমি উদ্ধার করতে চলেছো তা খুব সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। শুধু মাত্র বীরত্ব প্রদর্শন করে সেটা উদ্ধার করা সম্ভব নয়। বীরত্ব ও বুদ্ধি উভয়ের প্রয়োজন। আমি তোমাকে সেই স্থান পর্যন্ত নিয়ে যাবো যেখানে অলৌকিক তরবারি আছে। তারপর তুমি একাকী যাবে।বস্তুর মধ্যে যে সুক্ষ্ম পরমাণু রয়েছে তা এই অলৌকিক তরবারি র শক্তি র উৎস। তোমরা মানব জাতি হয়তো আরো সহস্র বৎসর পর এই পরমাণু শক্তি ব্যবহার করতে শিখবে। কিন্তু আমরা বিদ্যাধর জনজাতি বহু বছর আগে থেকেই এই পরমাণু শক্তি র শান্তি পূর্ণ ব্যবহার জানি। অলৌকিক তরবারি তুমি পাবে মানে তুমি সেটা ব্যবহার করার অধিকার পাবে। আসলে সেটা যেখানে লুকানো আছে সেখানেই থাকবে। তুমি ব্যবহার করার অধিকার পেলে একটা বিশেষ মন্ত্রের   সাহায্য নিয়ে অলৌকিক তরবারি ব্যবহার করতে পারবে। ’
এই সব কথা বলতে বলতে দুজনে ঘোড়ায় চড়ে এক সুন্দর উপত্যকায় হাজির হলো। সামনে একটি নীল স্বচ্ছ জলের হ্রদ। হ্রদের অপর দিকে এক বিশালাকায় গগনচুম্বী পর্বত।  এক স্থানে আদিত্য দেখলো এক একাকী শিবলিঙ্গ স্থাপিত। সেখানে ঘোড়া থামিয়ে কালকেতু আদিত্যকে বললেন ,‘যাও এই হ্রদের জলে স্নান করে এসো। আমি সঙ্গে করে নতুন বস্ত্র এনেছি। স্নান করে নতুন বস্ত্র পড়ো। অলৌকিক তরবারি লাভ করতে হলে প্রথমে দেহ মন শুদ্ধ করতে হয়।   ’
আদিত্য মহারাজ কালকেতুর কথা মতো স্নান করে নতুন বস্ত্র পরলো। ইতিমধ্যে কালকেতু   কিছু বনফুল সংগ্রহ করে রেখেছেন।
কালকেতু আদেশ করলেন ‘ এই শিবলিঙ্গের পূজা করো।ইনি অলৌকিক তরবারির রক্ষাকারী।এনার দয়া না হলে কেউ অলৌকিক তরবারির দর্শন পায় না।’
আদিত্য কালকেতুর কথামতো শিবলিঙ্গের পূজা করে অলৌকিক তরবারি তাকে প্রদানের আর্জি জানালো।
সব শেষে  কালকেতু তাকে এক খাড়া পাথরের দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে এক বিশেষ মন্ত্র আবৃত্তি করলো। আবৃত্তি শেষ হলে ঘরঘর আওয়াজ করে সামনে পাথরের দেওয়াল হতে এক পাথর সরে গেল।এক গুহা মুখ দেখা গেল। কালকেতু আদিত্য কে বললো এই গুহার মধ্যে রয়েছে তোমার আকাঙ্খিত দ্রব্য। এর পর তোমাকে একা গিয়ে ওটা উদ্ধার করতে হবে ।মায়া আংটি পরিহিত কোন ব্যাক্তি ছাড়া অন্য কেউ এই গুহায় প্রবেশ করলে জীবিত থাকবে না।  যিনি এই অলৌকিক তরবারি লুকিয়ে রেখেছেন তিনি এক বিশেষ সন্দেশ দিয়েছেন তোমার জন্য ।সন্দেশটি হলো ,‘ অলৌকিক তরবারি স্পর্শ করা যায় না। মন যে কোন স্থানে পৌঁছতে পারে। নিজেকে অলৌকিক তরবারিতে রূপান্তরিত করতে হয়। তাহলে অলৌকিক তরবারির সব শক্তি নিজের অস্ত্রেই লাভ হয়।’
কালকেতু বললেন ‘ যাও বৎস, এবার ঐ গুহায় প্রবেশ করো।ঐ গুহার অপর দিকে তোমার এই উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ। তুমি অলৌকিক  তরবারি কেবল মাত্র আত্মরক্ষার ও দুর্বল কে রক্ষা ও প্রজাহিতের জন্য ব্যবহার করবে। এই তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। তবে যদি কখনো আমার প্রয়োজন হয় তবে মায়া আংটির দিকে চেয়ে আমার কথা স্মরণ করবে । আমি তৎক্ষণাত সেকথা জানতে পারবো। এবং তোমার সাহায্য করার জন্য উপস্থিত হবো।’’
আদিত্য মহারাজ কালকেতু কে ভক্তিভরে প্রণাম করে বললো,
' আপনি আমার পিতার ন্যায়। আমি কখনো কোনদিন আপনার এই স্নেহ ভালবাসা ভুলবো না।'
কালকেতু  আদিত্য কে আশীর্বাদ করে কপালে স্নেহ চুম্বন করলেন।
আদিত্য এরপর সেই সরু ছোট গুহামুখ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।
গুহার ভেতরে অন্ধকার। আদিত্য এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। যতক্ষণ না চোখ সয়ে আসে।ক্রমশ চোখ সয়ে এলে আদিত্য লক্ষ্য করলো তীব্র আলো থেকে গুহায় প্রবেশ করে যতো অন্ধকার মনে হচ্ছিল আদৌ তা নয়। বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে। আদিত্য সামনে অগ্রসর হলে একটি দরজা চোখে পড়লো। দরজাটা পাথরের। আদিত্য দরজাটা গায়ের জোর দিয়ে ঠেললো। কিন্তু দরজা খুলল না। আদিত্য অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু কোন কিছুতেই ফল হলো না। এবার মুশকিল। আদিত্য বুঝতে পারছিলো না কি করা উচিত।যে কোন উপায়ে তাকে ভিতরে প্রবেশ করতেই হবে।

আদিত্যর মনে পড়ে গেল রাজকন্যা রত্নমালার সেই যোগিনী ধাইমা র কথা। তিনি বলেছিলেন যদি কখনো ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন হও তবে সেই লাল কাপড়ের টুকরো টি বুকে চেপে ধরে তাকে স্মরণ করতে। আপাতত এই দরজা খোলা আদিত্য র কাছে খুব জরুরি।  কোনো মানুষের পক্ষেই এই দরজা খোলা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এমন কোন কলা কৌশল আছে যার সাহায্যে এই দরজা খুলে যায়। আদিত্য মনস্থির করে নিল। যোগিনী মায়ের কাছে সাহায্য চাওয়া যাক।
আদিত্যর পোশাক এর ভিতর সেই লাল কাপড় টা রাখা আছে। সেটাই বার করে আদিত্য যোগিনী মায়ের কথা স্মরণ করলো। কিছুক্ষণ পর আদিত্য র কানে যোগিনী মায়ের কন্ঠ স্বর ভেসে এলো। যোগিনী মা বললেন ,‘ আদিত্য তুমি আমায় স্মরণ করে সঠিক কাজ করেছো। ঐ গুহায় মায়া আংটি পরিহিত মানুষ ছাড়া কেউ প্রবেশ করলে তৎক্ষনাৎ মৃত্যু হবে।তাই তোমাকে দূর হতেই পরামর্শ দিচ্ছি। এই দরজা কোনো মানুষের পক্ষেই খোলা সম্ভব নয়। কিন্তু তুমি খুলতে পারো। তুমি মায়া আংটি খানা ঐ দরজায় স্পর্শ করে গুহারক্ষক শিবলিঙ্গ স্মরণ করে তিন বার ‘ওঁ নম শিবায়’ বলো। দেখবে দরজা খুলে যাবে। কিন্তু ভিতরে যে বিপদের সম্মুখীন হবে সেখানে একমাত্র তোমার বীরত্ব ,সাহস ও বুদ্ধি কাজে লাগবে। আমি কোন সাহায্য করতে পারবোনা। ’
যোগিনী মার কথা থেমে গেল।
আদিত্য ওনার কথা মতো মায়া আংটি দরজায় স্পর্শ করে গুহারক্ষক শিব কে স্মরণ করে ওঁ নম শিবায় মন্ত্র টি তিন বার বললো।
একটা নীলাভ জ্যোতি আংটি হতে বেরিয়ে পুরো দরজা কে গ্রাস করলো। তারপর দরজাটা খুলে গেল।
আদিত্য খোলা তরবারি হাতে ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই পুনরায় দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। আদিত্য দেখলো এক বিশাল কক্ষ। অপরপ্রান্তে আরো একটি দরজা। যদিও সেই দরজাটা খোলা। কিন্তু দরজার পাশেই যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তাকে দেখে যে কোনো মানুষের বুক শুকিয়ে যাবে।এক বিরাট  একচক্ষু দানব সেই দরজা আগলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দানবের পা দরজার পাশে এক মোটা লোহার শিকল দিয়ে আটকানো। দানবের হাতে একটা পাথরের মুগুর। এই ভয়ঙ্কর দানবকে না হত্যা করে কোন ভাবেই ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করা যাবে না। আদিত্য কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর আদিত্য র মনে হলো
দানব টি চোখে কম দেখতে পায় । আদিত্য অনেকক্ষন এই কক্ষের ভেতর অবস্থান করছে কিন্তু দানব টা তাকে দেখতে পায় নি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আদিত্য এক টুকরো পাথর মেঝে হতে কুড়িয়ে দানবের দিকে ছুঁড়ে দিলো।পাথরের আওয়াজ পেয়ে দানব সেই দিকে মুগুর দিয়ে আঘাত করলো। আদিত্য পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে ঠিক করলো এই দানবকে একবার আঘাত করেই শেষ করতে হবে।আর সে বুঝতে পারলো তার তরবারি দানবের কিছুই করতে পারবে না। দানবের দুর্বল জায়গা হলো তার একমাত্র চোখ। কিন্তু দানবটির উচ্চতা যে কোন মানুষের তিনগুণ। সুতরাং তার চোখে আঘাত করতে হলে আদিত্য কে কোন উচুঁ জায়গায় উঠতে হবে। দানবের ডান দিকে একটা উঁচু পাথরের চাতাল  রয়েছে। সেই পাথরে আদিত্য এক ছুটে উঠে পড়তে পারে। কিন্তু তার আগেই দানব তার পায়ের শব্দ পেয়ে যাবে। আদিত্য হাতে এক টুকরো পাথর নিয়ে দানবের বাঁ দিকে ছুঁড়ে দিলো।দানব বাম দিকে ফিরে যেখানে পাথরটা পড়লো সেখানে মুগুর দিয়ে আঘাত করলো। সেই সুযোগ নিয়ে আদিত্য পাথরের চাতালের উপর উঠে এক রক্ত জল করা হুঙ্কার দিলো দানবের উদ্দেশ্যে।
আদিত্যর হুঙ্কারে চমকে গিয়ে দানব আদিত্য র দিকে ফেরা মাত্র আদিত্য তার শাণিত তরবারি দানবের একমাত্র চোখে আমূল বিদ্ধ করে বার করে নিলো।দানব যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হাতের মুগুর ছেড়ে চোখ চাপা দিয়ে বসে পড়লো। ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো আদিত্য । খোলা তরবারি হাতে লাফ দিয়ে পাথরের চাতাল থেকে নেমে দানবকে পাশ কাটিয়ে এক দৌড়ে খোলা দরজা দিয়ে পরের কক্ষে  ঢুকে পড়লো।
এই কক্ষে ঢুকে আদিত্য র নজরে এলো সেই অলৌকিক তরবারি।
কিন্তু আদিত্য হতাশ হয়ে গেল।
পুরো কক্ষ টি সাদা পাথরের তৈরী।
গুহার পুরো ছাদ সাদা র উপর চকচকে নীল রত্ন আটকানো। ছাদ অনেক উঁচুতে। ছাদের প্রায় কাছে শূন্যে অলৌকিক তরবারি ঝুলে আছে। কক্ষটি শূন্য।এমন কোন কিছু নেই যার সাহায্যে আদিত্য তরবারি হস্তগত করতে পারে। একমাত্র কোন উড়ন্ত পাখি ঐ তরবারি র কাছে পৌঁছাতে পারে।
আদিত্যর নজরে এলো তরবারি র গা বেয়ে এক ফোঁটা করে জল টপটপ করে নীচে পড়ছে।
আদিত্য অনেক ক্ষণ ধরে ভাবতে লাগলো কি ভাবে ঐ তরবারি লাভ করা যায়।তার আচমকা মহারাজ কালকেতুর কথা গুলো স্মরণে এলো। কথা গুলো হলো ,‘ অলৌকিক তরবারি স্পর্শ করা যায় না।  মন যে কোন স্থানে পৌঁছতে পারে। নিজেকে অলৌকিক তরবারিতে রূপান্তরিত করতে হয়। তাহলে অলৌকিক তরবারির সব শক্তি নিজের অস্ত্রেই লাভ হয়।’
আদিত্য বুঝতে পারলো তাকে এবার কি করতে হবে।
আদিত্য অলৌকিক তরবারি র নীচে গিয়ে পদ্মাসনে বসলো। অলৌকিক তরবারি হতে ফোঁটা ফোঁটা জল তার মাথায় পড়তে লাগলো। আদিত্য চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়ে নিজেকে ই অলৌকিক তরবারি ভাবতে লাগলো। এই ভাবে কতটা সময় কেটে গেল তার হিসাব নেই। অনেক ক্ষণ বাদে আদিত্য র মনে হলো তার ডান কর্ণে কেউ যেন একটা মন্ত্র বলছে। আদিত্য মন্ত্র টিকে মুখস্থ করে নিলো।তার অনুভূতি তাকে বলে দিলো সে অলৌকিক তরবারি র শক্তি লাভ করেছে।
এবারে তাকে বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে। মহারাজ কালকেতু বলেছেন যে তার প্রবেশ পথ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে না। তাই সে পুরো কক্ষটি ভালো করে দেখতে লাগলো কোন পথ আছে কিনা।একটু পরে তার চোখে পড়লো একটা পাথরের দরজা। কিন্তু এটা বন্ধ ও প্রায় কক্ষের দেওয়ালের সাথে মিশে আছে তাই এতোক্ষণ বুঝতে পারে নি।
আদিত্য দরজা টিকে খুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পুরো গায়ের জোর লাগানো সত্ত্বেও দরজা খোলা গেল না।
আদিত্য এবার তার তরবারি বার করলো।একটু আগেই শেখা মন্ত্র টি মনে মনে পাঠ করে তরবারি টি পাথরের দরজার দিকে উচিঁয়ে ধরলো।তার তরবারি থেকে একটা ভয়ঙ্কর লাল রশ্মি বের হয়ে পাথরের দরজার গায়ে আঘাত করলো। দরজাটি টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
একটা সুড়ঙ্গ দেখা গেল।
আদিত্য সুড়ঙ্গ দিয়ে এগিয়ে চললো। কিছুটা যাওয়ার পর  এক পাহাড়ের পাদদেশে উপস্থিত হলো।
কিন্তু একি। সামনে তার অশ্ব দাঁড়িয়ে। নাগরাজ তার কথা রেখেছে।তার অশ্ব তার কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
আদিত্য অশ্বের গায়ে মৃদু আদরের চাপড় মেরে বলল ‘আমি সফল হয়েছি রে। এখন আমায় দ্রুত বিজয় গড় নিয়ে চল। সেখানে একাধিক প্রিয় জন আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
এই বলে আদিত্য অশ্বারোহণ করে দ্রুত চললো তার পরিচিত জগতে।
(ক্রমশ)(এরপর পুনরায় বিজয় গড়)


অবিশ্রান্ত ভাবে দু দিন ঘোড়া ছোটাবার পর আজ  দুপুরে প্রথম মানুষের মুখ দেখলো আদিত্য। এই দুই দিনে খাওয়া ও সামান্য সময়ের জন্য বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া বাকি সময় শুধু ই  এগিয়ে চলা। খাওয়া বলতে বনের ফল। এতোক্ষণে একজন মানুষের দেখা পেল আদিত্য। একজন কাঠুরিয়া। জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে এসেছে।তার কাছ থেকে বিজয় গড় কতদূর জিজ্ঞেস করায়  সে বলল ‘তা অনেক দূর বটে।’কোন দিকে প্রশ্ন করায় সে দক্ষিণ দিক নির্দেশ করলো।
আবার এগিয়ে চলা।বেশ কিছুক্ষণ বাদে ছোট ছোট গ্রাম । তারপর বহুদূর থেকে বিজয়গড় রাজবাড়ীর সুউচ্চ তোরণ দূর থেকে দেখতে পেল আদিত্য। দেখা মাত্রই তার মনের অন্দরে ভেসে উঠলো রাজকন্যা  রত্নমালার মিষ্টি হাসি।
বিজয় গড় নগরীতে যখন আদিত্য প্রবেশ করলো তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আদিত্য প্রথমেই রাজবাড়ী গেল না । প্রথমে গেল শূরসেনের বাড়ি। শূরসেনের স্ত্রী ঘরের অলিন্দ থেকে পথের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দূর হতে ঘোড়ায় চড়ে আদিত্য কে আসতে দেখে দ্রুত নেমে বাড়ীর সদর দরজার সামনে দাঁড়ালেন। আদিত্য এসে ঘোড়া থেকে নেমে প্রথমেই মায়ের পদতলে বসে পদধূলি নিলো।শূরসেনের স্ত্রী এতোদিন বাদে পুত্র কে পেয়ে তার কপালে স্নেহ চুম্বন দিলেন। তারপর  দুই জনে গৃহে প্রবেশ করলেন। পরস্পরের কুশল বিনিময়ের পর আদিত্য মাতা কে প্রশ্ন করলো ‘ মাতা , সেনাধ্যক্ষ মহাশয় কোথায় ?’
শূরসেনের স্ত্রী উত্তর দিলেন ,‘ তুমি বোধহয় জানো না আমাদের রাজ্যের সামনে এখন ভয়াবহ বিপদ। খবর এসেছে প্রতিবেশী দুই রাজ্য মালবগড় ও সুন্দর গড় একত্রে আমাদের রাজ্য আক্রমণ করতে চলেছে। তাই মহারাজ ওনাকে ডেকেছেন কিভাবে এই বিপদ থেকে    উদ্ধার পাওয়া যায় তার মন্ত্রণা করার জন্য। ’
আদিত্য সব শুনে বললো ,‘ তাহলে আমায় অনুমতি দিন এখনি মহারাজার দরবারে যাওয়ার। এই বিপদে তার পাশে দাঁড়ানো আমার কর্তব্য।’
শূরসেনের স্ত্রী বললেন ,‘ বেশ যাও তবে রাত্রে বাড়িতে ফিরে আসবে ।যে কয়দিন রাজধানীতে থাকবে আমার কাছে খাওয়া দাওয়া করবে।’
আদিত্য শূরসেনের স্ত্রীর কাছে বিদায় নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে চললো রাজবাড়ী র দিকে। বেশি দূরে নয় । অল্পক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলো রাজবাড়ীর সদর দরজার কাছে। প্রহরীরা আদিত্য কে চিনতে পারলো। আদিত্য একজন প্রহরী কে বললো ‘মহারাজ কে খবর দাও আদিত্য ফিরে এসেছে। মহারাজ এর সাথে দেখা করতে চায়।   ’
একজন প্রহরী মহারাজ কে খবর দিলে তিনি তৎক্ষণাৎ আদিত্য কে মন্ত্রণাগৃহে নিয়ে আসার হুকুম দিলেন।
প্রহরী টি আদিত্য কে  মন্ত্রণাগৃহের কাছে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিলো।
আদিত্য  মন্ত্রণাগৃহে ঢুকে দেখলো , মহারাজ সূর্য সেন ও সেনাধ্যক্ষ শূরসেন দুজনেই চিন্তিত মুখে একটা গালিচায় মুখোমুখি বসে আছেন।
উভয়েই আদিত্য কে দেখে ভারি প্রসন্ন হলেন।  মহারাজ সূর্য সেন আদিত্য কে দেখে বললেন ,‘ এসো আদিত্য আমার পাশে বসো।’
আদিত্য বসলে শূরসেন বললো ,‘ তুমি কি জানো আমরা এক বিপদের সম্মুখীন হয়েছি।’
আদিত্য  শূরসেন কে বললো ,‘ আমি আপনার গৃহ হতে আসছি।মাতার মুখে সব কিছুই শুনেছি। তবু  আপনাদের কাছে আমি বিস্তারিত ভাবে সব তথ্য জানতে চাই। ’
তখন শূরসেন বললেন,‘ বেশ শোনো,  আমাদের এই ছোট রাজ্যের উপর আমাদের  প্রতিবেশী মালব গড় রাজ্যের লোভ দীর্ঘ কালের। এর আগেও তারা আমাদের রাজ্য আক্রমণ করেছিল । কিন্তু আমাদের কুশলী সৈনিক দের সাথে পেরে ওঠেনি। এখন সুন্দর গড় রাজ্যের রাজা দুর্জন সিং এর সাথে হাত মিলিয়ে উভয় রাজা দুই দিক থেকে আমাদের আক্রমণ করবে বলে গুপ্তচর মুখে খবর এসেছে। উভয় রাজাই সসৈন্যে আমাদের রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।এখন আমাদের যা সৈন্য শক্তি আছে তাতে যে কোনো এক জন রাজাকে বাধা দিতে পারবো। যদি সৈন্য গণ কে দুই ভাগ করে উভয় কেই বাধা দিতে যাই তবে পরাজিত হওয়া নিশ্চিত। তাই আমরা ঠিক করেছি সব সৈন্য কে রাজধানীতে একত্রিত করে রাজধানী অবরুদ্ধ করে  বাধা দেবো। ’
আদিত্য খুব ধীর মস্তিষ্কের ছেলে। সবটুকু শোনার পর বললো ,‘ মহারাজ আপনি যদি অনুমতি দেন    এবং সেনাধ্যক্ষ শূরসেন যদি আমার মার্গ দর্শন করেন তবে এই লড়াইয়ে আমি অংশগ্রহণ করতে চাই। আমি আমার  লক্ষ্য পূরণে সফল হয়েছি। আমি অলৌকিক তরবারির অধিকারী হতে পেরেছি। মহারাজ আপনি পূর্বে আমার পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম যে আমার লক্ষ্য পূরণ হলে বলবো। আমি আসলে ক্ষত্রিয় সন্তান। আমার পিতা হলেন সুন্দর গড়ের প্রয়াত মহারাজা প্রতাপাদিত্য দেব, মাতা হলেন মহারানী পদ্মাবতী। আপনারা আমায় সুযোগ দিন যাতে আমি আমার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারি।  ’
এই কথা শুনে শূরসেন আবেগের সাথে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো ‘ তুমি মহারাজ প্রতাপাদিত্য র পুত্র। তোমার পিতা আমার কাছে সহোদর ভাইয়ের মতো ছিলো। তাদের সেই স্নেহ আজো আমার স্মৃতিতে অম্লান।   ’
শূরসেন আদিত্য কে জড়িয়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন।
কিছু ক্ষণ পর আবেগ একটু স্তিমিত হলে শূরসেন বললেন ‘ তুমি আজ হতে আমার পরম আত্মীয়। তুমি আমার পুত্র সম। তুমি এই যুদ্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দান করো। ’
আদিত্য বললো ,‘ তা হয় না। আমি এই যুদ্ধে আপনার নেতৃত্বে লড়তে চাই। তা ছাড়া আমি এই রাজ্যের অধিবাসী নই। অন্য  সেনাধ্যক্ষ রা অসন্তোষ জানাতে পারেন। আপনি ঠিক এই মুহূর্তে শত্রু সৈন্য র অবস্থান আমাকে নির্দিষ্ট করে বলুন ’
মহারাজ সূর্য সেন এবার মুখ খুললেন ,‘ গুপ্ত চর মুখে খবর এসেছে যে দুর্জন সিং তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে আমাদের রাজ্য অভিমুখে সবে রওয়ানা দিয়েছেন।তার  এই রাজ্যে প্রবেশ করতে প্রায় বারো দিন লাগবে। তবে প্রবাল নারায়ণ এই রাজ্যের সীমান্ত অতিক্রম করে অনেকটা ভিতরে ঢুকে পড়েছে। আগামী পরশু সে রাজধানী বিজয় গড় কে ঘিরে থাকা বিজয় গিরি পাহাড়ের সরু গিরিপথে প্রবেশ করবে। আর ঐ গিরিপথ পার  হলেই রাজধানী এক দিনের পথ মাত্র।'
আদিত্য বললো ‘ মহারাজ আপনি আমাকে বাছাই করা পাঁচশত সৈন্য দিন। বাকি সৈন্য রা রাজধানীতে অবস্থান করুক । আমি আপনাকে কথা দিলাম যে কোনো মূল্যে আমি আমার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবো। প্রবাল নারায়ণের বিনাশ করবো।’
সূর্য সেন বললেন ‘ বেশ এই চরম বিপদের দিনে  যদি তুমি আমাকে ও আমার প্রিয় প্রজাদের রক্ষা করো তবে তোমাকে আমি তোমার পিতৃরাজ্য ফিরে পেতে সাহায্য করবো। তুমি কাল প্রভাতে পাঁচশত সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ যাত্রা করো। ঈশ্বর তোমার সহায় হোন। ’

রাজার মন্ত্রণাগৃহ থেকে সবে বাইরে এসেছে এমন সময় এক  অস্ফুট স্বর ভেসে এলো ‘কুমার।’
আদিত্য চেয়ে দেখলো রাজকন্যা র  সহচরী। শূরসেন ও মহারাজ এখনো মন্ত্রণাগৃহে আলোচনা রত। সহচরী বললো‘ কুমার , রাজকন্যা রত্নমালা অধীর আগ্রহে উদ্যানে আপনার জন্য অপেক্ষায় আছেন। ’

উদ্যানের এক প্রান্তে এক ছোট্ট সরোবর। সেই সরোবরের এক সোপানে বসে রাজকন্যা রত্নমালা গভীর চিন্তামগ্ন ছিল। সহচরী দূর হতে রাজকন্যা কে দেখিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো। আদিত্য রাজকন্যা র কাছে গিয়ে প্রথমবারের র জন্য মৃদু স্বরে ডাকলো ‘রত্নমালা।’
রত্নমালা মরালের ন্যায় ঘাড় ঘুরিয়ে আদিত্য কে চোখের কোণ দিয়ে দেখে বললো ‘কুমার মনে হয় এই অভাগিনী কে ভুলেই গেছেন। সেটাই স্বাভাবিক।’
আদিত্য রাজকন্যা র পাশাপাশি বসে বললো‘ যার অবস্থান আমার বক্ষে তাকে ভুলে থাকা যায় না। আজকেই বিজয়গড়ে ফিরেছি।এসেই শত্রুর আক্রমণ আসন্ন শুনে মহারাজের কাছে   এসেছিলাম। মহারাজের অনুমতিক্রমে আগামী কাল প্রভাতেই যুদ্ধ যাত্রা করবো। তোমার সাথে দেখা করার জন্য মনটা ছটফট করছিলো। মনে মনে ভাবছিলাম কিভাবে তোমার দেখা পাওয়া যায়। তুমি ডেকে পাঠালে দেখে খুশি হয়েছি।।রত্নমালা এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারলে তোমার পিতা কথা দিয়েছেন তিনি আমার পিতৃরাজ্য উদ্ধারে আমার পাশে থাকবেন।’
রত্নমালা বললো ‘ আর আমি সারাজীবন তোমার পাশে থাকতে চাই।’
এরপর আকাশের চাঁদ মাঝআকাশে যাওয়া পর্যন্ত অনেক কথা হলো।
রাতে আদিত্য ফিরে দেখলো শূরসেনের স্ত্রী খাবার নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। আদিত্য খেতে খেতে বললো‘ মা সেনাধ্যক্ষ মহাশয় খেয়েছেন ?’
শূরসেনের স্ত্রী বললো‘ তিনি খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। তুমি ও শুয়ে পড়ো কাল খুব প্রাতে তোমাদের উভয়কেই ডেকে দেবো।’
পরদিন সকালে রাজপ্রাসাদের সামনের ময়দানে পাঁচশত সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে । তাদের সামনে মহারাজ সূর্য সেন,শূরসেন ও আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে। মহারাজ বললেন 'শত্রুরা আমাদের রাজ্যের দোরগোড়ায় উপস্থিত।হে আমার বীর সৈনিক গণ এখন তোমাদের স্কন্ধে এক গুরুদায়িত্ব যে কোন মূল্যে এই মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার। এই তরুণ যুবক আজ হতে তোমাদের 'নায়ক' পদে অভিষিক্ত করলাম ।এর প্রতিটি আদেশ আমার আদেশ মনে করে মান্য করবে।'
আদিত্য এবার তার সামনে থাকা সৈনিক দের উদ্দেশ্যে বললো ‘ হে আমার প্রিয় বীর সেনানী গণ , এই গুরুতর বিপদের দিনে আমাদের স্কন্ধে দায়িত্ব পড়েছে বিজয় গিরির সরু গিরিখাতে মালবগড়ের রাজা প্রবাল নারায়ণ কে বিনাশ করবার।আর আমরা তা করে দেখিয়ে দেবো।’
সৈন্য রা সোল্লাসে চিৎকার করে বললো‘ জয় বিজয়গড়ের জয়,জয় মহারাজ সূর্য সেনের জয়।’
আদিত্য এবার সব সৈন্য কে আদেশ করলো সবাই পরস্পরের হাত স্পর্শ করার।
সবাই একে অপরের হাত ধরলে আদিত্য তার সম্মুখস্থ এক সৈনিকের কপালে তার মায়া আংটি স্পর্শ করে মনে মনে অলৌকিক তরবারির রক্ষক শিবলিঙ্গ কে স্মরণ করে ধ্যানে পাওয়া অলৌকিক তরবারি সক্রিয় করার মন্ত্র টি পাঠ করলো। মায়া আংটি নীলাভ হয়ে ঝলসে উঠলো।
এক  নীলাভ রশ্মির বন্যা বয়ে গেল সকলের মধ্যে দিয়ে।সকল সৈন্য র গা থেকে নীল রশ্মি ঠিকরে বেরোতে লাগলো।
আদিত্য এবার ঘুরে মহারাজ কে বললো ‘ আমায় এবার যাত্রা শুরু করার অনুমতি দিন।’
মহারাজ সম্মতি সূচক মাথা নাড়লে সকলে ঘোড়ার পিঠে চড়ে রওয়ানা দিলো।


কয়েক প্রহরের ভিতর আদিত্য নগর ছাড়িয়ে  বিজয় গিরির সরু গিরিপথের মূখে পৌঁছে গেলো।

আদিত্য দেখলো ,এক সরু পথ। দুই পাশে খাড়া পাহাড় যা চড়া যে কোন বাহিনী র পক্ষে কষ্টকর।
আদিত্য তার পাঁচশত সৈন্য কে দুই ভাগে ভাগ করলো। প্রথম ভাগে একশত সৈন্য। তাদের দায়িত্ব দেওয়া হ‌লো তারা গিরিপথের দুই পাশের চূড়ায় উঠে বিভিন্ন মাপের পাথর সংগ্রহ করে লুকিয়ে থাকবে ।আর আদিত্য বাকি চারশো সৈন্য নিয়ে লুকিয়ে থাকবে। শত্রুরা এলে আদিত্য উপযুক্ত সময় দেখে পতাকা সংকেত দেখাবে। তখন উপরে লুকিয়ে থাকা সৈন্য রা  শত্রুর উপর পাথর বর্ষণ করবে।
পাথর বর্ষণ শেষ হওয়া মাত্রই আদিত্য সবাইকে নিয়ে গিরিপথের এক মুখ দিয়ে আক্রমন করবে।
সারা দিন শত্রুর জন্য অপেক্ষা করলেও সেই দিন শত্রু রা এলো না। শত্রু সৈন্য  নিশ্চিন্ত ছিল যে ছোট বিজয়গড়ের পক্ষে এই বিরাট বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস হবে না।
পুরো বাহিনী যখন বিরাট সাপের মতো ঐ সরু গিরিপথ দিয়ে ঢুকে পড়েছে তখন ওপরে চূড়ায় অবস্থিত বিজয়গড়ের সৈনিক রা দেখলো আদিত্য এক পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে এক বিরাট লাল পতাকা আন্দোলিত করছে। অমনি সংকেত পাওয়া মাত্র শুরু হয়ে গেল বৃষ্টির মতো পাথর পড়া। পাথরের আঘাত পেয়ে মালব গড়ের সৈন্য রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো।রণহস্তী গুলো দৌড়াদৌড়ি করে নিজেদের বাহিনীর লোকেদের পিষ্ট করতে লাগলো। ঘোড়া গুলো চঞ্চল হয়ে পৃষ্ঠে সওয়ার নিয়েই উল্টো দিকে দৌড় দিল।
পাথর বৃষ্টি বন্ধ হওয়া মাত্রই আদিত্য অলৌকিক তরবারি জাগানিয়া মন্ত্র পাঠ করে চিৎকার করে আদেশ দিলো "আক্রমণ"।
মালবগড়ের সৈন্যরা শুধু দেখতে পেলো এক নীল ঘুর্নিঝড় এগিয়ে আসছে ।আর তার সামনে এক অস্ত্র ধারী যুবক। যুবকের হাতের তরবারি প্রতি মূহুর্তে হালকা লাল থেকে গাঢ় লাল হচ্ছে। আদিত্য তার ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো মালবগড়ের সৈন্য দের উপর।তার ও তার সৈনিক দের অস্ত্র দ্রুত শেষ করে দিতে লাগল বিপক্ষ বাহিনী কে। আদিত্যর হাতের অস্ত্র দ্রুত উত্তপ্ত হতে লাগলো অতি অল্প ক্ষণের মধ্যে ই অস্ত্রের তাপ চরম মাত্রায় পৌঁছে ঝলসিয়ে , পুড়িয়ে দিতে লাগলো শত্রু দের।যে কয়টি সৈন্য সাহস করে বাধা দিতে এসেছিলো প্রত্যেকেই হয় তরবারির আঘাতে নয়তো পুড়ে মারা গেলো।এক আতঙ্কের সৃষ্টি হলো মালবগড়ের সেনাবাহিনীর মধ্যে।সবাই পালাতে লাগলো।বিজয়গড়ের সৈন্য রা জয়ধ্বনি দিতে শুরু করেছে।
এমন সময় এক কন্ঠস্বর বলে উঠলো ‘যদি প্রকৃত বীর পুরুষ হও তবে অলৌকিক শক্তির ভরসা না করে সাধারণ যোদ্ধা হয়ে আমার মোকাবিলা করো।’
আদিত্য মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে মালবগড়ের রাজা প্রবালনারায়ণ।

আদিত্য বললো ‘ বেশ তবে তাই হোক।আজ পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবোই।’
প্রবালনারায়ণ বলল‘ আমি কিভাবে তোমার পিতৃহত্যার কারণ হতে পারি ? কে তোমার পিতা ?’
আদিত্য বললো ‘ মনে পড়ে সুন্দর গড়ের মহারাজ প্রতাপাদিত্য কে। আমি তার পুত্র।’
প্রবাল নারায়ণ বললো‘ বেশ তবে তোমাকেও আজ তোমার পিতার নিকট পৌঁছে দেবো।’
তারপর শুরু হলো এক অসাধারণ অসিযুদ্ধ। উভয়েই তরবারি চালনায় দক্ষ। বিদ্যুৎ গতিতে একে অপরকে তরবারি দিয়ে আঘাত হানছে আর অন্য জন দ্রুত প্রতিহত করছে। কিন্তু আজ ভাগ্য ন্যায়ের পক্ষে।একটু পরেই প্রবাল নারায়ণ এর তরবারি ছিটকে পড়লো। তৎক্ষণাৎ আদিত্য র তরবারি বিদ্ধ হলো প্রবাল নারায়ণের বক্ষে।

প্রবাল নারায়ণের মৃত্যুর সাথে সাথেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলো।মালবগড়ের কয়েকটি সেনাধ্যক্ষ এগিয়ে এলো আদিত্য র সামনে। নতজানু হয়ে নিজেদের তরবারি রেখে দিলো আদিত্য র পদপ্রান্তে।
এক বয়স্ক সেনাধ্যক্ষ বললো ‘ হে বীর আপনি আমাদের মহারাজ কে পরাজিত করেছেন। আমাদের মহারাজ এর কোন সন্তান বা উত্তরাধিকারী নেই।তাই  ন্যায় যুদ্ধের নিয়মানুযায়ী আপনি আজ হতে আমাদের রাজা। সম্পূর্ণ মালবগড়ের প্রজাবর্গ ও সেনাবাহিনীর পক্ষ হতে আমরা আপনার আনুগত্য স্বীকার করছি। আপনি চলুন আমাদের সাথে সেখানে আপনার রাজ্যাভিষেক হবে।’
আদিত্য বললো ‘ঠিক আছে ।আজ থেকে আমি আপনাদের দায়ভার গ্রহণ করলাম । কিন্তু এখনি আমি মালবগড় যেতে পারবো না আরো কিছু কাজ বাকি। মূল সৈন্যবাহিনী মালব গড় ফিরে যাক।আপনারা কিছু জন  আমার সঙ্গে বিজয় আসুন।’
সেনাধ্যক্ষ রা বললো ‘যথা আজ্ঞা মহারাজ।   ’
এরপর উভয় পক্ষের মিলিত সেনাবাহিনী এগিয়ে চললো বিজয় গড়ের দিকে।আরো এক শত্রু বিনাশ বাকি আছে। (ক্রমশ)


(এরপর অন্তিম পর্ব)

প্রবাল নারায়ণের মৃত্যুর খবর বিজয়গড়ে আদিত্যরা পৌঁছবার পূর্বে ই এসে গেল। আদিত্য যুদ্ধ জয়ের খবর দিয়ে একজন সৈন্য পূর্বেই বিজয় গড়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।

সদলবলে বিজয় গড়ে পৌঁছানোর পর আদিত্য দূর হতেই দেখতে পেলো মহারাজ সূর্য সেন ,শূরসেন আরো অনেকে রাজপ্রাসাদের বহিঃ তোরণের  কাছে সংবর্ধনা জানাতে এসে দাঁড়িয়েছেন।
মহারাজ সূর্য সেন এগিয়ে এসে বললেন ‘ মালবগড়ের নতুন মহারাজা কে স্বাগতম।’
আদিত্য সকলের প্রশংসায় কিঞ্চিত বিড়ম্বনায় পড়লো।
সব শেষে আদিত্য বললো ‘আমি নতুন কিছু করি নি , যা করেছি তা আমার কর্তব্য বোধ থেকেই করেছি।দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন এটাই শিখেছি।আপনারা আমায় আর্শীরবাদ করুন আমি যেন আমার কর্তব্যে অবিচল থাকতে পারি।   ’
মহারাজ সূর্য সেন বললেন ‘ আদিত্য তুমি আমার পুত্র স্বরূপ।আজ এই দূর্দিনের দিনে তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছো এই ঋণ অপরিশোধ্য । তবু আমি তোমাকে কিছু উপহার দিতে চাই।বলো তুমি আমার কাছে কি চাও ?’
আদিত্য ঈষৎ হেসে বলল ‘ মহারাজ যদি এমন কিছু চাই যা আপনার প্রাণাধিক প্রিয় , তবে আপনি কি তা আমার হাতে দেবেন ?’
সূর্য সেন বললো ‘ তুমি নিঃসংকোচে আমার কাছে কি চাও বলো। আমি নিশ্চয়ই তা তোমাকে দেবো।’
আদিত্য বললো ‘ মহারাজ আমি যখন আপনার কাছে এসেছিলাম  অতি সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে। আপনার দয়ায় আমি আজ এক ভূখন্ডে র রাজা হয়েছি। আপনার আশীর্বাদ থাকলে আমি নিশ্চিত আমার পিতার ন্যায় প্রজাবৎসল ও ন্যায় পরায়ন হতে পারবো। আমি আমার জীবনের এই সন্ধিক্ষণে আপনার কন্যা রাজকন্যা রত্নমালা কে সহধর্মিণী করে পেতে চাই। রাজকন্যা এই বিবাহে অরাজী হবেন না। ’
মহারাজ সূর্য সেন বললো ‘ পুত্র , আমি বৃদ্ধ হয়েছি ঠিকই কিন্তু  আমার কন্যার মনের ইচ্ছা অজ্ঞাত নই। তুমি যদি রাজা নাও হতে তবু ও আমি আমার কন্যা তোমার হাতে তুলে দিতাম ।কারণ তোমার মতো বীর যোদ্ধা আমার জামাতা হওয়ার উপযুক্ত। তোমাদের দুজনের বিবাহে আমার পূর্ণ সম্মতি আছে। আপাতত এই আসন্য যুদ্ধে র  পর আমি তোমাদের বিবাহের আয়োজন করবো। ’
আদিত্য এবার মালবগড়ের সেনাধ্যক্ষ দের সাথে মহারাজের পরিচয় করিয়ে দিলো। মহারাজ সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘আপনাদের সকলকে বিজয়গড়ে স্বাগত। এই যুদ্ধ আমরা চাই নি তবুও পাকেচক্রে আমরা এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি।প্রথমত লোভী অত্যাচারীর শাস্তি দিতে হবে।দ্বীতিয়ত সুন্দর গড়ের প্রয়াত মহারাজা প্রতাপাদিত্য র পুত্র রাজকুমার ও বর্তমানে মালবগড়ের রাজা আদিত্য কে তার পিতৃরাজ্য ফিরিয়ে দিতে হবে। আমি আপনাদের সকলের সহযোগীতা কামনা করছি। ’
উপস্থিত সকলে একসাথে বলে উঠল‘ আমরা সকলেই এই কাজে আপনার সহযোগিতা করবো।’
দিনকয়েক পর এক ভোরে খবর এলো দুর্জন সিং তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে বিজয় গড়ের সীমান্তে হাজির হয়েছ।
সেই দিন রাজার মন্ত্রণাগৃহে আলোচনা সভা বসলো যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে।
উপস্থিত শূরসেন, মহারাজ সূর্য সেন, আদিত্য, ও মালবগড়ের এক বয়স্ক সেনাধ্যক্ষ মঙ্গল সিং।
শূরসেন বললো " শত্রু এই মুহূর্তে রাজ্যের সীমান্তে অবস্থান করছে। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কোথায় ওদের বাধা দেবো। সুন্দর গড় বড় রাজ্য । ওদের সৈন্য সংখ্যা আমাদের দ্বিগুণ। প্রায় দুই লক্ষাধিক। সেক্ষেত্রে আমাদের সৈন্য সংখ্যা সর্বোচ্চ এক লক্ষ। যদি মালব গড়ের সৈন্য বাহিনী আমাদের সাহায্য করে তবুও তাদের সৈন্য মিলিয়ে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সৈন্য হবে । দ্বীতিয়ত ,ওরা রাজ্যের যে সীমান্ত দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তা মূলত সমভূমি। সমভূমি তে যুদ্ধ জয় সৈন্য সংখ্যা র ওপর নির্ভর করে। এখন আমাদের সকলে স্থির করতে হবে কোন কৌশল অবলম্বন করলে শত্রু বিনাশ সম্ভব।"
শূরসেন থামলে মহারাজ সূর্য সেন বললো ‘ ওরা রাজ্যের ভিতরে আরো কিছুটা অগ্রসর হওয়ার আগেই ওদের বাধা দিতে হবে। আমার মাথায় কোন সম্ভাবনা আসছে না। আদিত্য তুমি বলো কি ভাবে এই বিপদের মোকাবিলা করতে পারি।’
আদিত্য বললো ,‘ আমি আপনাদের আশঙ্কা অনুভব করছি। তবে আমি কিছু আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। একথা ঠিক  ওদের সৈন্য সংখ্যা বেশি। কিন্তু মনে রাখতে হবে আমাদের সম্মিলিত দেড় লক্ষ সৈন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈন্য।তারা প্রতিদিন যুদ্ধঅভ্যাস করে থাকে। প্রতিটি সৈন্য অন্য যেকোনো রাজ্যের সৈন্য অপেক্ষা দ্বিগুণ শক্তিশালী। উল্টো দিকে সুন্দর গড়ের সৈন্য  দুই লক্ষ হলেও তার মধ্যে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য সংগ্রহ করা অথবা জোর পূর্বক ধরে নিয়ে আসা প্রজা ও খনি শ্রমিক। তাদের অস্ত্র শিক্ষা সামান্য।ঐ প্রজা বর্গ দুর্জন সিং কে রাজা হিসেবে পছন্দ করে না। আমাদের গুপ্তচর বাহিনী খুব কৌশলে যদি তাদের মধ্যে প্রচার করে যে আমি প্রয়াত মহারাজ প্রতাপাদিত্য র সন্তান আদিত্য দেব , তবে নিশ্চিত অধিকাংশ প্রজাবর্গ পালিয়ে এসে আমার সৈন্য বাহিনীতে যোগ দেবে।  দ্বিতীয় ত যে অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে ওদের আসতে হবে তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো খরস্রোতা নদী সুবলা।সুবলা নদীর যে কোন জায়গা দিয়ে রথ , রণহস্তী, ও অন্যান্য যুদ্ধের রসদবাহী শকট নিয়ে পার হওয়া যাবে না।সুবলা নদী পার হতে পারা যায় কেবলমাত্র অরিদমন গ্রামের কাছে। অরিদমন গ্রামের দুই দিকে ঘন জঙ্গল রয়েছে।যা বিদেশি দের কাছে অগম্য। তবে আমরা স্থানীয় বাসিন্দারা জানি ঐ জঙ্গলে কোন স্থানে সৈন্য নিয়ে লুকিয়ে থাকা  যায়। আমাদের সম্মিলিত দেড় লক্ষ সৈন্য র মধ্যে এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে আমি ওদের আশার পূর্বেই অরিদমন গ্রামের প্রান্তে অবস্থান করবো। বাকি পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের মধ্যে পঁচিশ হাজার সৈন্য নিয়ে মঙ্গল সিং বাম পাশের জঙ্গলে ও বাকি পঁচিশ হাজার সৈন্য নিয়ে শূরসেন ডান দিকের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকবে শত্রু এলে প্রথমে আমি বাধা দেবো । যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমার সৈন্য দের পক্ষ হতে তিনবার জয়ঢাক বাজিয়ে সঙ্কেত প্রদান করলে আপনারা উভয়ে এক সাথে জঙ্গল হতে সসৈন্যে বেরিয়ে শত্রুর দুই পার্শ্বে আক্রমণ করবেন। তিন দিক থেকে আক্রান্ত হলে  শত্রুর দিশেহারা অবস্থা সৃষ্টি হবে । আমার সৈন্য বাহিনী মাতৃভূমি রক্ষার জন্য মরিয়া।অন্য দিকে শত্রু সৈন্য অন্যের ভূমিতে একটু হলেও আড়ষ্ট ভাবে থাকবে। তাদের আড়ষ্টতা কাটিয়ে ওঠার আগেই তারা দেখবে তারা তিনদিক হতে আক্রান্ত। তাদের মনোবল তখন তলানীতে অবস্থান করবে। পরাজয় তাদের নিশ্চিত। ’
আদিত্য তার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করলে সবাই নীরবে তা হৃদয়ে গেঁথে নিচ্ছিল।সবার প্রথমে মঙ্গল সিং বলে উঠলো ‘ অসাধারণ, অসাধারণ আপনার পরিকল্পনা। আমি গর্বিত আপনার অধীনে যুদ্ধ করতে পারবো এই ভেবে।’
এবার শূরসেন ও মহারাজ সূর্য সেন উভয়েই এই পরিকল্পনায় সম্মতি দিলেন।


সেই মতই সম্মিলিত বাহিনী কে তিন ভাগ করা হলো দুই ভাগ সৈন্য নিয়ে গোপনে মঙ্গল সিং ও শূরসেন আলাদা আলাদা ভাবে রওয়ানা দিলো। গোপনীয়তা প্রয়োজনীয়।কারণ কোথায় শত্রুর গুপ্ত চর ওৎ পেতে আছে ঠিক নেই।
আদিত্য বাকি সৈন্য নিয়ে অরিদমন গ্রামে শিবির তৈরি করে অবস্থান করলো। কিছু অল্প সৈন্য নিয়ে মহারাজ সূর্য সেন রাজধানীতে রইলো।
শত্রু এলো সপ্তম দিন বিকালে। শত্রু রা আশা করেনি যে বিজয় গড়ের সৈন্য রা সুবলা নদী পার করার জায়গা আটকে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। তারা বুঝলো আসল লড়াই এখানেই হবে। এদিকে শত্রুর দুই পাশের জঙ্গলে মঙ্গল সিং ও শূরসেন নিজের নিজের বাহিনী নিয়ে গোপনে লুকিয়ে রইলো। কোনো অবস্থায় শত্রু সৈন্য কে বুঝতে দেওয়া যাবে না তারা তিন দিক থেকে অবরুদ্ধ।
লড়াই শুরু পরদিন সকালে। শুরু তেই আদিত্য তার সব সৈন্য কে পরস্পরের হাত ধরে রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষার শপথ নিতে বললো। সকলে হাত ধরলে আদিত্য তাদের স্পর্শ করে মায়া আংটি ও অলৌকিক তরবারি জাগানিয়া মন্ত্র পাঠ করলো। আদিত্যর সব সৈন্য মায়া আংটির সুরক্ষা বলয় দিয়ে ঘেরা রইলো। এদিকে গুপ্ত চর বাহিনীর কৌশলী প্রচারে প্রভাবিত হয়ে  অনেক প্রয়াত রাজা প্রতাপাদিত্য র সন্তানের সমর্থন করে বাহিনী হতে পালিয়ে গেল।
মহারাজ দুর্জন সিং এর কাছে খবর গেলো যে প্রজা ও শ্রমিক দের নিয়ে যে অস্থায়ী বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল তাদের অধিকাংশই পালিয়ে গেছে।আর বাকিরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি করছে। দুর্জন সিং দাঁত কিড়মিড় করে বললো ‘ বিদ্রোহ। ঠিক আছে যুদ্ধ শেষ হোক প্রতিটি বিদ্রোহী কে মৃত্যু দন্ড দেবো।’
আদিত্য ঠিক করলো সেই প্রথম আক্রমণ করবে। রক্ষণাত্মক না থেকে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিলে শত্রু হতচকিত হবে।
যা ভাবা তাই কাজ। দুর্জন সিং কল্পনাতেও আনেন নি যে উল্টে তারা আক্রান্ত হবে। পুরোদস্তর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। দুই পক্ষই এখন সমান শক্তিশালী। কিন্তু আদিত্য র অলৌকিক তরবারি ফারাক গড়ে দিতে লাগলো। সুন্দর গড়ের সৈন্য রা আদিত্য র বিক্রমে কচুকাটা হতে লাগলো। তরবারি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ভয়াবহ বিকিরণ ছড়িয়ে দিতে লাগল। বহু শত্রু সৈন্য উত্তাপে পুড়ে মারা গেলো।এক হাহাকার অবস্থা সৃষ্টি হলো শত্রুর মধ্যে। এই সময়ে আদিত্য র নির্দেশে বাহিনীর পক্ষ হতে জয়ঢাক বাজিয়ে জঙ্গলে অবস্থিত শূরসেনের ও মঙ্গল সিং এর বাহিনী কে সঙ্কেত করা হলো। সাথে সাথেই উভয় বাহিনী ‘ জয় শিব শম্ভু ’ধ্বনি দিতে দিতে উভয় দিক থেকেই আক্রমণ করলো । সামনে ভয়াবহ অলৌকিক তরবারি হাতে আদিত্য র বিশাল বাহিনী আর দুই পাশ হতে আক্রান্ত হয়ে শত্রু সৈন্য অনুভব করলো পরাজয় আজ নিশ্চিত। অবিলম্বে শত্রু রা পালাতে লাগল।আর এই পালানো ক্রমশ সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হলো।সবাই পালাতে লাগল।
শত্রু সৈন্য যতো কমছে বিজয় গড়ের সম্মিলিত বাহিনী ততো নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে লাগলো।
দুর্জন সিং ধুরন্ধর লোক। তিনি দ্রুত বুঝতে পারলেন তিনি হারতে চলেছেন। তিনি অল্প কিছু বিশ্বস্ত সৈন্য নিয়ে নিজের রাজ্য সুন্দর গড়ের অভিমূখে পালিয়ে গেলেন।
সম্মিলিত বাহিনী বিজয়ের  উৎসব পালন করতে লাগলো। এই বিজয়োল্লাস স্তিমিত হওয়ার আগেই  সব সেনাধ্যক্ষ দের নিয়ে আদিত্য আলোচনা করতে বসলো। আলোচনা য় স্থির হলো আদিত্য র পক্ষে এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। দুর্জন সিং  গুছিয়ে ওঠার আগেই ওকে ধাওয়া করে শেষ করে দিতে হবে।
সুতরাং আদিত্য ও শূরসেন পঞ্চাশ হাজার ঘোড় সওয়ার নিয়ে দুর্জন সিং এর পশ্চাতধাবন করলো।আর মঙ্গল সিং বাকি সৈন্য নিয়ে পায়ে হেঁটে সুন্দর গড়ে র দিকে এগিয়ে চললো।
ঠিক হলো আদিত্য যদি রাস্তায় দুর্জন সিং এর দেখা না পায় তবে ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে রাজপ্রাসাদ অবরোধ করবে।আর মঙ্গল সিং বাকি বাহিনী নিয়ে তার সাথে যোগ দেবে।
পথে দুর্জন সিং এর দেখা পাওয়া গেল না। আদিত্য দ্রুত ধাওয়া করে রাস্তায় দুর্জন সিং কে না ধরতে পেরে রাজপ্রাসাদ অবরোধ করলো। এদিকে সুন্দর গড় রাজ্যের প্রজারা দুর্জন সিং এর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলো।তারা যখন জানতে পারলো তাদের পূর্বতন রাজার পুত্র আদিত্য , তখন তারা দলে দলে আদিত্য র বাহিনী তে যোগ দিলো। তাদের খাদ্য পানীয় দিয়ে সাহায্য করতে লাগলো।
মঙ্গল সিং বাকি সৈন্য বাহিনী নিয়ে আদিত্য র সাথে যোগ দিলো। এক ভয়ঙ্কর অন্তিম লড়াইয়ে র প্রস্তুতি শুরু হলো।
এদিকে দুর্জন সিং তার বিশ্বস্ত বাহিনী নিয়ে দুর্গ রক্ষা র প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজপ্রাসাদে র চওড়া প্রাচীরে ধানুকিরা তীর ধনুকে যোজন করে সতর্ক দৃষ্টি তে প্রহরারত রইলো।গরম তৈল নিয়ে কিছু সৈন্য অপেক্ষায় রইলো। বাকি সৈন্য রা বিশাল রাজ প্রাসাদের প্রবেশ পথ রক্ষা করে ব্যূহ রচনা করে অবস্থান করলো।
আদিত্য সকলের সাথে আলোচনা করছিলো সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে কিভাবে রাজপ্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করা যায়। কিন্তু কোন কূল খুঁজে পাচ্ছিলো না।এমন সময় তার দেহরক্ষী এক সৈনিক এসে বললো এক বৃদ্ধ তার সাথেই দেখা করতে চায় । আদিত্য তাকে তার সামনে আনতে বললো।
সেই বৃদ্ধ এলে আদিত্য তাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। তারপর তার পদধূলি মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করলো।
বৃদ্ধ টি হলো আদিত্য র অস্ত্র শিক্ষা গুরু রঘুবর।
আদিত্য রঘুবরকে উপযুক্ত আসন প্রদান ও সম্মান প্রদর্শন করে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।সকলেই রঘুবরকে সম্মান জানালো।
আদিত্য গুরু রঘুবর কে সব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে কি উপায়ে রাজপ্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করা যায় জানতে চাইলো।
রঘুবর বললো ‘ বৎস , উপায় আছে।এক গোপন সুড়ঙ্গ আছে যেখান দিয়ে তুমি অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে অলৌকিক তরবারি র সাহায্য নিয়ে ভিতর দিক থেকে প্রাসাদের প্রবেশ পথ আক্রমণ করবে।আর  বাকিরা সামনে থেকে আক্রমণ করবো। তুমি প্রবেশ পথ রক্ষা কারী সৈন্য দের পরাস্ত করে প্রবেশ পথ খুলে দেবে। তারপর সম্মিলিত বাহিনী জলস্রোতের মতো রাজপ্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করে প্রাসাদ দখল করবে।কাল পূর্ণিমা।কাল ভোর রাতে তোমাকে আমি সেই গোপন সুড়ঙ্গ দেখিয়ে দেবো। তুমি পাঁচশত দুর্ধর্ষ যোদ্ধা বেছে তৈরি থাকবে। ’
পরদিন মাঝরাতে পাঁচশত সৈন্য নিয়ে আদিত্য যাত্রা শুরু করলো।রঘুবর পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো।সকলে এসে থামলো এক শিব মন্দিরের সামনে।রঘুবর বললো প্রাসাদের বাইরে এই শিব মন্দির ও প্রাসাদের ভিতরের এক শিব মন্দির তোমার পূর্ব পুরুষ আদিত্য দেব তৈরী করেছিলেন। এই দুইটি শিব মন্দির এক গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে যুক্ত।যাতে বিপদের দিনে এই সুড়ঙ্গ পথে রাজবংশের লোকজন পালিয়ে বাঁচতে পারে। এই সুড়ঙ্গের সন্ধান দুর্জন সিং জানে না। একদিন এই গোপন সুড়ঙ্গ পথে তোমাকে বুকে নিয়ে আমি ও তোমার পিতা শ্যামজী পালিয়েছিলাম ।আজ তুমি পুনরায় এই গোপন পথে প্রবেশ করে রাজপ্রাসাদ দখল করো।
গুরু রঘুবরের আদেশে সকলে শিব লিঙ্গটা সরাতে এক সুড়ঙ্গ দেখা গেল। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে।।গুরু কে প্রণাম করে আদিত্য মশাল হস্তে নিঃশব্দে পাঁচশত সৈন্য নিয়ে সুড়ঙ্গের ভেতরে প্রবেশ করলো । অনেক ক্ষণ চলার পর এক জায়গায় গিয়ে দেখলো আবার ধাপে ধাপে সিঁড়ি  উপর দিকে উঠে গেছে। সবচেয়ে উপরে একটা পাথর দিয়ে বন্ধ। আদিত্য বুঝতে পারলো এই পাথরের উপর আরো একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। দুই জন সৈন্য বলপ্রয়োগ করে শিবলিঙ্গ টি সরাতে একটি অন্ধকার মন্দিরের ভিতর দৃশ্যমান হলো।সকলে এক এক করে উঠে এলো। এখনো রাতের অন্ধকার কাটেনি। বেশীরভাগ শত্রু সৈন্য ঘুমে অচেতন। দূরে প্রবেশ দ্বার দেখা যাচ্ছে। সেখানে কিছু পাহারাদার সৈন্য জেগে রয়েছে।
আদিত্যর পুরো বাহিনী  অস্ত্র নিয়ে তৈরী হলো। শত্রু সতর্ক হওয়ার আগেই তাকে পরাজিত করতে হবে।
সকলে প্রস্তুত হলে আদিত্য চিৎকার করে আদেশ দিলো। ‘আক্রমণ।জয় শিব শম্ভু।’
সুন্দর গড়ের সৈন্য রা কিছু বুঝতে পারার আগেই মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছিলো।এর ফাঁকে এক দল বিজয় গড়ের সৈন্য প্রবেশ পথ খুলে দিলো। শূরসেন তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত ছিল। প্রবেশদ্বার খোলা পেয়ে জলস্রোতের মতো বিজয় গড়ের সৈন্য রা ঢুকে পড়ল। ইতিমধ্যেই সূর্যোদয় হয়েছে। সুন্দর গড় রাজপ্রাসাদ অল্পক্ষণেই সম্মিলিত বাহিনী র দখলে চলে এলো। দুর্জন সিং তার অল্প কিছু দেহরক্ষী বাহিনী নিয়ে লড়াই করতে লাগলো। দুর্জন সিং কে সামনে লড়তে দেখে আদিত্য এক ধানুকি সৈন্য র কাছ থেকে তীর ধনুক চেয়ে নিলো। সাধারণ ধানুকিরা প্রায় আশি হাত  দূর পর্যন্ত নিঁখুত লক্ষ্যে তীর নিক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু দুর্জন সিং প্রায় দ্বিগুণ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল। দুর্জন সিং আদিত্য কে দেখতে পেয়েছে। আদিত্য কে তীর ধনুক হাতে নিতে দেখে হা হা করে হাসতে থাকলো। দুর্জন সিং ভাবলো আদিত্য যুদ্ধে অনভিজ্ঞ। এতো দূরত্ব থেকে তীর নিক্ষেপ করা যায় না। কিন্তু সকলকে অবাক করে একটা শাঁই করে তীর নিক্ষিপ্ত হলো। কেউ কিছু বুঝতে পারার আগেই সকলে দেখলো হাস্যরত একটা মূর্তি ধপ করে পড়ে গেল। একটা তীর তীব্র বেগে গিয়ে দুর্জন সিং এর গলায় বিঁধে গেল। দুর্জন সিং মারা গেলে তার বাকি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলো।
বিজয়োল্লাসে সম্মিলিত বাহিনী ধ্বনি তুললো ‘ জয় শিব শম্ভু।জয় মহারাজ আদিত্য র জয়।’
কয়েকদিন পর মহারাজ সূর্য সেন রাজকন্যা রত্নমালাকে সঙ্গে নিয়ে আদিত্য র রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে হাজির হলো । উপস্থিত হলো শ্যামজী। আদিত্য সকলকে সমাদর করে অতিথি সৎকার করতে লাগলো। মালবগড় থেকে রাজ মুকুট নিয়ে  এক বিশাল প্রতিনিধি দল উপস্থিত হলো।
তারপর এক শুভদিনে শুভ মূহুর্তে রাজকন্যা রত্নমালার সাথে আদিত্য র শুভ বিবাহ সম্পন্ন হলো।এর পর আরেকটি শুভ দিনে সুন্দর গড় ও মালবগড়ের মহারাজ ও মহারানী হিসাবে আদিত্য ও রত্নমালার অভিষেক হলো। ঠিক হলো বছরের প্রথম ছয় মাস আদিত্য সুন্দর গড় হতে ও বাকি ছয় মাস মালবগড় হতে রাজ্যশাসন করবে।  
অতঃপর
আমার গল্প ফুরালো,
নটে গাছটি মুড়ালো ,
কেনো রে নটে মুড়ালি ….।

  ( অলৌকিক তরবারি অন্তিম পর্ব শেষ)