Crss colum

Thursday, December 21, 2017

বাংলা ভূতের গল্প - অশরীরী আতঙ্ক।

বাংলা ভূতের গল্প -      অশরীরী আতঙ্ক (ছোট গল্প) ---
এখনো ভাবলেই গায়ে শরীর জুড়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে যায়।
আমাদের নতুন কেনা ফ্ল্যাট বাড়ীটায় রুপা আর আমি মেঝেতে  সতরঞ্জী পেতে রাতের খাবার খেতে বসে ছিলাম। শীতের রাত। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ ছিল। জানালায় ছিটকিনি দেয়া ছিল। কিন্তু দরজা আলতো করে ভেজানো ছিল। দুজনে খেতে খেতে টুকিটাকি সংসারের গল্প করছিলাম। এমন সময় হঠাৎ ঘরের  দরজাটা সশব্দে খুলে গেল। ঠিক যেন  কেউ দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো। আমার স্ত্রী দরজার দিকে পিছন ফিরে , আমার মুখোমুখি বসে খাচ্ছিল। এই ভাবে দরজা খোলার আওয়াজে রুপা ‘বাবাগো মাগো’ বলে আঁতকে উঠলো।
আমি হেসে বললাম “কি গো ভয় পেলে নাকি ?”
রুপা বললো , “না ,পিছন দিক থেকে  হঠাৎ আওয়াজে চমকে উঠেছি।”
আমি মজা করে বললাম, “ তোমার সবটাতেই ভয় । ঘরে ভূত ঢুকেছে। এই দেখ তোমার ভূতকে বেরিয়ে যেতে বলছি।”
এই বলে আমি দরজার দিকে তাকিয়ে ছদ্ম আদেশের সুরে বললাম , “এই  দরজা খুলে কে ঘরে ঢুকলি রে ? আমার বৌ ভয় পেয়েছে।এখনই দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যা ।”
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই, দুজনে র শিরদাঁড়ার মধ্যে হিমেল স্রোত বয়ে গেল। দেখলাম ক‍্যাঁচ আওয়াজ করে ঘরের দরজা টা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেলো।
যেন যে এসেছিলো ,সে আমার কথা শুনে চলে গেল।
সেই রাতে আতঙ্কে দুজনেই ঘুমোতে পারলাম না।
পরেরদিন সকালে গেলাম মিলনের বাড়িতে।
এই  ফ্ল‍্যাটবাড়ীটা র খোঁজ ওই এনেছিল।
অফিস থেকে লোন নিয়ে ও জমানো সঞ্চয় ভেঙে অনেক কষ্টে এই ফ্ল‍্যাট বাড়ীটা কিনেছি। এর আগে উত্তর কোলকাতার এক ঘিঞ্জি অঞ্চলে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। বহু দিনের ইচ্ছা ছিলো নিজের বাড়ীর। আমার বেসরকারী চাকরীর অল্প রোজগার। আর রূপার প্রাইমারী স্কুলের চাকরীর  রোজগার,এই ছিল ভরসা।
যাইহোক মাথা গোঁজার আশ্রয় না হয় হলো।
কিন্তু নতুন ফ্ল্যাটে এসব কি বিপত্তি ?
মিলনের কাছ থেকে তেমন কিছুই তথ্য পাওয়া গেলো না।
মিলন শুধু জানে , ফ্ল্যাট টি যার ছিল তারা এখন আমেরিকায় চলে গেছে।
আর ফ্ল্যাট টি র কথা ও জেনেছিলো ওর বন্ধু তপনের কাছ থেকে।তপন সপ্তাহ খানেক আগে দিল্লি তে বদলি হয়ে গেছে।
মিলন আমায় বলল , “তুই এই ইন্টারনেটে র যুগেও এখনো ভূতের বিশ্বাস করিস ? এসব তোদের উদ্ভট কল্পনা।”
আমি ও একটু দোটানায় পরলাম। যা দেখেছি যা যেমন উড়িয়ে দিতে পারছি না, আবার এই আধুনিক যুগে একটা ঘটনা র জন্য ভূত প্রেত ইত‍্যাদী ভেবে নেওয়া ঠিক নয়।
হয়তো এ ঘটনা র কোনো যুক্তি গ্রাহ্য কারণ আছে যেটা আমি বুঝতে পারছি না।
দেখতে দেখতে বেশ কয়েক দিন কেটে গেলো। নতুন কিছু ঘটলো না। আমরা দুজন ঐ ঘটনার কথা প্রায় ভুলতে বসেছি।
রবি বার আমার অফিসের ছুটি । রুপা বললো , “চলো না আজ একটা সিনেমা দেখে আসি।” আপত্তি র কিছুই ছিলো না । সুতরাং ইভনিং শোয়ে সিনেমা দেখে ভালো রেঁস্তোরায় খেয়ে দেয়ে যখন ঘরে ফিরলাম তখন ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই।
দরজা  খুলে ঢুকতেই দুজনেই ফোনে ‘সাবওয়ে সার্ভার’ গেম খেলার আওয়াজ পেলাম। কয়েক দিন আগে ই এই গেমটি ফোনে ভরেছি। রুপা এই গেমটি খেলতে খুব ভালো বাসে।
চমকে গিয়ে রুপা কে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম , “ফোন নিয়ে যাওনি?”
রুপা ফিসফিস করে ই উত্তর দিল , “না”।
আওয়াজ টি আসছে আমাদের শোয়ার ঘর থেকে। দুজনে শোয়ার ঘরের খোলা দরজা র কাছে গিয়ে উঁকি দিলাম।
যা দেখলাম তাতে , আমাদের দুজনের সেদিনের অনুভূতি টা ফিরে এলো।
দেখলাম, …..
রুপা র ফোনটা বিছানা থেকে এক হাত উঁচু তে ভাসছে। ঠিক কেউ যেন বিছানায় বসে ফোনে গেম খেলছে। তফাত শুধু , খেলোয়াড় অদৃশ্য।
কতক্ষন যে এইভাবে দেখছিলাম জানি না। হঠাৎ আঁক করে একটা আওয়াজে ঘুরে দেখি রুপা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। ততক্ষণাত ঘরের ভিতরে থাকা খেলোয়াড় ফোন টি বিছানায় ফেলে দিলো। আমি রুপাকে ধরে তোলবার চেষ্টা করছি, তখন অনুভব করলাম কেউ যেন আমার পাশে দিয়ে সাঁৎ করে বেরিয়ে গেল।
অবিলম্বে ডাক্তার এলো । ডাক্তার রুপা কে দেখে শরীর দূর্বল বললো। আমরা দুজনেই চুপচাপ রইলাম। আমাদের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
রুপা বেশ ভয় পেয়েছে । আমি ফোনে অফিসের বস কে স্ত্রীর শরীর খারাপ বলে সাতদিন ছুটি নিলাম।
আমি জানি রুপা মনে মনে বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। আমাদের কোন সন্তান নাই। তাই আমাকেই ওর পাশে থাকতে হবে। এই সময়ে ওর পাশে থাকা জরুরী।
দিন দুয়েক পরের কথা । আমি দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু ভাত ঘুম দিয়ে ছিলাম। রুপা দুপুরে ঘুমায় না। এটা ওটা সংসারের কাজ করে। নয়তো টিভি তে সিরিয়াল দেখে। বিকেলে চা করে নিয়ে এসে রুপা আমায় ডাকলো। বিছানায় বসেই দুজনে চা খেতে খেতে গল্প করছিলাম। তখন রুপা আমায় বলল , “তুমি যদি রাগ না করো , তবে একটা কথা বলবো ?” আমি  বললাম 'কি?’
রুপা উত্তর দিল “জানো ও আসলে একটা ছোট্ট ভারি মিষ্টি দেখতে  মেয়ে।”
আমি বললাম  “বুঝতে পারলাম না।”
রুপা বললো “যে আমাদের বাড়িতে আজব কান্ড ঘটাচ্ছে, তার কথা বলছি। আরে বাবা, সেদিন ফোনে যে গেম খেলছিলো , তার কথা বলছি।”
আমি এতক্ষণে বুঝতে পারলাম।
আমি বললাম “তুমি কি করে জানলে , ওটা একজন বাচ্ছা মেয়ে ?”
রুপা উত্তর দিলো “আমি দেখেছি । তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে , আমি তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম। তখন আয়নার মধ্যে দিয়ে দেখলাম একটা বছর তিনেকের  ছোট্ট মেয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে । আমার দিকে চেয়ে হাসছিলো।কি সুন্দর মিষ্টি দেখতে।”
আমি রুপা কে বললাম , “তুমি ভয় পেয়োনা । আমি  একটা তান্ত্রিক বা রোজা ডাকার ব‍্যবস্থা করছি ।”
রুপা মনে হয় কথাটা শুনে খুশি হলো না । কিছু না বলে ঘর থেকে চলে গেল।
দেখতে দেখতে ছুটি শেষ হয়ে গেল । নতুন কিছু ঘটনা ঘটলো না । কিন্তু আমার মনে হচ্ছে রুপা আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে । রুপা কে আগের থেকে একটু বেশি হাসিখুশি লাগছে। আগে সন্তান না হওয়ার জন্য সবসময় মনমরা হয়ে থাকতো ।এখন আর সেইরকম নেই । বরং আগের চেয়ে বেশি প্রাণবন্ত লাগছে।
যাইহোক আমি অফিসে জয়েন করলাম। বিভিন্ন চেনা পরিচিত লোককে একটা ভালো রোজা বা তান্ত্রিক এর সন্ধান দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। হঠাৎ এই ধরনের অনুরোধ শুনে অনেকেই জানতে চাইলো ব‍্যাপারটা কি ? সুতরাং কিছু কিছু ঘটনা র কথা তাদের কাছে প্রকাশ করতে হলো।সব শুনে অনেকেই  বললো , তারা চেষ্টা করবেন ।
অফিস থেকে বাড়ী ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায় । আমার কাছে মেইন দরজার একটা চাবি থাকে ,আর একটা চাবি রুপা র কাছে থাকে।যে যখন আসি যাই নিজের নিজের চাবি ব‍্যবহার করি। চাবি ঢুকিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই শুনতে পেলাম রুপার কন্ঠ। কাউকে যেন বলছে , ' দুষ্টুমি করবি না , আমার কোলে আয় , না হলে বাবাকে বলে দেবো।’
আমি পা টিপে টিপে শোয়ার ঘরের দরজা র কাছে গিয়ে উঁকি দিলাম। দেখলাম….
                রুপা মেঝেতে বসে আছে আর তার কয়েক হাত দূরে একটা বাচ্ছা মেয়ে বসে আছে । বাচ্ছা মেয়ে টির মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল , ফর্সা রং ,আর হাসিটা ভারি মিষ্টি।  রুপা মেয়েটির সাথে কথা বলছিলো। আমার রুপা কে হাসিখুশি দেখে ভারি ভালো লাগছিলো । কিন্তু না , এসব দূর্বলতা কে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক নয়। একটা গলা খাকারি দিলাম । আমার আওয়াজ শুনে রুপা আমার দিকে তাকালো। আর বাচ্ছা মেয়ে টি শূন্যে মিলিয়ে গেল।
এটা দেখে রুপা আমার ওপর ঝাঁঝিয়ে উঠলো। রুপা বললো , “দিলে তো আমার মেয়ে টিকে ভয় পাইয়ে। যতক্ষণ তুমি থাকবে, সে ভয়ে আমার কাছে আসবে না।”
রুপা সারা সন্ধ্যে আমার সাথে কথা বললো না। রাত্রে খাওয়াদাওয়া র পর আমার ওপর রাগ দেখিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। রাগ আমারো হয়ে ছিলো। আমি ও বেশী জোরাজুরি না করে নিজের ঘরে শুয়ে পড়লাম।
ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। ঘড়িতে দেখলাম রাত দুটো। বাথরুমে গেলাম । হালকা হয়ে এসে ভাবলাম , রুপা রাগ করে ঐ ঘরে শুয়ে আছে। দেখি যদি রাগ ভাঙানোর যায়।
পাশের ঘরে ঢুকে দেখি রুপা ঘুমোচ্ছে আর তার পাশে একটা ফুটফুটে ডল পুতুলের  মতো মেয়ে ঘুমিয়ে আছে।
আমি একটুও ভয় পেলাম না । দুজনে র পায়ের কাছে বিছনার ওপর বসলাম। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম দুজনে র দিকে। এমন একটি পরিবারের স্বপ্ন ই তো আমি আর রুপা দেখেছিলাম । আমরা দুজন আর আমাদের সন্তান। ভাগ্য আমাদের সন্তান দেয় নি । আজ এই মেয়ে টির মধ্যে রুপা নিজের মাতৃত্ব অনুভব করছে। হতে পারে এই শিশু টি জীবিত নয়। কিন্তু রুপা র কাছে এই শিশু টি সন্তান সম। রুপার কাছে তো,এ যখন আসে শরীর ধারণ করেই আসে । মনে হয় শৈশবে ই মৃত্যু হওয়ায় মায়ের আদর থেকে অনেক দিন বঞ্চিত হয়ে আছে। তাই রুপার কাছে মাতৃস্নেহ পেয়ে বারেবারে তার কাছে আসে।
আমি বসে আছি মনে হয় টের পেয়ে রুপার ঘুম ভেঙে গেল। রুপা উঠে বসলো। আমি মেয়ে টির দিকে চেয়ে আছি দেখে রুপা বললো , “ওর নাম রেখেছি  ‘তমা’। আমি বললাম “খুব সুন্দর নাম ।”
আমাদের কথা শুনে ই মনে হয়  'তমা’র ঘুম ভেংগে গেল।চোখ রগরাতে রগরাতে মায়ের কোলে বসলো । রুপা হাসি মুখে ‘তমা’ কে বললো ,যা বাবার কোলে বস। ছোট্ট দুষ্টু টা টলটল  পায়ে এগিয়ে এসে আমার কোলে বসলো । একটা সূক্ষ্ম অপার্থিব বস্তু দিয়ে তৈরি শরীর।দেখা যায় কিন্তু আঁকড়ে ধরা যায় না । কিন্তু এই বা কম কি ? আমাদের সন্তান হীনতার দুঃখ দুজনকেই পীড়া দিতো ।আজ মনে হচ্ছে ,সব দুঃখ দূর হয়ে গেছে। এই দিনটি র জন্য ই আমরা স্বামী স্ত্রী অপেক্ষা করেছি। আমার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল পড়তে লাগলো। আমার দেখাদেখি রুপা ও কাঁদতে লাগলো। আমি জানি এই অশ্রু আনন্দের।
পরেরদিন সকালে রুপা আর আমি বিছানায় বসে চা খাচ্ছি , এমন সময় মিলনের ফোন টা এলো। ফোনে মিলন বললো , “দাদা , আপনি একজন তান্ত্রিকের সন্ধান চেয়ে ছিলেন , তেমন একজন ভালো তান্ত্রিকের সন্ধান পেয়েছি।”
আমি একবার রুপার মুখে র দিকে তাকালাম। মেঝেতে খেলায় ব‍্যাস্ত 'তমা'র দিকে তাকালাম।
তারপর ফোনে মিলন কে উত্তর দিলাম “না ভাই, আমার আর কোন তান্ত্রিকের প্রয়োজন নেই । ভেবে দেখলাম ঐগুলি সবই আমার মনে র ভুল ছিল । আজকের আধুনিক  যুগে ভূতের বিশ্বাস করাটা বোকামি।”
ফোন টা রেখে রুপার ও তমার দিকে চেয়ে হেসে ফেললাম।(শেষ)।