Crss colum

Sunday, March 11, 2018

অনুভূতি ।

আমার ক্লাস নাইনে পড়া ছেলে নীল হঠাৎ প্রশ্ন করলো ,'আচ্ছা বাবা,লক্ষ্মী ঠাকুরের ভিতরে ভগবান থাকে ?’

একটু হকচকিয়ে গেলাম। সামনে গীতা বই । গীতা পড়ছিলাম। মেয়ে র ডায়রিয়া হয়েছে। তাই অফিস যেতে পারিনি। সকাল থেকেই ডাক্তার আর ওষুধের চক্করে ঘুরে এসে এবারে একটু পড়তে বসেছি। গীতা , তবে সাধারণ গীতা নয় । সর্বোৎকৃষ্ট যোগশাস্ত্রীয় ব‍্যাখ‍্যা সমৃদ্ধ “প্রণব গীতা”।

যাই হোক , জবাব তো কিছু দিতেই হয়।

শুরু করলাম।

শোন, তুই যে প্রশ্নটি করেছিস তা সাধারণ মানের নয়। তাই তোকে ঐ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে আরো কিছু তথ্য জানতে হবে। তবে বুঝতে পারবি। আমি নিজে যতটা জেনেছি , বুঝতে পেরেছি,ও অনুভব করেছি তাই বলছি।

হিন্দু ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ হলো বেদ। বলা হয় তার মধ্যে সব তত্ত্ব ই লুকিয়ে রয়েছে। এবং তার থেকে আসল তত্ত্ব বুঝতে পারা কঠিন।

তাই মুনি ঋষি রা সহজে বোধগম্য হবার জন্য রচনা করলেন উপনিষদ।মূল উপনিষদ উনিশটি। এছাড়া আরো অনেক উপনিষদ রয়েছে।

উপনিষদ এর মধ্যে হিন্দু ধর্মের মূল তত্ত্ব কথা গুলো সহজেই বোধগম্য করে লেখা আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাহিনী র আশ্রয় নিতে হয়েছে।

আবার উপনিষদ অনেক গুলি।তাই সব কটি পড়ে তার মধ্যে থেকে সার বস্তু খোঁজ পাওয়া কঠিন।

তখন সৃষ্টি হলো শ্রীমদ্ভগবদগীতা।

যা বলা হয়ে থাকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী।

এটি আসলে মহাভারতের অংশ।

মহাভারত বেদব্যাস এর লেখা।

এই শ্রীমদ্ভগবদগীতা তে লেখা আছে …

সর্বোপনিষদ গাভী স্বরূপ। শ্রীকৃষ্ণ গোয়ালা বা দোগ্ধা।পার্থ বা অর্জুন বৎস বা বাছুর। সুধীজন ভোক্তা।আর গীতামৃত ই দুধ।

কিন্তু মুশকিল হলো গীতা পড়ে তার অর্থ বোঝা কঠিন।

গীতা যত বেশি পড়া হবে এবং তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করা হবে , তাতে প্রতিবার নতুন নতুন অর্থ অনুভব হবে। প্রতিটি অর্থ ই সঠিক।

কারণ হিন্দু ধর্মে বলা হয়ে থাকে সকলেই ধর্ম পালন করে চলেছে। কিন্তু প্রত‍্যেকের ধর্মীয় স্তর এক প্রকার নয়। তাই যে যার স্তর অনুযায়ী গীতার অর্থ অনুভব করবে। এবং সেই সেই স্তরে সেই ব‍্যাখ‍্যাটি সঠিক ফল প্রদান করে তাকে আরো উচ্চ মার্গে নিয়ে যাবে। এই জন্য ই গীতার বিভিন্ন প্রকার ব‍্যাখ‍্যা পাওয়া যায়।

এখন যারা একেবারেই কিছু বোঝে না তাদের কাছে গীতা শোনানো বেকার। তাই তাদের জন্য আরো সহজ বোধ‍্য ভাবে তৈরী হয়েছে পুরাণ।যাতে বিভিন্ন মনোরম কাহিনী র সাহায্য নিয়ে হিন্দু দর্শনের মূল কথা গুলো বলা হয়েছে।ঐ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ধর্মের মূল কথা গুলো ঢুকিয়ে দেবার এটাই সবচেয়ে সহজ পথ।

এবার আসি ঈশ্বরের কথায়।

উপনিষদে আছে হিন্দুদের মূল ঈশ্বর যিনি বা যা হতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে তার নাম ব্রহ্ম। তিনি নিরাকার ও নির্গুণ । নির্গুণ কথা টির অর্থ কর্ম নিরপেক্ষ।

তিনি এই ব্রহ্মাণ্ডের কোন কিছু কর্মতেই অংশগ্রহণ করেন না। তিনি মূল স্রষ্টা হয়েও, সৃষ্টি নিরপেক্ষ। এই কথা টি এর চেয়ে সহজ ভাবে বোঝানো মুশকিল। নিজের ধর্মীয় স্তরের উন্নতি হলে আপনা থেকেই অনুভব হবে।

উপনিষদ এ সৃষ্টি তত্ত্ব সম্পর্কে এই ভাবে বলা হয়েছে (স্মৃতি থেকে বলছি )

“যখন চারিদিকে তমসাচ্ছন্ন ছিল , কোন কিছুই ছিল না তখন কেবল ‘ এক’ অব‍্যক্ত রূপে অবস্থান করছিলেন। 'একের’ ইচ্ছা হলো ‘বহু’ হবেন তখন সেই নির্গুণ ব্রহ্ম হতে সগুণ সম্পন্ন হলেন।  সগুণ ব্রহ্ম দুই ভাগে বিভক্ত হলেন।

এক ভাগ হলো পুরুষ ।অন‍্য ভাগ প্রকৃতি।

বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় যা কিছু ম‍্যাটার ও এনার্জি তাহাই প্রকৃতি।(আইনস্টাইনের থিওরি অনুযায়ী ম‍্যাটার ও এনার্জি একই। শুধু রূপে র তফাৎ। মূল সুত্র E=MC2  ।)

আর পূরুষ হলো স্পেস ও টাইম।(আধুনিক গবেষণা প্রমাণ করেছে স্পেস ও টাইম পরস্পর সম্পৃক্ত ।)

এই জগতে যা কিছু দেখা যায় তা প্রকৃতি । প্রকৃতি মাতৃ স্বরূপ।কারণ প্রকৃতি জীবন ও চৈতন্য কে প্রতিপালন করে।

এমনকি আমাদের  মানব শরীরো  প্রকৃতি।

কিন্তু তার মধ্যে কার চৈতন্য বা আত্মা পুরুষ।কারণ জীবাত্মা  পরমাত্মার অংশ।

এখন মূল প্রশ্নে আসি।যে কোন মূর্তি র মধ্যে কি ঈশ্বর আছে ?

উত্তর নিশ্চয়ই আছে।

সাকার ও নিরাকার উভয়ই একই ঈশ্বরের দুই টি রূপ মাত্র।

পরুষ কে অবলম্বন করে প্রকৃতি জগত সংসার  প্রতিপালন করে। আমরা পুরুষ রূপ কে কৃষ্ণ,শিব ইত‍্যাদী নাম দিয়ে থাকি।আর প্রকৃতি কে রাধা ,গৌরী  ইত‍্যাদী বলে থাকি।

আমরা যে অর্ধনারীশ্বর  মূর্তি দেখে থাকি তা  একই সাথে পুরুষ ও প্রকৃতি বোঝায়।

পুরুষ নিরপেক্ষ ভাবে সৃষ্টি তে অংশ নেয়। প্রকৃতি পুরুষ কে অবলম্বন করে সংসার প্রতিপালন করে।তাই দেখুন কালী মায়ের পায়ের তলায় শিব  শব রূপে অবস্থান করছে।আর মা সেই শবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে  জগতের সৃষ্টি ও সংহার করে চলেছেন। যদিও এই সব মূর্তি র অন্যান্য ব‍্যাখ‍্যা আছে।

জগতে সব কিছুর উপর পুরুষ ও প্রকৃতি ভাব খেলা করছে।

এর অর্থ জড় বস্তুর মধ্যে ও পুরুষ নিস্ক্রিয় চৈতন্য রূপে অবস্থান করছে। এখন কেউ যদি ভক্তি দিয়ে সেই জড়ের মধ্যে কার নিস্ক্রিয় চৈতন্য কে জীবের ন‍্যায় সক্রিয় চৈতন্য তে রূপান্তরিত করে তবে বলা চলে সেই জড় পদার্থ সেই ক্ষণের জন্য সুক্ষ্ম রূপে তার আরাধ্য রূপে অবস্থান করে। এবং তার মনের ইচ্ছা পূরণ করে।

এটাই আমাদের মূর্তি পূজার মূল ভিত্তি।

আমাদের ধর্মে বলা হয় নিরাকার এর উপাসনা হয় না।

নিরাকার এর শুধু চিন্তন বা ধ‍্যান করা যায়।

সাধারণ মানুষের অত সময় নেই ধ‍্যান করার। তাই তাদের জন্যে সাকার রূপে র উপাসনা বা মূর্তি পূজা। তার চেয়ে একটু উন্নত স্তরের জন্য আছে মূর্তি র থেকে উন্নত চিহ্ন উপাসনা।লিঙ্গ শব্দের অর্থ যে চিহ্ন তা অনেকেই জানেন। এবং তার উপাসনা তাই আরো সহজ ও সংক্ষিপ্ত।বলা হয় শিব লিঙ্গের উপাসনার জন্য এক ফোঁটা অশ্রু জল আর একটি বেলপাতাই যথেষ্ট।শিব কথাটির অর্থ মঙ্গল। এতেই ভক্তদের পার্থিব ও আত্মিক উভয় প্রকার মঙ্গল সাধিত হবে।

অনেকেই বলে থাকেন হিন্দু দের তেত্রিশ কোটি দেবতা।

সংস্কৃত ভাষায় কোটি শব্দের অর্থ প্রকার।

তাহলে তেত্রিশ কোটি মানে তেত্রিশ প্রকার।

আমার মনে হয় প্রকৃতির মঙ্গলকারী শক্তি হিন্দু দের কাছে দেবতা রূপে ও সংহার কারী শক্তি দানব রূপে পরিচিত।

সৃষ্টি ও সংহার উভয়ের সাহায্যে জগত সংসার চলে। এবং উভয়ের প্রয়োজন আছে।

আপাতত এই পর্যন্ত। নীলের একটা প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে এই লেখাটি র অবতারণা।

যদিও নীল কে আরো সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিলাম।

কিন্তু লেখার সময় আরো ডিটেইল সে মনের কথা লিখলাম।

আমি যা এখনো পর্যন্ত অনুভব করেছি তাই লিখলাম। তবে এটিই আল্টিমেট ট্রুথ নয়।

কেউ হয়তো আরো উন্নত স্তরে অবস্থান করছেন। ফলে তিনি হয়তো আরো বেশি সত‍্যের সন্ধান পেয়েছেন। তাই তার দৃষ্টি ভঙ্গি হয়তো আরো সুন্দর। তিনি যদি আমার অনুভূতি র ভূল ধরে শুধরে দেন তবে আনন্দিত হবো।