Crss colum

Monday, July 22, 2019

রক্ষক ১


                        (১)


১৯৪০ সালের গ্রীষ্মের এক দুপুর।
কর্ণসুবর্ণ।
প্রফেসর অবিনাশ আচার্য নিজের তাঁবুতে ক্যাম্প খাটে শুয়ে চোখ বুজে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তিনি সাধারণত দুপুরবেলায় ঘুমোন না। কিন্তু এই প্রখর রৌদ্রে সাইটে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া খোঁড়াখুঁড়ি তদারকি করার জন্য ভাস্কর তো আছেই। ভাস্করের উপর যে কোনো ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়।ছেলেটার ইতিহাসের ব্যাপারে একটা আলাদা টান আছে। অবিনাশ বাবু যৌবনে প্রাচীন ইতিহাসের বিষয়ে এই ধরনের টান অনুভব করতেন। তখন সারাদিন ধরে মজুরদের কাজকর্ম তদারকি করতেন। কিন্তু এখন আর পোষায় না।  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে কর্ণসুবর্ণে যে এই খননকার্য  চলছে তার প্রধান দায়িত্বে রয়েছেন প্রফেসর অবিনাশ আচার্য। সহকারী হিসেবে রয়েছেন তার প্রিয় ছাত্র ভাস্কর চৌধুরী। কিছুদিন আগেই ভারতের ইতিহাস নিয়ে পি এইচ ডি করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক হয়ে যোগ দিয়েছেন।
প্রফেসর আচার্য ক্যাম্প খাটে শুয়ে এটা ওটা ভাবছিলেন।প্রধানত তার কাজের বিষয়ে।কর্ণসুবর্ণ এককালে ছিল গৌড়াধিপতি শশ্মাঙ্কের রাজধানী। এখানকার খনন কার্যে যদি অসাধারণ কিছু পাওয়া যায় তবে তা ভারতের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে। সেই সঙ্গে তিনিও বিখ্যাত হয়ে যেতে পারেন। ঠিক যেমন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় হয়েছেন মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার করে।
এই সব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লেন। আচমকা ভাস্করের ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল।চোখ রগড়াতে রগড়াতে তাঁবুর বাইরে এলেন। দেখলেন ভাস্কর দাঁড়িয়ে আছে। অবিন্যস্ত পোশাক আর লাল ধুলোয় তাকে চেনাই দায়। ভাস্কর বললো "স্যার একবার সাইটে চলুন। একটা নতুন জিনিস পেয়েছি।"
প্রফেসর আচার্য বললো "চলো"।
অল্পক্ষণের মধ্যেই দুজনে সাইটে পৌঁছে গেলেন। মজুরের দল ধরাধরি করে একটি তামার কলসী তুলে এনেছে। কলসীর মুখ তামার ঢাকনা আঁটা।
কলসীটা তুলে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রফেসর আচার্য ও ভাস্কর দুজনের কৌতুহল আর বাঁধ মানছিলো না। প্রফেসর আচার্য তামার কলসীর ঢাকনাটা খুলে ফেললেন। বেশ জোর লাগাতে হলো।আঠা জাতীয় কিছু দিয়ে ঢাকনাটা কলসীর মুখে বসানো ছিল। কলসীর ভিতর থেকে একটা পুঁথি বের হলো। তালপাতার পুঁথি। ভাষাটা সংস্কৃত। প্রফেসর আচার্য ,ভাস্করকে পুঁথি টা দিয়ে বললেন ‘তুমি পুঁথিটি নিয়ে যাও।এর অনুবাদ করে এনে আমায় দেখাবে। ’
ভাস্কর বললো ‘ঠিক আছে।’
ভাস্কর পুঁথিটি নিয়ে গেলো। প্রফেসর আচার্য মনে মনে ভাবলেন “ যদি বড়ো কোনো তথ্য এই পুঁথি থেকে পাওয়া যায় তবে তিনি বিখ্যাত হয়ে যাবেন। অবশ্য তিনি একাই সব কৃতিত্ব নেবেন না ।ভাস্করকেও সমান কৃতিত্ব দেবেন।  ”
সেই রাতে  যখন প্রফেসর আচার্য তার তাঁবুতে ঘুমিয়ে ছিলেন একটা ছায়ামূর্তি তার তাঁবুর সামনে এলো।একটু ইতস্তত করে চাপা গলায় বলল ‘ স্যার।’
দুই তিনবার ডাকার পর প্রফেসর আচার্য সাড়া দিয়ে বললেন ‘ কে ? ভাস্কর ?’
ভাস্কর বললো ‘ হ্যাঁ ’
প্রফেসর আচার্য বললেন “ কি ব্যাপার?এতো রাত্রে ?”
ভাস্কর বললো ‘ অনুবাদ টি নিয়ে এসেছি।এক ভবিষ্যতবাণী। আপনি একবার নিজে দেখুন।’
প্রফেসর আচার্য বললেন " তাঁবুর ভিতরে এসো।”
তাঁবুর ভিতরে হ্যারিকেনের ঢিমে আলোয় প্রফেসর আচার্য অনুবাদ টি পড়তে লাগলেন।সাদা ফুলস্কেপ কাগজে সুন্দর বাংলা হস্তাক্ষরে খুবই যত্ন সহকারে ভাস্কর অনুবাদ টি লিখে এনেছে।
প্রফেসর আচার্য পড়া শুরু করলেন …."আমি সায়নাচার্য মহামহিম গৌড়াধিপতি মহারাজ শশ্মাঙ্কের আদেশে মহারাজের সিংহাসনে আরোহণের দশম বর্ষে এই কথাগুলো লিপিবদ্ধ করিতেছি। কিছুদিন পূর্বে মহারাজ একবার রাজকার্য উপলক্ষে তাম্রলিপ্ত বন্দরে উপস্থিত হন। সেখানে উনি  বর্গভীমা নামে এক মহাদেবীর পীঠস্থান দর্শন করেন। ভীষন অরণ্য ভূমি দ্বারা বেষ্টিত সেই জাগ্রত দেবীর মন্দির। সেই নির্জন মন্দিরে উনি এক অতীব শক্তিমান ত্রিকালদর্শী মহাযোগীর সাক্ষাৎ লাভ করেন। সেই ত্রিকালদর্শী যোগী র অলৌকিক ক্ষমতা মহারাজ নিজে প্রত্যক্ষ করেন।পরে সেই যোগী পুরুষের কাছে নিজের রাজ্যের ভবিষ্যত জানতে চান। সেই যোগী পুরুষ মহারাজ কে একথা জানান যে , মহারাজের মৃত্যুর পর তার উত্তর পুরুষ গণ রাজ্য শাসনে অক্ষম হবেন। পরবর্তী শতাধিক বৎসর দেশে অরাজকতা বিরাজ করবে। তারপর এক নতুন রাজবংশের উত্থান হবে। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে ভবিষ্যতবাণী তিনি করেন তা সমগ্র প্রাণীকুল ও মানব সভ্যতা আগামী পনেরোশো বৎসরের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন হবে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র কোনো অর্ধমানব তিনটি মহান জ্ঞান যুক্ত হয়ে এবং সৃষ্টির আদিকাল থেকে লুকিয়ে রাখা এক ভয়াবহ  অস্ত্রের অধিকারী হয়, তবে তার দ্বারা এই মহাপ্রলয় রোধ করা সম্ভব।
তিনটি মহান জ্ঞান লাভ করতে হলে সেই অর্ধমানবকে খুঁজে পেতে হবে লুক্কায়িত করে রাখা তিনটি জ্ঞান কূপ। সেই তিনটি জ্ঞান কূপ সৃষ্টির তিন গুণ সত্ব ,রজ ও তমো গুণের আধার। প্রথম দুইটি জ্ঞান কূপ পৃথিবীতে অবস্থিত হলেও তৃতীয় টি পৃথিবীর বাইরে অন্য জগতে অবস্থান করছে। সেই তিনটি জ্ঞান কূপে অবগাহন করলে তবেই তিনটি মহান জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায় এই  বলে ত্রিকালদর্শী যোগী অদৃশ্য হয়ে যান। এবং অদৃশ্য হওয়ার আগে মহারাজ কে নির্দেশ দিয়ে যান এই ভবিষ্যতবাণী আগামী দিনের মানব জাতির নিমিত্ত লিপিবদ্ধ করে লুক্কায়িত করে রাখার জন্য।
আমি সায়নাচার্য মহারাজ শশ্মাঙ্কের নির্দেশ অনুযায়ী তার মুখ থেকে শোনা সবটুকু লিপিবদ্ধ করে ভবিষ্যতে র মানব জাতির জন্য লুক্কায়িত করে যাচ্ছি।"
অনুবাদ টি এখানেই শেষ।
সবটুকু পড়ার পর প্রফেসর অবিনাশ আচার্য ভাস্করকে বললেন , “ এই  পুঁথি ও তার অনুবাদ প্রকাশ করা যাবে না। কেউ বিশ্বাস করবে না।প্রকাশ করলে তুমি আমি দুজনেই সকলের কাছে হাসির পাত্র হবো। তুমি এই পুঁথি ও তার অনুবাদ নিয়ে কাল সকালের গাড়ীতে কোলকাতা চলে যাও।ঐ গুলি তোমার ব্যাক্তিগত সংগ্রহে রেখে দাও। ”
ভাস্কর বললো “ আপনি ঠিক কথাই বলেছেন স্যার। কিন্তু এগুলো আপনার কাছেই রাখুন না।”
প্রফেসর  বললেন “ সেটা ঠিক হবে না। তাছাড়া আমার উত্তরাধিকারী কেউ নেই। ভবিষ্যতে আমার সম্পত্তির মধ্যে এটা পাওয়া গেলে সকলের কাছে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হবে। মৃত্যুর পর বদনামের ভাগিদার হতে চাই না। তুমি যুবক ও উদ্যমী । এমনিতেই তোমার ব্যাক্তিগত প্রচেষ্টায় সংগ্রহ করা অনেক পুঁথির কথা গুণীজন মহলে আলোচিত হয়।এই পুঁথি সেই সব সংগ্রহের মধ্যে থাকলে কেউ সন্দেহ করবে না।  ”
ভাস্কর মাথা নিচু করে প্রফেসর আচার্য কে প্রণাম করে বললো
‘ আপনি যা চাইছেন তাই হবে স্যার।’



                         (২)
মঙ্গল  ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যবর্তী গ্রহাণুপুঞ্জ বলয়।
সময় -  অনির্দিষ্ট।
নিকষ কালো অন্ধকার। মহাশূন্যে সেই জমাট বাঁধা অন্ধকারের একদিকে বৃহস্পতি গ্রহ ,অন্যদিকে রয়েছে মঙ্গল। মাঝে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে বিরাট বিরাট পাথরের খন্ড। ছোট্ট বালির দানার মতো টুকরো থেকে বিশাল কয়েক কিলোমিটার ব্যাপী পাথরের টুকরো। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে একটি  মৃদু আলোর  গোলক এই সব ভাসমান গ্রহাণুর সঙ্গে ঘুরে চলেছে।আরো কাছ থেকে দেখলে দেখা যাবে  সেই আলোর গোলকের মধ্যে এক অপার্থিব আলোক কণা দিয়ে তৈরি শরীর পদ্মাসনে ধ্যানমগ্ন।
ইনি রক্ষক।এই সৌর মন্ডলের রক্ষক। সৃষ্টির আদিতে ইনি পার্থিব শরীর ধারণ করে পৃথিবীতে ও সৌর মন্ডলের আরো একটি গ্রহ ও একটি উপগ্রহে জীবন ধারণের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। পরে জীবন চক্র আপন নিয়মে চলতে শুরু করলে  তিনি পার্থিব শরীরের লয় ঘটান। এখন বিশ্ব চৈতন্যের (universal consciousness) নির্দেশে সুক্ষ্ম শরীরে এই সৌর মন্ডলের রক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন।
বহুকাল সেই ধ্যান মগ্নতায় কোনো ব্যাঘাত ঘটে নি। কিন্তু আচমকা তার  চোখের পাতায় মৃদু কম্পন হলো। ধীরে ধীরে তিনি চোখ মেলে তাকালেন।তার দৃষ্টি সোজা গিয়ে পড়লো বহুদূরে থাকা  তার প্রিয় পৃথিবীর উপর। তিনি অনুভব করলেন তার প্রিয় পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে। এর আগে মঙ্গল গ্রহের জীব জগতের ধ্বংস  একই ভাবে হয়েছিল। তিনি রোধ করতে পারেন নি। আজ মঙ্গল গ্রহে র অতি ক্ষুদ্রতম এক অংশে জীবন টিকে রয়েছে। বাকি নিরানব্বই শতাংশ অংশ জীবন হীন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। আজ বিশ্ব চৈতন্য তাকে পরিস্কার অনুভব করিয়েছে কিভাবে পৃথিবীর জীবজগৎ ধ্বংস হতে চলেছে। সেই সঙ্গে এক নির্দেশাবলী এসেছে কিভাবে এই জীব জগতকে রক্ষা করতে হবে।
এজন্য পুনরায় তাকে পৃথিবীতে গিয়ে পার্থিব শরীর ধারণ করতে হবে। কিন্তু  একটা সমস্যা রয়েছে। তাকে গর্ভে ধারণ করার মতো তেজস্বিনী মাতৃশক্তি পৃথিবীতে নেই। এছাড়া তিনি জন্মগ্রহণ করার পর সব পূর্ব কথা বিস্মৃত হবেন। সেক্ষেত্রে তার উপযুক্ত শিক্ষাগুরু প্রয়োজন। যিনি তাকে তিন জ্ঞান ও উপযুক্ত অস্ত্র  প্রাপ্তি করতে সহায়তা করবেন।
কিছুক্ষণ  চিন্তা করার পর তার মুখে হাসি ফুটলো। উভয় সমস্যার সমাধান আছে। প্রথমে তাকে যেতে হবে বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ ইউরোপাতে। সেখানেই আছে তাকে  গর্ভে ধারণ  করার উপযোগী ‘ মা’। তারপর তিনি যাবেন উপযুক্ত শিক্ষাগুরু র সন্ধানে রক্তিম গ্রহ মঙ্গলে।
(পরবর্তী অংশ পরের পর্বে)