Crss colum

Sunday, November 17, 2019

আরশোলা

ছাদের একদম কিনারায়  তিন্নি দাঁড়িয়ে আছে। এই সুযোগ। মুন্নি র প্রেতাত্মা প্রতিশোধের স্পৃহা য় পাগল। রাহুল কে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তিন্নি।এই সুযোগ, শুধু একটা ধাক্কা দেওয়া। কিন্তু তিন্নির দিকে হাওয়ায় ভেসে এগিয়ে যেতেই তিন্নি আচমকা পিছন ফিরে মুন্নির প্রেতাত্মার দিকে তাকিয়ে বললো " ও তুই ? আত্মহত্যা করার পরেও এখানে ঘুরঘুর করছিস ? লজ্জা করে না ?"
মুন্নি খানিকটা হতচকিত হয়ে উত্তর দিলো " তুই আমার জীবন থেকে রাহুল কে কেড়ে নিয়েছিস । তোকে আজ ছাড়বো না।"
তিন্নি বললো " বাজে বকিস না। রাহুল তোকে নয় আমাকে ভালোবাসে।"
মুন্নি আরো একটু তিন্নির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো " ওসব জানি না।আজ তোর শেষ দিন। আমার মতো ছাদ থেকে পড়ে আজ তোর মৃত্যু হবে। আমি এখন অশরীরী আত্মা ।তুই আমাকে আটকাতে পারবি না।"
তিন্নি বললো " তাই বুঝি ? তোর যম আমার পকেটে আছে।এই নে।"
এই বলে তিন্নি তার জিন্সের প্যান্টের পকেট থেকে কি একটা বের করে মুন্নির প্রেতাত্মার দিকে ছুঁড়ে দিলো।
মুন্নির প্রেতাত্মা জিনিসটার দিকে তাকিয়ে " বাবাগো ,মাগো ,বাঁচাও ,বাঁচাও " এই সব চিৎকার করতে করতে দৌড়ে গিয়ে ছাদের এক কিনারায় গিয়ে মিলিয়ে গেলো।

তিন্নি একগাল হেসে মুন্নির প্রেতাত্মার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া প্লাস্টিকের তৈরি আরশোলা টি তুলে পকেটে রেখে দিলো।

ভূত হয়ে গেলেও মুন্নির এখনো জীবিত থাকার সময়ের আরশোলার উপরের ভয় কাটেনি।

Saturday, November 16, 2019

আয়না

ঘরের মধ্যে ঢুকে বিরাট মানুষ প্রমাণ বড়সড় আয়নাটাকে দেখে চমকে গেলো বিভাস।দুই বছর আগে বিদেশে কাজে যাওয়ার সময় এই আয়নাটা ছিলো না। ঘন্টা দুয়েক আগে বিভাস বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরেছে। দোতলায় এই ঘরটিতে ঢুকে বেশ চমকে গেছে। অনিতা রান্নাঘরে ব্যস্ত। কৌতুহল বশত আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো বিভাস। পরিস্কার নিজেকে দেখা যাচ্ছে। পকেট থেকে একটা ছোট্ট চিরুনি বার করে চুল আঁচড়াতে লাগলো। আয়নাটা কিন্তু বেশ। হঠাৎ বিভাসকে চমকে দিয়ে আয়নার প্রতিচ্ছবি টি চিরুনি টা পকেটে রেখে অন্য পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে বিভাসের দিকে তাক করে তিনটি গুলি ছুঁড়লো। আয়ানা কে পাতলা পর্দার মতো ভেদ করে গুলিগুলো বিভাসের বুকে লাগলো। বিভাস চিরুনি হাতেই লুটিয়ে পড়লো। আয়নার ভিতরে থাকা প্রতিচ্ছবি বিভাস আয়নাটা ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো। গুলির আওয়াজে অনিতা দৌড়ে এসে দেখলো বিভাস পড়ে আছে ,আর তার পাশে অবিকল দ্বিতীয় বিভাস দাঁড়িয়ে আছে। অনিতা ভ্রু কুঁচকে দ্বিতীয় বিভাসকে প্রশ্ন করলো "কাজ হয়েছে ?"
দ্বিতীয় বিভাস বললো "একদম পারফেক্ট।একটু সাহায্য করো তো।"
তারপর দুজনে ধরাধরি করে বিভাসের মৃতদেহটি আয়নার মধ্যে দিয়ে উল্টোদিকে ছুঁড়ে দিলো।
প্যারালাল ইউনিভার্স থেকে আসা অনিতার গত দুই বছরের প্রেমিক বিভাস বললো " আর আমাদের কোনো বাধা রইলো না। এখন শুধু এই দুই ইউনিভার্সের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা কারী আয়নার মতো দেখতে পোর্টাল টি বন্ধ করে দিলেই নিশ্চিন্ত।"
বিভাস নিজের পকেট থেকে একটা রিমোট বার করে একটা স্যুইচ টিপতেই আয়নাটা সম্পূর্ণ উবে গেলো।পড়ে রইলো শুধু সাদা দেওয়ালের শূন্যতা।

Tuesday, November 12, 2019

রক্ষক ১০

                  (১৪)

বজ্র ড্রাগনের দেশ।

হিমালয়ের কোলে এই দেশটিকে বলা হয় প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড ‌। বলা হয়ে থাকে এটি এশিয়া মহাদেশে সবচেয়ে সুখী দেশ। সহজ সরল এই দেশের মানুষরা। জনসংখ্যার অধিকাংশ লোকই হল বৌদ্ধধর্মে র। এই দেশের সত্তর শতাংশ জমি সুন্দর সবুজ ঘন জঙ্গলে ঢাকা। দেশটির নাম ভুটান।

উত্তর দিকে জনপ্রাণী হীন এক অঞ্চল। আদিত্য গুরুদেব তমোঘ্ন র সাথে এগিয়ে চলেছে লামডিং এর সন্ধানে। আশেপাশে একশো কিলোমিটারের মধ্যে কোন জনবসতি নেই। চারিদিকে বিশাল বিশাল উঁচু পর্বতশ্রেণী। প্রতিটি পর্বতের মাথায় সাদা বরফের পুরু আস্তরণ। সেই ধূধূ করা শীতল মরুভূমির  ন্যায় প্রান্তরে দুইটি মানুষ চলেছে এক লুকানো গুম্ফার সন্ধানে। নাম লামডিং। জনশ্রুতি আছে যে এই লামডিং গুম্ফা তৈরি করেছে অশরীরী কিছু অপদেবতা। এই গুম্ফায় যদি কোন মানুষ বা অন্য কোন জীব প্রবেশ করে তবে তার মৃত্যু নিশ্চিত। তারচেয়েও বড় ব্যাপার এই গুম্ফাকে খুঁজে বার করা সহজ নয়। প্রথমে খুঁজে পেতে হবে তর্জনী পাহাড়। সেই তর্জনী পাহাড়ের তর্জনী যেদিকে নির্দেশ করবে সেই পথেই লুকানো রয়েছে লামডিং গুম্ফা।
আদিত্য গুরুদেব কে বললো "গুরুদেব , আপনি সত্ত্বগুণের কূপ সম্পর্কে কিছু উপদেশ দিন। কিছুক্ষণ আগে আপনি বলছিলেন যে প্রথমে আমাদের তর্জনী পাহাড় খুঁজে বার করতে হবে। কি এই তর্জনী পাহাড় ? কেনইবা এটি খুঁজে বার করতে হবে ? সত্ত্বগুণের কূপের সাথে এর সম্পর্ক কি? দয়া করে আমার কৌতুহল নিরসন করুন।"
তমোঘ্ন বললেন " এই পথে আরও কিছুটা যাওয়ার পর দেখতে পাবে এক মুষ্টিবদ্ধ হাতের মত শৃঙ্গযুক্ত অনুচ্চ পাহাড়। সেই পাহাড়ের মাথায় কম উচ্চতার কারণে বরফ জমে না। এছাড়া কম উচ্চতা হওয়ারজন্য সেই পাহাড়ের এর কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত তাকে দূর হতে শনাক্ত করা যায় না। পাহাড়ের চূড়া টি দেখতে অনেকটা যেন মুষ্টিবদ্ধ হাত। আর একটি তর্জনীর মত পাথরের টুকরো যেন মুষ্টিবদ্ধ হাত থেকে একটি নির্দিষ্ট দিক নির্দেশ করে আছে। আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য সেই তর্জনী পাহাড় খুঁজে বার করা। তারপর সেই তর্জনী পাহাড়ের তর্জনীর নির্দেশিত দিকে এগিয়ে চলতে হবে। যেতে যেতে আমরা একটি ঝর্ণার সন্ধান পাবো। সেই ঝর্ণার কাছেই লুকানো আছে লামডিং গুম্ফা। আর এই লামডিং গুম্ফার মধ্যেই রয়েছে সত্ত্বগুণের কূপ। এই গুম্ফায় প্রবেশ করামাত্র এখানকার রক্ষণ কারী শক্তি মানুষের জ্ঞানের , সত্যনিষ্ঠা র ও দৃঢ়তার পরীক্ষা নেন। যারা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনা তারা মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এখানকার রক্ষণ কারী শক্তির নাম ব্রাহ্মী শক্তি। পূর্বে  রজোগুণের কূপে অবগাহন করার আগে যে দেবী তোমাকে বাধা প্রদান করছিল তিনি ছিলেন নারায়নী শক্তি। আর তমোগুণের কুপের রক্ষাকারী শক্তি হল গৌরী। প্রতিটি শক্তির কাজ হল তিন গুণকে অযোগ্য অধিকারীর হাত থেকে রক্ষা করা। সৃষ্টির প্রারম্ভে বিশ্ব চৈতন্য  নিজের নির্গুণ অবস্থা থেকে সগুণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি করার জন্য নিজের সত্তাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন, যার এক ভাগ পুরুষ ও অন্য ভাগ প্রকৃতি। বিজ্ঞানের ভাষায় বিশ্ব চৈতন্যের পুরুষ রূপ হল স্পেস বা স্থান। আর প্রকৃতির রূপ হল এনার্জি। রজোগুণের কূপ আসলে ম্যাটার বা পদার্থের প্রতীক। তাই রজোগুণের কূপে অবগাহন করে তুমি সমগ্র পদার্থের উপর অধিকার পেয়েছো। রজোগুণের কূপ থেকে তুমি যে অষ্টসিদ্ধি পেয়েছ তার সম্পর্কে বিস্তারিত বলছি ।

অষ্ট সিদ্ধি

1. অণিমা, 2. মহিমা, 3. লঘিমা, 4. গরিমা, 5. প্রাপ্তি, 6. প্রাকাম্য, 7. ঈশিতা, 8. বশিতা

এই আট প্রকার সিদ্ধির বৈশিষ্ট গুলো হলোঃ-

1. অনিমা :-  ইচ্ছা করলেই অনুর মত ক্ষুদ্র আকার ধারন করতে পারেন অথবা নিজেকে শূণ্য রুপে পরিণত করতে পারেন...!! এরকম সিদ্ধি অর্জনকে বলে "অনিমা"...!!

2. মহিমা :- তিনি ইচ্ছামতো নিজের আকার বাড়াতে পারতেন এবং যে কোনও জড়রুপ ধারণ করতে পারেন...!! এই ধরনের সিদ্ধি অর্জনকে বলে "মহিমা"...!!

3. লঘিমা :- তিনি ইচ্ছামতো দেহের ওজন হালকা করে জলের উপর হেঁটে যেতে বা শূন্যে ঘুরে বেড়াতে পারেন...!! এরকম সিদ্ধি অর্জনকে বলে "লঘিমা"...!!

4. গরিমা:- তিনি নিজের ওজন ইচ্ছেমত বৃদ্ধি করতে পারেন...!! এই সিদ্ধি অর্জনকে বলে "গরিমা"...!!

5. প্রাপ্তি :- তিনি যে কোনও স্থান থেকে যা ইচ্ছা, তাই প্ৰাপ্ত করতে পারেন...!! অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্ঞানও নিজের মুষ্টিবদ্ধ করতে পারেন...!! এরকম সিদ্ধি অর্জনকে বলে "প্ৰাপ্তি"...!!

6. প্রাকাম্য :- কোনও বাসনা চরিতাৰ্থ করতে এবং কখনও নিরাশ না হওয়ার জন্য যে সিদ্ধি অর্জন করতে হয় তাকে বলে "প্রাকাম্য"...!!

7. ঈশিতা :- তিনি কোনও স্থানে কিছু অদ্ভুত জিনিষ সৃষ্টি করতে পারেন বা ইচ্ছানুসারে কোন জিনিস ধ্বংসও করতে পারেন...!! সৃষ্টির নবকিছু আর্বিভাব ও ধ্বংস তাঁর ক্ষমতার আওতায়...!! এরকম সিদ্ধি অর্জনকে বলে "ঈশিতা"...!!

8. বশিতা :- তিনি জড় উপাদান গুলোকে ইচ্ছা অনুসারে নিয়ন্ত্ৰণ করতে পারেন...!! সৃষ্টির প্রতিটি জীবকে নিজের বশীভূত করতে পারেন মুহূর্তের মধ্যেই...!! এরকম সিদ্ধি অর্জনকে বলে "বশিতা"...!!

সুতরাং বুঝতেই পারছ রজোগুণের কূপ তোমাকে জড়জগতের উপর বা ম্যাটারের উপর প্রভুত্ব দিয়েছে। তবে এখানে একটি শর্ত আছে। সাধক যেমন অষ্টসিদ্ধি নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন তুমি তেমনি নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে না কেবলমাত্র জগতের কল্যাণে তুমি এই অষ্টসিদ্ধি ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে।

এবারে তোমাকে সত্ত্বগুণের কূপে অবগাহন করে পুরুষ বা স্পেসের বা স্থানের উপর অধিকার কায়েম করতে হবে। স্পেসের উপর অধিকার পেলে তুমি যে কোন স্থানে অনায়াসে পৌঁছতে পারবে। সেই সঙ্গে ইচ্ছামত অন্য প্রাণী অথবা বস্তুকে অন্যস্থানে পাঠিয়ে দিতে পারবে। পরবর্তীকালে তমোগুণের কূপে অবগাহন করে তুমি সময়ের ওপর কর্তৃত্ব পাবে যার সাহায্যে প্রয়োজনমতো যেকোনো সময় রেখায়  (স্পেস -টাইমে) গমন করতে পারবে।

এবারে তোমাকে তমোগুণের কূপ সম্পর্কে কিছু কথা বলি। তমোগুণের কূপ আসলে শক্তির (এনার্জি) প্রতীক। এনার্জি বা শক্তি দুই ধরনের। প্রথমত যে শক্তি আমরা সাধারণত দেখতে পাই । এইগুলো শুভশক্তি। দ্বিতীয়তঃ রয়েছে পরাশক্তি বা ডার্ক এনার্জি। এই ডার্ক এনার্জি খুব ভয়ঙ্কর।একে সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে জগতের মঙ্গল হবে কিন্তু এর অপপ্রয়োগের ফলে জগত ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে। তাই তমোগুণের কূপে তোমাকে সর্বোচ্চ পরীক্ষার সামনে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।"

ওই দেখো আমরা তর্জনী পাহাড়ের সামনে এসে গেছি।ওইযে তর্জনীর মত একটি পাথর একটি নির্দিষ্ট দিক নির্দেশ করছে। ওই দিকেই রয়েছে লামডিং গুম্ফা। জনপ্রাণীহীন  সেই গুম্ফায় বহু রহস্য অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য। চলো, আরেকটু পা চালিয়ে। 

(ক্রমশ)(অষ্ট সিদ্ধি সম্পর্কিত তথ্যাবলী অন্য জায়গা থেকে সংগৃহীত করা)


Tuesday, November 5, 2019

রক্ষক ৯


(১৩)
সহ্যাদ্রি পর্বতমালা।
সহ্যাদ্রি পর্বতমালা সাধারণত পশ্চিম ঘাট পর্বতমালা নামে পরিচিত। বিশাল বিশাল পর্বতশ্রেণী ভারতের পশ্চিম উপকূল ঘেঁষে একদম দক্ষিণতম বিন্দু পর্যন্ত প্রসারিত। 
পশ্চিম ঘাট পর্বতমালা র এক নামহীন পাহাড়ী উপত্যকায় দুই জন মানুষ এগিয়ে চলেছেন। ঘন জঙ্গলে ঢাকা এই অংশে মানুষের  পদক্ষেপ পড়ে না বললেই চলে। কদাচিৎ দুই একটা  দূরবর্তী আদিবাসী সম্প্রদায়ের  মানুষ এখানে শিকারের খোঁজে এসে পড়ে। তবে  তারা যদি বুঝতে পারে তারা ডাইনি বুড়ির আস্তানার কাছে এসে পড়েছে তবে তারা তৎক্ষণাৎ ফিরে যায়। আদিবাসী গ্রামের  মানুষ গুলো ডাইনি বুড়িকে যমের মতো ভয় করে।বংশ পরম্পরায় তারা শুনে এসেছে ঐ দূরের উপত্যকায় কোনো অজানা স্থানে রয়েছে ডাইনি গুহা । সেখানে যেতে নেই। সেখানে যারা যায় তারা আর কখনো ফিরে আসে না।সবাই এড়িয়ে চলে এই রহস্যময় অঞ্চলকে।
আজ সেই নির্জন ঘন হিংস্র শ্বাপদ সঙ্কুল  জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে দুই জন মানুষ। একজন গুরুদেব তমোঘ্ন আর দ্বিতীয় জন আদিত্য।  
সেই নির্জন পথে যেতে যেতে আদিত্যের মনে একটা প্রশ্নের উদয় হলো। সে গুদে কে প্রশ্ন করলো " গুরুদেব, আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে আমরা কেন প্রথমে রজোগুণের কূপের উদ্দেশ্যে চলেছি ?"
একটুও না থেমে গুরুদেব তমোঘ্ন আদিত্যকে উত্তর দিলো " তুমি উপযুক্ত প্রশ্নই করেছো। পৃথিবীতে দুইটি কূপ রয়েছে। সত্ত্বগুণের ও রজোগুণের। কিন্তু অবগাহন করতে হলে প্রথমে রজোগুণের কূপে যাওয়াটাই উচিত। কারণ রজোগুণ আসলে সত্ত্বগুণ ও তমোগুণের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করে। উভয় গুনের শক্তির  মধ্যে সাম্যতা আনে। মানুষ যদি অতিরিক্ত সাত্বিক প্রকৃতির হয় সেটি যেমন ক্ষতিকর তেমনি অতিরিক্ত তামসিক প্রকৃতির মানুষ ক্ষতিকর। তুমি যদি প্রথমেই সত্ত্বগুণের কূপে অবগাহন করো তবে তুমি অতিরিক্ত সাত্বিক প্রকৃতির হবে। সে ক্ষেত্রে তুমি ঈশ্বর সাধনা ভিন্ন অন্য যেকোনো কাজকে অবহেলা করবে। এবং যে কারণে তোমার জন্মগ্রহণ করা তা থেকে কর্তব্য চ্যুত হবে। তাই প্রথমেই রজোগুণের কূপে অবগাহন করা উচিত। রজোগুণের কূপে অবগাহন করা মাত্র তুমি চিরকালের জন্য নীরোগ হবে। তোমার উপস্থিত বুদ্ধি প্রখর হবে। শুধু বুদ্ধি সাহায্যেই তুমি যেকোনো যুদ্ধে প্রতিপক্ষ থেকে এক কদম এগিয়ে থাকবে। এছাড়া রজোগুণের কূপে অবগাহন করার পর তুমি একটি বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হবে।  তুমি অষ্টসিদ্ধি র যাবতীয় গুন লাভ করবে কেবলমাত্র জগত কল্যাণের হেতু। অর্থাৎ যোগী যেমন সাধনার দ্বারা অষ্ট সিদ্ধি লাভ করে নিজের এবং জগতের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে তুমি তেমনি ব্যবহার করতে পারবে না। তবে জগতের প্রয়োজনে তুমি অষ্ট সিদ্ধির  যাবতীয় গুন লাভ করবে। এছাড়া রজোগুণের কূপ তোমাকে একটি বিশেষ অস্ত্রের অধিকারী করবে। এই অস্ত্র হল অতি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন আলোক তরঙ্গ অস্ত্র বা লেজার বিম। তুমি নিজের চোখ থেকে যেকোনো লক্ষ্যবস্তুতে লেজার বিম নিক্ষেপ করতে পারবে।
ওই যে কাছেই পাহাড় টা দেখতে পাচ্ছ ওখানেই  আমাদের গন্তব্য স্থল। ওখানে রয়েছে একটি গুহা। আদিবাসী সমাজে এটা ডাইনি গুহা নামে পরিচিত। কেন এই গুহার নাম ডাইনি গুহা হল সেটা গুহায় প্রবেশ করলেই বুঝতে পারবে। গুহায় প্রবেশ করা মাত্রই গুহার অধিষ্ঠাত্রী দেবী প্রবেশকারী কে সাবধান করে । সাধারণ আদিবাসী জনগণ ব্যাপারটি বুঝতে না পেরে এটিকে কোন ডাইনির ক্রিয়াকলাপ ভেবে ভুল করে ।আদিবাসী জনগোষ্ঠী এই অঞ্চল এবংওই গুহাকে এড়িয়ে চলে। তার অবশ্য সম্যক কারণ আছে। সেটাও গুহায় প্রবেশ করামাত্র বুঝতে পারবে।শুধু যোগ্য ব্যক্তি এই গুহায় প্রবেশ করতে পারে। অযোগ্যরা মৃত্যুমুখে পতিত হয় ।চলো , পা চালিয়ে চলো কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবো।"
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে এক বিশাল পাহাড়ের সামনে উপস্থিত হলো। পার শুরুর দিকে ঢালটা খুব একটা খাড়াই নয়। গুরুদেব  আদিত্যকে নিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলেন। অল্প কিছুক্ষণ ওঠার পর তারা একটি গুহা মুখের সামনে এসে পৌছলেন। গুহার ওপরে একটা পাথরের উপর একটি ত্রিভুজ চিহ্ন খোদাই করা আছে। ত্রিভুজের মধ্যে একটি বিন্দু চিহ্ন।
গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন " এই ত্রিভুজ চিহ্ন টি যে দেখতে পাচ্ছ এটি র তিনটি কোণ তিনটি কূপের প্রতীক। তিনটি বাহু তিনটি গুণের প্রতীক। এবং মধ্যবর্তী বিন্দুটি পাশুপত অস্ত্রের প্রতীক। "
আদিত্য প্রশ্ন করল " গুরুদেব আপনি কি করে এই কূপের সন্ধান পেলেন ?"
গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন " আমি নিজে এই তিনটি কূপে অবগাহন করেছি। কিন্তু চেষ্টা করেও পাশুপত অস্ত্র লাভ করতে পারিনি। সেজন্য আমি তোমায় তিনটি কূপে অবগাহন করার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারি কিন্তু পাশুপত অস্ত্র তোমাকে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় পেতে হবে। আমাকে আমার গুরু এই তিনটি কূপের সন্ধান দিয়েছিলেন। যুগ যুগ ধরে পাঠশালার শিক্ষার্থীরা অশুভ বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। গুরু পরম্পরা য় আমরা এই তিনটি কূপের অবস্থানের কথা জানি।আমরা আমাদের উপযুক্ত ও যোগ্য শিক্ষার্থীকে এই বিষয়ে অবগত করি এবং তাদের এই তিনটি কূপে অবগাহন করতে সাহায্য করি । যাতে তারা ভবিষ্যতে যে কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। পাঠশালার  প্রধান হওয়ার যোগ্যতাই হলো ,এই তিনটি কূপে অবগাহন করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা।
এখন শোনো মনে রাখবে রজোগুণ স্থিতাবস্থা বজায় রাখে। রজোগুণ হলো সত্ত্বগুণ ও তমোগুণের মধ্যবর্তী অবস্থা। উভয় গুনের ভালো অংশটুকু  দিয়ে রজোগুণ  তৈরি হয়েছে। এই গুণ পেতে হলে তোমাকে সবকিছুর মধ্যে মধ্যবর্তী কোন কিছুকে পছন্দ করতে হবে।"
এরপর গুরুদেব তমোঘ্ন একটা মন্ত্র জপ করলে তার হাতে উদয় হলো এক আশ্চর্য তরবারি। সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠলো সেই তরবারি। সেই তরবারি টা আদিত্যর হাতে তুলে দিয়ে গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন " এটি গুরু পরম্পরায় চলে আসা মন্ত্রপূতঃ তরবারি। এর একটি বিশেষ গুণ আছে। এই তরবারি যতক্ষণ তোমার হাতে থাকবে ততক্ষণ তুমি ক্লান্ত হবে না। আমার কাজ তোমাকে শুধুই পথনির্দেশ করা।এখন এই গুহার মধ্যে প্রবেশ করে তোমাকে সেই কুপের সন্ধান ও তাতে অবগাহন নিজেকেই করতে হবে। আমার অভিজ্ঞতা বলে ভিতর তোমাকে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। আর এই কাজের জন্য এই পরম্পরাগত তরবারি তোমার বিশেষ প্রয়োজন হবে। এখন যাও নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দাও।"
আদিত্য ভক্তিভরে গুরুদেব কে প্রণাম করে তার আশীর্বাদ নিল তারপর তরবারি গ্রহণ করে সেই গুহায় প্রবেশ করলো।
বেশ বড়সড় গুহা । গুহামুখ চওড়া হলেও খানিকটা দূর গিয়ে সরু হয়ে গিয়েছে। ভিতরে অন্ধকার কি আছে দেখা যাচ্ছে না। খোলা তরবারি হাতে নিয়ে আদিত্য এগিয়ে চলেছে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর আদিত্য পিছন ফিরে দেখল গুরুদেব কে দেখা যাচ্ছে না। আদিত্য এগিয়ে চললো। অনেকক্ষণ যাওয়ার পর আদিত্য দেখতে পেলো সরু হয়ে যাওয়া গুহাটি পুনরায় চওড়া হতে শুরু করেছে। আরো কয়েক মিনিট হাঁটার পর আদিত্য একটা বিশাল হল ঘরের মতো জায়গায় এলো। হল ঘরটিতে অনেক উঁচু থেকে সূর্যের আলো ফাটল দিয়ে আসছে। আলোর তীব্রতা বলে দিচ্ছে সূর্য এখন মধ্যগগনে। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে সামনে একটা অতলস্পর্শী খাদ। একটা বিশাল পাথরের টুকরো খাদের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত সেতুর মতো পড়ে আছে। আদিত্য বুঝতে পারল তাকে ওই পাথরের সেতু দিয়ে ওপারে যেতে হবে ওপারে আরো একটি গুহামুখ দেখা যাচ্ছে। আর সেই সেতুর ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে আছে একটি বিশাল সিংহ। আদিত্যকে এগিয়ে যেতে হলে ওই সিংহটির মুকাবিলা করেই যেতে হবে। আদিত্য সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই একটা নারী কন্ঠস্বর বলে উঠলো " ফিরে যাও। যেখান থেকে এসেছো সেখানে ফিরে যাও। না হলে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত।"
আদিত্য চমকে গিয়ে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। নারী কণ্ঠস্বর আবার বলে উঠলো " ফিরে যাও।"
আদিত্য কাউকে না দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো " ফিরে যাওয়ার জন্য আমি আসিনি। তুমি কে সামনে এসো।"
নারী কন্ঠ বলল " আমি এই গুহার অধিষ্ঠাত্রী দেবী।"
আদিত্য বলল " আপনি আমার প্রণাম নেবেন। এই সৌরমণ্ডল কে বাঁচাবার জন্য আমার তিনটি জ্ঞান কূপে অবগাহন করা প্রয়োজন। আপনি আমার কাজে সহায় হোন।"
নারীকণ্ঠ পুনরায় শোনা গেল " তার আগে তুমি তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করো। সামনে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত সিংহ কে এড়িয়ে অথবা হত্যা করে সামনে এগিয়ে যাও। সামনে তোমার জন্য আরো পরীক্ষা অপেক্ষা করছে।"
এদিকে আদিত্যর গলার স্বর ঘুমন্ত সিংহ কে জাগিয়ে তুলেছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে সিংহটি এখন ক্ষুধার্ত। আর সামনে তার খাদ্যরূপে উপস্থিত একটি মানুষ। নাম আদিত্য। সিংহটি ধীরে ধীরে আদিত্য দিকে এগিয়ে আসছে। আদিত্য খোলা তরবারি বাগিয়ে নিয়ে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সিংহটি একটা হাই তুলে আদিত্যর মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। দুই শত্রু পরস্পরের দিকে চোখ রেখে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর সিংহটি লাফ দেয়ার উপক্রম করলো। আদিত্য তার তরবারি টা শক্ত হাতে ধরে সিংহের দিকে চোখ করে সামান্য নিচু হয়ে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে সিংহের লাফ দেয়ার জন্য অপেক্ষায় রইলো। সিংহটি আদিত্য র উদ্দেশ্যে লাফ  দেয়া মাত্রই আদিত্য এক দৌড়ে খানিকটা এগিয়ে সিংহের বুকে শূন্যেই তার তরবারিটা গুঁজে দিলো। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাইডে লাফিয়ে সরে গেলো। তরবারি টা সিংহের বুকে গোঁজা মাত্রই সিংহটি র মৃত্যু হয়েছিল। সিংহটি পাথরের চাতালে ধপাস করে পড়লো। আদিত্য কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে সিংহের কাছে গিয়ে তার বুকের পাঁজরের ভেতর থেকে তরবারি টা বের করে নিলো। তারপর পাথরের সেতু দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। সামনে আরো একটি গুহামুখ। সেখান দিয়ে খানিকটা এগোবার পর আবার একটি হলঘর। এখানে একটি পাথরের চাতালের উপর সুন্দর সুন্দর সোনালী ধাতুর থালায় বিভিন্ন রকমের ফল সাজানো আছে। কোন থালায় আম, কোনোটিতে জাম, কোনোটিতে কলা, কোনোটিতে নারিকেল, কোনটিতে আপেল , কোনটিতে আঙ্গুর ইত্যাদি। সেই নারী কন্ঠ বলে উঠলো " তুমি যে উদ্দেশ্যেই আমার গুহায় আসো না কেন তুমি আমার অতিথি। আর অতিথি সৎকার আমার পরম কর্তব্য। ওইযে রাশি রাশিফল মূল দেখছো ওর মধ্যে একটি মাত্র তোমার খাদ্য। বাকিগুলি বিষাক্ত। ওই ফল গুলির মধ্যে নিজের জন্য খাদ্য ও পানীয়ের অভাব মিটে যাবে এমন কিছু পছন্দ করো। তুমি তোমার বুদ্ধি ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার পরিচয় দাও।"
আদিত্য সব ফলগুলির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর সে নারিকেল টি বেছে নিয়ে  তরবারি দিয়ে সেটি ছাড়িয়ে তার জল পান করলো। এবং শাঁস টি খেলো। নারী কন্ঠ বলে উঠলো " সাধু ,সত্যিই তুমি সাহস ও বুদ্ধিতে অতুলনীয়। এগিয়ে যাও সামনে আরেকটি গুহামুখ আছে। সেই গুহামুখ দিয়ে গেলে তুমি তিনটি কূপ দেখতে পাবে। তার মধ্যে সঠিক কূপটি বেছে নিয়ে অবগাহন করতে হবে। মনে রাখবে ভুল কূপে অবগাহন করা মাত্রই তুমি মৃত্যুমুখে পতিত হবে। তোমার জয় প্রার্থনা করি।"
আদিত্য বললো "ধন্যবাদ দেবী।"
আদিত্য সামনের গুহা মুখ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা খোলা প্রান্তরে গিয়ে পড়লো। সামনে তিনটি  গোলাকার কূপ  রয়েছে। দেখে বুঝা যাচ্ছে বেশি গভীর নয়। তিনটিতেই জল রয়েছে। একদম বামদিকে যেটি রয়েছে তার জলের রং হলুদ। মধ্যে যেটি রয়েছে তার রং লাল। ডান দিকে যেটা রয়েছে তার জলের রং বেগুনি। তিনটি জলাশয়ে নামবার জন্য পাথরের সিঁড়ি রয়েছে।
আদিত্য এবার চিন্তায় পড়ে গেল। দেবী বলেছেন সঠিক কূপটি বেছে নিতে হবে। তিনটির মধ্যে কোনটি সঠিক বেছে নেওয়া মুশকিল। মনে পড়লো গুরুদেব বলেছেন রজোগুণ হল সত্ত্বগুণ ও তমোগুণের মধ্যবর্তী অবস্থা। মনে পড়ল শিক্ষাগ্রহণের  সময় সে শিখেছিলো সূর্যের আলোয় লুকিয়ে আছে সাতটি রং। সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রং বেগুনি আর সবচেয়ে দীর্ঘতম তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের রং লাল। মধ্যবর্তী তরঙ্গদৈর্ঘ্য হলুদ রঙের। যেহেতু রজোগুণ বাকি দুই গুণের মধ্যবর্তী অবস্থা তাই এক্ষেত্রে আদিত্য স্থির করলো সে হলুদ রঙের জল যুক্ত কূপে অবগাহন করবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ।
আদিত্য হলুদ বর্ণের কূপে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নামলো। খুব একটা গভীর নয়। জলের গভীরতা কোমর পর্যন্ত। সে মনে মনে গুরুদেব কে প্রণাম করে জলে স্নান করলো। স্নান করে মাথা তোলা মাত্র মনে হল শরীরের সব দুর্বলতা দূর হয়ে গেছে। শরীরটাকে অনেক হালকা ও ঝরঝরে লাগছে। 
সেই নারী কন্ঠে বলে উঠলো "ধন্য তুমি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আশীর্বাদ করি তুমি তোমার কাজে সফল হও।"

আদিত্য যে পথে এসেছিল সেই পথে পুনরায় বাইরে এলো। দেখলো গুরুদেব একটি পাথরের ওপর বসে ধ্যানমগ্ন। আদিত্য এসে তার পদস্পর্শ করে প্রণাম করলো। গুরুদেবের ধ্যানভঙ্গ হলো। তিনি হেসে বললেন "প্রথম ধাপ সম্পন্ন হলো। এখনো অনেক গুলি বাকি। চলো যাওয়া যাক হাতে সময় বেশী নেই। (চলবে)

Friday, November 1, 2019

রক্ষক ৮


                     (১২)

সময় ২০৩৯ সাল।
পাঠশালা।
হিমালয়ের গোপন উপত্যকা।

গত পরশু থেকে প্রবল তুষার ঝড় শুরু হয়েছে। চারিদিকে সাদা রঙের বরফে আচ্ছন্ন। সেই প্রবল তুষার ঝড় ও সেই সঙ্গে ক্রমশ বেড়ে চলা শৈত্যপ্রবাহে পাঠশালার বাইরে কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই।

 সূর্যোদয় হওয়ার কিছু পরেই আদিত্য কে গুরুদেব তমোঘ্ন ডেকে পাঠালেন ‌। যদিও সূর্যোদয় বলতে সূর্য উঠেছে তা নয়।এই তুষারপাতের মধ্যে সূর্য ওঠা অসম্ভব। পূর্ব দিক আলোর ছটায় সাদা রঙের হওয়াকেই পাঠশালার সকলে সূর্যোদয় ধরে নিয়ে  দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু করা হয়।

'পাঠশালা' নামের এই শিক্ষায়তনটি বিশালাকায় ও বহু কক্ষবিশিষ্ট। তার মধ্যে কোন কক্ষে গুরুদেব তমোঘ্ন থাকেন সেটা আদিত্য জানতোই না।

এক শিক্ষক আদিত্য কে ডেকে নিয়ে পথ দেখিয়ে গুরুদেব তমোঘ্ন র কক্ষের সামনে পৌঁছে দিলেন।

আদিত্য দেখলো সে এক বিশালাকায় কারুকার্য খচিত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। শিক্ষকটি আগেই চলে গেছে। একটু ইতস্তত করে দরজায় ধাক্কা দিলো।অতবড় দরজাটা আদিত্যর সামান্য ধাক্কা দেওয়াতেই খুলে গেলো।

আদিত্য গুরুদেব তমোঘ্ন র ঘরে প্রবেশ করলো। বিরাট লম্বা হলঘরের মতো ঘর। চারিদিকে থরে থরে আলমারিতে ভর্তি। বেশীরভাগ আলমারিতে বই পত্র ও বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথি সংরক্ষিত রয়েছে। কয়েকটা আলমারিতে অস্ত্র শস্ত্র রয়েছে। তার মধ্যে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র আদিত্যর অজানা। আদিত্য এদিক-ওদিক তাকিয়ে অনেক অজানা রহস্যময় বস্তু দেখতে পেলো। একটা পাকানো দড়ি দেখতে পেলো। যেটা আপনাআপনি গুটিয়ে যাচ্ছে আবার কিছুক্ষণ বাদে খুলে যাচ্ছে। একটা ছোট কলসি চোখে পড়লো।যার মুখ দিয়ে গল গল করে নীলাভ ধোঁয়া বেরিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল একটা খুব সুন্দর রহস্যময় ফুলের গাছ। গাছটিতে একটিমাত্র রামধনুর মতো সাত রংয়ের পাপড়িযুক্ত ফুল ফুটে আছে। সবচেয়ে আশ্চর্য গাছের লম্বা লম্বা পাতা গুলো তার দিকে ইশারা করে কাছে ডাকছে। অনেকটা মানুষ যেমন হাতের ইশারায় অন্য মানুষকে কাছে ডাকে ঠিক তেমনি। আদিত্য আজব আকর্ষণে সেই গাছটির দিকে এগিয়ে গেলো। গাছটির কাছে যাওয়ার আগেই একটি চেনা কণ্ঠস্বর তাকে বাধা দিয়ে বললো "খবরদার গাছটিকে ছোঁবে না।"

আদিত্য চমকে গিয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো গুরুদেব তমোঘ্ন ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন।

গুরুদেব আবার বললেন "গাছটিকে ছুঁলেই তুমি ভয়ংকর বিপদে পড়বে। এটি  সম্মোহনী গাছ। সারা পৃথিবীতে এই একটিমাত্র সম্মোহনী গাছ অবশিষ্ট আছে। এই গাছকে ছোঁয়া মাত্র গাছের গায়ে অবস্থিত অতি সূক্ষ্ম রোঁয়া থেকে তীব্র বিষাক্ত রাসায়নিক তোমার ত্বকের মধ্য দিয়ে রক্তে পৌঁছে যাবে। তুমি তৎক্ষণাৎ জীবন্ত পুতুলের মত হয়ে যাবে। কোনরকম নড়াচড়া করতে পারবেনা । এমনকি তোমার কোন রকম নড়াচড়া করার ইচ্ছা পর্যন্ত থাকবে না। তারপর গাছটি তার সূক্ষ্ম রোঁয়া গুলি দিয়ে তোমার শরীরের যাবতীয় রক্ত চুষে নেবে।"

গুরুদেবের কথা শুনে আদিত্য তৎক্ষণাৎ সভয়ে পিছিয়ে এলো।

আদিত্য এরপর গুরুদেব কে প্রণাম করলো। তারপর একটু দোনা মোনা করে প্রশ্ন করলো "গুরুদেব এই পাকানো দড়ি ও কলসির রহস্য বড়ো জানতে ইচ্ছা করে।"

গুরুদেব তমোঘ্ন বলল "ওই যে দড়িটা দেখছো ওটা একটা ভয়ঙ্কর শস্ত্র। ওই দড়ি কেউ ছিঁড়তে পারে না। এমনকি কোনো অস্ত্রের সাহায্যে ওটি কাটা যায় না। ওটি কারোর দিকে ছুঁড়ে দিলে সে দড়িতে আপনা থেকেই আবদ্ধ হয়ে যায়। একটা বিশেষ মন্ত্র দ্বারা এই দড়িকে নিজের বশে রাখা যায়। নয়তো এই দড়ি তার স্বভাব বশতঃ যেকোনো জীবন্ত বস্তুকে বা প্রাণীকে আবদ্ধ করে।

আর ওই যে কলসিটা থেকে নীলাভ ধোঁয়া বেরিয়ে আছে ওইটার মধ্যে পৃথিবীর যাবতীয় লুকানো গুপ্তধন রয়েছে। একটি বিশেষ মন্ত্র আছে। এই মন্ত্রটি পাঠ করে যদি কেউ ওই কলসির মধ্যে হাত দেয় তবে পৃথিবীর যেকোনো একটি লুকানো গুপ্তধনের কিছু অংশ অবশ্যই হাতে পাবে।"

তমোঘ্ন এবার আদিত্য কে তার পিছনে পিছনে আসতে বললেন। গুরুদেব তমোঘ্ন তার ঘরের একটি বিশেষ বইয়ের আলমারির কাছে গিয়ে  আলমারি খুলে দুটি বইয়ের স্থান পরিবর্তন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটি বইয়ের আলমারি স্থান  পরিবর্তন করলো। একটা গুপ্ত দরজা প্রকাশ হলো। আদিত্য দেখল ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে । গুরুদেব তমোঘ্ন আদিত্যকে আহ্বান করলেন "এসো যাওয়া যাক ।" 

গুপ্ত দরজার মধ্যে দিয়ে আদিত্য গুরুদেব তমোঘ্নর সাথে এক নতুন কক্ষে উপস্থিত হলো।

এই কক্ষে কোনো আসবাবপত্র নেই। কক্ষের মেঝেতে এক সুন্দর আশ্চর্য নকশা করা গালিচা বিছানো। কক্ষের এক পাশে একটি সুন্দর কারুকার্যখচিত দরজা আছে। গুরুদেব তমোঘ্ন আদিত্যকে বসতে ইশারা করলেন। আদিত্য বসলে তিনিও তার সামনে বসলেন।

গুরুদেব তমোঘ্ন বলতে শুরু করলেন " প্রিয় আদিত্য, 

                     আজ তোমাকে তোমার জীবনের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানাবো। তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র। তুমি অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। তোমার ন্যায়  কুশলী যোদ্ধা এই মুহূর্তে পৃথিবী তথা সৌরমন্ডলে বিরল। এত অল্প দিনে তুমি এতকিছু শিখতে পেরেছো শুধু তাই নয় সব  রকম বিদ্যাতেই তুমি নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছো। আমি তোমার বর্তমান জন্মের প্রায় সব তথ্যই জানি। সেই সঙ্গে তুমি পূর্ব জন্মে কি ছিলে এবং কেনইবা জন্মগ্রহণ করেছো সেই সব জানি।

সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই সৌরমণ্ডলের একজন অভিভাবক আছেন। তিনি কখনো প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে এই সৌরমণ্ডলের অস্তিত্ব যাতে বজায় থাকে এবং এর প্রাণীকুলের অস্তিত্ব যাতে রক্ষা পায় সেজন্য প্রতিনিয়ত সচেষ্ট থাকেন। এই অভিভাবক রক্ষক নামে পরিচিত। যদিও বহুকাল আগেই তার দেহের বিনাশ হয়েছিলো তবু তিনি সুক্ষ্ম দেহে এই সৌরমণ্ডলের এক বিশেষ স্থানে অবস্থান করছিলেন। 

 কিছুকাল আগে তিনি জানতে পারেন বর্তমান পৃথিবীর জীবিত প্রাণীকুল এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে।এক বিশালাকায় গ্রহাণু পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়তে চলেছে।  রক্ষক এই বিষয়ে জানতে পেরে পুনরায় পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করেন।

তুমি হলে সেই রক্ষক। তোমার মা একজন মাতৃকা । পিতা ছিলেন মানুষ। তোমার মধ্যে একাধারে মাতৃকা জাতির গুণ রয়েছে তেমনি আবার মানুষের মতোই আবেগ ও ভালোবাসা রয়েছে।

বৎস, আজ পৃথিবী এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। এক বিশাল গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। সেই গ্রহাণু যদি পৃথিবীতে আছড়ে পরে তবে তৎক্ষণাৎ পৃথিবীর সব প্রাণীকুল ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমার মধ্যে সেই শক্তি বর্তমান আছে যার সাহায্যে তুমি পৃথিবীর আপামর প্রাণীকূলকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারো। পূর্ব জন্মে তুমি ছিলে এই সৌরমন্ডলে রক্ষক। বর্তমান জন্মেও তুমি পুনরায় এই সৌরমণ্ডলের রক্ষকে পরিবর্তিত হবে। সেজন্য তোমায় শক্তি অর্জন করতে হবে। এই পৃথিবীতে দুইটি জ্ঞান কূপ রয়েছে। একটি রজোগুণের কূপ অন্যটি সত্ত্বগুণের কূপ। এই দুইটি কূপে অবগাহন করার পর তুমি তৃতীয় তমোগুণের কূপে অবগাহন করার অধিকার লাভ করবে। দ্বিতীয় কূপটি রয়েছে পৃথিবীর বাহিরে বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা যেখানে তোমার মা অবস্থান করছেন। সেখানেও তোমায় নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। তিনটি কূপে অবগাহন করার পর তোমাকে এক ভয়াবহ অস্ত্র "পাশুপত " এর অধিকার লাভ করতে হবে। এই পাশুপত অস্ত্র বিনা কিছুতেই ওই বিরাট গ্রহাণুকে ধ্বংস করা যাবে না। আমি তোমায় তিনটি কূপে অবগাহন করতে সাহায্য করবো কিন্তু পাশুপত অস্ত্র সম্পূর্ণ নিজের বিদ্যা বুদ্ধি ও কৌশলের দ্বারা তোমায় লাভ করতে হবে।"

গুরুদেব তমোঘ্ন চুপ করলেন।

আদিত্য বলল " গুরুদেব আমি আপনার চরণ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করছি আমার জীবন সকলের কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করলাম। আপনি আমায় পথ দেখান আমি নিশ্চিত আমি এই সৌর মন্ডল তথা পৃথিবীকে আগত বিপদ ও ভবিষ্যতের যাবতীয় বিপদ থেকে রক্ষা করবো।"

গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন " বেশ ,সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এমনিতেই সময় আমাদের হাতে খুব অল্পই আছে। তুমি প্রস্তুত তো?"

আদিত্য বললো "আমি প্রস্তুত।"

গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন "এসো আমার সঙ্গে।"

গুরুদেব তমোঘ্ন সেই গোপন কক্ষের যে কারুকার্যখচিত দরজাটি রয়েছে তার সামনে এলেন।

গুরুদেব তমোঘ্ন আদিত্য কে উদ্দেশ্য করে বললেন" এই যে দরজাটি দেখছো এটি আসলে একটি টাইম পোর্টাল। এটি আসলে এক জটিল যন্ত্রের প্রবেশদ্বার। এই যন্ত্রের সাহায্যে এই সৌরমন্ডলের যেকোনো স্থানে ইচ্ছা করা মাত্র নিমেষের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় এবং সেখান হতে পুনরায় এখানে ফেরা যায়। "

গুরুদেব তমোঘ্ন আদিত্যর হাতে একটি আংটি পরিয়ে দিয়ে বললেন " এই আংটি টি এই যন্ত্রটির সুইচের মতো। আংটির  উপর যে লাল রঙের পাথরটি আছে সেটিতে চুম্বন করে তুমি যে স্থানে যাওয়ার কথা ভাববে সেখানেই তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যাবে। এখন চলো তোমাকে নিয়ে প্রথমে রজোগুণের কুপে পৌঁছাবো। যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করার পর তুমি ও আমি একইসাথে নিজের নিজের আংটির পাথর চুম্বন করবো। যেহেতু আমি সেই কূপের অবস্থান জানি তাই আমি সেই স্থানের কথা চিন্তা করবো। তুমি কেবল ভাবতে থাকবে 'আমার ইচ্ছাই তোমার ইচ্ছা।'"

গুরুদেব তমোঘ্ন হাতের ধাক্কা দিয়ে সেই কারুকার্যখচিত দরজাটি খুলে ফেললেন। ভিতরে নিকষ কালো অন্ধকার ।

গুরুদেব তমোঘ্ন ও আদিত্য সেই কাল অন্ধকারাচ্ছন্ন যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করলেন। গুরুদেব তমোঘ্ন আদিত্য কে আদেশ করলেন " এবারে আংটিতে চুম্বন করো।"

দুজনে তাদের নিজের নিজের আংটিতে চুম্বন করলো। (চলবে)