Crss colum

Monday, November 23, 2020

রক্ষক ১৩

ইউরোপা।
বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ।

মহাকাশযান থেকে আদিত্য দেখতে পেল এক শুভ্র পিরামিড। ঠিক যেন মিশরের পিরামিড।আর পিরামিড কে ঘিরে রেখেছে এক বুদবুদ। গুরুদেব বুঝিয়ে দিলেন " ঐ যে বুদবুদ টি দেখছো ওটি শ্বাস নেওয়ার উপযুক্ত  বাতাসের বুদবুদ। এমনিতে মাতৃকা গোষ্ঠী বাতাসের সাহায্য ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু অতি উন্নত টেকনোলজি দিয়ে তৈরি এই বুদবুদ এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও এখানে আসা মানুষজন দের বাঁচিয়ে রাখতে তৈরি করা হয়েছে। তাদের মহাকাশযান ক্রমশ বাতাসের বুদবুদের ভিতরে প্রবেশ করলো।আকাশ থেকে যতটা ছোট মনে হচ্ছিল ভিতরে প্রবেশ করার পর বুঝতে পারলো ততটা ছোট নয় ।অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে এই বুদবুদ।
মহাকাশযান  ধীরে ধীরে পিরামিড আকৃতির বিশাল শুভ্র মার্বেল পাথরের মন্দিরের প্রধান প্রবেশ পথের সামনে দাঁড়ালো । আদিত্য ও গুরুদেব তমোঘ্ন মহাকাশযান থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। দেখল তাদের স্বাগত করবার জন্য দশ জন মাতৃকা মন্দিরের প্রধান প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সর্বাগ্রে দাঁড়িয়ে আছে আদিত্যর মা ময়ূরী। আদিত্য ময়ূরীর কাছে গিয়ে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে     প্রণাম করলো। ময়ূরী তাকে উঠিয়ে তার কপালে স্নেহ চুম্বন দিলো। বহুদিন বাদে মা ও ছেলের মিলন হলো। উভয়ের চোখ দিয়ে টপটপ করে আনন্দ অশ্রু ঝরতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ময়ূরী বলল, "  আদিত্য আমি তোর সব খবর রাখি। সর্বদা তোর চিন্তা করি। তুই সত্ত্বগুণের ও রজোগুণের কুপে অবগাহন করেছিস। এখন তোর সামনে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। তমোগুণের কূপ জয় করা সহজ নয়। কিন্তু আমি জানি এই কাজ তুই পারবি। তোকে পারতেই হবে। আয় তোকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।"
এই বলে আদিত্য র একটি হাত ধরে তাকে সর্বপ্রথমে  তাদের সকলের গুরুমা প্রবীণা মাতৃকার কাছে নিয়ে গেল। আদিত্য প্রবীণা মাতৃকাকে ভক্তিভরে প্রণাম করলো। তিনি আশীর্বাদ করলেন "জয়ী হও"। একে একে সকল মাতৃকা আদিত্যকে আশীর্বাদ করলেন। তারপর সকলে মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
আদিত্য দেখল বিশাল সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত এক মন্দির। মন্দিরের ঠিক মধ্যস্থলে এক বিরাট আকারের কূপ রয়েছে। সেই কূপের দিকে নির্দেশ করে প্রবীণ মাতৃকা বললেন " আদিত্য এই হল তমোগুণের কূপ। সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে রহস্যময় স্থান। এবার তোমার পরীক্ষা হয় অন্য প্রকার হবে। ঠিক কি প্রকার সে সম্পর্কে আমি কিছুই বলবো না। তবে প্রকৃত রক্ষক হওয়ার জন্য যে গুণ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটা তোমার মধ্যে আছে কিনা এটা তার পরীক্ষা নেবে। তুমি একজন মাতৃকার গর্ভজাত।মাতৃকা জাতির পুরুষদের শূন্য মণি ছয়মাস বয়স হলেই মিলিয়ে যায়। তখন সে সাধারণ মানুষ। কিন্তু তুমি যে মূহুর্তে তমোগুণের কূপের মধ্যে প্রবেশ করবে তৎক্ষনাৎ তোমার মিলিয়ে যাওয়া শূন্য মণি আবার প্রকাশিত হবে। সেই সঙ্গে মাতৃকা জাতির সব গুণাগুণ তুমি অর্জন করবে। এই তমোগুণের কূপে অবগাহন করলেই  স্পেস টাইমের উপর তোমার কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু একটা সাবধান বাণী আছে। এই তমোগুণের কূপ আসলে একটা ছোট ব্ল্যাক হোল। এখানে প্রবেশ করা সহজ । কিন্তু বের হওয়া খুবই কঠিন। এই মন্দিরের অপরদিকে আরো একটি কূপ রয়েছে। সেটার ভিতরটা ধবধবে সাদা। সেটাই এই কূপের অপর প্রান্ত। সেটা একটা হোয়াইট হোল। ব্ল্যাক হোল দিয়ে প্রবেশ করে পরীক্ষায় তমোগুণের  রক্ষাকারী শক্তি দেবী গৌরীকে সন্তুষ্ট করলে তবেই তার আশীর্বাদে হোয়াইট হোল দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে। না হলে সারাজীবন ভিন্ন কোনো টাইম লাইনে বন্দী হয়ে থাকবে।  আশা করি বুঝতে পেরেছো ?"
আদিত্য বললো " বুঝতে পেরেছি । এবার আমাকে প্রবেশ করার অনুমতি দিন।"
এমন সময় গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন " "একটু দাঁড়াও।"
এই বলে    তিনি তার পোশাকের ভিতর থেকে একটা  আংটি বার করে আদিত্যর হাতে তুলে দিয়ে বললেন " এটা একটা রিয়েলিটি আংটি। এটার একটা বিশেষ গুণ রয়েছে। এটা  আঙ্গুলে পরা মাত্রই তোমার বিস্মৃত হয়ে যাওয়া স্মৃতি কে পুনরায় জাগিয়ে তুলবে। এই আংটির মধ্যে যে লাল রঙের পাথরটি দেখতে পাচ্ছ সেটাকে চাপ দিলেই তুমি নিজের আপন জগতে ফেরত আসতে পারবে। সেই সঙ্গে আরও একটি কথা স্মরণে রেখো তমোগুণের কুপের সময় ও আমাদের সৌরমণ্ডলের সময় এক নয়। তমোগুণের কূপে তুমি যদি এক বৎসর কাটাও সেটা আমাদের জগতে একদিনের সমান হবে। তোমাকে তমোগুণের কূপ থেকে আমাদের সময়কালের সাত দিনের মধ্যে ফেরত আসতে হবে যদি কোন কারনে ব্যর্থ হও তবে তুমি চিরকালের জন্য ওখানে আটকে পড়ে যাবে। তুমি কুপে প্রবেশ করার আগে এই আংটিটা ছুঁড়ে দাও। আমাদের জগতের সাতদিন পূর্ণ হবার আগেই এই আংটিটা তোমার কাছে ফেরত আসবে। এখন যাও। নিজের কর্তব্য সাধন করে বিজয়ী হয় ফেরত এস এই আশীর্বাদ করলাম।"
আদিত্য গুরুদেবের কাছ থেকে আংটিটি নিলো তারপর তমোগুণের কূপে সেটি নিক্ষেপ করলো। পুনরায় সবাইকে প্রণাম করে তমোগুণের কূপে ঝাঁপ দিলো।

চারিদিকে কালো অন্ধকার। এত কালো যে কোন স্থান হতে পারে সেই ধারণা ছিলনা। অন্ধকারে আদিত্য নেমেই চলেছে। কতক্ষণ ধরে চলেছে সেই সময়ের হিসেব নেই। অনেকক্ষণ বাদে তার মনে সন্দেহ হলো সে কি আদৌ নামছে নাকি উঠছে? কিছুই বুঝতে পারা যাচ্ছে না। আরো বহুক্ষণ ধরে নামার পর আদিত্যর মনে ভয় জন্মালো। এই কূপের আদৌ কি কোন অন্ত আছে? এত দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার পরেও এই কূপের শেষ হচ্ছে না। আদিত্য চোখ বুজে ফেললো। মায়ের কথা, গুরুদেবের কথা খুব মনে পড়ছে। এই অন্তহীন কূপ থেকে ছাড়া পেয়ে আবার কখনো কি তাদের দেখতে পাবে আদিত্য ?
এমন সময় আদিত্যর কানে এক কোমল নারী কন্ঠ বলে উঠলো " তমোগুণের কূপে তোমাকে স্বাগত। আমি এই কূপের রক্ষণ কারী শক্তি 'গৌরী'। আমি সকলের মানসিক দৃঢ়তা ও কর্তব্যনিষ্ঠার পরীক্ষা নিয়ে থাকি। যে কোন প্রাণীর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা মায়া , মোহ , মমতা। এগুলোকে জয় করা সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। আমি তোমার জীবনের উদ্দেশ্য জানি। ভবিষ্যতের রক্ষক হতে গেলে তোমাকে এই দুর্বলতা গুলির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। কর্তব্যের খাতিরে প্রয়োজনে সবকিছুই বলি দিতে হবে। এবারে তুমি যে জগতে পৌঁছবে তা তোমার বাস্তব জগত হতে ভিন্ন প্রকৃতির। সেখানে পৌঁছানো মাত্রই তোমার পূর্ব স্মৃতি লোপ পাবে। কি কারনে কী উদ্দেশ্যে তুমি এই অজানা জগতে যাত্রা করেছিলে তা ভুলে যাবে। অবশ্য এতদিন যেসকল ক্ষমতা তুমি অর্জন করেছ তা তোমার স্মরণে থাকবে। বাকি সবকিছুই তুমি ভুলে যাবে। সঠিক সময় তোমার গুরুদেবের দেখানো রিয়েলিটি আংটি তুমি খুঁজে পাবে । যা কিছুক্ষণের জন্য তোমার উদ্দেশ্য তোমাকে মনে করিয়ে দেবে। তারপর তোমার সিদ্ধান্ত হয় তোমাকে রক্ষক করে তুলবে অথবা চিরকালের মতো এই জগতে বন্দী করবে।
আশা করি তুমি এই পরীক্ষায় জয়ী হবে।"

হঠাৎ আদিত্য নিজের বন্ধ চোখের পাতায় আলোর আভাস পেলো। সে ধীরে ধীরে চোখ খুললো। দেখল একটি পাহাড়ি টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সামনে খুব সুন্দর সবুজ পাহাড়ি উপত্যকা দেখা যাচ্ছে। আরও অনেক দূরে একটি ছোট্ট অথচ খুব সুন্দর শহর চোখে পড়ছে। আদিত্য বুঝতে পারল ওই দূরের ছোট্ট শহরটি তার গন্তব্য। সে দ্রুত টিলা থেকে নেমে পাহাড়ি শহরের দিকে এগিয়ে চললো। বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর দেখলো একটা রাখাল বালক অনেকগুলি ভেড়া নিয়ে চড়াতে বেরিয়েছে। রাখাল বালক টি তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। রাখাল বালক টি এগিয়ে    এসে তার হাত ধরে  এক অজানা ভাষায় তাকে কিছু বললো। ভাষাটি অজানা হলেও আদিত্য স্পষ্ট বুঝতে পারল রাখালবালক টি তাকে বলছে " তুমি কে? কোথা থেকে আসছ ? তোমার কপালে নীল রঙের ওটা কি চকচক করছে?"
আদিত্য তার কথার উত্তরে বললো " আমি আদিত্য। এখানে কেন এসেছি বা কিভাবে এসেছি জানিনা। আমার কপালে কি চকচক করছে জানা নেই । এটা কোন জায়গা? "
যদিও আদিত্য তার নিজের ভাষায় কথাগুলি বলছিলো , কিন্তু শূন্য মণির বিশেষ গুনে কথাগুলি রূপান্তরিত হয়ে সামনে থাকা রাখাল বালকটি নিজের ভাষায় সেগুলো শুনতে পাচ্ছিল।
রাখাল ছেলেটি উত্তর দিলো , "  আমাদের এই রাজ্যের নাম স্বপ্ন রাজ্য। ওই যে দূরে শহরটি দেখতে পাচ্ছ ওটা আমাদের রাজধানী স্বপ্নপুরী। আমাদের রাজ্যের খুব বিপদ । কিছুদিন আগে আমাদের  রাজা মারা গেছেন। আর তারপর হতে আকাশ থেকে অনেক বিপদ আমাদের উপর হানা দিচ্ছে। মন্দিরের  প্রধান পুরোহিত ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন অজানা জগত হতে এক রাজার আগমন হবে। সে আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। সেই থেকে আমরা সবাই অজানা জগত থেকে আসা মানুষের সন্ধান করে চলেছে। তুমি কি কোন অজানা জগত থেকে আসছ?"
আদিত্য বললো " জানি না"। রাখাল ছেলেটি  বললো "  চলো তোমাকে আমাদের শহরে নিয়ে যাই।"
যেতে যেতে রাখাল ছেলেটি তাকে বলে চললো "  আমাদের রাজার কোন পুত্র সন্তান নেই। একটি মাত্র কন্যা সন্তান রয়েছে। আমাদের রাজ্যের নিয়ম কেবলমাত্র পুরুষরাই রাজা হবে। বহুকাল পূর্ব হতেই ভবিষ্যৎ বাণী রয়েছে এই রাজ্যে যখনই কোন রাজার অভাব হবে তখনই আকাশ হতে বিপদ নেমে আসবে।  একমাত্র রাজাই পারবে এই বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করতে। "
দেখতে দেখতে তারা দুজনে বিরাট উঁচু প্রাচীর ঘেরা শহরের মূল দরজার সামনে এসে পৌঁছল।( ক্রমশ)


Tuesday, November 17, 2020

রক্ষক ১২

লাদাখ, এক গোপন উপত্যকা।
একটি খুব ছোট মহাকাশযান আকাশে উড়লো। দেখতে অনেকটা অত্যাধুনিক ফাইটার প্লেন এর মতো। তারমধ্যে অপ্রশস্ত জায়গায় দুটি মানুষ বসে আছে। দুজনেই আমাদের পরিচিত। চালকের আসনে বসে আছেন গুরুদেব তমোঘ্ন। তার পাশে অন্য একটি আসনে বসে আছে আদিত্য।
আদিত্য প্রশ্ন করল "গুরুদেব আমরা এখন কোথায় চলেছি ও কী উদ্দেশ্য নিয়ে চলেছি"।
তমোঘ্ন বললেন "এবারে আমাদের গন্তব্য তমোগুণের কূপ। এই যে বিমানটি দেখছো,  এটি এক বিশেষ ধরনের বিমান। মঙ্গল গ্রহের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে এটি তৈরি। এটি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাডারে ধরা পড়ে না। সম্পূর্ণরূপে ষ্টেলথ প্রযুক্তি। যা পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বিমান প্রযুক্তির চেয়েও সর্বাধুনিক। আত্মরক্ষার জন্য এতে লেজার বিম থেকে কনভেনশনাল মিসাইল পর্যন্ত আছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার এটি যেমন পৃথিবীর ও অন্যান্য গ্রহের বায়ুমন্ডলে চলাচল করতে পারে তেমনি মহাকাশে এটি যাতায়াত করতে পারে।মহাশূন্যে এটির গতিবেগ সর্বোচ্চ আলোর 2 শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এই গতিবেগ সৌরমণ্ডলের যে কোন গ্রহে খুব অল্প সময়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত। পুরো সৌরমণ্ডলে এত সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিমান খুব অল্প সংখ্যক আছে। তোমাকে আগেই বলেছি তমোগুণ এর কূপ রয়েছে তোমার মায়ের বাসস্থান বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ ইউরোপাতে। সেখানে যেতে হলে এটির সাহায্য ছাড়া অসম্ভব। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে মহাশূন্যে গিয়ে পড়বো। সেখান থেকে গতিবেগ বাড়িয়ে চাঁদকে একটি চক্কর মেরে আমরা বৃহস্পতির দিকে সর্বোচ্চ গতিতে এগিয়ে যাব। এই পথ যথেষ্ট বিপদসংকুল। যদিও সর্বাধুনিক কম্পিউটার আমাদের পথকে সুরক্ষিত করার দায়িত্বে আছে, তবুও অ্যাস্ট্রয়েড বেল্ট পেরোনোর সময় যেকোনো বিপদ আসতে পারে। তুমি তো জানো আমার বাসস্থান মঙ্গল গ্রহ ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝখানে বহু গ্রহাণুপিন্ড ঘুরপাক খাচ্ছে। ধারণা করা হয় এই স্থানে একটি গ্রহ বর্তমান ছিল। কিন্তু কোন কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে গ্রহটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সেই গ্রহের টুকরো টুকরো খন্ড গুলি এখনো সূর্যের চারিদিকে ঘুরে চলেছে। এগুলোকে অ্যাস্টরয়েড বা গ্রহাণুপুঞ্জ বলে। 
সামান্য কিছু সময় পরে তাদের মহাকাশযান পৃথিবীর নীল দিগন্তরেখা পেরিয়ে কালো অন্ধকার সাম্রাজ্যে প্রবেশ করলো। চারিদিকে কালো অন্ধকারের মধ্যে পৃথিবীটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরে সেটা অনেক ছোট হয়ে গেল। এদিকে চাঁদের আকার ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের মহাকাশযান চাঁদের অনেক কাছে পৌঁছে গেছে। গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন "তোমার বাম দিকে দেখো  মহাকাশযানের জানালার সঙ্গে একটি টেলিস্কোপ সংযুক্ত করা আছে। সেটা দিয়ে চাঁদকে আরো পরিস্কার ভাবে দেখতে পারবে। আমরা এখন চাঁদের আলোকিত দিকের কয়েক কিলোমিটার উপর দিয়ে উড়ে চলেছি । আমি মহাকাশযানের গতি একটু কম রেখেছি,  যাতে তুমি সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখতে পাও।"
গুরুদেব বললেন "ওই দেখো ঠিক তোমার সামনে চাঁদের মাটিতে একটি পতাকা উড়ছে। টেলিস্কোপে আরেকটু জুম করে দেখো পতাকাটা আমেরিকার। বহুদিন আগে মানুষ প্রথমবার যখন চাঁদের মাটিতে পা দিয়েছিল তখন স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ ওই পতাকাটি ওখানে পুঁতে রেখে গিয়েছিল। চাঁদের বায়ুমণ্ডল প্রায় না থাকার কারণে ওটা এখনো অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। এবার আমরা চাঁদের অন্ধকার দিকে কি আছে দেখবো। চাঁদের অন্ধকার দিক এর প্রায় সবকিছুই মানুষের অজানা। এখানে আমাদের মার্শিয়ান জাতির একটি ছোট্ট উপনিবেশ আছে। যদিও আমি এখন সেখানে নামবো না। তবে সেটা তোমাকে মহাশূন্য থেকেই দেখাবো।"
সামান্য সময় পরে আদিত্যদের মহাকাশযান চাঁদের আলোকিত অংশ ছেড়ে অন্ধকার দিকে এগিয়ে চললো। চাঁদের অন্ধকার দিকে আদিত্য প্রথমে কিছু দেখতে পেল না। তারপর চোখ সয়ে গেলে আস্তে আস্তে টেলিস্কোপ এর সাহায্যে সবকিছু নজরে পড়লো। টেলিস্কোপে অন্ধকারে দেখার নাইট ভিশন মোড চালু করে দিল। আলোকিত দিকের থেকে এই দিকে পাহাড় পর্বত অনেক বেশি। অন্ধকারে বেশ কয়েকটি জায়গায় লাল রঙের মনে হচ্ছে। গুরুদেব তমোঘ্ন বুঝিয়ে দিলেন ওগুলো জীবন্ত আগ্নেয়গিরি।লাভা উদগীরণ করছে বলে উত্তপ্ত লাভা লাল রঙের মনে হচ্ছে।
এক বিরাট আগ্নেয়গিরি দেখিয়ে গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন " ঐ যে বিশাল আগ্নেয়গিরি দেখছো ওর কাছেই মার্সিয়ান জাতির একটি ছোট্ট উপনিবেশ আছে।আর এই উপনিবেশে র অনেক নিচে আগ্নেয়গিরির ঠিক তলায় গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এই গ্যালাক্সির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র পাশুপত। এখন আমরা এখানে নামবো না। তমোগুণের কূপ জয় করার পর তোমাকে এখানে আসতে  হবে। পাশুপত কে লাভ করা সহজ নয়। ভয়ঙ্কর কিছু অজানা পরীক্ষা দিয়ে নিজের যোগ্যতা  প্রমাণ করে তবেই পাশুপত যেখানে রয়েছে সেই গোপন কক্ষে পৌঁছান যায়। কিন্তু পাশুপত নিজেই চৈতন্য যুক্ত। তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তবেই তার কৃপা লাভ হবে।
চলো যাওয়া যাক।"
এবার তাদের মহাকাশযান উড়ে চললো বৃহস্পতি গ্রহের অভিমূখে। মহাকাশযান এখন আলোর   দুই শতাংশ গতিবেগে এগিয়ে চলেছে। খুব দ্রুত তারা  পৃথিবীর পরের গ্রহ মঙ্গল পেরিয়ে গেলো। মঙ্গল পেরিয়ে যাওয়ার সময় গুরুদেব তমোঘ্ন তার জন্মভূমির উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন।
এবারে পড়লো অ্যাস্টরয়েড বেল্ট।  সর্বাধুনিক প্রযুক্তি তাদের নিরাপদে ভয়ঙ্কর সেই বলয় পার করে দিলো।
এরপর এগিয়ে আসছে সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতি। গুরুদেব তমোঘ্ন এবার মহাকাশযানের গতিবেগ একটু একটু করে কম করতে শুরু করলেন। তিনি বললেন" আমরা বৃহস্পতি গ্রহে নামবো না। আমাদের গন্তব্য ঐ যে দূরে দেখা যাচ্ছে সাদা রঙের মিটমিট করা আলোকবিন্দু।
ওটাই ইউরোপা। বৃহস্পতির উপগ্রহ।
ওখানেই তোমার মা আছেন। আর আছে তমো গুণের কূপ।"
ক্রমশ আলোকবিন্দুটি বড় হচ্ছে। মহাকাশযান এগিয়ে চলেছে।(ক্রমশ)


Monday, November 16, 2020

ফোট!শালা!!

বিবাহ বার্ষিকীর দিন অন্তত একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে।
ডিউটি বেরোবার সময় মধু বলেছিলো " আজকে  অন্তত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো।মনে আছে তো?"
অনন্ত মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বললো " তা আবার ভুলি?"
মনে মনে বললো " ঐ দুঃখের দিন টা বাকি জীবনে অন্তত ভুলবো না।"
প্রেম করেই বিয়ে হয়েছিল  দুজনের। তখনকার কিশোরী মধুরিমা আর আজকের মধুরিমার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেই লাজুক হাসি, সেই মন ভোলানো ভ্রুকুটি আজ কোথায়?
বিয়ের তিন বছর পরেও যখন বাচ্ছা হলো না তখন আস্তে আস্তে মধুর স্বভাবের পরিবর্তন হতে লাগলো। দিনদিন তার ব্যবহার রুক্ষ্ম থেকে রুক্ষতর হতে লাগলো। প্রথম প্রথম বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে দৌড়োদৌড়ি ,শেষে ডাক্তার ছেড়ে এই ঠাকুর ,ওই ঠাকুর এর কাছে মানত  শুরু হলো। কিছুদিন পরে মধুরিমা হাল ছেড়ে দিল। এবারে সে সরাসরি অনন্তকে দোষ দিতে লাগলো।
যদিও অনন্তর কোন দোষ ছিলনা। কিছুদিন আগেই  একজন বড় ডাক্তার এর কাছে মধুরিমাকে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারবাবু মধুরিমা র আড়ালে  অনন্তর কাছে বলেছিল, মধুরিমার শরীরের অভ্যন্তরীণ ত্রুটির জন্য বাচ্ছা আসছে না। সেই কথাটি অনন্ত মধুরিমা দুঃখ পাবে বলে তার কাছে এখনো প্রকাশ করেনি।
কিন্তু যত দিন গড়াতে লাগল মধুর ব্যবহার খুবই খারাপ হতে লাগলো। দিনরাত এটা ওটা নিয়ে অনন্তর সঙ্গে ক্রমাগত ঝগড়া শুরু হলো। অনন্ত খুবই ঠাণ্ডা প্রকৃতির ছেলে। একবার ঝগড়ার সময় মধুরিমা অনন্তকে ধরে কয়েক ঘা পিটিয়ে দিল। তবুও অনন্ত টু শব্দটিও করল না। সেই শুরু হলো এখন অনন্ত ঝগড়া হলেই মাঝে মাঝে মধুর হাতে মার খায়। তবুও অনন্ত মধুকে ভালোবাসে। আর ভালোবাসে বলেই তাকে কিছু বলেনা। সবকিছুই নীরবে সহ্য করে।
অনন্ত একটা আইটি ফার্মে চাকরি করে। আইটি ফার্মে চাকরির প্রবেশের সময় নির্দিষ্ট থাকলেও বের হওয়ার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। মাঝেমাঝেই কাজ করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়। তার ওপর প্রতিদিন ওপরওলার ঝাড় খেতেই হয়।
অনন্ত নিরীহ ভীতু  স্বভাবের ছেলে। ঘরে মধুর অত্যাচার আর চাকরি ক্ষেত্রে উপরওয়ালা বাগচী  সাহেবের অত্যাচার দুটোই চুপচাপ হজম করে। মধু অবশ্য রোজকার অনন্তকে জ্বালায় না। যেদিন তার মেজাজ খারাপ থাকে সেদিন কোনো না কোনো ছুঁতোয় অনন্তর সঙ্গে ঝগড়া করে। শুধু ঝগড়া করে নয় খুবই খারাপ ভাষায় অনন্তকে গালাগালি করে। সেই সঙ্গে হাতের কাছে ছোঁড়ার মত কিছু থাকলেই ছুঁড়ে মারে। আজকাল অনন্তর এসব সহ্য হয়ে গেছে। মধুর মেজাজ একটু খারাপ বুঝলেই অনন্ত এটা ওটা কাজের বাহানায় সেখান থেকে সরে পড়ে।
আজ অফিসে এসে অনন্ত সিনিয়র দেবাঞ্জনদাকে আগেই বলে রেখেদিলো একটু কাজ কম দিতে। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে আজকে বাড়ি যেতে হবে। দেবাঞ্জন দা তাদের টিম লিডার। দেবাঞ্জন দা ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল, " কেন? আজকে এত তাড়া কেন?"
একগাল হেসে অনন্ত উত্তর দিল " আজ আমার বিবাহ বার্ষিকী।"
দেবাঞ্জন দা বলল "ছাড়তে পারি যদি একটা বিয়ার খাওয়াস।"
অনন্ত বললো "  দাদা একটা কেন দুটোই আনান।ক্যান্টিনে বসে আমিও একটু চেখে বাড়ি যাবো।"
দেবাঞ্জনদা বললো ," ঠিক আছে তবে আমি আনিয়ে রাখছি, টাকা টা কিন্তু দিয়ে দিবি।"
সন্ধ্যা সাতটার কিছু আগেই অনন্ত ও দেবাঞ্জন ক্যান্টিনে গিয়ে দুটো বিয়ার আর এক প্লেট বাদাম ভাজা নিয়ে বসলো। বিয়ার দুটো অফিসের পিয়ন কে দিয়ে দেবাঞ্জন আগেই আনিয়ে রেখেছিল ‌। এই সময় কেউ ক্যান্টিনের দিকে আসে না। সুতরাং দুজনেই নিশ্চিন্তে নিজেদের পান ভোজনে ব্যস্ত থাকলো।
অনন্ত যখন উঠবে উঠবে করছে ঠিক সেই সময় ফোনটা এলো। বাগচী সাহেবের ফোন।
বাগচী সাহেব বললো " অনন্ত গতকাল তোমাকে একটা প্রোজেক্ট দিয়েছিলাম সেটা কি কমপ্লিট হয়েছে?"
অনন্ত  একটু হকচকিয়ে উত্তর দিলো " না স্যার , ওটা আপনাকে কাল কমপ্লিট করে দেবো।"
বাগচী সাহেব একটু রেগে গিয়ে বললো " আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। তুমি আজকের মধ্যেই কাজটা কমপ্লিট করে আমাকে ইমেইল এ ফাইলটা সেন্ড করো।আজ না হলে কাল থেকে তোমার আসার প্রয়োজন নেই।"
এই বলে বাগচী সাহেব ফোনটা রেখে দিলো।
দেবাঞ্জন বোধহয় এই রকম কিছু একটা আঁচ করেছিল।সে জিজ্ঞেস করল " কেস গড়বড় ?"
অনন্ত উত্তর দিলো " তোমরা যাও । আমার যেতে দেরি হবে।"
দেবাঞ্জন বললো ," হয়েছে টা কি বলবি তো?"
অনন্ত উত্তর দিলো ," হয়েছে আমার কপালটাই খারাপ।মধু আসার সময় পইপই করে বলে দিয়েছে আজ তাড়াতাড়ি ঘরে যেতে।আর আজকেই  হারামী বুড়োটার কাজ কমপ্লিট করে যেতে হবে।অন্তত ঘন্টা চারেক লাগবে।আর তুমি তো মধুর মুখের ভাষা জানো।আজ আমার কপালে দুঃখ আছে।"
দেবাঞ্জন অনন্ত র অনেক দিনের সহকর্মী ও পারিবারিক বন্ধু। মধুরিমা র সঙ্গে পরিচয় আছে। সেই সঙ্গে মধুরিমা র খান্ডারনি চরিত্র সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।
দেবাঞ্জন বললো ," আমি তোকে কিছু সাহায্য করতে পারি ?"
অনন্ত ম্লান হেসে বললো , " কাজের ডিটেইলস তুমি জানো না , সুতরাং দুজনে কাজটা ভাগ ভাগ করে করবো তেমন উপায় নেই। তুমি কিছু ভেবোনা। আমি কাজ শেষ করে অফিসে চাবি দিয়ে ,চাবিটা সিকিউরিটি র  কাছে রেখে যাবো।"
দেবাঞ্জন তবু বললো ," কিন্তু অত রাতে বাড়ি ফিরবি কি করে ?"
অনন্ত বললো " আমার বাড়ি তো বেশি দুরে নয়। তিন কিলোমিটার দূরে। যদি কিছু পেয়ে যাই তাহলে ভালো , নাহলে হেঁটে ই বাড়ি ফিরতে হবে।কাল রবিবার অফিস ছুটি। সুতারাং অফিসে আসার তাড়া নেই। একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠলেই চলবে। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।প্রায় সবাই তো চলে গেছে। তুমি ও আর রাত করো না। "
এই বলে অনন্ত তার কম্পিউটার নিয়ে কাজ শুরু করলো।
দেবাঞ্জন অফিস থেকে বেরোনোর সময় সিকিউরিটি কে বলে গেলো অনন্ত র কাজ শেষ হতে রাত হবে। সে যেন খেয়াল রাখে।
পুরো প্রোজেক্ট টা শেষ করে বাগচী সাহেবের ইমেইল এ ফাইলটা সেন্ড করে অনন্ত দেখলো অফিসের ওয়ালক্লকে তখন রাত প্রায় বারোটা বাজে। পকেটে মোবাইল টা সাইলেন্স করে দিয়েছিল কাজে ডিস্টার্ব হবে এই ভেবে। এখন মোবাইল বের করে দেখলো তাতে নয়টা মিসকল এলার্ট।সবকটাই মধুর মোবাইল থেকে।
অনন্ত একবার ভাবলো মধুকে পরিস্থিতি টা ফোন করে জানিয়ে দেয়। কিন্তু তারপর ভেবে দেখলো তাতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবার সম্ভাবনা আছে। তাই  হোয়াটসঅ্যাপ এ মেসেজ করে দিলো ' অফিসে র কাজে আটকে গিয়েছিলাম, এখন বাড়ি ফিরছি।'
অফিসের দরজার কাছে টুলে বসে সিকিউরিটি রতন ঘুমে ঢুলছিলো। তাকে একটু নাড়া দিতেই সে তড়াক করে উঠে বললো ," আপনার কাজ শেষ বাবু ?"
অনন্ত গম্ভীর হয়ে বললো ," হ্যাঁ , তুমি অফিসের দরজায় চাবি দিয়ে শুয়ে পড়।"
রাস্তায় নেমে দেখলো একটাও জনপ্রাণী নেই।অঘ্রাণ মাস। হালকা ঠান্ডা পড়েছে। একটু শীত লাগছে। কিন্তু সে সব পাত্তা না দিয়ে অনন্ত বাড়ির দিকে হনহন করে হাঁটা দিল। খানিকটা দুরে  চৌমাথা পেরিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে মনোহরপুকুর রোড।মনোহরপুকুর রোড ধরে দুই কিলোমিটার গেলেই অনন্ত দের শতরূপা অ্যাপার্টমেন্ট। তার তিন তলায় অনন্ত র ফ্ল্যাট। মনোহরপুকুর রোডের এই রাস্তা টা এমনিতেই নির্জন। তার ওপর খ্রিস্টান দের কবরস্থান ও তার পাশেই আমতলা শশ্মান জায়গাটাকে একটু যেন ভুতুড়ে করে তুলেছে। এমনিতেই বেশ খানিকটা জায়গা কোন মানুষের বসতি নেই। রাস্তার দুই পাশের স্ট্রীট লাইটের হালকা আলো আর তার সঙ্গে হালকা কুয়াশা য় অনন্ত র একটু গা ছমছম করে উঠলো। সে সব কে পাত্তা না দিয়ে  কবর স্থানের মেন গেট থেকে একটু এগোতেই স্ট্রীট লাইটের আলোয়  অনন্ত র চোখে পড়লো একটা কালো কুচকুচে বিড়াল ছানা। রাস্তার ঠিক মাঝখানে বসে আছে।আর অপার্থিব এক প্রকার মিঁয়াও মিঁয়াও আওয়াজ করছে। অনন্ত আরো একটু কাছে যেতেই বিড়াল ছানা টি রাস্তার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পায়চারি শুরু করে দিল। ঠিক যেন অনন্ত কে যেতে দেবে না। একটু দূরের  ষ্ট্রীট লাইটের আলো বিড়াল ছানাটির চকচকে গায়ে পড়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে। হঠাৎ আচমকা অনন্ত র মনে হলো ওটা কোনো বিড়াল ছানা নয়। বরং একটা ধাড়ী বিড়াল। আরো কিছুক্ষন সময় পর দেখলো বিড়াল ছানার আকার বেড়েই চলেছে। এখন ওটা একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুরের মতো। অনন্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি র উপর নজর করতে লাগলো।আরো একটু পরে একটা বাছুর সাইজের কালো বিড়াল অনন্ত র সামনে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনন্ত কিন্তু সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।  তার মধ্যে একটুও চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে না। বরং সে পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে তার থেকে একটা সিগারেট নিয়ে মুখে   দিয়ে অন্য প্যাকেট থেকে একটা দেশলাই      বার করে ফস করে মুখের সিগারেট টি জ্বালিয়ে একটা সুখটান দিলো।
তখনো তার সামনে সেই বিড়াল টি দাঁড়িয়ে আছে। তবে এখন সেটি অনন্ত র মাথা ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় একটা পূর্ণ বয়স্ক হাতির মতো সাইজ। তারপর ক্ষণেই বিড়ালটির রূপ একটা বীভৎস মূর্তিতে পরিবর্তিত হয়ে উঠলো।প্রায় বারো ফুট উঁচু মূর্তি টি মানুষ আকৃতির হলেও মানুষ নয়। তার মাথা  থেকে  লম্বা লম্বা চুলের গোছা পা পর্যন্ত নেমেছে । তার মুখটাকে বেশ কিছু চুল ঢেকে থাকায় পরিস্কার ভাবে মুখটাকে দেখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা চুলের গোছা গুলো সাপের মতো নড়াচড়া করছে। একটা চুলের গোছা অন্য চুলের গোছার উপর ওঠানামা করছে। লোকটার পরণে একটা কালো জোব্বা গোছের পোশাক।আর ষ্ট্রীট লাইটের স্পষ্ট আলোয় দেখা যাচ্ছে সেই ভেতর থেকে দুটো মুষ্টিবদ্ধ হাত বের হয়ে আছে।হাত দুটো য় একটুও মাংস নেই। শুধুই হাড়।
মূর্তি টি তীব্র শব্দ করে এক পৈশাচিক হাঁসি হেঁসে উঠল। নির্জনে সেই হাসি শুনে অনন্ত র শরীরে হালকা শিহরণ খেলে গেল। অনন্ত সেটাকে পাত্তা না দিয়ে মুখের সিগারেট টিতে শেষ সুখটান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর খুব শান্ত স্বরে মূর্তিটির উদ্দেশ্যে বললো , " তোমার ভেলকিবাজি শেষ হয়েছে? তাহলে এবার পথ ছাড়ো।"
ঠিক এই সময় অনন্ত র ফোনটা রিং হতে থাকলো। অনন্ত পকেট থেকে ফোনটা বার করে রিসিভ করে স্পীকার অন করে দিলো।
মধুর রাগী কন্ঠস্বর শোনা গেল " তোমার পিন্ডির কাজ শেষ হয়েছে?"
অনন্ত খুব ঠাণ্ডা স্বরে উত্তর দিলো "দেখো না মধু একে কাজ শেষ হতেই এতো রাত হয়ে গেছে , তার ওপর রাস্তায় একজন পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। যেতেই দিচ্ছে না।"
মধুর রাগ এতোক্ষণ অনন্ত র উপর হচ্ছিলো । কিন্তু যেইমাত্র অনন্ত র মুখে শুনলো একজন তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে অমনি তার মনে অনন্তর প্রতি সহানুভূতি জাগলো আর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অজানা ব্যাক্তির উপর। মধু ভাবলো সামনে কোনো মাতাল দাঁড়িয়ে অনন্ত র পথ আটকেছে।
মধু বললো "ফোনটা স্পীকারে দিয়ে সামনের জনের দিকে ঘোরাও তো।"
অনন্ত উত্তর দিলো " ফোনটা স্পীকারেই আছে ।আমি সামনের জনের দিকে ঘোরাচ্ছি । তুমি একটু ভালো করে রগড়ে দাও।"
এবারে মধু তার মধুর ভাষণ শুরু করলো " শূয়োরের বাচ্ছা, অলপ্পেয়ে ড্যাকরা , তোদের মতো রাস্তার কুকুরের জ্বালায় কি কোনো ভদ্রলোক পথে বেরোতে পারবে না? তোদের মরণ হয় না? এতো রাতে মদ গাঁজা গিলে রাস্তায় মস্তানি করছিস? ঝাঁটাপেটা করে তোর বিষ ঝেড়ে দেবো ............."
অনন্ত পকেট থেকে আরো একটি সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে সুখটান দিতে লাগলো। ওদিকে মধুর বাক্যবাণ তখনো থামার লক্ষণ নেই। মধু বলে চলেছে " তোর মা বাবা পাঁঠা সন্তানের জন্ম দিয়েছে ...."
এদিকে মধুর বাক্যবাণ শুরু হতেই সামনে থাকা ভয়াবহ বীভৎস মূর্তিটির মধ্যে উল্টো পরিবর্তন শুরু হয়েছে। সেটা আবার একটি বিড়ালে পরিবর্তন হয়েছে।
মধু বলে চলেছে " তোদের সমাজে কোনো স্থান নেই। তোদের চিড়িয়াখানায় ভরে দেওয়া দরকার।..."
বিড়াল টির আকার ক্রমশ ছোট হচ্ছে। দেখতে দেখতে বিড়ালটি পুনরায় একটা ছোট্ট ছানায় পরিণত হয়ে রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে মিউ মিউ করছে।
অনন্ত এবার সিগারেট টা ফেলে দিয়ে ফোনটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে মধুকে বললো " এবার চুপ কর ।ঐ ব্যাটার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। "
মধু বললো " ঠিক আছে রাখছি। তবে ফের যদি জ্বালাতন করে আমাকে ফোন করবে। চাবকে ওটার পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেবো। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।"




মধুর ফোনটা কেটে দিয়ে অনন্ত দেখলো তখনো বিড়াল ছানাটি রাস্তার এক ধারে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে।
অনন্ত নিজের মনেই  একটু হেসে এগিয়ে গেলো। বিড়াল ছানাটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আচমকা বাগচী সাহেবের কথা মনে হলো।তার মনে বাগচী সাহেবের ওপর রাগ  আগে থেকেই ছিল। আজকের ঘটনার জন্য বাগচী সাহেব দায়ী।আর এটা মনে আসতেই রাগের চোটে বিড়াল ছানাটির পেটে সজোরে বুটের একটা লাথি কষিয়ে দিয়ে বলে উঠলো " ফোট! শালা!!!"