Crss colum

Tuesday, November 21, 2017

গল্পঃ - দেহহীন।

কিছুক্ষণ আগে আমার মৃত্যু হয়েছে। প্রথমে বুঝতে পারি নি। কর্মক্ষেত্রে একা থাকি। স্ত্রী ও কন্যা আগে আমার সঙ্গেই থাকত। কিন্তু কিছুদিন আগে আমি নতুন বাড়ি করার পর ,সেখানেই থাকে। আমি পুরানো অফিস কোয়ার্টারে একাকী দিন যাপন করি। সপ্তাহে একদিন বা কখনো দুই দিন বাড়ি যাই। বাড়ি বেশি দূরে নয়। ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা। কিন্তু প্রতিদিন ভোরবেলা অফিসে আস্তে অসুবিধা তাই এখানেই থাকি।
গতকাল সন্ধ্যা থেকেই শরীরটা একটু গড়বড়  করছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম এসিডিটি হয়েছে। ঘরে একটা এন্টাসিড ছিল সেটাই খেয়েছিলাম। রাত ন'টা নাগাদ আমার স্ত্রী মিনতি ফোন করেছিল । এটা-ওটা কথা বলার পর, আমি বলেছিলাম’ “শরীরটা ভালো নেই”। মিনতি  শুনে ই আমায় একগাদা কথা শুনিয়ে দিল। আমি নাকি লোভ সামলাতে না পেরে এটা-ওটা খাই, তাই আমার এত শরীর খারাপ করে। রাগে আমি তৎক্ষণাৎ ফোনটা কেটে দিয়েছিলাম। রাত্রে তেমন কিছু আর না খেয়ে , শুধু  একগ্লাস দুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম । রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি। ভোর চারটে নাগাদ একবার বাথরুমে গিয়েছিলাম। বাথরুম থেকে এসে সবে  বিছানায় শুয়েছি এমন সময় বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে উঠলো। প্রথমে খুব একটা পাত্তা দিইনি। তারপর ক্রমশ যন্ত্রণাটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মনে হয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম।
পুনরায় যখন আমার অস্তিত্বে ফিরে এলাম দেখলাম আমি আমার ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। ঘরে নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। নাইটল্যাম্পের মৃদু আলোয় মনে হল বিছানায় কেউ একজন শুয়ে আছে। প্রথম নজরে মনে হল আমার চেনা কেউ। হঠাৎ আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম ,” “ ঐ লোকটা তো আমি”।
তবে কি আমি  , অনির্বাণ চ‍্যাটার্জ্জী কি আর বেঁচে নেই ??
আমার এবার সত্যি খুব ভয় পাচ্ছে।
এখনো যে আমার অনেক কাজ বাকি আছে।
না, যে করেই হোক আমাকে বাঁচতেই  হবে। আমি বারবার চেষ্টা করলাম শরীরের মধ্যে পুনরায় প্রবেশ  করতে ।।
না কিছুতেই পারছি না।
এখনো যে আমার অনেক কাজ বাকি। মেয়ে টার পড়াশোনা বাকি। ইচ্ছা ছিলো মেয়ে টার  বিয়ে ভালো ঘরে ধুমধাম করে দেবো।
কিছুই শেষ পর্যন্ত হলোনা।
আমার মৃতদেহের দিকে চেয়ে এত কথা ভাবছিলাম ।
একটা ফাঁকা ঘরে, একটা মৃতদেহ র সাথে এতক্ষন আছি বেশ ভয় ভয় লাগছে। হলেও বা নিজের মৃতদেহ। পাশের ঘরে গেলাম। পাশের ঘরটি ঠাকুরঘর। বহুদিন থেকে আমি মা কালীর একনিষ্ঠ ভক্ত। বছরে বছরে আমার ঘরে কালীপুজোর দিন বড় করে পুজো হয়। মা কালীর মূর্তি র দিকে চেয়ে মনে মনে বললাম “মাগো, তুই একি করলি ? এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। এর মধ্যেই টেনে নিলি।”

এখনই ভোর হবে। হরিপদ ঘর পরিষ্কার করতে আসবে।
হঠাৎ ইচ্ছা হল মিনতিকে দেখবার। মূহুর্তের মধ্যেই দেখি আমি আমার ঘরে পৌঁছিয়ে গিয়েছি। নতুন কেনা বক্স খাটের উপর মিনতি ও লেখা শুয়ে আছে। মিনতি বাচ্চাদের মত  জড়সড় হয়ে শুয়ে থাকে। আর আমার মেয়ে লেখা এখনো মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। দু'জনেই এখনো জানেনা, আমি আর নেই।
হঠাৎ মনে হল হরিপদ ডাকছে “বাবু, ও বাবু, দরজাটা খুলুন।”
তৎক্ষণাৎ আমি আবার আমার ঘরে পৌঁছে গিয়েছি।
ওরে হরিপদো, আমি আর কখনই দরজা খুলব না।
বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর, পাশাপাশি কোয়ার্টারের কয়েকজন চলে এলো। হরিপদো তাদের উদ্দেশ্যে বলল, “অনেকক্ষণ ধরে ডাকছি, বাবু সাড়া দিচ্ছে না।”
অবিলম্বে কিছুক্ষণের মধ্যে ই অফিসের সিকিউরিটি অফিসার চলে এলেন। সবাই মিলে দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল। দরজা ভেঙ্গে ফেলা মাত্র হরিপদো ছিটকে  ঘরের ভিতরে ঢুকল। আমাকে দেখামাত্রই “বাবু  গো” বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমি জানি হরিপদো আমায় খুবই ভালবাসতো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর চলে গেল সর্বত্র।
আমার স্ত্রী ,মেয়ে ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন , সহকর্মীরা ও অধীনস্ত লোকেরা সবাই এসে ভিড় করলো।
আমি ছিলাম অফিসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জুনিয়ার ম‍্যানেজার । তাই লোকের ভীড় তো হবেই।
আমি সবকিছুই দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কেউ আমায় দেখতে পাচ্ছে না। আমার কোয়ার্টারের সামনের ফাঁকা জায়গায় আমার মৃতদেহ ছোট মৃতদেহ বহন কারি খাটের উপর রাখা হয়েছে। গলায় অফিসের সহকর্মীদের দেয়া ফুলের মালা। চড়া গন্ধের ধূপ জ্বলছে। একদিকে দেখলাম আমার সহকর্মী সুশান্ত খুব কাঁদছে। দেবুকে দেখলাম তার কাছে গিয়ে  সান্তনা দিচ্ছে। সুশান্ত কাঁদতে কাঁদতে বলল, “অনির্বাণ দার সাথে আমার মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু আমি তাকে বড় দাদার চোখে দেখতাম। আজ মানুষটি চলে গেছে ন , আমার মনে হচ্ছে যেন প্রিয়জন হারালাম।”
এক কোণে দেখলাম আমার মেয়ে লেখা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আমি জানি ওর কাছে আমি ই সব ছিলাম।
ক্রমশ মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল। মেয়ে মুখাগ্নি করল । আমি একধারে দাঁড়িয়ে দেখছি আমার নশ্বর শরীরটাকে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করছে।
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ আমাকে ‘খোকা’ বলে ডাকলো। চেয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছেন। মা বহুদিন আগে গত হয়েছেন। মা বললেন “খোকা এখানে আর থাকতে হবে না। চল তোকে তোর নিজের জায়গায় পৌঁছে দিই।”
আমি বললাম “কোথায় মা”?
মা বললেন “মৃত্যু র পর পুনরায় জন্ম না নেওয়া পর্যন্ত প্রত‍্যেক আত্মার কর্ম অনুযায়ী নিজের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে জ্ঞান অর্জন এর জন্য অবস্থান করতে হয় । তারপর আবার জন্ম নিতে হয় , এই চক্র ই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আমার পুনঃ জন্মের নির্দেশ এসেছে। শুধু তোর সাথে দেখা করবো বলে এতদিন অপেক্ষা করছি।চল যাওয়া যাক।”
মায়ের হাত ধরে এক অজানা সুন্দর স্থানে হাজির হলাম। একটি খরস্রোতা নদী বয়ে চলেছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম।
আমি মাকে প্রশ্ন করলাম “মা এটা ই কি স্বর্গ ?”
মা উত্তরে বললেন “হতে পারে। আসলে তোর কর্ম তোর অবচেতন মনের ইচ্ছা অনুযায়ী সূক্ষ্ম জগতে  এই জায়গাটা সৃষ্টি করেছে। প্রত‍্যেক মানুষ এর  কর্ম অনুযায়ী তাদের থাকার স্থান ভিন্ন ধরনের হয়। আমার থাকার স্থান ভিন্ন। আমি শুধু তোকে এখানে পৌঁছে দিতে এসেছি। এবার চলি”।
আমি বললাম “মা আমি কি এখানে একা থাকবো ?”
মা বললেন “সেটা তোর ইচ্ছে র উপর নির্ভর করছে। তবে তোর চেয়ে নিম্ন স্তরের কেউ তোর এখানে আসতে পারবে না ।”
মা চলে গেলেন।
আমি নতুন জায়গা টা ভালো করে দেখতে লাগলাম। হ‍্যাঁ , আমি ঠিক এই ধরনের জায়গা র কথাই স্বপ্নে দেখেছি। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আমার জায়গা টা ভালো লেগে গেলো। এখানে  দিন রাত নেই।  সব সময় যেন ঊষা কাল। সব সময় কোন কাজ করার চেষ্টা করি । এখানে যে কোন কাজ  সহজেই হয়ে যায়। কোন কিছু জানার চেষ্টা করলে বা জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করলে সেই জ্ঞান আপনা আপনি অন্তরে অনুভব হয়। [ কৃতজ্ঞতা স্বীকার ঃ অনেক দিন আগে বিভূতিভূষণ এর দেবযান পড়ে ছিলাম। এই লেখাটি তে তার ছায়া আছে ,বিশেষত পরলোকের বর্ণনায় ।]
এক দিন নদীর ধারে ঘুরছি ,দেখি  আধপাগলা মতো   মধ‍্য বয়স্ক  একটা লোক নদীর ধারে বসে আছে। কাছে গিয়ে বললাম “আপনি কে ?”
তিনি উত্তর দিলেন , “আমি মায়ের ছেলে। বসে বসে মায়ের লীলা খেলা দেখছি।”
আমি প্রশ্ন করলাম, “আপনার মা কোথায়?”
তিনি বললেন “যা দেখছি সবই তো আমার মা । এই বিশ্ব প্রকৃতি ই তো আমার মা । এমনকি এই স্থূল শরীর, সুক্ষ্ম শরীর  ,কারণ শরীর, সবকিছুই আমার মা। মা নিজেই বিশ্ব প্রকৃতি।”
ভাল করে তাকিয়ে ওনাকে আমার খুব চেনা মনে হল।
আরে ;! ইনিই তো সেই বিখ্যাত…...।
ওনাকে সেই কথা বলতে , উনি বললেন  “জানি না , হয়তো হবেও বা….”
এই বলে গভীর জঙ্গলের দিকে চলে গেলেন।
হঠাৎ মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো লেখার কথা ভেবে। ভাবা মাত্রই পৌঁছে গেলাম লেখা র কাছে। দেখলাম লেখা  আমার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে টসটস করে চোখের জল ফেলছে। আমিও কেঁদে ফেললাম। “ মাগো তোকে ছেড়ে আমিও সুখে নেই।”
আবার ফিরে এলাম নিজের জায়গায়। এমনি করেই দিন কাটতে লাগলো। মাঝে মাঝে যাই লেখা ও মিনতি কেমন আছে দেখতে। হঠাৎ শুনলাম লেখার বিয়ে। আমি মারা যাওয়ার পর আমাদের বাড়ির আর্থিক অবস্থা নিন্মগামী হয়েছে। তাই লেখার বিয়ে কোন রকমে এক বেসরকারি চাকুরী জীবির  সাথে হচ্ছে। আমি চেয়েছিলাম লেখার বিয়ে আরো উন্নত ঘরে হোক। কিন্তু আমার কিই বা করার আছে। যাই হোক বিয়ের মন্ডপে সূক্ষ্মরূপে উপস্থিত হয়ে আমি লেখাকে প্রাণ ভরে আর্শীবাদ  করলাম ।
“মাগো যে ঘরে যাবি , সেই ঘরকে আলোকিত করে রাখবি।”
দিন যায় এক এক করে। এখানে এক দিন মানে পার্থিব এক চান্দ্র মাসের সমান। অনেক জ্ঞান অর্জন হচ্ছে।আল্টিমেট ট্রুথ বলে কিছু নেই। ঈশ্বর ই একমাত্র সত্য। এই জগতে তার শরীর স্বরূপ।
তবুও  সব কিছু র মাঝে  মনটা বড়ই উচাটন করে লেখা র জন্য। লেখার অভাব অনটন আমায় বড়ই পীড়া দেয়। হয়তো আমার কৃত  পাপের এটাই নরকভোগ ।
একদিন দেখা হয়ে গেল সেই পাগলা ঠাকুরের সাথে । তিনি বললেন ,”তোকে যেতে হবে। এখানে তোর থাকার দিন শেষ হয়ে গেছে।”
আমি বললাম “কোথায় যাবো ?”
তিনি উত্তর দিলেন “যেখানে তোর মন যেতে চাইছে, তোর মেয়ের কাছে”।  “বাবা হয়ে মেয়ের দুঃখ দূর করতে পারিস নি , যা এবার  পুত্র হয়ে মেয়ের প্রতি কর্তব্য পালন কর। মায়ের দুঃখ দুর কর।”
আমি বললাম  “ঠাকুর মনে মনে আমি হয়তো এটাই চাইছিলাম। তুমি আমায় আশীর্বাদ করো আমি যেন নিজের কর্তব্য পালন করতে পারি।”

সেই পাগলা ঠাকুর আর্শীবাদ করলেন। আমি অনুভব করলাম আমি যেন ছোট হয়ে যাচ্ছি। ক্রমশ সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্ম তর হচ্ছি। একসময় বিন্দু তে পরিণত হলাম। সেই বিন্দু আমি পৃথিবী তে এসে ঘুরতে ঘুরতে কোন এক আশ্চর্য উপায়ে হয়তো বা ঈশ্বরের আশীর্বাদে এক অন্ধকারে আশ্রয় পেলাম। আমি জানি এটাই মাতৃগর্ভ।
“ মাগো আর কিছু দিন অপেক্ষা করো , আমি আসছি তোমার কোলে শিশু রূপে তোমার সব দুঃখ ঘোচাতে।” (শেষ)।








Monday, November 20, 2017

বাংলা গল্প: গল্প -ভাগ‍্যবদল

বাংলা গল্প: গল্প -ভাগ‍্যবদল: গল্পঃ - ভাগ্য বদল। মানুষের যখন অনেক দুঃখ হয় তবে ই সে জীবন শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবে। জীবন খুবই আশ্চর্য ঘটনা র সম্মূখীন করে দেয় মানুষ কে...

গল্প -ভাগ‍্যবদল

গল্পঃ - ভাগ্য বদল।
মানুষের যখন অনেক দুঃখ হয় তবে ই সে জীবন শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবে।
জীবন খুবই আশ্চর্য ঘটনা র সম্মূখীন করে দেয় মানুষ কে ।রবি যথেষ্ট দৃঢ়চেতা । মৃত্যু র কথা কখনো ই সে চিন্তা করেনি।সে তার অনেক দুঃখের মধ্যেও বাঁচতে চেয়েছিলো। ছোট বেলা থেকেই অসীম কষ্টের সাথে বড় হয়েছে। বাবা মারা গিয়েছিল ছোটবেলায় ।মা অনেক কষ্টকরে রবিকে মানুষ করেছে।মা খুব ভালো সেলাই করতেন । অসময়ে সেই সেলাই বোনা ই সংসার টাকে টিকিয়ে দিলো । কোনরকমে মা ছেলের সংসার চলতে লাগলো। রবি পড়াশোনা য় খুবই ভালো  ছিল। একটি র পর একটি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হতে হতে রবি একসময় বি এসসি   পাশ করলো। রবি এরপরও মাষ্টার্স ডিগ্রী করতে চেয়েছিলো  । কিন্তু মায়ের দিকে চেয়ে আরো পড়বো এই কথাটা বলতে পারলো না ।তার পড়াশোনার খরচ যোগাড় করতে ,  মা দিন রাত  পরিশ্রম করেছেন । রবি পড়াশোনা করার জন্যে এতদিন ভালো করে মায়ের দিকে চেয়ে দেখেনি। আজ দেখলো । মায়ের শরীর একেবারে ভেঙ্গে গেছে । তাই সে “আরও পড়বো” না বলে ,'মা এবার থেকে আমি চাকরি করব' এই কথাটা বললো।
কিন্তু চাকরি কি এতো সহজে ই জোটে ? অনেক চেষ্টার পর একটি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি তে ৬০০০ টাকা মাইনের  একটা চাকরি জুটলো। কিন্তু রবি র  এমনই কপাল ,এই চাকরি পাবার এক মাসের মধ্যে মা মারা গেলেন। মা ছাড়া রবির আর কেউই ছিলো না পৃথিবীতে। রবি একা হয়ে গেল।
একাকীত্বের জীবন। সারাদিন কাজ আর রাতে বাড়িতে ফিরে ঘুম। বেশ চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিনের ঘটনা তার জীবন ওলট-পালট করে দিল। মিথ্যা টাকা চুরির অপরাধে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। চুরির অপবাদ সহ্য হলো না। সে ভাবল এই জীবন রেখে কি হবে? দুঃখ ছাড়া এই জীবনে তার আর কিছুই পাওয়ার নেই । এই জীবন রাখার চেয়ে শেষ করে দেওয়া ভালো। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল আজকেই তার জীবন শেষ করে দেবে। শহরের এক পাশে নদীর ধারে একটি পোড়ো বাড়ির সন্ধান রবি জানতো । সেখানে কেউ থাকেনা। রবি ঠিক করল ওখানে গিয়ে  বাড়িটির তিনতলা থেকে নদীতে লাফ  দিয়ে জীবন শেষ করে দেবে। রবি সাঁতার জানত না।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রবি সেই বাড়িটির তিন তলার  ছাদে উঠলো। তখন সন্ধ্যা হয় হয় । কেউ কোথাও নেই। রবি সেই বাড়িটির ন‍্যাড়া  ছাদের কিনারায় দাড়িয়ে নিচের দিকে তাকালো। অনেক নিচে খরস্রোতা নদী বয়ে চলেছে । রবি চোখ বুজে ' মা তোমার কাছে আসছি ' এই বলে নীচে লাফ দিল। নীচে নদীতে পড়বার আগেই , রবি  জ্ঞান হারিয়ে ফেললো । জ্ঞান হারাবার ঠিক আগে রবি  ডান হাতের আঙুলে শক্ত মতো কিছু একটা বস্তু অনুভব করল ।
রবির যখন জ্ঞান ফিরল, দেখল সে নদীর ধারে মাটিতে শুয়ে আছে । চারিদিকে অন্ধকার। কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু নদীর জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রবি শুয়েই  রইল । শরীরে অসহ্য ব্যাথা। হঠাৎ চোখের সামনে একটা নীল আলোর বিন্দু দেখা দিল। রবি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল। নীল আলোর বিন্দু টা ক্রমশ বড় হতে লাগলো । রবি অবাক হয়ে গেল। এক সময় আলোর বিন্দুটি থেকে একটি মানুষের মূর্তি দেখা গেল। রবি  দেখলো মানুষটিকে হুবহু  তার মত দেখতে। সেই আলোর মধ্যে থাকা মূর্তি টি তার দিকে চেয়ে হাসলো। রবি প্রশ্ন করল ‘তুমি কে?’। সেই মূর্তি টি উত্তর দিল‘আমি রবিন।’ ‘আমি অন্য জগৎ থেকে  আসছি’। রবি পুনরায় প্রশ্ন করল‘তার মানে ?’। রবিন উত্তর দিলো‘তার মানে খুব স্পষ্ট। তোমাদের বিশ্ব তিন মাত্রার। আমরা ছয়  মাত্রার বিশ্বে থাকি। আমরা তোমাদের চেয়ে অনেক উন্নত। আমাদের বিশ্বে আমি তোমারি প্রতিরূপ । আমাদের বিশ্বে সময় আরো ধীরে চলে ।প্রতিটি মাত্রা র বিশ্ব একে অপরের মধ্যে পিঁয়াজের খোলা র মতো রয়েছে।শুধু মাত্রা ভিন্ন হওয়ার জন্য ঐ সব মাত্রার অবস্থান কারী প্রাণীরা যা বুঝতে পারে না। তারা ভাবে অন্য জগত বলে কিছু নেই। আসলে বিভিন্ন dimension অসংখ্য প্রাণী জগৎ দ্বারা পরিপূর্ণ। তোমাদের এখানের 100 বছর মানে আমাদের জগতের এক বছর সময়। আজ এক মুহূর্তের জন্য তোমার তিন মাত্রার জগত ও আমার ছয় মাত্রার জগত এর সাথে সংযুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঠিক সেই সময় আমার একটি দুর্লভ ও গুরুত্বপূর্ণ বস্তু এই জগতে তোমার কাছে চলে আসে। কারন এই জগতে তুমি আমারই প্রতিরূপ। এই দুর্লভ বস্তুটি হল আমারই আবিষ্কৃত সৌভাগ্য আংটি।  এটি এখন তোমার ডান হাতের অনামিকায় শোভা পাচ্ছে। রবি তৎক্ষণাৎ তার ডান হাত এর দিকে চেয়ে দেখল তার ডানহাতে একটি লাল রংয়ের ধাতব আংটি।
রবিন পুনরায় বলল , এই আংটি টি আমি এখনো সম্পূর্ণ রূপে পরীক্ষা করে উঠতে পারিনি। ভালোই হলো, আমার নিজের তৈরি probability analyzer বা সম্ভাবনা বিশ্লেষক যন্ত্রটি আমায় জানাচ্ছে যে তোমার ভবিষ্যৎ খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমি এই জগতে এসেছি আমার হারিয়ে যাওয়া সৌভাগ্য আংটি ফেরত নিয়ে যেতে। কিন্তু এই আংটি ফিরত নিয়ে গেলেও , তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে এটি আমার আকাঙ্ক্ষিত কাজ নিশ্চিতভাবে করবে। তারচেয়ে এই ভালো যে এটি তোমার কাছেই থাক। আমি আমার জগত থেকে লক্ষ্য রাখবো এই আংটি টি কিভাবে তোমার জীবন পরিবর্তন করে।  তোমার জীবনে যখন এটির প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে তখন এটি আমি এটি ফিরত নিয়ে যাবো।

এরপর নীলাভ আলোটি ও তার মধ্যে থাকা মূর্তিটি মিলিয়ে গেল।
এদিকে পূর্ব আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। রবি উঠে দাঁড়ালো। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। নদীতে জলের ধারে গিয়ে মুখ চোখে জল দিল। এরপর বাড়ির পথ ধরল। ঘরে যখন পৌঁছল তখন খিদেতে পেট চুঁইচুঁই করছে। মুড়ির টিন থেকে একটা বাটিতে মুড়ি বার করে খেতে লাগলো। এমন সময় বাইরে থেকে কেউ একজন “ও রবিদা” বলে ডাকলো। রবি ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল মোড়ের মাথায় লটারির টিকেট বিক্রেতা অমর দাঁড়িয়ে আছে। অমর কে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। অমর হাঁস ফাঁস করে যা বলল তার মানে দাঁড়ায় এই যে কয়েক দিন আগে অমর রবিকে জোর করে যে লটারির টিকেট গিয়েছিল আজ তার result বেরিয়েছে। রবি প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। পুরো 5 লাখ টাকা। tax কেটে হাতে 300000 পাবে। রবি কিছুক্ষণের জন্য হতম্ভব হয়ে গেল। একবার নিজের ডান হাতের অনামিকার দিকে চেয়ে দেখল। হাতের আংটি টি যেন আরো লাল দেখাচ্ছে।
কয়েক দিনের মধ্যেই রবি পুরস্কারের টাকাটা পেয়ে গেল। টাকা পাওয়ার পর রবি কয়েক দিন ভাবল সে কি করবে। সে প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরীর কাজ খুব ভালো করে জানে। সে ঠিক করল একটা ছোটখাটো প্যাথলজিক্যাল laboratory খুলবে। এমনিতে এই অঞ্চলে প্যাথলজিক্যাল laboratory র অভাব রয়েছে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। কয়েক দিনের মধ্যেই নিজের বাড়ির সামনের ঘরে মায়ের নামে একটি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি খুললো। মাস তিনেক যেতে না যেতেই সেটা রমরমিয়ে চালু হয়ে গেল।
একবছর বাদের কথা। রবির এখন দুটি ব্যবসা। একটি laboratory ও অন্যটি গাড়ির ব্যবসা। একদিন রবি এক ডাক্তারের চেম্বারে দেখা করতে গিয়েছিল, সেখানে দেখল অনন্যা বসে আছে। রবি আগে যেখানে কাজ করতো সেই  ল্যাবরেটরির মালিক সুরজিৎ বাবুর মেয়ে অনন্যা। কাজের সূত্রে রবি র সাথে অনন্যার পরিচয় ছিল। যদিও তখন ছিল মালিক ও কর্মচারীর সম্পর্ক । রবি অনন্যা কে দেখে প্রশ্ন করল “তুমি এখানে?”
অনন্যা ম্লান হেসে উত্তর দিল “বাবার খুব অসুখ”। রবি উদ্বেগের সঙ্গে প্রশ্ন করল “কেন কি হয়েছে?”। অনন্যা বলল “cancer। তুমি পারলে একবার এসো। বাবা একবার তোমার সাথে দেখা করতে চায়।”  রবি বলল “আজ বিকালে যাবো তোমাদের বাড়িতে”।
ডাক্তার খানা থেকে বেরিয়ে রবির মন খারাপ হয়ে গেল । সন্ধ্যাবেলা সুরজিৎ বাবুর বাড়ি পৌঁছে কলিং বেল টিপতে অনন্যা দরজা খুলে দিল। অনন্যার মা আগেই মারা গিয়েছিল। বাবা ও মেয়ের সংসার। অনন্যা সাথে শোবার ঘরে গিয়ে দেখল সুরজিৎ বাবু শুয়ে আছেন। চেহারা একদম কঙ্কালসার হয়ে গেছে। রবিকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। রবি বলল “উঠতে হবে না। আপনি যা বলবার শুয়ে শুয়েই বলুন।” সুরজিৎ  বাবু বললেন, “রবি তুমি আমায় ক্ষমা কর। আমি অন্যায় ভাবে তোমায় অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি। আমি একবারও তোমায় অপবাদ দেওয়ার আগে জানবার চেষ্টা পর্যন্ত করিনি ‘তুমি দোষী কিনা।’ পরে বুঝতে পেরেছি তুমি আদৌ চুরি করনি। চুরিটা অন্যজন করেছিল। এবং আমায় ভুল বুঝিয়ে তোমার নামে অপবাদ দেয়ানো হয়েছিল। তুমি আমার ক্ষমা কর। তুমি চলে যাবার পর আমার ব্যবসা ক্রমশ নিচের দিকে গেছে। আজ আমার ক্যান্সার হয়েছে। আর কয়েকদিন মাত্র আমার আয়ু। তুমি আমার একটি উপকার কর। তুমি নতুন করে আমার ব্যবসার হাল ধর। এই জগতে আমার মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। তুমি যদি আমার ব্যবসা ও আমার মেয়ে অনন্যার দেখা শোনা র ভার নাও তবে আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারি।” এতগুলি কথা বলতে গিয়ে  সুরজিৎ বাবু হাঁপিয়ে  উঠলেন। রবি তাড়াতাড়ি তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
দুই বছর পরের কথা রবি তার বিবাহিত স্ত্রী অনন্যা র সাথে দিঘা বেড়াতে গিয়েছিলো। এখনো অনেক রাত্রে অনন্যা ঘুমিয়ে পড়ার পর, রবি ঘুম না আসায় বাইরে বারান্দায় বসে ছিল। হঠাৎ সামনে নীল আলোর বিন্দু দেখা দিল। আলোর বিন্দু কি ক্রমশ বড় হয়ে, তারমধ্যে থেকে একটি মুর্তি দেখা দিল। রবি চিনতে পারল।
রবিন  রবি কে প্রশ্ন করল “কেমন আছো?” রবি উত্তর দিল “ভাল আছি ।”
রবিন বলল “তোমার সময় পাল্টিয়ে গেছে কি ?”  রবি বলল “হ‍্যাঁ ।” “কিন্তু কিভাবে বুঝব আমার ভাগ্য অন্যরকম ছিল”। রোবিন উত্তর দিল “আমার সৌভাগ্য আংটি তোমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। আসলে তুমি সেই রাত্রে নদীর জলে ডুবে মারা গিয়েছো। কিন্তু নদীতে পড়বার আগে আমার তৈরি সৌভাগ্য আংটি তোমার হাতে আসায় তুমি বেঁচে যাও। এই দেখো বিকল্প ইতিহাস কি বলছে,”। এই বলে রবিন নিজের কাছ থেকে একটি কাগজ বের করে রবির হাতে দিল। রবি দেখলো সেটি একটি ডেথ সার্টিফিকেট। যাতে পরিষ্কার করে রবি র নাম লেখা আছে। তারিখটা সেইদিনের। এছাড়া একটি খবরের কাগজের কাটিং রবিন রবিকে দিল। যাতে একটি মৃতদেহের  ছবির  নিচে  হেডিং লেখা আছে জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে রবি দাস নামে এক যুবক। ছবির মৃতদেহ টি হুবহু রবির মতোই দেখতে।” রবি কাগজগুলো ফিরত দিয়ে , আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল “কিন্তু এটি কিভাবে কাজ করে?”
রবিন উত্তর দিল “প্রত্যেকটি ঘটনারই ঘটবার  বা ,না ঘটবার সম্ভাবনা একই সাথে কাজ করে। আমার আংটি আসলে খুবই সূক্ষ্ম উন্নত মানের একটি গেজেট,  যেটি ধারণকারীর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সম্ভাবনা টি কে বাস্তবায়িত করে। এখন  আমি আমার যন্ত্রটি তোমার কাছ হতে ফিরিয়ে নিতে এসেছি। আমার সম্ভাবনা বিশ্লেষক জানাচ্ছে তোমার ভবিষ্যৎ জীবনে কোন অসুবিধা হবে না। তাই তুমি এবার আমার আংটি টি ফেরত দাও।”
রবি হাসি মুখে আংটি টি খুলে রবিনের হাতে দিয়ে বলল “আবার কবে আমাদের দেখা হবে ?”
রবিন উত্তর দিল “ আমি আর তুমি আলাদা সত্ত্বা নই।   প্রতি ব্রহ্মাণ্ড এ , প্রতি টি মাত্রায় আমরাই আছি আলাদা শরীরে । কিন্তু আসলে আমরা একটাই চেতনা।  একটি ই চেতনা প্রতি ডাইমেনশন এ  আলাদা আলাদা শরীর ধারণ করে এই জগত কে উপভোগ করি। কিন্তু আমরা ঘুমের মধ্যে  পরস্পরের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে নিজেদের চৈতন্য কে আরো উন্নত করি।”
“বিদায় , হয়তো আবার দেখা হবে ভবিষ্যতে।”
নীলাভ আলোটি ও তার মধ্যে থাকা রবিন ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।”
পিছনে খুট করে আওয়াজ পেয়ে   রবি চেয়ে দেখল অনন্যা ঘুমিয়ে থেকে উঠে এসেছে। অনন্যা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো “কার সাথে কথা বলছিলেন ?”  
রবি উত্তর দিল “নিজের সাথে। চলো ঘরে যাই ভিতরে যাই , বাইরে  ঠান্ডা পড়ছে ।” (শেষ ) ।