।। সম্রাট ধর্মপাল।।
আজ আপনাদের শোনাবো ইতিহাসের এক বিখ্যাত প্রেম কাহিনী।
রাষ্ট্রকূটরাজ গোবিন্দ র কন্যা রন্না দেবী র বাঙালি সম্রাট ধর্মপালের প্রতি প্রেম।
সম্রাট ধর্মপাল। |
যে প্রেম বাঙালি জাতিকে এক বিরাট বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছিলো।
আমরা অনেকেই নিজেদের ইতিহাস জানি না।
ধর্মপাল ছিলেন মহারাজ গোপালদেবের পুত্র।
মহারাজ শশ্মাঙ্কদেবের মৃত্যুর পর একশত বছর ব্যাপী বাঙালি জাতির বিপর্যয় চলে। শশ্মাঙ্কদেবের পুত্র মানবদেব তার বিশাল গৌড় সাম্রাজ্য ধরে রাখতে অক্ষম হয় ।
এই সময় বঙ্গ দেশে শুরু হয় মৎস্যান্যায়। বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গিলে খায়। তেমনি শশ্মাঙ্ক র মৃত্যুর পর দেখা যায় অসংখ্য ছোট বড় সামন্ত রাজা একে অপরের ক্ষতি সাধনে ব্যাস্ত।
সাধারণ মানুষের দূর্ভোগ চরমে ওঠে। এই অবস্থা একশত বছর ব্যাপি স্থায়ী হয় । বাংলা র ইতিহাসে এই সময় মাৎস্যান্যায় হিসাবে বিখ্যাত।
এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেয় মহারাজ গোপালদেব।
সম্রাট ধর্মপাল। |
ইতিহাস বলে তিনি ছিলেন দয়িতবিষ্ণুর পৌত্র , ও ব্যপোটের পুত্র।কে এই দয়িতবিষ্ণু ,কেই বা ব্যপোট ,তা ইতিহাস জানে না।
গোপালদেব ছিলেন বিচক্ষণ ব্যাক্তি। তিনি ধীরে ধীরে পুরো বাংলা দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। তিনি বাংলার পালবংশের সূচনা করেন।
গোপালদেব আত্মরক্ষা ও রাজ্য রক্ষার জন্য সৃষ্টি করেছিলেন এক দূর্ধর্ষ বাঙালি বাহিনী।
কৈবর্ত, বাগদী,ডোম, ও কেওট ইত্যাদী বর্ণের তাগড়া জোয়ান ছেলেদের নিয়ে তৈরী এই বাহিনী। তাদের হাতিয়ার বলতে ছিল তরোয়াল,ঢাল ,সড়কি ও বল্লম।টাঙ্গি ও শোভা পেত কোন কোন সৈন্য দের কাঁধে।
অস্ত্র সামান্য , কিন্তু অস্ত্র ধারীরা অসামান্য। গঙ্গা , পদ্মা , মেঘনার মতো নদী অস্ত্র নিয়ে সাঁতার দিয়ে পেরোতে এরা অভ্যস্ত। দুশমন যদি খাড়া পাহাড়ের মাথায় কেল্লা গড়ে থাকে , তবে রাতের আঁধারে এই কালো মুশকো জোয়ানরা টিকটিকির মতো সড়সড় করে উঠে পড়ে কোমরে একটা খাটো টাঙ্গি বেঁধে।
এই দূর্ধর্ষ বাহিনীর ভয়ে তখন কাঁপছে পুরো উত্তরাপথ। এই দূর্মদ বাহিনী পতাকা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে,গৌড় মগধের জয়ধ্বনি দিতে দিতে ছেয়ে ফেলেছে পুরো উত্তর ভারত।
সিন্ধু তীর কামরুপ পর্যন্ত সব রাজারা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে বাঙালি ধর্মপাল কে সম্রাট বলে।
কনৌজেশ্বর ইন্দ্ররাজ কে বিতাড়িত করে ধর্মপাল তার বংশবদ মিত্র চক্রায়ুধ কে কনৌজের সিংহাসনে বসান ।চক্রায়ুধের অভিষেক উপলক্ষে আমন্ত্রণ জানানো হয় সিন্ধুর তীর পর্যন্ত সব রাজা দের। যারা আসেন তারা সকলেই বাঙালি সম্রাট ধর্মপালের অধীনতা স্বীকার করেন।ধর্মপাল কারো রাজ্য হরণ করেন না। তিনি সামান্য কিছু রাজকরের বিনিময়ে পরাজিত রাজ্য কে ছত্রছায়া দান করে থাকেন।
চক্রায়ুধের অভিষেক উপলক্ষে থানেশ্বর , বিদর্ভ, মৎস্য,শিবাকোট্ট ও তক্ষশীলা ইত্যাদী রাজ্য থেকে কোন রাজা বা প্রতিনিধি কেউ আসে নাই।
তাই চক্রায়ুধের অভিষেক অন্তে বিশাল দূর্ধর্ষ বাঙালি বাহিনী ‘ জয় মগধ নরেশ ধর্মপাল ’ এই ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে চললো এই সব রাজ্যগুলিকে অধীনে আনার জন্য।
(প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, তখন ‘বাংলাদেশ বা বাংলা’এই কনসেপ্ট গড়ে ওঠেনি। সমগ্র বাংলা তখন মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এই অঞ্চলের অধীবাসিরা তখন বাকি উত্তর ভারতের কাছে মাগধী নামে পরিচিত ছিল। মগধের রাজধানী ছিল পাটলীপুত্র। অবশ্য মহারাজ শশ্মাঙ্কের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ।)
পঞ্চনদের দেশ পর্যন্ত দুর্বার গতিতে এগিয়ে চললো ধর্মপালের বিজয় বাহিনী। বাঙালি সাম্রাজ্য ব্রহ্মপুত্র থেকে সিন্ধু বিপাশা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত।
কিন্তু প্রতিরোধ এলো মরুভূমির গুর্জররাজ নাগভটের কাছ থেকে।
নাগভট রণসজ্জা শুরু করলো দূরাগত বাঙালি বাহিনী কে অসিমূখে অভ্যর্থনা করার জন্য।
কিন্তু নাগভটের সমরপিপাসা মেটানোর সূযোগ ধর্মপালের হলো না।
তিব্বত রাজ শ্রক শেম গাম্পো ঠিক করলেন তিনি বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তার করবেন এবং এক বিশাল তিব্বতীয় নৌবাহিনী গড়ে তুলবেন।
তিনি তাই নেপাল আক্রমণ করেছেন। নেপাল ঠিক গৌড়বঙ্গের উত্তর দিকে অবস্থিত। নেপাল পরাজিত হলে তিব্বতরাজের কাছে গৌড় বঙ্গ নিরাপদ থাকবে না।তাই ধর্মপাল সসৈন্যে দৌড়লেন আশ্রিত সামন্ত রাজ্য নেপাল কে রক্ষা করার জন্য।
তাছাড়া সম্রাট হিসেবে এটি তার কর্তব্য।
কিন্তু সে যুদ্ধ সহজে থামবার নয়। জলস্রোতের মতো তিব্বতী সৈন্য আসছে। বাধ্য হয়ে ধর্মপাল কেও নতুন নতুন বাহিনী আনাতে হচ্ছে গৌড় থেকে।
এদিকে গুর্জর রাজ নাগভট দেখলেন এই সুযোগ।ধর্মপাল তিব্বতের সাথে যুদ্ধরত।এই সুযোগে নাগভট বিশাল বাহিনী নিয়ে পাটলিপুত্র অবরোধ করলো।পাটলিপুত্র তখন গৌড় মগধ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী।
গৌড় থেকে সচিবেরা আবেদন পাঠালেন সম্রাটের কাছে। 'চলে আসুন সম্রাট। নয়তো আজ যাবে পাটলিপুত্র , এরপর যাবে গৌড়।’
ধর্মপাল পড়লেন উভয় সঙ্কটে।
তিনি যদি পেছিয়ে আসেন তবে তিব্বত রাজ শ্রক শেম গাম্পো এগিয়ে আসবে। আবার যদি পাটলিপুত্র তথা গৌড় মগধ সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে।
কে রক্ষা করবে এই গৌড় মগধ সাম্রাজ্য ?
এগিয়ে এলেন এক সূন্দরী রাজকন্যা।
সম্রাট ধর্মপাল। |
ভারতের দাক্ষিণাত্য দেশে তখন রাষ্ট্রকূট দের রাজত্ব।তারা তখন উত্তর ভারতের রাজনীতি র সাথে সম্পর্ক রাখতেন না।
একদিন রাষ্ট্রকূট রাজ গোবিন্দ তার মেয়ে রন্না কে বললেন , “তোমার তো বিবাহের বয়স হলো। এবার তোমার বিবাহের ব্যবস্থা করতে হয়।”
রন্না উত্তর দিলো , “ পিতা , আমি আমার বর বেছে রেখেছি।”
গোবিন্দ বললেন , “কে ?”
রন্না দেবী তখন এক সূবর্ণ পেটিকা থেকে এক দেবকান্তি জ্যোতির্ময় যুবকের প্রতিকৃতি বার করলো।
সারা ভারত জুড়ে তখন রাজন্য মহলে দেবকান্তি বীরশ্রেষ্ঠ ধর্মপালের কীর্তি আলোচিত।
কিশোরী রন্না এই দেবকান্তি যুবকের কীর্তি শুনে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছেন ধর্মপাল কে। গোপনে তার প্রতিকৃতি জোগাড় করেছেন ।
প্রতিকৃতি হাতে নিয়ে গোবিন্দ লজ্জাবনত মেয়ে র দিকে তাকিয়ে বললেন , “ এ তো মনে হচ্ছে ধর্মপাল।”
রন্না বললেন , “আপনি ঠিক ধরেছেন বাবা।এটি গৌড়ের সম্রাট ধর্মপালের প্রতিকৃতি।”
গোবিন্দ উত্তর দিলো , “কিন্তু ধর্মপাল তো এখন ভীষণ সংকটের মধ্যে আছে।”
রন্না বললো “তুমি তাকে উদ্ধার করো বাবা।”
সম্রাট ধর্মপাল। |
অতঃপর কয়েক দিনের মধ্যেই বিশাল রাষ্ট্রকূট বাহিনী এগিয়ে চললো পাটলিপুত্র অভিমূখে।
পাটলিপুত্র অবরোধ কারী নাগভটের সাথে যুদ্ধ হলো রাষ্ট্রকূট সৈন্য দের।
গুর্জর রাজ নাগভট কে চূর্ণ করে রাষ্ট্রকূট বাহিনী এগিয়ে চললো নেপাল অভিমূখে ধর্মপালকে সাহায্য করার জন্য।
এদিকে ধর্মপাল চর মূখে রাষ্ট্রকূট দের উপস্থিতি ও নাগভটের পরাজয়ের ঘটনা শুনেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রকূট দের উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারছেন না।
কয়েক দিনের মধ্যেই রাষ্ট্রকূটদের দূত ও মহারাজ গোবিন্দর কুলপুরোহিত ধর্মপালের কাছে এলেন রাজকন্যা রন্না র সাথে সম্রাট ধর্মপালের শুভ পরিণয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
কয়েক দিন পরে রাজকন্যা রন্না র সাথে ধর্মপালের বিবাহ সম্পন্ন হলো।
গৌড়ের সাম্রাজ্য লক্ষ্মী হলেন রাষ্ট্রকূট দুহিতা রন্না।।
আর তিব্বত রাজ শ্রক শেম গাম্পো গৌড় ও রাষ্ট্রকূট দের মিলিত বাহিনীর সম্মূখীন হওয়ার সাহস করলেন না।
আজ বাঙালি তার প্রকৃত ইতিহাস ভুলে গেছে। তাই বাঙালি ভীরুতা কে আশ্রয় করেছে। অথচ এই বাঙালি এক সময় বাহুবলে সমগ্র উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল।
সম্রাট ধর্মপাল ও রাজকন্যা রন্না র নাম বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
সম্রাট ধর্মপাল। |