Crss colum

দাবানল.

(এই লেখা গল্পটি সম্পূর্ণভাবে কল্পিত .কোথাও যদি বাস্তবের সাথে কোন মিল থাকে তা কাকতালীয় )

দাবানল -- ভবেশ মিত্র এলাকায় ভবাদা বলেই পরিচিত . আজ ছোট মেয়ে বিজয়ার প্রণাম করতে এসেছে .সন্ধ্যা বেলায় অমলকে দিয়ে দু কিলো খাসীর মাংস আনানো হয়েছ.এমনিতে ভবেশবাবু রাত আটটার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে নেন . আজ রান্না শেষ হতে একটু দেরি হল .প্রায় পৌনে দশটার সময় হৈমন্তী এসে বললো ‘খাবে চলো . বৌমা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে .’ ভবেশবাবু টিভি থেকে চোখ সরিয়ে হৈমন্তীর দিকে তাকালেন .হৈমন্তীর বেশ বয়স হয়েছে বোঝা যায় .কিন্তু দৃষ্টি যেন আগের মতোই আছে .ভবেশবাবু হৈমন্তীর চোখের দিকে তাকাতে ইদানীং অসস্তি বোধ  করেন . একটা নীরব অভিযোগ সেই দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে অনুভব করেন . হৈমন্তী চলে যাবার পর ভবেশবাবু টিভি বন্ধ করে খাবার টেবিলে এলেন .আজ সবাই একসাথে রাতের খাবার খাওয়া হবে . ছোটোখোকা  এখনো আসেনি .বড় ছেলে রবি ,ছোটো মেয়ে নীলা , রবির ছেলে অনীক ,নীলার মেয়ে শ্রাবণী ,ভবেশবাবুর পি .এ. অমল সবাই আজ একসাথে খাওয়া হবে .অমল এই বাড়ীতেই থাকে .ভবেশবাবু এসে বসতেই রবির বৌ রমা খাবার দিতে শুরু করলো .ঠিক সেই সময় আওয়াজটা ভেসে এলো “ ……..  তসবী “.পরক্ষণেই আর একদলের চিতকার “............হু …..আকবর “.অমল টেবিল থেকে উঠে কাঁচের জানালার কাছে গিয়ে পাশের বসতির দিকে তাকালো.মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে ভবেশবাবু র দিকে তাকিয়ে বললো ‘সার ,আবার আক্রমণ করেছে.এবারে সংখ্যায় আরো বেশী মনে হচ্ছে .’ ভবেশবাবুর মনে বাবার মুখ থেকে শোনা ভয়ংকর স্মৃতিগুলি মনে পড়ে যেতে থাকে . পূর্ববঙ্গের নোয়াখালিতে তাদের আদি বাড়ী.তখনো ভবেশবাবুর জন্ম হয়নি .কোনো এক রাত্রে বাবা,মা,আর ছোটো কাকা জীবন বাঁচাতে সব কিছু ছেড়ে এক অজানা গন্তব্যে যাত্রা শুরু করে .চারিদিকে তখন হিন্দু পরিবারগুলি কে এই আতঙ্কের ধ্বনি ঘিরে ধরেছে.ধর্ষণ ,হত্যা লুঠপাট শুরু হয়েছে.সেই ভয়ংকর দিনগুলি বাবা ,মা ছোটো কাকা যতদিন বেঁচে ছিলেন কখনো ভোলেননি .এই জায়গাটায় যখন তাদের পরিবার বাসা বেঁধেছিলো তখন এটি একটি বর্ধিষ্ণু মফস্বল.মূলত হিন্দু প্রধান .বাবা চেয়েছিলেন তাদের পরিবারের পূর্ণ নিরপত্তা . ভবেশবাবুর জন্ম পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি. বাবা একটা আপার প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন .ছোটো কাকা পুলিশের চাকরি পেয়েছিলেন.কলেজে পড়ার সময় ভবেশবাবু বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন .সেই সময় হৈমন্তীর সাথে পরিচয় .তারপর প্রেম.ভবেশবাবুর আদর্শ হৈমন্তীকে আকৃষ্ট করেছিলো .প্রায় বেকার ভবেশবাবুকে বিয়ে করতে সে সময় হৈমন্তী দ্বিধা করেনি .পার্টির কাজে তখন প্রায়ই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হতো .হৈমন্তী তখন একটি প্রাইমারী বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছে.হৈমন্তী ঐ সময় পুরো সংসারের ভার একা বহন  করেছে.তারপরে দিন বদল হলো .লাল পার্টির সরকার এলো আটাত্তরে . ভবেশবাবু এই অঞ্চলের এম .এল এ নির্বাচিত হলেন . সীমান্ত ঘেঁষা এই মফস্বলে তখন প্রতিদিন লোক সংখ্যা বেড়ে চলেছে .মূলত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী .ভবেশবাবুর দলের সরাসরি মদতে এই দেশে ঢুকলেই পেয়ে যাচ্ছে রেশন কার্ড .ভবেশবাবুর টু পাইস আমদানি বেড়েই চলেছে. এই অঞ্চলের বাঘে গরুতে তখন ভবেশবাবুর কথায় একঘাটে জল খায়.চারিদিকে স্তাবকের দল . এই সময় থেকে হৈমন্তী নিজেকে ভবেশবাবুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলো .আসলে হৈমন্তী সেই আদর্শবাদী মানুষটাকে এখনকার মানুষটার সাথে মেলাতে পারছিলো না .ভবেশবাবুও ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন .কিন্তু তখন ঐ সব সেন্টিমেন্টাল ব্যাপারে কান দেবার সময় নেই .ক্রমশ এই মফস্বল ছোটোখাটো শহরের চেহারা নিলো .কিন্তু অনুপ্রবেশকারীরা আস্তে আস্তে জনসংখ্যার চরিত্র পাল্টে দিলো.হিন্দুরা একসময় বেশী ছিল.আজ তারা এই শহরে সংখ্যালঘু হয়ে গেলো. টাকার নেশা, ক্ষমতার নেশা ভবেশবাবুকে পেয়ে বসেছে. ক্রমশ লাল পার্টি র ক্ষমতা চলে যাবার উপক্রম হলো .পরিস্থিতি দ্রুত বুঝে গিয়ে ভবেশবাবু দল বদল করে পুনরায় জয়ী হলেন .ভবেশবাবুর নতুন দল লাল পার্টির হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিলো .বড় ছেলে রবি এখন এলাকার সবচেয়ে বড় প্রমোটার .ছোটো সোম এলাকা দাপিয়ে বেড়ায় বেশ কিছু বন্ধু বান্ধবের সাথে.ভবেশবাবু সব খবর রাখেন .কিছুদিন আগে সোম একটি মেয়ে ঘটিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলো .মেয়েটি সুইসাইড করে .কিছুদিন কাগজে লেখালেখি .ভবেশবাবু অনেক কষ্টে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেন .নতুন দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই অঞ্চলে ধর্মীয় বিভাজন  আরো বেড়েছে. প্রতিদিন হিন্দুরা আক্রান্ত হচ্ছে.কিন্তু ওপর তলার সুস্পষ্ট নির্দেশ.অহিন্দু ভোটারদের উপর ভর করে তার দল নির্বাচনী বৈতরণী পার করেছে .তাই কোনোভাবেই অহিন্দু জনগণকে চটানো যাবে না . এদিকে গেরুয়া পার্টি হিন্দুদের মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে .সবচেয়ে বড় ঝামেলাটা হলো এবারে দূর্গা ঠাকুর বিসর্জনের দিন .মূর্তি ভাঙার সংকল্প নিয়ে একদল অহিন্দু  ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র হিন্দু জনতার উপর .কিন্তু প্রতিরোধের মুখে রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হলো উভয় পক্ষই থানায় গেলো . ভবেশবাবু থানার বড়বাবুকে পরিস্কার জানিয়ে দিলেন যে কটি হিন্দু ছেলে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তাদের সবাইকে গ্রেফতার করতে .কেউ গ্রেফতার হলো ,বেশিরভাগ এলাকা ছাড়া হলো . কিন্তু আজ আবার এলাকা আক্রমণ হয়েছে .আজ আর প্রতিরোধ করার কেউ নেই .ভবেশবাবু থানায় ফোন করলেন .বড়বাবু পরিস্কার জানিয়ে দিলো তার হাত পা বাঁধা.ওপর তলার নির্দেশ ছাড়া তিনি কিছু করতে পারবেন না .ভবেশবাবু এবারে সর্বোচ্চ স্তরে সাহায্য চাইলেন . একজন জুনিয়র সচিব পর্যায়ের লোক জানালেন সবাই এখন কার্ণিভাল নিয়ে ব্যাস্ত.আপনি কাল সকাল দশটা নাগাদ ফোন করুন. অমল দৌড়ে এসে জানালো ‘সার আমাদের বাড়ীর পাশাপাশি তিনটি বাড়ীতে আগুণ লাগিয়েছে .আগুন ক্রমশ বাড়ছে.যে কোনো সময় আমাদের বাড়ীতেও লেগে যাবে .’  ভবেশবাবু তক্ষুণি দমকলে ফোন লাগালেন  .ওদিক থেকে একজন বললো ‘সার আমরা এখনই গাড়ী পাঠিয়ে দিচ্ছি .কিন্তু ওদিকে ঝামেলা হচ্ছে .গাড়ী পৌঁছতে দেরি হবে.’  ভবেশবাবু ফোন রেখে দিলেন.সকলে তার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে. আক্রমণকারীরা তার বাড়ী আক্রমণ করবে না .বাইরে পাহারা আছে .কিন্তু আগুন ?সেতো তার দলের নয় .যে কোনো মুহূর্তে তার লেলিহান শিখা এই পরিবারকে গ্রাস করবে .ভবেশবাবুর মনে হলো একটি দাবানল ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে .তিনি চক্রব্যুহে থাকা অভিমন্যুর মতো .ঢোকার রাস্তা জানেন কিন্তু বেরোবার রাস্তা জানেন না .

No comments:

Post a Comment