Crss colum

Thursday, April 20, 2017

স্নেহময়ের প্রতিশোধ

স্নেহময়ের নামের সাথে চেহারার যে সাদৃশ্য আছে ,সেটা স্নেহময়কে যারা চেনে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে .ছোটো বেলা থেকেই স্নেহময়ের শরীরে স্নেহ পদার্থের প্রাচুর্য একটু বেশী . তবে কেউ যদি স্নেহময়কে মোটা বলে তবে স্নেহময় ভয়ানক রেগে যান .আর রাগলেই স্নেহময়ের কথা আটকে যায় . তখন শুধুই দাঁত কিড়মিড় করা ছাড়া উপায় থাকে না .তবে সুখের কথা এখন স্নেহময়কে কেউ খুব একটা রাগায় না .কারণ স্নেহময়ের বয়স এখন পঞ্চাশ .স্নেহময়ের মেয়ে লতিকার বয়স কুড়ি . লতিকা কলেজে পড়ে .সুতরাং এই বয়সে স্নেহময়কে কে আর রাগাবে ? তবে  অঘটন যে ঘটে না তা নয় তবে  তা সংখ্যায় কম . এই তো কয়েকদিন আগে অফিসে ছুটির পর  সহকর্মীরা সবাই  বড় সাহেবের  বিবাহ বার্ষীকির পার্টিতে গিয়েছিল .সেখানে সুরেন বোস স্নেহময়কে বিরিয়ানী খেতে দেখে বলে ফেলেছিলো ‘ স্নেহময়দা একটু কম করে খান ,দিন দিন যে হারে মোটা হয়ে যাচ্ছেন ! ’  ব্যাশ এইটুকু শুনেই  স্নেহময়ের মাথায় আগুন চড়ে গেলো .  রেগে সুরেন বোসকে একটা কড়া জবাব দিতে গেলো ,কিন্তু মুখে বিরিয়ানী থাকায় আর আল-জিভ টা আটকে যাওয়ায় কিছু তো বলতেই পারলেন না বরং বিষম খেয়ে হুলুস্থুল অবস্থা. সেই থেকে সুরেন বোসের সাথে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছেন স্নেহময় .
আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস ছুটি হয়ে গেলো স্নেহময়ের . বাস  থেকে নামলেই সামনে রিক্সা স্টেন্ড .স্নেহময় রিক্সা করেই বাড়ী থেকে বাস রাস্তা পর্যন্ত যাতায়াত করেন .আগে এটুকু রাস্তা হেঁটেই যেতেন .কিন্তু এখন আর পারেন না .তাই রিক্সা করেই যাতায়াত করেন .রিক্সা ওলা চেনা .আজ  রিক্সায় উঠতেই বললো ‘বাবু ওদিকে রাস্তা সারাই হচ্ছে .তাই পার্কের পাশ দিয়ে ঘুরে যাবো .’ স্নেহময় কিছু উত্তর করলেন না  .যেদিক দিয়ে খুশী ঘুরে যাক ,ঘরে পৌঁছলেই হলো .
রিক্সায় বসে স্নেহময় এদিক  ওদিকে তাকাতে তাকাতে চলেছেন .হঠাত্ স্নেহময়ের নজর  গেলো পার্কের ভেতরে . ওটা লতিকা  তো ? স্নেহময়ের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে তাই মুখটা দেখতে পাচ্ছেন না .কিন্তু ঐ বেগুনী রঙের চুড়িদার গত মাসেই স্নেহময় লতিকা কে কিনে দিয়েছেন .সামনে একটি যুবক দাঁড়িয়ে আছে .যুবকটিকে স্নেহময় চেনেন .মহা বজ্জাত ছেলে .নাম রাহুল .ঐ চাটুজ্জে দের বাড়ীর ছেলে . শুনেছেন পড়াশুনায় নাকি ভালো .কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং এ ডিগ্রী আছে .আর চাটুজ্জেদের তো কম্পিউটারের ব্যবসা .চাঁদনী মার্কেটে বিশাল শোরুম . একবার স্নেহময় লতিকার জন্য কম্পিউটার কিনতে ওদের শোরুমে গিয়েছিলেন .তা বড় চাটুজ্জে অনেক খাতির করেছিলেন .দাম কম নিয়েছিলেন . কিন্তু এই রাহুল বলে ছেলেটিকে স্নেহময় একদম দেখতে পারেন না .আসলে কিছুদিন আগের কথা .ছুটির দিন ছিলো .স্নেহময় বাজার করে রিক্সায় করে ফিরছিলেন .চাটুজ্জে দের বাড়ীর কাছে একটা ‘নব জাগরণ সংঘ ’ বলে ক্লাব আছে .ঐখানে রাস্তা বেশ সরু .তার ওপর রাস্তা সারাই হচ্ছিল বলে খানা খন্দ  হয়েছিলো .স্নেহময়ের রিক্সা ঐখান দিয়ে যাবার সময় একটা গর্তে চাকা ঢুকে যায় .রোগাপটকা রিক্সা ওলা কিছুতেই  চাকাটি গর্ত থেকে তুলতে পারছিলো না .তখন পাশ দিয়ে কতোগুলি কিশোর যাচ্ছিল তাদের বললো ‘ভাই ,একটু ঠেলে দাও না .’ কিশোর গুলি হাত লাগাতে চটপট রিক্সাটি গর্ত থেকে উঠে পড়লো .কিশোর গুলির মধ্যে একজন রিক্সা ওলার উদ্দেশ্য  বলে উঠলো ‘কাকু বড্ড মোটা তাই ,নাহলে তুমিই গর্ত থেকে তুলতে পারতে .’ একথা শোনা মাত্রই স্নেহময়ের রক্ত গরম .স্নেহময় কিশোরগুলিকে কিছু একটা চড়া কথা বলতে যাবে ,এমন সময় সামনের ক্লাব থেকে এই রাহুল বলে ছেলেটি বেরিয়ে এসে কিশোরটির মাথায় হালকা চাঁটি মেরে বললো ‘কানাকে কানা ,খোঁড়াকে খোঁড়া ,আর মোটাকে মোটা বলতে নেই .’ততক্ষণাত স্নেহময়ের যাবতীয় রাগ গিয়ে পড়লো রাহুলের উপর . তারপরের ঘটনা  কালী পুজোর সময় .নব জাগরণ ক্লাবের কালীপুজো খুব জাঁকিয়ে হয় .কালীপুজোর পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় এলাকার সবাইকে বসিয়ে খাওয়ানো হয় .নিরামিস অনেক রকম আইটেম . পাড়ার ছেলেরা সকালেই বলে গেছে সন্ধ্যাবেলায় তাড়াতাড়ি যাবার জন্য .সেইমতো আটটা নাগাদ স্নেহময় সপরিবারে  পুজো মন্ডপে গিয়ে দেখলেন বেশ ভিড় .দুই একজন স্নেহময়ের মতো বয়স্ক আছেন .সবাই পাড়ার .কেউ চেনাপরিচিত  ,কেউবা আবার বন্ধু হয় . লতিকা ও স্নেহময়ের স্ত্রী মেয়েমহলে চলে গেলো .স্নেহময় কয়েকজন বন্ধুর সাথে জমিয়ে আড্ডা দিয়ে দশটা নাগাদ খেতে বসলেন . পরিবেশন করছিলো এই রাহুল নামের ছেলেটি  .স্নেহময় একটু খেতে ভালোবাসে .তাছাড়া ভাত দিয়ে মুগের ডাল আর তার সাথে ফুলকপি আলু কষা দারুণ টেষ্টি হয়েছে .স্নেহময় অলরেডি দুবার ভাত নিয়েছে .তৃতীয়বার রাহুল ভাত নিয়ে এলে স্নেহময় ‘না না ’করলো .হঠাত্ রাহুল বলে উঠলো ‘কাকাবাবু এতো কম খেলে হয় !আপনার মতো চেহারা যাদের তারা  এত কম খেলে দুর্বল হয়ে পড়বে .’স্নেহময় চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো সবাই মুচকে মুচকে হাসছে .লোকজন থাকায় রাগ হওয়া স্বত্তেও স্নেহময় নিজেকে কন্ট্রোল করে নিলো .
সেই থেকে ছেলেটিকে স্নেহময় একদম দেখতে পারেন না . আর সেই ছেলের সাথে লতিকা কথা বলছে .যদিও স্নেহময় লতিকার মুখ দেখতে পান নি .তবুও স্নেহময় নিশ্চিত ওটা লতিকাই ছিলো .  আজ বাড়ী গিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করবেন .
বাড়ী গিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে স্নেহময় হুঙ্কার ছাড়লেন  ‘মৃণালিনী  ,মৃণালিনী’. লতিকার মা মৃণালিনীদেবী  তখন শোবার ঘরে টিভি সিরিয়াল দেখছিলেন .এই সময় হাঁকডাক করলে মৃণালিনী ভয়ানক রেগে যান .স্নেহময়ের ডাক মৃণালিনী শুনতে পেয়েছিলেন.কয়েকবার ডাকাডাকির পর উঠে গিয়ে স্নেহময়কে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ‘কি হলো যাঁড়ের মতো চিল্লাচ্ছ কেনো ?’ জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমন হয় ,তেমনি মৃণালিনীর আওয়াজে স্নেহময়ের গলার জোর চুপসে গেলো .স্নেহময় বললো ‘লতু কোথায় ? ’ .মৃণালিনী উত্তর দিলো ‘কোথায় আবার  ,ওর এক বন্ধুর বাড়ী গেছে .’ স্নেহময় বললো আমি লতুকে পার্কের মধ্যে  ঐ চাটুজ্জে দের রাহুল নামে ছেলেটার সাথে দেখলাম . মৃণালিনী ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো  ‘কপালে কাটা দাগ ওলা ফর্সা সুন্দর মতো ছেলেটা ?’. স্নেহময় বললো ‘ঐ ছেলেটির কথাই বলছি ’. মৃণালিনী বললো ‘তা ছেলেটিতো খুবই ভালো . এই তো শিবরাত্রির দিন বাজারের শিব মন্দিরে আমি আর লতু জল ঢালতে গিয়েছিলাম .গিয়ে দেখি বিশাল ভিড় .হঠাত ঐ রাহুল বলে ছেলেটির সাথে দেখা .সব শুনে ছেলেটি আমাদের সবাইকে এড়িয়ে প্রথমে পুজোর ব্যবস্থা করে দিলো .তাছাড়া লতুর মুখে শুনেছি ছেলেটি মস্ত কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার. এক বিরাট কোম্পানীতে চাকরী করে .অনেক টাকা মাইনে পায় .তা এমন সোনার টুকরো ছেলের সাথে লতু যদি বন্ধুত্ব করে ,তাতে তোমার কি গায়ে জ্বালা ধরে ?.’
গায়ে যে কি জ্বালা ধরে সেটা স্নেহময় সবাইকে বলতে পারবে না . তবে যে ছেলে তাকে মোটা বলে অপমান করে তার সাথে মেয়েকে মিশতে দেওয়া যায় না .
লতু বাড়ী আসার পর তাকে প্রশ্ন করে স্নেহময় বুঝতে পারলো  রাহুলের সাথে লতু র বন্ধুত্ব বেশ কিছু দিনের .আর এই ব্যাপারটা মৃণালিনী আগাগোড়াই জানে .সব শুনে স্নেহময় চেঁচিয়ে উঠে বললো ‘চক্রান্ত ,চক্রান্ত .ঘর শত্রু  বিভীষণ. তোকে আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি লতু ঐ ছেলেটির সাথে তোমার মেশা চলবে না .আর আমার বাড়ীতে আমার কথাই শেষ কথা .’এই বলে স্নেহময় নিজের ঘরে চলে গেলো .
কয়েকদিন পরের কথা .সকাল থেকে ই খুব তোড়জোড় চলছে স্নেহময়ের বাড়ীতে .সন্ধ্যায় লতিকাকে দেখতে আসবে .পাত্র বিদেশে চাকরি করে ,বিদেশেই থাকে .আজ পাত্রের মা বাবা আসবে . স্নেহময়ের অফিসের এক কলিগ এই সম্বন্ধটা এনেছে .  যারা আসবে তাদের বাড়ী দক্ষিণ কলকাতায় .স্নেহময় ফোনে ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়েছেন .   বলেছেন নতুন বাজারের কাছে এসে ফোন করলে স্নেহময় নিজে গিয়ে নিয়ে আসবেন . এদিকে লতু খুবই কান্নাকাটি করছে .মৃণালিনী লতিকাকে  বোঝাচ্ছে . স্নেহময় নিজে খেতে ভালোবাসেন তেমনি খাওয়াতেও ভালোবাসেন . অনেক রকম মিষ্টি কোল্ড ড্রিংকস এনে রেখেছেন . বিকাল থেকে  সেজে গুঁজে অপেক্ষায় রইলেন কখন পাত্র পক্ষ আসে .মৃণালিনী এদিক লতিকাকে বুঝিয়ে বাড়ীর ও বাবার সম্মানের কথা বলে সাজিয়ে রেডি করেছেন .
ওরা এলো বিকাল পাঁচটা নাগাদ .গাড়ীর হর্ন শুনে স্নেহময় তড়িঘড়ি করে বাড়ীর বাইরে এসে দেখলেন ,পাত্রের মা বাবা একটা টাটা সুমো থেকে নামছেন .আর তাদের সাথে যাকে নামতে দেখলো স্নেহময় ,তাকে  দেখেই স্নেহময়ের গা হাতপা চিড়বিড় করে জ্বলে উঠলো .ঐ রাহুল নামের ছেলেটি .রাহুল গাড়ী থেকে নেমে পাত্রের বাবার দিকে তাকিয়ে বললো ‘কাকাবাবু ,আমি তাহলে আসি ?’ .পাত্রের বাবা হেসে বললো ‘ঠিক আছে বাবা ,তুমি এসো .’
ঘরে ঢোকার পর সোফায় সবাইকে বসিয়ে কোল্ড ড্রিংকস দেওয়ার পর স্নেহময় ভদ্রতার খাতিরে প্রশ্ন করলো ‘আপনাদের বাড়ী চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো ?’. পাত্রের বাবা একগাল হেসে বললো ‘অসুবিধা ? আরে আপনি তো মশাই ফেমাস লোক .নতুন বাজারের কাছে এসে আপনার নাম ঐ ছেলেটিকে বলতেই ছেলেটি বলে উঠলো  “মোটা কাকাবাবুর বাড়ী যাবেন ? চলুন আমি পৌঁছে দিচ্ছি .” তারপর আসতে আসতে ছেলেটি কতো গল্প করলো .’ এসব কথোপকথনের মধ্যে মৃণালিনী প্লেটে মিষ্টি সাজিয়ে আনলো .মিষ্টির প্লেটের দিকে তাকিয়ে পাত্রের বাবা বলে উঠলো‘আরে মশাই ,আমাকেও কি খাইয়ে আপনার মতো মোটা করে দেবেন নাকি ?’ .স্নেহময়ের মুখটা ক্রমশ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হতে লাগলো . তারপরে লতিকাকে দেখার পর চলে যাবার সময় গাড়িতে ওঠার আগে পাত্রের বাবা বলে উঠলো ‘আমি ঐ রাহুল বলে ছেলেটির কাছে আপনি মোটা শুনে ভেবেছিলাম আপনার মেয়েও আপনার মতো মোটা .এখন দেখছি আমার ধারণা ঠিক নয় .’ .
ওরা সবাই চলে গেলে স্নেহময় কিছুক্ষণ সোফায় গুম হয়ে বসে রইলেন .স্নেহময়কে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে মৃণালিনী আর ঘাঁটালেন না . কিছুক্ষণ পর স্নেহময় উঠলেন .মৃণালিনীকে হাঁক দিয়ে বললেন  ‘আমি একটু বেরোচ্ছি  ,ফিরতে রাত হবে .’
স্নেহময় ফিরলো রাত দশটা নাগাদ .দেখলো মৃণালিনী  লতিকাকে রাতের খাবার দিচ্ছে .স্নেহময় হাত ধুয়ে এসে খাবার টেবিলে র সামনের চেয়ারে বসে মৃণালিনীকে বললো ‘খেতে দাও . ’ মৃণালিনী একটা থালায় রুটি আর কষা মাংস দিলেন .লতু একপাশে মুখ গোঁজ করে খাচ্ছে .মৃণালিনীও চুপচাপ .হঠাত স্নেহময় বলে উঠলো ‘সব ঠিক করে ফেললাম .সামনে কুড়ি তারিখে লতুর বিয়ে .হুঁ    হুঁ      বাবা ,আমার সাথে লাগা .এবারে বাছাধন টের পাবে স্নেহময়ের প্রতিশোধ কাকে বলে !’ মৃণালিনী বললো ‘কোথায় ঠিক হলো ? যারা এসেছিল তাদের বাড়ী ?’স্নেহময় উত্তর দিলো ‘তাদের বাড়ী হবে কেন ?  ঐ যে চাটুজ্জেদের বাড়ীর  রাহুল বলে ছেলেটির সাথে .বড় চাটুজ্জের সাথে ফাইনাল কথা বলে আসছি . বাইরের লোকের সামনে আমায় মোটা বলা ! এবারে সব লোকের সামনে এই মোটাকে বাবা বলে ডাকতে হবে .এটাই স্নেহময়ের স্নেহের প্রতিশোধ ’.
লতিকার নিজের চেয়ার থেকে উঠে এঁটো মুখে স্নেহময়ের টাকে একটা সস্নেহে চুমু খেয়ে আদর করে বললো ‘আমার আদরের মোটা বাবা.’ (শেষ).

No comments:

Post a Comment