Crss colum

Wednesday, February 14, 2018

জীবনের দেনা পাওনা।

        শ্রদ্ধাঞ্জলি
___________________
জীবনের দেনা পাওনা।
সুরধনীর তীরে এসে বসলে মনটা কেমন হালকা হয়ে যায়।কলকল রব করে বয়ে চলা জলস্রোত, মিষ্টি বাতাসের স্পর্শের স্নিগ্ধতা কেমন যেন এলোমেলো করে দেয় সবকিছু।
আজকের আমি পরিপূর্ণ। মনে পড়ে যায় ,একদিন যে আমি সকলের স্নেহ বা দয়ার পাত্র ছিলাম আজ সেই আমি সকলের কাছেই সফল বলে পরিচিত।
কেউ কখনো জানতে চায়নি এই চোখ ধাঁধানো সফলতার জন্য কতটা মূল্য আমায় দিতে হয়েছে। কখনো নিজেই অন্তরে অন্তরে তূল‍্যমূল‍্য বিচার করে দেখি কতটা হারিয়েছি ,আর কতটা পেয়েছি। হিসাব মেলাতে পারিনা।জানি হিসাব কখনো মিলবে না।মহাকাল যেমন অনেক কিছু কেড়ে নেয় আবার সময় হলে আপনার পাওয়ার ঝুলি  উপচে পড়ে। স্মৃতি গুলো ভিড় করে আসে মনে ….।

রাতের বেলা খেতে বসেছি, আমি ও দাদা একসাথে।মা খাবার বেড়ে  দিচ্ছেন। গরীবের সংসার। প্রতিদিন যে খাবার জুটবেই এমন নিশ্চয়তা ছিল না।
যাই হোক মা খেতে দিয়েছেন।ডাল ও রুটি।  তখন তাই মনে হতো অমৃত। সবে দু এক গ্রাস মুখে দিয়েছি।মা আচমকা প্রশ্ন করলো , “তুই কি ঐ মেয়েটার সাথে সম্পর্ক ত‍্যাগ করবি ?”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম , “কোন মেয়েটা বলতো ?”
মা বললো, “পুস্প।”
আমি বললাম , “মা আমি তোমাকে আগেও বলেছি , আবার বলেছি, পুস্পর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।ওর সাথে আমার শুধুই শিক্ষক ও ছাত্রীর সম্পর্ক।”
মা বললেন, “তুই ওদের বাড়ি ছেড়ে দে।”
আমি বললাম, “তুমি জানো এখানে আমার পড়াশোনা র অসুবিধা। তাছাড়া যদি আমি  ওদের বাড়ি ছেড়ে দিই তাহলে তোমার অন‍্যায়  দাবি কে মান‍্যতা দেওয়া হয়। আমি হলপ করে বলছি পুস্পর সাথে এখনো আমার কোন সম্পর্ক তৈরি হয় নি।তবে ভবিষ্যতে যদি তৈরী ও হয় তার মধ্যে আমি খারাপ কিছু দেখি না। আমি ওদের বাড়ি ছেড়ে আসবো না।”
আমার কথা শুনে মায়ের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। এরপর মা যেটা করলো , আমি সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।জানি না পৃথিবীর কোন মা তার সন্তানের সাথে এমন আচরণ করেছে কিনা। মা আমার খবারের থালাটি টেনে সরিয়ে নিয়ে বললো, “ঐ মেয়েটার সাথে সম্পর্ক রাখলে আমার এখানে খাওয়া বন্ধ। নিজের ব‍্যবস্থা নিজেই করে নাও।”

আমি কয়েকটা মূহুর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।  
তারপর সোজা উঠে চলে এলাম আমার ঘরে। দাদা পিছন পিছন এসে আমায় বললো , “শোন, মায়ের কথায় কান দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মায়ের রাগ হয়তো দেখবি কালকের মধ্যেই গলে জল হয়ে যাবে।”
আমি বললাম , “না দাদা, মা যখন বলেছে , নিজের ব‍্যবস্থা নিজেই করে নিতে , তবে আমি তাই করবো। তুমি শুধু এটুকু দেখো মায়ের যেন কোন অযত্ন না হয়।আর হ‍্যাঁ , যে কোন ব‍্যাপারে আমি যেমন তোমার পাশে ছিলাম, তেমনি থাকবো।”
তারপরে ও দাদা কয়েকবার আমায় বোঝাতে এসেছিল কিন্তু আমি আর ওদের বোঝা হতে চাই নি।

ঘটনা র সুত্রপাত, প্রায় একবছর আগে।
বাবার মৃত্যুর পর আমি মা ও দাদা দেশ ছেড়ে চলে এলাম। দেশে র আত্মীয়-স্বজন এমন পরিস্থিতি তৈরী করলো যে ভিটে মাটি সব কিছু ছেড়ে চলে এলাম এই মফস্বলে।টালির চালের এক কামরা ভাড়া বাড়ি । আট ফুট বাই দশ ফুট ঘর। তার ভাড়া মাসে পঞ্চাশ টাকা। দাদার অল্প রোজগারে তিনজনে খেয়ে ঐ টুকু টাকা ভাড়া জোটাতে হিমসিম খাওয়ার জোগাড়। তবু ঐ ছোট্ট ঘরটিতে ই কোনো রকমে দিন গুজরান হতে লাগলো আমাদের।
দেশ থেকে আসার সময় আমি এনেছিলাম একটা পায়জামা, একটা জামা আর একটা হাওয়াই চটি।
দাদারো সম্বল একই রকমের। সীমিত পোশাক দুজনে ভাগাভাগি করে পড়তাম। আমার ছিলো পড়াশোনা র ইচ্ছা। পড়াশোনায় আমি চিরকালই মেধাবী ছিলাম।গরীব বলে স্কুল ফি লাগতো না। বইপত্র প্রায় কিছুই ছিলো না।এর ওর থেকে চেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
মদ মাতালে পাড়া। অশিক্ষিত জন মজুর ও খেটে খাওয়া মানুষের বসবাস। শিক্ষা দীক্ষা র চর্চা প্রায় নেই বললেই চলে।
পড়াশোনার  খুবই অসুবিধা হতো। আমাদের ভাড়া বাড়ীর পাশেই অসীমাদি। খুবই ভালো বাসতেন আমায়। পড়াশোনা খুব পছন্দ করতেন। একদিন উনি আমাদের বাড়িতে এসে পরামর্শ দিলেন কয়েকটি বাড়ীর পরে ঈশ্বরদার সাথে কথা বলতে। ঈশ্বর দার বাড়ীর ভাড়াটিয়া উঠে গিয়েছে। ওদের ঐ ঘরটি আমাদের বর্তমান ভাড়া বাড়ীর থেকে বড়। তাছাড়া আলাদা একটা বাথরুম।আর রান্না বান্না করার জন্য একফালি বারান্দা।
দাদা বললো, “ভাড়া নিশ্চয়ই অনেক হবে।”
অসীমাদি বললেন, “ একবার কথা বলেই দেখো না।”
কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় দাদা আমায় পাঠালো কথা বলার জন্য। বৃষ্টি হচ্ছিল।ছাতা মাথায়  টুকটুক করে গিয়ে কড়া নারলাম ঈশ্বরদার বাড়িতে।
দরজা খুলে দিল পুষ্প। বললাম , “বাবা বাড়িতে আছেন ?”
পুষ্প পিছনদিকে মুখ করে ডাকলো , “বাবা, তোমায় একজন ডাকছেন।”
আমি যদিও পুষ্পকে নাম ধরে চিনতাম। কিন্তু ও আমায় চিনতো না।এটাই স্বাভাবিক। একটা গরীব , রোগাটে প‍্যাংলা ছেলেকে না চেনাই স্বাভাবিক।
সকলের অবজ্ঞা আমার কাছে খুব স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। পুষ্প র বাবা দরজার কাছে এসে আমায় দেখে বললেন , “আপনি ?”
আমি বললাম  “আমরা পাশেই ভাড়া থাকি। শুনলাম আপনার একটি খালি ঘর আছে , যদি ভাড়া দেন।


পুষ্প র বাবা ছাপোষা মানুষ।আমায় ঘরে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়ালেন।যে ঘরটি ভাড়া দেবেন সেটা হ‍্যারিকেন নিয়ে গিয়ে আমায় দেখালেন। দেখলাম বড়সড় ঘর। বুঝলাম বেশ ভালই ভাড়া হবে। উনি ঘর দেখিয়ে বললেন ,  “আপনার পছন্দ হয়েছে ?”
আমি বললাম , “আমায় তুমি বলুন। আমি আপনার থেকে কতো ছোট। আপনার ঘর তো পছন্দ । কিন্তু এর ভাড়া তো আমরা দিতে পারবো না।”
ঈশ্বর বাবু বললেন , “দেখুন ভাড়া বড় কথা নয়। সারাদিন কাজের সুত্রে আমায় ঘরের বাইরে থাকতে হয়। আমি চাই একটি ভদ্র শিক্ষিত পরিবার এখানে ভাড়া থাকুক। আপনারা ব্রাহ্মণ। আপনাদের মতো শিক্ষিত পরিবার যদি এখানে থাকে তবে আমি নিশ্চিতভাবে কাজকর্ম করতে পারবো। ঐখানে যে ভাড়া দেন আমাকে তাই দেবেন।”
পরের মাসেই চলে এলাম পুষ্পদের বাড়ী।
ঈশ্বর বাবুর  ছোট সংসার। স্ত্রী ও দুই মেয়ে  । পুষ্প ও সবিতা।
সবিতার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।আর পুষ্পর তখন ক্লাস এইট। চেহারায় একটু নারীসুলভ ভাব এলেও মনের দিক থেকে এখনো শিশু।
আমার দাদা একটি ছোট খাটো কারখানায় কাজ করতো।আর আমি কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি।
নিজের পড়াশোনার খরচ টিউশনি করে যোগাড় করতাম। এই অঞ্চলে শিক্ষিত লোক প্রায় ছিলো না বললেই চলে। ভালো প্রাইভেট টিউটর এর অভাব ছিলো। সেই শূন্যতা আমি আসার পর দূর  হয়ে গেল। ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলে মেয়েরা আমার কাছে ভর্তি হতে লাগলো। প্রতিদিন সকালে ও বিকালে কয়েকটি ব‍্যাচ পড়াতাম।
বেশ দিন কাটছিলো।
বাড়িতে ছোট বলতে দুজন। আমি আর পুষ্প। দাদা প্রতিদিন ফেরার সময়  হাতে করে দুটি লজেন্স নিয়ে আসতো। একটা আমার, একটা পুষ্পর। পুষ্প র লজেন্স টি হয় পুষ্পর হাতে, নয়তো পুষ্পর মায়ের হাতে দিয়ে দিতাম।  
একদিন দাদা এসে আমার হাতে লজেন্স দিয়েছে । আমি এদিকে ওদিকে পুষ্পকে খূঁজে দেখতে না পেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘পুষ্পকে দেখলে ?’
মা বললো 'আমাদের বাথরুমে কাপড় কাচছে।’
গিয়ে দেখি তার দুই হাতে সাবান। বললাম 'এই নে তোর লজেন্স।’
পুষ্প বললো , 'আমার দু হাতে সাবান। তুমি মুখে দিয়ে দাও।’
আমি তখন লজেন্স টি খুলে ওর মুখে দিয়ে দিলাম । দাদাও ঐখানে  দাঁড়িয়ে ছিল।মা ঘর থেকে এই ঘটনা টা দেখতে পেয়েছিলো।
মা ছিলো তখনকার দিনের গ্রাম‍্য মহিলা। এই অতি সাধারণ ঘটনা টা তার মনে কি ধারণা সৃষ্টি করলো বলা মুশকিল। স্বামী মারা যাওয়ার পর এই দুই ছেলেই সম্বল। সন্তানের প্রতি মায়ের অধিকার বোধ কোথাও যেন ধাক্কা খেল। মা ভাবলো পুষ্পর প্রেমের জালে আমি জড়িয়ে পড়েছি।
ক্রমাগত সন্দেহ, অবিশ্বাস মাকে ক্রমশ অসুস্থ করে তুললো। মাঝে মাঝেই মা অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগলো। সারাদিন সেই এক চিন্তা, ছেলে বাড়িওয়ালার মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। শেষে এত অশান্তি দেখে দাদা একদিন আমায় ডেকে বললো, 'ভাই ,মা দিনকে দিন আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আরো অশান্তি শুরু করেছে। তারচেয়ে চল , আমরা পুরানো বাড়িতে ভাড়া চলে যাই।’
আমি বললাম, 'দাদা ওখানে একটুখানি জায়গা,তার ওপর পড়াশোনার পরিবেশ নেই। আমি যাবো না । আমি এখানেই থেকে পড়াশোনা করবো। তুমি যদি চাও তো মাকে নিয়ে ওখানে যেতে পার।’
সেইমতো দাদা মাকে নিয়ে ঐবাড়িতে উঠে গেল। আমি প্রতিদিন দুইবেলা ঐ বাড়িতে খেতে যেতাম।
কিন্তু তাতেও মায়ের চিন্তা দুর হয়নি। অবশেষে এক দিন দুপুরে মা খেতে না দিয়ে আমায় তাড়িয়ে দিল।

নিজের ঘরে এসে কাঁদতে লাগলাম। তারপর ভাবলাম না মায়ের এই অন‍্যায় অযৌক্তিক দাবি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। নিজের ব‍্যবস্থা নিজেই করবো।

শুরু হলো জীবন সংগ্রাম। কোন দিন খাওয়া জোটে। কোনদিন জোটে না। সকাল বিকাল বেশ কতগুলো ব‍্যাচ ছাত্র ছাত্রী পড়াই। কিন্তু বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রী ছিল গরীব দুঃস্থ পরিবার হতে। নিজেরাই ঠিক মতো খেতে পায় না,আমায় মাস মাইনে দেবে কি করে ?
ইতিমধ্যে একটা ব‍্যাপার ঘটে গেছে।পুস্প মাঝে মাঝে আমার কাছে পড়াশোনার অসুবিধা হলে  পড়াশোনা দেখে নিতো। কারণ ওর প্রাইভেট টিউটর রোজ আসতো না। শেষে একদিন ওর বাবা বিরক্ত হয়ে আমায় বললো, তুমি ই বরং আমার মেয়েটার পড়াশোনার ভার নাও। তার বদলে তুমি আমার যে ঘরটিতে ভাড়া আছো তার ভাড়া দিতে হবে না।
আমার সব ছাত্র ছাত্রী রা ছিল গরীব ঘর থেকে। অধিকাংশ ই মাসমাইনে দিতে পারতো না।সে কারণে রোজ খাবার জোটার নিশ্চয়তা ছিল না। কোন কোন সময় ছাত্রছাত্রী রা তাদের ঘর থেকেই কিছু খাবার আমার জন্য নিয়ে আসতো।
একদিন সকালে সবাই পড়াশোনা করে চলে যাবার পর একা বিছানায় বসে আছি, হঠাৎ খুব কান্না পেল। ভাবতে লাগলাম , পৃথিবীর যত দু্ঃখ আমাকে গ্রাস করেছে। এই জীবনে কিছু মাত্র সুখের সন্ধান পেলাম না। কখন যে চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই টস্ টস্ করে জল ঝর়ছিলো  জানি না। ইতিমধ্যে পুস্প কখন ঘরে ঢুকে আমায় কাঁদতে দেখে ওর মাকে ডেকে এনেছে। ছোটমা আমার কাছে এসে আমার মাথাটা বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, 'তুমি কাঁদছো কেন? আমি তো তোমার মায়ের মতো। তোমার এখন সময় টা খারাপ যাচ্ছে।এটি সাময়িক। আবার দেখবে তোমার মা তোমায় কাছে টেনে নেবে।আর আজ থেকে তুমি রান্না করে খাবে না। আমাদের সাথেই খাবে। যখন তোমার অবস্থা ভালো হবে , তখন তুমি আমায় টাকা ফেরত দিও। আমি নিশ্চয়ই নেব।’
এরপর..
পুস্পদের বাড়ি তেই খাওয়া দাওয়া করতাম।পুস্প রোজ আমার কাছে পড়তে আসতো।এমনি আসা যাওয়ার মাঝে কখন যেন দুটি মন এক হয়ে গেল।এক অসহ্য ছটফটানি ছিল পরস্পরের সান্নিধ্যে থাকার।
ওদিকে দাদার বিয়ে ঠিক হলো। মা আর দাদা একটা ঘরেই ওপরে ও নিচে বিছানা করে শুত। এখন দাদার বিয়ে ঠিক হওয়ায় মা ঠিক করলো আমার কাছে এসে থাকবে। আমি মাকে ডেকে পরিস্কার বললাম , 'ভালো করে শুনে নাও, এই ঘরটা আমি পুস্পকে পড়াই বলে বিনামূল্যে থাকতে পাই। আর ভবিষ্যতে ঐ পুস্পকেই বিয়ে করবো। সুতরাং সব জেনে বুঝে যদি আমার কাছে থাকতে চাও তো , থাকতে পারো।’
মা এখন দেখলাম এই শর্তেই রাজী হলো।
দেখতে দেখতে দাদার বিয়ে হলো। বৌদি ঘরে এলো। সংসার আবার গড়গড়িয়ে চলতে লাগল। কিন্তু তখন কি জানতাম অদূর ভবিষ্যতে আমার জীবনে কি ভয়ঙ্কর কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে।
বৌদির সাথে আমার সম্পর্ক ছিল ছোট ভাইয়ের মতো। কিন্তু বৌদি আমার ও পুস্পর সম্পর্ক টা মেনে নিতে পারে নি। মুখে কিছু বলতো না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা প‍্যাঁচ কষতে লাগলো। আসলে বৌদির ইচ্ছা ছিলো তার আইবুড়ো বোনটিকে আমার ঘাড়ে চাপানোর। সেই উদ্দেশ্যে বৌদি ধীরে ধীরে বাড়ির সকলের কানে একটু একটু বিষ ঢালতে লাগল।মা ইতিমধ্যে পুস্পকে পছন্দ করছে তাই মায়ের কাছে সুবিধা করতে পারেনি। তাই বৌদি তার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য টার্গেট করলো ঈশ্বর বাবুকে। ঠিক কি কি বৌদি ঈশ্বর বাবুকে বলেছিল তা আজো জানি না। ঈশ্বর বাবু আমার ও পুস্পর সম্পর্কের কথা জানতেন। একপ্রকার মেনেও নিয়েছিলেন।
কিন্তু যেখানে মানুষের ভাবনা শেষ হয় , সেখান হতে ঈশ্বরের ভাবনা শুরু হয়।
ইতিমধ্যে পুস্প মাধ‍্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। হঠাৎ একদিন আমার কাছে এসে বললো , 'কয়েকদিন থাকবো না। দিদির বাড়ি যাবো।’
আমি বললাম , 'যাও।দেখো সেখানে সুখের সাগরে ভেসে আমার মতো দীনজন কে ভুলে যেও না।’
পুস্প হাসলো।পুস্পর হাসিটা ভারি মিষ্টি। হাসলে গালে খুব সুন্দর টোল পড়ে।পুস্প হেসে বলল , 'যাও, তোমার সবটাতেই ইয়ার্কি।’
আমি কি ছাই জানতাম এই হাসিই আমার দেখা পুস্পর শেষ হাসি।
পুস্প যাওয়ার পর বেশ কয়েকটি দিন কেটে গেলো।পুস্প এলো না। কয়েকটি সপ্তাহ কেটে গেল পুস্প এলো না। একদিন অধৈর্য হয়ে ছোটমাকে প্রশ্ন করলাম , ‘পুস্প কবে ফিরবে ?’
ছোটমা গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো, 'সে আর ফিরবে না।সে তোমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না।’
আমি বললাম, 'আমি বিশ্বাস করি না।’
এরপর পুস্পর সন্ধানে এদুয়ার ওদুয়ার দৌড়াদৌড়ি। কিন্তু কোনো লাভ হলো না।ওর দিদির বাড়িতে একদিন গেলাম। না পুস্প সেখানেও নেই।
শেষে এক বন্ধুর পরামর্শে থানায় অভিযোগ করলাম যে পুস্পর সাথে আমার প্রেম আছে তাই পুস্পর বাবা ঈশ্বর বাবু পুস্পকে কোথাও জোর করে আটকে রেখেছেন। শেষে পুলিশের মধ‍্যস্থতায় স্থির হলো ঈশ্বর বাবু পুস্পকে থানায় নিয়ে আসবে। সেখানে পুস্প বলবে আমায় আদৌ ভালোবাসে কিনা।
সেইমতো এক রবিবার পুস্পর বাবা পুস্পকে নিয়ে থানায় এলো।সাথে একগাদা লোকজন। আমি বললাম ‘এতো লোকজনের কি প্রয়োজন? এটা একটা মেয়ের পার্সোনাল ব‍্যাপার। শুধু আমি, ঈশ্বর বাবু,থানার তরফে একজন আর পুস্প থাকলেই হবে।’
কিন্তু ঈশ্বর বাবু  সকলের সামনেই পুস্পকে কথা বলতে বাধ্য করলেন। এতটা সময়ের মধ্যেই পুস্প একবারের জন্যেও আমার চোখের দিকে তাকায় নি। মাটির দিকে চেয়ে কোনরকমে অস্ফুট স্বরে বলল , “আগে ভালো বাসতাম। এখন বাসি না।”
আমি বললাম ‘আর কিছু শোনার আমার প্রয়োজন নেই।’
পুস্পকে ওর লোকেরা যখন নিয়ে চলে যাচ্ছে , তখন ঈশ্বর বাবু বললেন, 'তাহলে পুস্পর লেখা চিঠিপত্র আর ছবিগুলো ফেরত দাও’।পুস্প তখন একটু পা বাড়িয়েছে। এই কথাটা শোনা মাত্রই ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর বাবার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো, “তুমি যা চেয়েছিলে তা বলেছি। আর কোন কিছু তুমি চাইবে না।”
তারপর আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল “এই শোন, তুমি যদি আমায় ভালবাসো তবে একটা কিছু ফেরত দেবে না।”
এই আমার  পুস্পর সাথে শেষ দেখা। ঈশ্বর বাবুকেও বেশি দিন পুস্পকে আটকে রাখতে হয় নি।
কয়েকদিন পরে খবর পেয়েছিলাম এক রাতে হতভাগীটা বিষ ভেবে অমৃত খেয়ে অমৃতলোকে নিজের স্থান করে নিয়েছে।
আর আমাকে তার প্রেমের চিরঋণী করে গেছে।
একে একে সবাই চলে গেছে। মা, দাদা, বৌদি ...সবাই। আমি হতভাগা পড়ে আছি স্মৃতির সম্বল বুকে নিয়ে।
জানিনা আরো কত দিন এ বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে।
     (শেষ)।

No comments:

Post a Comment