Crss colum

Tuesday, April 16, 2019

শেষ লোকালের আলো

আজ সন্ধ্যায় মনে হয় বৃষ্টি হয়েছে। এখানে ওখানে জল জমে আছে।আজ পূর্ণিমা।গোল চাঁদটা এখন মাঝ আকাশে আসবো আসবো করছে।আর আকাশের ঝকঝকে চাঁদের প্রতিবিম্ব বৃষ্টিস্নাত জলার জমা জলে পড়ে ঝিলিক দিচ্ছে।ঐ দূরে জলার পাড়ে পাইকপাড়ার দিকে কেমন ধোঁয়াশা ভাব ।মনে হয় হালকা হিম পড়েছে। শীতকালে সাধারণত বৃষ্টি হয় না । কিন্তু আজ হয়েছে।আর বৃষ্টি যেন হিমেল ভাবটা বাড়িয়ে দিয়েছে। একটি রাত জাগা পাখির কর্কশ ডাকে যেন হুঁশ ফিরে পেলাম।
না , দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না।আমায় হাঁটতে হবে। এখনো অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে। হাঁটতে আমার ভালো লাগে।সবাই বলে কালু সেখের ছেলেটা সারারাত শুধু এদিকে ওদিকে হেঁটে বেড়ায়।তারা সবটুকু যে ঠিক বলে তা নয়। হেঁটে বেড়াই একথা ঠিক। কিন্তু এদিকে ওদিকে নয়। প্রতি রাতে আমি নির্দিষ্ট রাস্তায় হাঁটতে থাকি। যেখানে থাকি সেখান থেকে শুরু করে বুড়ির বাঁধ দিয়ে  গিয়ে  ভৈরবতলার শ্মশান।সেখান থেকে ডান হাতি বেঁকে একটু হাঁটলেই রেললাইন। রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে গন্তব্য পর্যন্ত।
আমি যখন হাঁটি তখন প্রায় নিশুতি রাত।এদিক পানে এমনিতেই কেউ আসে না।তাই এই নির্জন রাস্তায় কি যে ভালো লাগে তা বলার নয়। ঝিঁঝিঁ র ডাক, ব্যাঙের গ্যাঙোর গ্যাং, জোনাকির মিটমিটে আলো সরীসৃপের বুকে হাঁটার শব্দ সব যেন নেশা ধরানো স্বপ্নের মতো লাগে। সবাই বলে কালু সেখের ছোট ছেলেটা পাগল।তা বলুক। কিছু আসে যায় না। শুধু ছোট্ট ছোট্ট হারামি বাচ্চাগুলো মাঝে মাঝে আমায় দেখলে ঢিল ছোঁড়ে তখন খারাপ লাগে। আব্বা আমায় স্কুলে পাঠিয়েছিলো ছোটোবেলায়। কিন্তু মাস্টার মশাইয়ের কড়া শাসন আমার ভালো লাগে নি। তাই একদিন মাস্টার মশাই ছড়ি বাগিয়ে মারতে এলে তার হাত থেকে ছড়ি কেড়ে দুই আধখানা করে ফেলে দিয়ে দে দৌড়। তারপর থেকে আর স্কুলে যাই নি। আব্বা কয়েকবার পাঠাবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু আম্মি আর যেতে দেয়নি।
আম্মি আমায় খুব ভালোবাসে। আম্মি আমায় বলে "আলি তোকে নিয়েই আমার চিন্তা"।আলি আমার ডাক নাম। ভালো নাম একটা ছিল। কিন্তু সে নাম কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তাছাড়া পাগল ছাগল মানুষের নাম নিয়ে কি হবে।সবাই আমায় আলি পাগলা বলেই ডাকে।
ঐ সব ডেকরা ছোঁড়াগুলো ঢিল ছুড়ে মারে বলে আমি দিনের বেলায় খুব একটা বেরোই না।সুয্যিমামা পাটে গেলে রাতের আঁধারে হাঁটতে বেরোই। প্রথম প্রথম বাড়ির বাকি মানুষজন যেমন আব্বা, আম্মি , দাদারা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু আমি ঠিক লুকিয়ে পালাতাম সারা রাত হেঁটে ঘুরে বেড়িয়ে ভোর বেলায় ঘরে ফিরতাম। আম্মি আমার ঘরে পান্তা রেখে দিতো। ভোরবেলায় এসে পান্তা খেয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোতাম।সবার এটা গা সওয়া গোছের হয়ে যাওয়ায় এখন আর কেউ বাধা দেয় না।
এখন অবশ্য এদিকে ওদিকে হাঁটি না।যে রাস্তা বলছিলাম সেটা দিয়েই শুধু হাঁটি।আর আমার হাঁটার রাস্তায় ভুল করেও যদি কেউ এসে যায় তবে তাকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়ি। আমার ভয়ে ইদানিং কেউ আর এদিকে আসে না।
আজ ভৈরব তলার শশ্মানে এসে দেখলাম সদ্য কেউ মরা পুড়িয়ে গেছে। এখনো চিতা থেকে পোড়া পোড়া একটা গন্ধ উঠছে।না কেউ কোথাও নেই। পায়ের কাছে একটা খসখস শব্দ শুনে দেখলাম একটা কালো ছয় হাতি বুক বেয়ে এগিয়ে আসছে। শীতকালে সাধারণত সাপ বেরোয় না।আজ মনে হয় গর্তে জল ঢুকে পড়ায় বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কি হলো জানিনা। মনে হয় বিপদের গন্ধ পেয়েই সাপটি পাশের জলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো।
যাই হোক আমি ডানহাতি রাস্তা ধরে রেললাইনে এসে পড়লাম। রেললাইনের পাশ দিয়ে যাতায়াত করার রাস্তা আছে। কিন্তু আমি সকলের থেকে আলাদা ধাঁচের। আমি রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।দুরে কোথাও হতে একটু কোলাহল মতো শোনা যাচ্ছে।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম চার পাঁচ জন লোক একসাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে আসছে। আমি ভ্রুক্ষেপ করলাম না রেললাইন ধরে হাঁটতে লাগলাম। অনেক দূরে একটা ছোট্ট আলোক বিন্দু দেখা যাচ্ছে। যতই সময় যাচ্ছে বিন্দু টি ততই বড়ো হচ্ছে।  বিন্দু টি ক্রমশ একটি জোরালো হেডলাইটের রূপ নিচ্ছে। শেষ লোকালের আলো।পিছনের লোকগুলো মনে হয় আমায় দেখতে পেয়েছে।পিছন থেকে হৈ হৈ শুনতে পাচ্ছি। আমি আরেকটু জোরে হাঁটতে লাগলাম। সামনে শেষ লোকালের আলো জোরদার হচ্ছে। পিছনের পায়ের শব্দ গুলো দ্রুত হচ্ছে। মনে হয় আমায় বাঁচাতে দৌড়ে আসছে। ওরা জানে না ঐ আলোই আমার গন্তব্য। আমি আলোর দিকে দৌড়ে যেতে লাগলাম। শেষ লোকালের ড্রাইভার একটুও ট্রেন থামানোর চেষ্টা করলো না। এই লাইনের প্রতিটি ট্রেন ড্রাইভার জানে ঠিক এই জায়গায় প্রতিদিন এক আধ পাগল পথিক ট্রেনে কাটা পড়ে। যেমন পড়েছিল তিন বছর আগে। বহুবার ট্রেনে কাটা পড়ার পর ট্রেন থামিয়ে খোঁজাখুঁজি হয়েছে কোনো লাশ পাওয়া যায় নি।আজো পাওয়া যাবে না। প্রতিদিন রাতে আমি আমার কবর থেকে জেগে উঠি। তারপর পরিচিত রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসে ঠিক এই খানে শেষ লোকালের আলোয় নিজেকে শেষ করে দিই। এই একই ঘটনা দিনের পর দিন পুনরাবৃত্তি হয়। হয়তো এটাই চলবে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত।
ঐ আসছে শেষ লোকাল।ঐ আমার গন্তব্য। আমি ছুটে চলেছি………(শেষ)

No comments:

Post a Comment