Crss colum

Tuesday, January 2, 2018

বাংলা অনলাইন কল্প বিজ্ঞান - মহাশূন্যের পথিক।

প্রথমে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। আমি স্লিপিং চেম্বারের বাইরে আসতে , একটা যান্ত্রিক গলায় শুনতে পেলাম “ওয়েলকাম , কমান্ডার রাহুল বসু।”
যার কাছ থেকে আওয়াজ টি এলো , এবারে সে এগিয়ে এলো । অবশ্য এগিয়ে এলো ঠিকই, কিন্তু হেঁটে নয়, বরং অ‍্যান্টিগ্র‍্যাভিটি রশ্মির সাহায্যে উড়ে।
সে মানুষ নয় ।সে এই 'নিউটন 2350’ মহাকাশ যানের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মচারী ,এক রোবট।নাম 'আইনষ্টাইন’ ওরফে 'আই’।
'আই’  এগিয়ে এসে আমায় রিপোর্ট করলো “এভরিথিং ওকে। মহাকাশযান 'নিউটন 2350’ এখনো অতি আলোক গতিতে লক্ষ্যবস্তু 'নোভা’র দিকে এগিয়ে চলেছে। লক্ষ্য বস্তু এখনো 0.5 আলোকবর্ষ দূরে। অবিলম্বে মহাকাশযানের গতি কমিয়ে  আলোর নব্বই শতাংশ গতিতে আনা উচিত।”
আমি বললাম “ধন্যবাদ তোমায় ‘আই’। এবারে অটোমেটিক কন্ট্রোল থেকে ম‍্যানুয়াল কন্ট্রোল নেব । তবে সবার আগে তুমি জানাও  ক‍্যাপটেন রোশনি তার স্লিপিং চেম্বার থেকে উঠেছেন কিনা।”
এবারে ‘আই’ পুনরায় বলল , “ক‍্যাপটেন রোশনির ঘুম ভেঙেছে। তিনি অতি শীঘ্রই আপনার সাথে যোগ দেবেন।”
এই সব কথা বলতে বলতে দেখি ক‍্যাপটেন রোশনি  আমার দিকে এগিয়ে আসছে। টানা ছয় মাস ঘুমোবার পর তাকে আগের চেয়ে বেশি ফ্রেশ ও সুন্দরী লাগছে। মহাকাশযান সৌর জগৎ ছাড়িয়ে যাওয়ার পরই আমরা ‘অতি আলোক গতি’ সেট করে দিয়ে , পূর্ব নির্ধারিত ব‍্যাবস্থা অনুযায়ী স্লিপিং চেম্বারে ঘুমোতে চলে গিয়েছিলাম।
কারণ আমাদের লক্ষ্য বস্তু 'নোভা’ গ্রহ 432 আলোকবর্ষ দূরে ছিলো।
ক‍্যাপটেন রোশনি কাছে এসে বললো “সুপ্রভাত, কমান্ডার রাহুল।”
আমি ও প্রত্যুত্তরে বললাম “ওয়েলকাম”।
যদিও দুজনেই জানি এই মহাশূন্যে , কোন দিন বা রাত নেই। তবুও পৃথিবীর অভ‍্যাস মতো দেখা হলে সাদর সম্ভাষণ জানানো।
রোশনি বললো , “কমান্ডার , বর্তমান পরিস্থিতি কি যদি একটু বলেন , ভালো হয়।”
আমি বললাম “সব কিছু পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে।আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা 'ছয় মাস ঘুমোবার পর তোমায় আরো সুন্দর লাগছে’ ।”
রোশনি হেসে ফেললো। আসলে ও জানে আমি যতই ইয়ার্কি করি , আসলে কাজের ব‍্যাপারে আমি খুবই সিরিয়াস।
এই মিশনটি  শুধু আমাদের জন্য নয় মানবজাতির পক্ষে ও  গুরুত্বপূর্ণ।
বেশ কয়েক বছর আগে এই 'পোলারিস ৯১৩’  সৌরমণ্ডলের একটি গ্রহ থেকে একটি বার্তা আমাদের বিজ্ঞানী রা পাচ্ছিল।  বিজ্ঞানী রা বার্তাটি ডিকোডিং করার পর অ‍্যানালিসিস করে দেখা যায় এটি অতি উন্নত বুদ্ধিমান কোন জীবের তৈরী। বার্তা টি তে   জানানো হয়েছে  “এটি  ‘নভেরীয়’ নামে এক জাতির পক্ষ থেকে  ব্রহ্মাণ্ডের অন্যান্য উন্নত জীবদের উদ্দেশ্য প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের জানানো হচ্ছে তারা যেন তাদের প্রতিনিধি যত শীঘ্র সম্ভব তাদের গ্রহে প্রেরণ করে। বর্তমানে নভেরীয় জাতি তাদের জ্ঞান ভান্ডার অন‍্য বুদ্ধি মান প্রাণীদের সাথে ভাগ করে নিতে আগ্রহী। যদি উন্নত জীবজগৎ গুলি তাদের প্রকৃত ইতিহাস জানতে চায় তবে অবিলম্বে তাদের কাছে আসা একান্ত জরুরী।”
বার্তাটি এখানেই শেষ হয় নি ।এর পরের অংশ জুড়ে  রয়েছে বিজ্ঞানের কচকচি।  এতদিনে মানুষ অনেক উন্নত হলেও ‘অতি আলোক গতি’ করায়ত্ত করতে পারে নি । সেই কারণে   বহু দূরের আলোকবর্ষে প্রাণ আছে একথা নিশ্চিত রূপে প্রমাণ পেলেও  যোগাযোগ করে উঠতে পারে নি ।
এই বার্তা টি থেকে বিজ্ঞানীরা প্রথম বার 'অতি আলোক গতি’   কিভাবে লাভ করা যায় তার সুত্র খুঁজে পেল।
অবশেষে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী দের সমবেত চেষ্টায় ‘অতি আলোক গতি’  লাভ করলো।
তার পর এই বর্হিঃমহাকাশে এই অভিযান।যার পোশাকি নাম 'নিউটন ২৩৫০’।নভেরীয় জাতি র পক্ষ থেকে বার্তা এসে ছিল তাই ঐ সৌরমণ্ডলের পঞ্চম গ্রহ টি র নাম রাখা হয়েছে 'নোভা’। বার্তা টি নোভা থেকে ই এসেছিল।
এই মহাকাশ কর্মসূচি তে  অংশ নেওয়ার জন্য  সব নভশ্চর দের কাছ থেকেই ঐচ্ছিক আবেদন পত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল। ঐচ্ছিক কারণ , এই মিশনটি বহু দূরের উদ্দেশ্যে  । এবং এই যুগে আর কখনো ফিরে আসা যাবে না । কারণ মহাকাশযান ‘অতি আলোক গতিতে’ যাবার জন্য আইনষ্টাইনের ‘জেনারেল রিলেটিভিটি’সুত্র অনুযায়ী সেখানকার সময় ধীর গতিতে চলবে। এবং মহাকাশচারী দের সাপেক্ষে পৃথিবীর সময় অতি দ্রুত চলবে ।ফলে মহাকাশচারী দের সময় যদি মাত্র এক বছর বৃদ্ধি পায় তবে পৃথিবীতে কয়েক শো বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাবে।
রাহুল ও রোশনি একই অ‍্যাকাডেমি তে নভশ্চর হওয়ার ট্রেনিং নিয়ে ছিলো। যদিও রোশনি রাহুলের চেয়ে এক বছরের জুনিয়র ছিলো।
অন্যান্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় রোশনি রাহুলের কাছে বেশী আকর্ষণীয় ছিলো। রোশনি র সৌন্দর্য ,ব‍্যাক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা,সব কিছুই রাহুলের কাছে ভালো লাগতো।
রাহুল নিজে সব শিক্ষার্থী দের মধ্যে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিলো। অন্যান্য কম বয়সী মহিলা শিক্ষার্থী রা রাহুলের সান্নিধ্য পেতে আগ্রহী থাকলে​ও রাহুল খুব বেশী তাদের পাত্তা দিতো না।
কিন্তু যখন রোশনি এই মহাকাশ অ‍্যাকাডেমী তে ট্রেনিং এর জন্য এলো তখন যেন  মহাদেবের ধ‍্যান ভঙ্গ হলো।
যে রাহুল মহিলা দের পাত্তা দিতো না ,সে নিজের কাজের ফাঁকে সময় পেলেই রোশনি র মন পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলো।
কিন্তু বিধি বাম।
রোশনি একদিন মিষ্টি মিষ্টি কথায় রাহুল কে বুঝিয়ে দিলো ,সে এই মহাকাশ অ‍্যাকাডেমিতে মহাকাশচারী হওয়ার উদ্দেশ্যে এসেছে।আর রাহুল নিজে ও সেই উদ্দেশ্যে এসেছে। সুতরাং তাদের দুজনের ই উচিত এই সব সেন্টিমেন্ট কে পাত্তা না দিয়ে নিজের শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হওয়া।
এরপর থেকে রাহুল বুঝে যায় এ বড়ো কঠিন ঠাঁই।
মন থেকে রোশনি র আশা ত‍্যাগ না করলেও,আর কখনো রোশনি কে ডিস্টার্ব করে নি রাহুল।
এক সময় মহাকাশ অ‍্যাকাডেমি তে সফল ভাবে উত্তীর্ণ হয়ে  একের পর এক মহাকাশ অভিযানে অংশ গ্রহণ । এবং এই মুহূর্তে রাহুল একমাত্র মহাকাশচারী , যে প্রত‍্যেকটি অভিযানে একশো শতাংশ সফল।
রোশনি মহাকাশে প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে দীর্ঘ দিন গবেষণা করেছে।তার গবেষণা বিজ্ঞানী মহলে উচ্চ প্রশংসা পেয়েছে।
প্রথমে ঠিক হয়ে ছিলো  এই নোভা গ্রহের অভিযান মানুষ বিহীন রকেটের সাহায্যে হবে ।
পরে মত পাল্টে ঠিক হয় , পুরো অভিযান টা আংশিক ভাবে যন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে । এবং অভিযানে র  শুরু ও শেষ  অংশ টুকু মনুষ্যচালিত হবে  ।
এই প্রথম বার মানুষ 'অতি আলোক গতি'তে অভিযান চালাবে। বিজ্ঞানী রা চিন্তায়​ ছিলেন মানুষের মস্তিষ্ক আদৌ এই গতি সহ্য করতে পারবে কিনা। অবশেষে তারা একটি উপায় বার করলো।
অভিযানে র মধ‍্যবর্তী অংশ , যখন ‘অতি আলোক গতি'তে মহাকাশ যান ছুটবে , সেই সময় মহাকাশ যানের নিয়ন্ত্রণ রোবট করবে । এবং ঐ সময় মহাকাশচারী​দের রকেটের অভ‍্যন্তরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে। তাতে এই গতি র তীব্র এফেক্ট যেমন কম অনুভূত হবে , তেমনি দীর্ঘ যাত্রার রসদ বাঁচবে।
কিছু দিন আগেই এক প্রাণী বিজ্ঞানী যে কোন প্রাণীকে দীর্ঘ কাল ঘুম পাড়িয়ে রাখার উপায় আবিষ্কার করেছেন।এই ঘুমন্ত অবস্থায় প্রাণীটির মেটাবোলিজম প্রায় শূন‍্যে নেমে যায় । এবং প্রাণী টির বয়স বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
অতঃপর রোশনি ও রাহুল দুজনের নাম একই সাথে এই অভিযানে র সাথে যুক্ত হওয়া।
এখনো পর্যন্ত সবকিছুই নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে।
রাহুল পৃথিবীর কমান্ড সেন্টারের উদ্দেশ্যে একটা ভিডিও বার্তা ছেড়ে দিলো । বার্তা য় দুজনের বর্তমান অবস্থা থেকে সবকিছুর বিবরণ ছিলো।
যদিও এই বার্তা যদি আলোর বেগেও যায় , তবু 432 বছর পরে পৃথিবীতে পৌঁছবে।আদৌ জানা নেই তাদের সেই বার্তা গ্রহণ করার জন্য পৃথীবিতে কেউ অপেক্ষা করবে কিনা।
নোভা গ্রহটি যত কাছে আসছে মহাকাশ যানের গতিবেগ তত কম করা হচ্ছে। মহাকাশ যান এখন ম‍্যানুয়াল কন্ট্রোলে চলছে। মহাকাশ যানের গতিবেগ এখন  আলোর তিরিশ শতাংশ। লক্ষ্য বস্তু নোভা গ্রহের দূরত্ব মাত্র আশী লক্ষ কিলোমিটার দূরে। প্রতি মূহুর্তে দূরত্ব কমছে।
অকস্মাৎ রোশনি বলে উঠলো , “রাহুল দেখতো , একটা চকচকে কিছু আমাদের যানের দিকে এগিয়ে আসছে।”
রাহুল প্রথমে ব‍্যাপারটা লক্ষ করে নি।
রোশনি বলার পর মহাকাশ যানের বিশাল স্ক্রীনে র দিকে তাকিয়ে দেখলো দূরে ছোট মতো একটা কিছু দ্রুত মহাকাশ যান লক্ষ করে এগিয়ে আসছে। এখনি যানের গতিপথ না পাল্টে ফেললে মহাকাশ যান চুরমার হয়ে যাবে।
রাহুল দ্রুত কন্ট্রোল প্যানেলে নির্দেশ পাঠালো গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য।
কিন্তু প্রত্যুত্তরে কন্ট্রোল প্যানেল থেকে মেসেজ এলো 'কমান্ড ডিনায়েড’।
রাহুল রোশনি কে বললো , “গতিপথ পরিবর্তন করতে পারছি না । তুমি একবার চেষ্টা করো।”
রোশনি ও চেষ্টা করলো গতিপথ পরিবর্তন করতে। কিন্তু ফল কিছুই হলো না। মহাকাশ যান একই গতিতে ঐ আজব চকচকে বস্তু টির দিকে এগিয়ে চলেছে। কম্পিউটার বলছে আর কুড়ি মিনিট পর ঐ চকচকে বস্তু টির সাথে মহাকাশ যানের ধাক্কা নিশ্চিত।
রাহুল প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেল।
লক্ষ্য বস্তু র এতো কাছে এসে এই পরিণতি।
রাহুল বুঝে উঠতে পারছিলো না ,কি করা উচিত।
হঠাৎ রোশনি রাহুলের দিকে ফিরে বললো , “রাহুল শান্ত হও। জানি মৃত্যু নিশ্চিত। তবু ও  আমরা দুজন অভিযাত্রী। মৃত্যু র আগের মূহূর্ত পর্যন্ত আমাদের উচিত সবকিছুর রেকর্ড রাখা। এবং সেই রেকর্ড পৃথিবীর উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা।যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অভিযাত্রীরা সেই সব বিপদের মোকাবিলা করতে পারে।
আরো একটা কথা রাহুল , যেটা তুমি এতদিন শুনতে চাইলেও , আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি।আজ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই কথাটি তোমার কাছে প্রকাশ করছি। তোমার সান্নিধ্যে থাকতে থাকতে কবে যে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি জানি না।আই লাভ ইউ।”
কথা গুলো শুনতে শুনতে রাহুলের মুখে খুশি ও দুঃখের মিশ্রিত ভাব ফুটে উঠলো।
রাহুল বললো , “আজ আমার জীবন সার্থক মনে হচ্ছে। মৃত্যুর সময় তোমার পাশে থাকতে পারবো। তোমার কাছে একটা শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করছি। তুমি না বলো না।তোমায় প্রথম ও শেষ বারের মতো একটা চুম্বন করতে চাই ।”
এই কথা শেষ হওয়ার পর দু'জনের ওষ্ঠ মিশে গেলো।
কিন্তু না কর্তব্য আগে । মূহুর্ত পরে  বিচ্ছিন্ন হয়ে  নিজের নিজের আসনে বসে সব কিছুই রেকর্ড করতে ও একই সাথে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে প্রেরণ করতে লাগলো।
যে বস্তু টি এগিয়ে আসছে সেটা এখন অনেক কাছে চলে এসেছে।
প্রায় এক কিলোমিটার ব‍্যাসার্ধ বিশিষ্ট একটি গোলক।
রাহুল গোলক টির উদ্দেশ্যে লেসার বিম ছুঁড়ে মারলো। লেসার গোলক টিকে এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল।এ কেমন বস্তু ? তবে কি এটা কঠিন নয়। রাহুল মহাকাশ যানের যাবতীয় অস্ত্র গোলকটি কে লক্ষ্য করে ছুঁড়তে লাগলো। কিন্তু কোন অস্ত্র গোলকটি র কিছু মাত্র ক্ষতি করতে পারলো না। মহাকাশযানটির পথ পরিবর্তন করার পুনরায় চেষ্টা করলো। না কিছুতেই কিছু হবার নয়। মহাকাশ যানটি যেন কোন অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।আর কয়েক মূহুর্তের অপেক্ষা । তারপর মহাকাশ যানটি আছড়ে পড়বে গোলকটি র অভ‍্যন্তরে।
(মহাশূন্যে র পথিক - প্রথম পর্ব সমাপ্ত)

No comments:

Post a Comment