আমার নাম টিক টিক।
জন্মের পর মায়ের আদর বেশীদিন কপালে জোটে নি। আমি ও আমার অনেক ভাইবোন একসাথে, মায়ের সাথেই ঘুরে বেড়াতাম।
কোথাও খাবারের সন্ধানে পেলে বা কোন বিপদের সঙ্কেত পেলেই মা হাঁক মারতো “কোথায় গেলি রে সবাই ?” তক্ষুনি আমরা যে যেখানে থাকতাম এক ছুট্টে মায়ের কাছে দৌড়ে আসতাম । অবশ্য বিপদ কেন জানি না , আকাশ থেকে নেমে আসতো। হঠাৎ হঠাৎ দেখতাম এক একজন ভাইবোন কেমন গায়েব হয়ে যেতো। তারপর মায়ের সে কি কান্না । মনে হতো মায়ের সর্বস্ব নিয়ে কোন দানব চলে গেছে।
আমি ও বেশি দিন মায়ের কাছে থাকতে পারলাম না । মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য এক জায়গায় আশ্রয় পেলাম । কয়েকদিন মায়ের কথা খুব মনে পড়তে লাগলো। তারপর আস্তে আস্তে মায়ের স্মৃতি আমার কাছে আবঝা হয়ে গেল।
নতুন জায়গাটা আমার বেশ মনে ধরে গেল। প্রচুর খাবার আর অন্যান্য সাথীদের সাহচর্যে দিন বেশ ভালই কাটছিল।
ইতিমধ্যে আমি বেশ হুষ্টপুষ্ট হয়েছি । সারা শরীরে যৌবনের তাড়না। কয়েক জন সঙ্গীনিকে বেশ ভালই লাগে। এখানে আমি একাই সর্দার। সব সঙ্গীনি আমায় খাতির করে ।কেউ কেউ রীতিমত ভয় করে। যখন যে সঙ্গীনি পাই তার উপর নিজের যৌবন জ্বালা মেটাই । তাদের ইচ্ছা ,অনিচ্ছার কোনো পরোয়া করি না।
এখানে আমার এক মালিক আর মালকিন আছে । মালিক সব সময় ঘরে থাকে না ।মালকিন বেশ ভালই। দুপুর বেলা ডেকে খেতে দেন । অবশ্য উনি সবাইকেই খেতে ডাকেন। আমরা সকলেই দৌড়ে খেতে আসি। কিন্তু বাকি সবাইকে আমি ঠিক মতো খেতে দিই না ।মেরে তাড়িয়ে দিই । সব খাবার একাই খাবার চেষ্টা করি।
এই ভাবে বেশ দিন কেটে যাচ্ছিল।
একদিন দুপুরে মালকিন খেতে দিয়েছে, আমি অভ্যাস মতো সবাইকে মেরে তাড়িয়ে নিজে খাবার চেষ্টা করছি , হঠাৎ নজরে এলো মালিক একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি টা আমার সুবিধার লাগলো না । কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো। মালিক দেখি মালকিনের কাছে এসে আমার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো , “এর জন্য একজন ভালো দর দিয়েছে। তুমি বললে দিয়ে দোব।”
মালকিন উত্তর দিলো , “আমি মেয়ে মানুষ , আমি কি আর বলবো । তুমি যা ভালো বুঝবে তাই করবে।”
কয়েকদিন পরে মালিক একজনের কাছে আমায় বিক্রি করে দিলো ।
সেই লোকটা আমায় সাইকেলে করে নিয়ে গেলো । আমায় একটা খাঁচার মতো ঘরে রেখে দিলো । এখানে আমার মতো অনেকেই আছে।সকলে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা । তবে খাবার অসুবিধা নেই। পর্যাপ্ত খাবার। সবার কথা মনে পড়ছে। বিশেষত সঙ্গীনি দের কথা।
এখানে ও আমার এক সঙ্গীনি জুটে গেলো। তার কাছেই জানলাম ,দুই এক দিনের মধ্যেই নাকি কোন বড় উৎসব। সেই দিনের জন্যে ই নাকি আমাদের এতো জনকে জড় করেছে । সেই দিন নাকি এই লোকটি সবাইকে মেরে ফেলবে।
আমি বললাম , “তা কেন ? আমরা কি দোষ করেছি ?”
আমি বললাম , “এ অন্যায় হতে দেওয়া যায় না।এর প্রতিকার করতেই হবে।”
কিন্তু আমি অসহায়ের মতো দেখলাম প্রতিদিন আমার এক একজন সঙ্গী কে মেরে ফেলা হচ্ছে।
তারপর এসে গেল সেই উৎসবের দিন। চারিদিক থেকে কান ফাটানো আওয়াজ ভেসে আসছে।
সকাল থেকেই আমাদের এখানে খুব ভীড় । চোখের সামনে একের পর এক সাথীকে মেরে ফেলতে লাগলো।
অবশেষে ঘনিয়ে এলো সেই সময় । আমার পালা।
একজন মোটা মতো লোক আমার দিকে তাকিয়ে দোকানদারকে বললো , “এই মোরগটি ওজন করো ।”
অমনি দোকানদার আমার ডানা দুটি ধরে একটা পাক দিয়ে দাঁড়িপাল্লায় চাপিয়ে বললো , “দু কিলো ।”
লোকটি বললো “কেটে দাও ।” আমাকে তক্ষুনি মাংস কাটার হাড়কাঠের ওপর ফেললো। আমার নতুন সঙ্গীনি দেখলাম মুখ টা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দুঃখ ভোলার চেষ্টা করছে।একটু পরেই হয়তো ওর পালা আসবে।
একটা ধারালো ছুরি আমার গলা লক্ষ্য করে নেমে আসছে।
মৃত্যু র আগে একটা তীব্র আর্তনাদে বলে উঠলাম , “ওগো দয়াময়, তুমি ই বলো এ কেমন উৎসব,অন্যর প্রাণের বিনিময়ে ।” (শেষ)
No comments:
Post a Comment