Crss colum

Monday, November 23, 2020

রক্ষক ১৩

ইউরোপা।
বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ।

মহাকাশযান থেকে আদিত্য দেখতে পেল এক শুভ্র পিরামিড। ঠিক যেন মিশরের পিরামিড।আর পিরামিড কে ঘিরে রেখেছে এক বুদবুদ। গুরুদেব বুঝিয়ে দিলেন " ঐ যে বুদবুদ টি দেখছো ওটি শ্বাস নেওয়ার উপযুক্ত  বাতাসের বুদবুদ। এমনিতে মাতৃকা গোষ্ঠী বাতাসের সাহায্য ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু অতি উন্নত টেকনোলজি দিয়ে তৈরি এই বুদবুদ এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও এখানে আসা মানুষজন দের বাঁচিয়ে রাখতে তৈরি করা হয়েছে। তাদের মহাকাশযান ক্রমশ বাতাসের বুদবুদের ভিতরে প্রবেশ করলো।আকাশ থেকে যতটা ছোট মনে হচ্ছিল ভিতরে প্রবেশ করার পর বুঝতে পারলো ততটা ছোট নয় ।অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে এই বুদবুদ।
মহাকাশযান  ধীরে ধীরে পিরামিড আকৃতির বিশাল শুভ্র মার্বেল পাথরের মন্দিরের প্রধান প্রবেশ পথের সামনে দাঁড়ালো । আদিত্য ও গুরুদেব তমোঘ্ন মহাকাশযান থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। দেখল তাদের স্বাগত করবার জন্য দশ জন মাতৃকা মন্দিরের প্রধান প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সর্বাগ্রে দাঁড়িয়ে আছে আদিত্যর মা ময়ূরী। আদিত্য ময়ূরীর কাছে গিয়ে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে     প্রণাম করলো। ময়ূরী তাকে উঠিয়ে তার কপালে স্নেহ চুম্বন দিলো। বহুদিন বাদে মা ও ছেলের মিলন হলো। উভয়ের চোখ দিয়ে টপটপ করে আনন্দ অশ্রু ঝরতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ময়ূরী বলল, "  আদিত্য আমি তোর সব খবর রাখি। সর্বদা তোর চিন্তা করি। তুই সত্ত্বগুণের ও রজোগুণের কুপে অবগাহন করেছিস। এখন তোর সামনে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। তমোগুণের কূপ জয় করা সহজ নয়। কিন্তু আমি জানি এই কাজ তুই পারবি। তোকে পারতেই হবে। আয় তোকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।"
এই বলে আদিত্য র একটি হাত ধরে তাকে সর্বপ্রথমে  তাদের সকলের গুরুমা প্রবীণা মাতৃকার কাছে নিয়ে গেল। আদিত্য প্রবীণা মাতৃকাকে ভক্তিভরে প্রণাম করলো। তিনি আশীর্বাদ করলেন "জয়ী হও"। একে একে সকল মাতৃকা আদিত্যকে আশীর্বাদ করলেন। তারপর সকলে মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
আদিত্য দেখল বিশাল সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত এক মন্দির। মন্দিরের ঠিক মধ্যস্থলে এক বিরাট আকারের কূপ রয়েছে। সেই কূপের দিকে নির্দেশ করে প্রবীণ মাতৃকা বললেন " আদিত্য এই হল তমোগুণের কূপ। সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে রহস্যময় স্থান। এবার তোমার পরীক্ষা হয় অন্য প্রকার হবে। ঠিক কি প্রকার সে সম্পর্কে আমি কিছুই বলবো না। তবে প্রকৃত রক্ষক হওয়ার জন্য যে গুণ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটা তোমার মধ্যে আছে কিনা এটা তার পরীক্ষা নেবে। তুমি একজন মাতৃকার গর্ভজাত।মাতৃকা জাতির পুরুষদের শূন্য মণি ছয়মাস বয়স হলেই মিলিয়ে যায়। তখন সে সাধারণ মানুষ। কিন্তু তুমি যে মূহুর্তে তমোগুণের কূপের মধ্যে প্রবেশ করবে তৎক্ষনাৎ তোমার মিলিয়ে যাওয়া শূন্য মণি আবার প্রকাশিত হবে। সেই সঙ্গে মাতৃকা জাতির সব গুণাগুণ তুমি অর্জন করবে। এই তমোগুণের কূপে অবগাহন করলেই  স্পেস টাইমের উপর তোমার কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু একটা সাবধান বাণী আছে। এই তমোগুণের কূপ আসলে একটা ছোট ব্ল্যাক হোল। এখানে প্রবেশ করা সহজ । কিন্তু বের হওয়া খুবই কঠিন। এই মন্দিরের অপরদিকে আরো একটি কূপ রয়েছে। সেটার ভিতরটা ধবধবে সাদা। সেটাই এই কূপের অপর প্রান্ত। সেটা একটা হোয়াইট হোল। ব্ল্যাক হোল দিয়ে প্রবেশ করে পরীক্ষায় তমোগুণের  রক্ষাকারী শক্তি দেবী গৌরীকে সন্তুষ্ট করলে তবেই তার আশীর্বাদে হোয়াইট হোল দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে। না হলে সারাজীবন ভিন্ন কোনো টাইম লাইনে বন্দী হয়ে থাকবে।  আশা করি বুঝতে পেরেছো ?"
আদিত্য বললো " বুঝতে পেরেছি । এবার আমাকে প্রবেশ করার অনুমতি দিন।"
এমন সময় গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন " "একটু দাঁড়াও।"
এই বলে    তিনি তার পোশাকের ভিতর থেকে একটা  আংটি বার করে আদিত্যর হাতে তুলে দিয়ে বললেন " এটা একটা রিয়েলিটি আংটি। এটার একটা বিশেষ গুণ রয়েছে। এটা  আঙ্গুলে পরা মাত্রই তোমার বিস্মৃত হয়ে যাওয়া স্মৃতি কে পুনরায় জাগিয়ে তুলবে। এই আংটির মধ্যে যে লাল রঙের পাথরটি দেখতে পাচ্ছ সেটাকে চাপ দিলেই তুমি নিজের আপন জগতে ফেরত আসতে পারবে। সেই সঙ্গে আরও একটি কথা স্মরণে রেখো তমোগুণের কুপের সময় ও আমাদের সৌরমণ্ডলের সময় এক নয়। তমোগুণের কূপে তুমি যদি এক বৎসর কাটাও সেটা আমাদের জগতে একদিনের সমান হবে। তোমাকে তমোগুণের কূপ থেকে আমাদের সময়কালের সাত দিনের মধ্যে ফেরত আসতে হবে যদি কোন কারনে ব্যর্থ হও তবে তুমি চিরকালের জন্য ওখানে আটকে পড়ে যাবে। তুমি কুপে প্রবেশ করার আগে এই আংটিটা ছুঁড়ে দাও। আমাদের জগতের সাতদিন পূর্ণ হবার আগেই এই আংটিটা তোমার কাছে ফেরত আসবে। এখন যাও। নিজের কর্তব্য সাধন করে বিজয়ী হয় ফেরত এস এই আশীর্বাদ করলাম।"
আদিত্য গুরুদেবের কাছ থেকে আংটিটি নিলো তারপর তমোগুণের কূপে সেটি নিক্ষেপ করলো। পুনরায় সবাইকে প্রণাম করে তমোগুণের কূপে ঝাঁপ দিলো।

চারিদিকে কালো অন্ধকার। এত কালো যে কোন স্থান হতে পারে সেই ধারণা ছিলনা। অন্ধকারে আদিত্য নেমেই চলেছে। কতক্ষণ ধরে চলেছে সেই সময়ের হিসেব নেই। অনেকক্ষণ বাদে তার মনে সন্দেহ হলো সে কি আদৌ নামছে নাকি উঠছে? কিছুই বুঝতে পারা যাচ্ছে না। আরো বহুক্ষণ ধরে নামার পর আদিত্যর মনে ভয় জন্মালো। এই কূপের আদৌ কি কোন অন্ত আছে? এত দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার পরেও এই কূপের শেষ হচ্ছে না। আদিত্য চোখ বুজে ফেললো। মায়ের কথা, গুরুদেবের কথা খুব মনে পড়ছে। এই অন্তহীন কূপ থেকে ছাড়া পেয়ে আবার কখনো কি তাদের দেখতে পাবে আদিত্য ?
এমন সময় আদিত্যর কানে এক কোমল নারী কন্ঠ বলে উঠলো " তমোগুণের কূপে তোমাকে স্বাগত। আমি এই কূপের রক্ষণ কারী শক্তি 'গৌরী'। আমি সকলের মানসিক দৃঢ়তা ও কর্তব্যনিষ্ঠার পরীক্ষা নিয়ে থাকি। যে কোন প্রাণীর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা মায়া , মোহ , মমতা। এগুলোকে জয় করা সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। আমি তোমার জীবনের উদ্দেশ্য জানি। ভবিষ্যতের রক্ষক হতে গেলে তোমাকে এই দুর্বলতা গুলির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। কর্তব্যের খাতিরে প্রয়োজনে সবকিছুই বলি দিতে হবে। এবারে তুমি যে জগতে পৌঁছবে তা তোমার বাস্তব জগত হতে ভিন্ন প্রকৃতির। সেখানে পৌঁছানো মাত্রই তোমার পূর্ব স্মৃতি লোপ পাবে। কি কারনে কী উদ্দেশ্যে তুমি এই অজানা জগতে যাত্রা করেছিলে তা ভুলে যাবে। অবশ্য এতদিন যেসকল ক্ষমতা তুমি অর্জন করেছ তা তোমার স্মরণে থাকবে। বাকি সবকিছুই তুমি ভুলে যাবে। সঠিক সময় তোমার গুরুদেবের দেখানো রিয়েলিটি আংটি তুমি খুঁজে পাবে । যা কিছুক্ষণের জন্য তোমার উদ্দেশ্য তোমাকে মনে করিয়ে দেবে। তারপর তোমার সিদ্ধান্ত হয় তোমাকে রক্ষক করে তুলবে অথবা চিরকালের মতো এই জগতে বন্দী করবে।
আশা করি তুমি এই পরীক্ষায় জয়ী হবে।"

হঠাৎ আদিত্য নিজের বন্ধ চোখের পাতায় আলোর আভাস পেলো। সে ধীরে ধীরে চোখ খুললো। দেখল একটি পাহাড়ি টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সামনে খুব সুন্দর সবুজ পাহাড়ি উপত্যকা দেখা যাচ্ছে। আরও অনেক দূরে একটি ছোট্ট অথচ খুব সুন্দর শহর চোখে পড়ছে। আদিত্য বুঝতে পারল ওই দূরের ছোট্ট শহরটি তার গন্তব্য। সে দ্রুত টিলা থেকে নেমে পাহাড়ি শহরের দিকে এগিয়ে চললো। বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর দেখলো একটা রাখাল বালক অনেকগুলি ভেড়া নিয়ে চড়াতে বেরিয়েছে। রাখাল বালক টি তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। রাখাল বালক টি এগিয়ে    এসে তার হাত ধরে  এক অজানা ভাষায় তাকে কিছু বললো। ভাষাটি অজানা হলেও আদিত্য স্পষ্ট বুঝতে পারল রাখালবালক টি তাকে বলছে " তুমি কে? কোথা থেকে আসছ ? তোমার কপালে নীল রঙের ওটা কি চকচক করছে?"
আদিত্য তার কথার উত্তরে বললো " আমি আদিত্য। এখানে কেন এসেছি বা কিভাবে এসেছি জানিনা। আমার কপালে কি চকচক করছে জানা নেই । এটা কোন জায়গা? "
যদিও আদিত্য তার নিজের ভাষায় কথাগুলি বলছিলো , কিন্তু শূন্য মণির বিশেষ গুনে কথাগুলি রূপান্তরিত হয়ে সামনে থাকা রাখাল বালকটি নিজের ভাষায় সেগুলো শুনতে পাচ্ছিল।
রাখাল ছেলেটি উত্তর দিলো , "  আমাদের এই রাজ্যের নাম স্বপ্ন রাজ্য। ওই যে দূরে শহরটি দেখতে পাচ্ছ ওটা আমাদের রাজধানী স্বপ্নপুরী। আমাদের রাজ্যের খুব বিপদ । কিছুদিন আগে আমাদের  রাজা মারা গেছেন। আর তারপর হতে আকাশ থেকে অনেক বিপদ আমাদের উপর হানা দিচ্ছে। মন্দিরের  প্রধান পুরোহিত ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন অজানা জগত হতে এক রাজার আগমন হবে। সে আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। সেই থেকে আমরা সবাই অজানা জগত থেকে আসা মানুষের সন্ধান করে চলেছে। তুমি কি কোন অজানা জগত থেকে আসছ?"
আদিত্য বললো " জানি না"। রাখাল ছেলেটি  বললো "  চলো তোমাকে আমাদের শহরে নিয়ে যাই।"
যেতে যেতে রাখাল ছেলেটি তাকে বলে চললো "  আমাদের রাজার কোন পুত্র সন্তান নেই। একটি মাত্র কন্যা সন্তান রয়েছে। আমাদের রাজ্যের নিয়ম কেবলমাত্র পুরুষরাই রাজা হবে। বহুকাল পূর্ব হতেই ভবিষ্যৎ বাণী রয়েছে এই রাজ্যে যখনই কোন রাজার অভাব হবে তখনই আকাশ হতে বিপদ নেমে আসবে।  একমাত্র রাজাই পারবে এই বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করতে। "
দেখতে দেখতে তারা দুজনে বিরাট উঁচু প্রাচীর ঘেরা শহরের মূল দরজার সামনে এসে পৌঁছল।( ক্রমশ)


No comments:

Post a Comment