Crss colum

Monday, June 10, 2019

নতুন প্রভাত

সানাইয়ের সুরটা ভেসে আসছে। সামনাসামনি কোনো বিয়ে হচ্ছে বোধহয়। এতো করুণ সুর যে কেন প্রতিটি বিবাহের অনুষ্ঠানে বাজানো হয় তা অনিকেত এতোদিন বুঝতে পারতো না। কিন্তু আজ সে অনুভব করছে সানাইয়ের সুর এতো করুণ কেন। প্রতিটি বিবাহের অনুষ্ঠান যেমন নব দম্পতির জীবনে সুখ বয়ে আনে তেমনি অনেক কান্নার জন্ম দেয়। সে কান্না কখনো কন্যার বাবা মায়ের,যারা তাকে বুকে আগলে রেখে বড়ো করে তুলেছে তাদের। নতুবা তার মতো ভাগ্যহীন প্রেমিকদের।তিন মাস আগে থেকেই মল্লিকা নিজেকে তার জীবন থেকে সরিয়ে নিচ্ছিলো। অনিকেত বুঝতে পারছিলো সব কিছুই। কিন্তু তার কিছুই করার ছিলো না।এক জন অর্ধ বেকার যুবকের পক্ষে সংসার করার বিলাসিতা শোভা পায় না। মল্লিকার দোষ নেই। সেই কলেজে ঢোকার প্রথম বছরেই আলাপ। তারপর বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। মল্লিকা অনেক দিন অপেক্ষা করেছিলো। কিন্তু আর পারলো না।ওর বাড়ী থেকে বিয়ের দেখাশোনা অনেক দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। মল্লিকা পড়াশোনার বাহানা দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু বি এ ফাইনাল ইয়ারে পাশ করে যাওয়ার পর আর কোনোভাবেই বাড়ীর চাপ ঠেকাতে পারলো না। তবুও মল্লিকা শেষ চেষ্টা হিসাবে অনিকেত কে বলেছিলো তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু অনিকেত রাজী হয় নি।রাজী হবেই বা কি করে ? বাবার চটকলের চাকরি থেকে রিটায়ার্ড হতে আর এক বছর বাকি। মায়ের দুই চোখে ছানি পড়েছে।বাম চোখটায় তো আর কিছুই দেখতে পায় না। ঘরে বিবাহযোগ্যা বোন।এই অবস্থায় সামান্য টিউশনির টাকার উপরে ভরসা করে এতো বড়ো ঝুঁকি নেওয়া যায় না। চোখে জল নিয়ে মল্লিকা কাঁদতে কাঁদতে  চলে গিয়েছিল। সেদিন অনিকেত কাঁদে নি। পাথরের মতো চুপচাপ বসেছিল পার্কের এক কোণের বেঞ্চিতে।

আজকেও সেই বেঞ্চিতেই বসে আছে । কিন্তু আজ আর চোখের জল বাঁধ মানছে না। আজকে মল্লিকার বিয়ে।শুনেছে পাত্র নাকি সরকারি চাকুরে। বিশাল বড়োলোক।ভালোই ! মল্লিকা সুখেই থাকবে। নিজেকে আজ বড়ই অসহায় মনে হচ্ছে অনিকেতের। নিজের জীবনটাকে মূল্যহীন মনে হচ্ছে। কি হবে এই জীবন রেখে । নিজেকে ধিক্কার দেয় অনিকেত। মনের কষ্ট চাপা দিতে সকাল বেলাতেই  ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলো অনিকেত। সারাদিন কিছু খায় নি। সন্ধ্যা হতে গঙ্গার ধারে এই পার্কের সেই নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসেছিলো অনিকেত। এই বেঞ্চিতে বসে একসময় ঘন্টার পর ঘন্টা দুজনে গল্প করেছে। ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু আজ নিদারুণ বাস্তব অনিকেতকে বুঝিয়ে দিচ্ছে জীবন টা এতো সহজ নয়।
‘এই জীবনে যখন মল্লিকা কে পেলাম না , তখন এই জীবন রাখবো না।’নিজের মনে বিড়বিড় করে বললো অনিকেত।‘ মা গঙ্গা তুমি সাক্ষী, আমি সত্যিই ভালোবেসেছিলাম মল্লিকাকে। তোমার বুকেই আজ আশ্রয় নেবো। আমার শেষ ইচ্ছা  পরের জন্মে মল্লিকাকে যেন স্ত্রী হিসাবে পাই।’চাপা স্বরে বললো অনিকেত।

আচমকা পিঠে একটা চাপড় এসে পড়লো , সেই সঙ্গে একটা চেনা গলার স্বর “ কিরে তাহলে ঠিক করেই ফেললি যে আত্মহত্যা করবি?”

অনিকেত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেই চমকে গেলো। পার্কের বড়ো বড়ো ল্যাম্পপোস্টের আলোতে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে অমৃত দাঁড়িয়ে।
অনিকেতের মুখ দিয়ে একটু গোঙানির মতো আওয়াজ বেরিয়ে এলো। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে অনিকেত বললো ‘ তুই , তুই এখানে ?’
অমৃত নির্দ্বিধায়  বেঞ্চির পিছন দিক থেকে ঘুরে গিয়ে অনিকেতের  পাশে বসে বললো “ হ্যাঁ আমি ।তোর জন্য আসতেই হলো।”
অনিকেত বললো “ কিন্তু তুই তো মারা গেছিস । শশ্মানে তোর দেহ আমার চোখের সামনেই সৎকার হয়েছে।”
অমৃত বললো ‘ তাতে কি ? আমি কি শেষ হয়ে গেছি ? নাকি আমার ইচ্ছা , অনিচ্ছা,আশা আকাঙ্খার নিবৃত্তি হয়েছে ? গীতায় পড়িসনি যে আত্মা অমর।’
অনিকেত বললো ‘না সেটা জানতাম। কিন্তু এই প্রথম প্রমাণ পেলাম।’
অমৃত বললো ‘ তাহলে কি ঠিক করলি ? আত্মহত্যা করবি ? করবি কর । আমি বাধা দেবো না।একাই আছি । তুই আত্মহত্যা করলে দুই জন হবো।’
অনিকেত বললো “ আমার দুঃখ তুই বুঝতে পারবি না।”
অমৃত বললো “ কি বুঝতে পারবো না ? মল্লিকা কে তুই অনেক অনেক ভালোবাসিস ,এটা বুঝতে পারবো না ? মল্লিকা ছাড়া তোর জীবনে বাঁচার কোনো মানে হয় না ,এটা বুঝতে পারবো না ? আসলে তুই বুঝতে পারছিস না যে , এগিয়ে চলাই জীবন। কোনো একটি ঘটনা নিয়ে আঁকড়ে পড়ে থাকা জীবন নয়। সুখ , দুঃখ দুটোই জীবনে আসবে। কিন্তু সেই অনুভূতি গুলোকে পিছনে ফেলে আরো নতুন অনুভবের আশায় এগিয়ে যেতে হবে। মল্লিকা তোর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। কিন্তু সেটা আজ অতীত।সে নতুন সংসার জীবন পেতেছে। তোদের দুজনের উচিত পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখে জীবন টাকে নতুন করে গড়ে তোলা। ”
অনিকেত বললো ‘ বলা সহজ। কিন্তু ওকে ভুলে থাকতে পারা আমার কাছে অসম্ভব।’
অমৃত বললো “ আচ্ছা যে মা বাবা তোকে এতোগুলো বছর ধরে মানুষ করলো ,তুই চলে গেলে তাদের কি হবে একবারো ভেবেছিস ?যে বোন সকাল সন্ধ্যা তোর এটা ওটা ফাই ফরমাশ খাটে ,যার সব শখ আবদার দাদার কাছে , তার কথা তুই ভুলে গেলি কি করে ?  তোর কি সব কর্তব্য বোধ প্রেমিকার ভালোবাসার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে ?  এতটা অমানুষ তুই হলি কিভাবে ?”
অমৃত বলে চললো “ জানিস তো আমার একটা বোন ছিল। বাবা মা অনেক আগেই মারা গিয়েছিল।  অনেক কম বয়স থেকেই আমার কাঁধে বোনের দায়িত্ব এসে পড়েছিলো। আমি সারাদিন কাজ করে , সংসার চালিয়ে ,সন্ধ্যায় নাইট কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল নিজে বড়ো হবো । ভালো চাকরি করবো। খুব ভালো ঘরে বোনের বিয়ে দেবো। কিন্তু সেসব আর হলো না।এক সন্ধ্যায় কলেজ থেকে ফেরার সময় একটা বাস আচমকা আমার বুকের ওপর দিয়ে…….. ”।অমৃত থেমে যায়। অনিকেত দেখলো অমৃতের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। অনিকেত জানে অমৃতের এই শরীর , চোখের জল , কোনোটাই আসল নয়, বায়বীয়। কিন্তু তার অনুভূতি টি খাঁটি।
অমৃত পুনরায় বললো ,“ আমার জীবন টাতো আর নেই। কিন্তু তোর টাতো এখনো আছে।জানিস আমার মৃত্যুর সময় আমার শেষ চিন্তা কি ছিলো ?  ”
অনিকেত বললো  “কি ?”
অমৃত উত্তর দিলো “ দাদা হিসাবে কর্তব্য টুকু করতে পারলাম না।  আমার বোন এখন কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে লোকের বাড়ি কাজ করে। সমাজের লোলুপ হায়েনার দল থেকে নিজেকে কতোদিন লুকিয়ে রাখতে পারবে জানি না। তাকে রক্ষা করার এখন আর কেউ নেই।
তুই কি চাস তোর বোনের পরিণতি আমার বোনের মতো হোক?”
অনিকেতের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এলো। অনেকক্ষণ ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো।
শেষে অনিকেত বললো “ তুই চুপ কর। আমি বুঝতে পারছি যে ,সব কিছুর থেকে কর্তব্য বড়ো। আমি নিজের কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইছিলাম।আজ থেকে আমি কখনো নিজের কর্তব্য পালন থেকে বিচ্যুত হবো না। ”
অমৃত বললো “ যাক ভালো লাগছে এই ভেবে যে তুই জীবনের মহত্ত্ব বুঝতে পেরেছিস।আর একটা কথা , চাকরির আশায় বসে না থেকে ব্যবসা কর না। ছোটোখাটো ব্যবসা দিয়ে শুরু কর।যেমন মনে কর  অর্ডার নিয়ে মাল সাপ্লাই। আমরা ভাই-বোন ঘরে   চানাচুর ,ঝুড়িভাজা ,বাদাম ভাজা এই সব তৈরী করে বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই দিতাম। তুই তো আমার সরঞ্জাম গুলো নিয়ে ঐসব তৈরী করে  দোকানে দোকানে সাপ্লাই দে। আমার বোনের সঙ্গে পার্টনারশীপ করে নতুন করে ব্যবসা শুরু কর। তাতে আমার বোনের  ও তোর উভয়েরই মঙ্গল হবে।যাক চলি রে সকাল হয়ে আসছে।ঐ দেখ পূর্ব দিকের আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। আমার কথাটা মনে রাখিস …  ”
অমৃত ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
অনিকেত পূর্ব দিকে আকাশে উদীয়মান সুর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সূর্যের আলো আজ তার মনের সব গ্লানি মুছে দিয়ে নতুন আশা বহন করে আনছে।

No comments:

Post a Comment