Crss colum

Wednesday, September 11, 2019

রক্ষক ৭

                    (১১)
সিনহারাজা ফরেস্ট ,শ্রীলঙ্কা।
সময় - ২০৩৮ সাল।

থিরুপালী  তার গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে। আসলে বুনো শুয়োরটার পিছনে ধাওয়া করতে করতে একটা জেদ চেপে গেছে। গ্রামের সব যুবকদের মধ্যে তার শিকারের দক্ষতা বেশী একথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে। তার ছোঁড়া তীরে বুনো শুয়োরটা আহত হয়েছে এটা নিশ্চিত। মাটিতে পড়া ফোঁটা ফোঁটা রক্ত এই ব্যাপারে স্বাক্ষী দিচ্ছে।আরো কিছুটা ঝোপঝাড় ভেঙে এগিয়ে গিয়ে দেখলো বুনো শুয়োরটা একটা বিরাট গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ঝিমোচ্ছে। তার পিঠে এখনো থিরুপালীর  ছোঁড়া তীর গেঁথে আছে।থিরুপালীকে এগিয়ে আসতে দেখেই বুনো শুয়োরটা তীর বেগে সামনের টিলার একটা গুহায় এক ছুট্টে ঢুকে পড়লো। এইবার থিরুপালী একটু বেকায়দায় পড়লো। থিরুপালী এই দিকে আগে কখনো শিকারে আসেনি।এই দিকটাকে সবাই বলে  ' রাক্ষস বন'। গ্রামের বুড়োরা বলে এদিকেই কোথাও রয়েছে রাক্ষস গুহা।
এই গুহাটা সেই গুহা নয়তো ?
বিশাল গুহা মুখের মধ্যে দিয়ে  থিরুপালী এক প্রকার ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভিতরে ঢুকলো।মনে মনে বুদ্ধের নাম জপ করতে লাগলো।এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠছে।
গুহাটা বাইরে থেকে যতটা বড়ো লাগছিলো , ভিতরে ঢুকে দেখলো আরো বড়ো। গুহার ভিতরে খুব বেশী অন্ধকার নেই। অনেক অনেক উঁচুতে একটা ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ছে গুহার মধ্যে থাকা একটা জলের চৌবাচ্চায়। সেখান থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে গুহার ভেতরে এক মায়াবী মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
থিরুপালী গুহার ভেতরে ঢুকে প্রথমে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলো না। তারপর ক্রমশ চোখ অল্প আলোয় সয়ে এলে সব কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো।
গুহার ভেতরে অনেকটা প্রশস্ত হলঘরের মতো জায়গা। মধ্যিখানে একটা জলের চৌবাচ্চা।থিরুপালী জলের চৌবাচ্চার একদিকে দাঁড়িয়ে ছিলো।তার অপর দিকে একটা বিরাট বড়ো পাথরের সিংহাসন। সিংহাসন টা এতোটাই বড়ো যে তার বসবার স্থানে থিরুপালীরা তিন ভাই ও বাবা মা সমেত সেখানে শুয়ে পড়তে পারে।
সিংহাসনে এক ভীতিকর বিরাট কুৎসিত চেহারার মূর্তি  পদ্মাসনে বসে আছে। এতো বড় নিস্পন্দ মূর্তি দেখে থিরুপালীর ভয় করছিলো।শুয়োর টাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়াই মঙ্গল।
থিরুপালী দেখলো বিশাল পাথরের সিংহাসনে র পাদদেশে বুনো শুয়ারটি নেতিয়ে পড়ে আছে। থিরুপালীর ভয় লাগছিলো। তাড়াতাড়ি শুয়োর টাকে শেষ করে দিয়ে সূর্যের আলো থাকতে থাকতে ঘরে ফিরতে হবে।থিরুপালী দ্রুত তার কাছে গিয়ে তীর ধনুক টা মাটিতে নামিয়ে রেখে কোমরে গোঁজা ছুরি টা বের করে শুয়োর টাকে বাগিয়ে ধরে তার গলায় পোঁচের পর পোঁচ মারতে লাগলো।শুয়োরটা যন্ত্রণায় ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলো। থিরুপালী একমনে তার কাজ করছিলো। কিন্তু তার মনে হলো পিছনে কিছু একটা নড়ে উঠলো। চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখলো সিংহাসনে বসা ভয়াবহ বিরাট মূর্তি টা উঠে দাঁড়িয়েছে। মূর্তি টা তার বিশাল হাত বাড়িয়ে থিরুপালীর কোমর টা জড়িয়ে ধরলো। ঠিক যে ভাবে কেউ বিড়াল ছানা কে ঘাড়টা ধরে তুলে ধরে তেমনি বিশাল বড়ো মূর্তি টা থিরুপালীকে চাগিয়ে তার মুখের কাছে তুলে আনলো।এক মূহুর্ত থিরুপালীর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বিরাট বড়ো হাঁ করে থিরুপালীকে মুখে পুরে কয়েকবার চিবিয়ে গিলে ফেললো।
বহুকাল সাধনার পর সে ক্ষুধার্ত হয়েছিল।আজ জেগে উঠতেই দেখলো খাদ্য আপনা থেকেই তার কাছে এসে পৌঁছেছে। এটা তার সাধনার ফল।
এতকাল সাধনায় সে অনেক অভাবনীয় ক্ষমতা লাভ করেছে।আজ যে কোনো জায়গায় সে নিমেষে পৌঁছে যেতে পারে।যে কোন রূপ ধারণ করতে পারে।যে কোনো ভোগ্য বস্তু অনায়াসেই পেতে পারে। তবে যে সঙ্কল্প নিয়ে সে এই গুহায় হাজার হাজার বছর আগে সাধনায়  বসেছিলো তা আংশিক ভাবে সফল হয়েছে।
মূর্তি টি মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে গুহার বাইরে এলো।
বহুকাল বাদে সূর্যের মুখ দেখলো সে।

সে হলো রাক্ষস বংশের শেষ রাক্ষস  "ত্রিকাল"। মানব জাতির আক্রমণে রাক্ষস বংশ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সামান্য কিছু জন কোনোক্রমে টিকে যায়। কিন্তু সেই সামান্য কিছু জন রাক্ষস কালক্রমে মানব জাতির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অবলুপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত একজন মাত্র টিকে থাকে ।সে হলো "ত্রিকাল"।ত্রিকাল মানবজাতির অবলুপ্তি কামনা করে এই গুহায় সাধনায় বসে। কঠোর সাধনায় শেষ পর্যন্ত বিশ্বচৈতন্য তার অন্তরাকাশে জ্যোতি আকারে উপস্থিত হয়।

সেই জ্যোতি থেকে এক গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর তার অন্তকর্ণে বলে ওঠে

"তোমার সাধনায় আমি তুষ্ট। কিন্তু তুমি যে উদ্দেশ্যে সাধনা করেছো সেই ইচ্ছা আমি সরাসরি পূর্ণ করতে পারি না। তোমার বংশের পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের পরিণামে তোমার বংশ লোপ পেয়েছে। মানবজাতি যদি অনুরূপ কর্ম করে তবে কালের নিয়মে তারাও অবলুপ্ত হবে। কিন্তু এই ক্ষণে আমি তাদের ধ্বংস সাধন করবো না। তবে তুমি তোমার ইচ্ছা পূরণের একটি সূযোগ পাবে। কিছু কাল পরে মানবজাতি এক ভয়াবহ সমস্যা র সম্মুখীন হবে। সেই সমস্যা থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে এক রক্ষকের জন্ম হবে। সেই রক্ষকের  প্রয়োজন হবে এক ভয়ঙ্কর ক্ষমতাশালী অস্ত্রের।তার নাম পাশুপত। আমি তোমাকে অতীব ক্ষমতার অধিকারী করলাম। আমার আশীর্বাদে তুমি যে কোন রূপ ধারণ করতে পারবে।যে কোনো অস্ত্র তুমি ইচ্ছা করা মাত্রই তোমার হস্তে আবির্ভূত হবে। তুমি ইচ্ছা মাত্র যে কোনো স্থানে গমন করতে পারবে। রক্ষক পাশুপত যেখানে লুকিয়ে রাখা আছে সেখানে পৌঁছানো মাত্রই তুমি তা জানতে পারবে। তুমি যদি রক্ষককে বাধাদান করে সফল হও তবে মানবজাতি পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হবে।"
তারপর থেকে ত্রিকাল  এতোদিন ধরে সাধনায় লিপ্ত থেকে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু আজ তার সাধনা ভঙ্গ হওয়ায় বুঝতে পারলো তার প্রতিশোধের সময় আসন্ন।আর অল্প কিছুদিন পরেই তার ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে।
ত্রিকাল গুহার বাইরে এসে দেখলো সব কিছুই ছোট হয়ে গেছে। গাছপালা ও অনেক ছোটোখাটো। এখন তাকে কিছু দিন আত্মগোপন করে থাকতে হবে। তাই প্রথমে নিজের আকৃতি একটু আগেই খাদ্য হওয়া মানুষটির মতো করে নিলো। তারপর ঐ মানুষটির মতোই রূপ ধারণ করে নিলো।
এবার তাকে কেউ রাক্ষস বলে চিনতে পারবে না।

এখন শুধু অপেক্ষা সঠিক সময়ের।

                     (১২)

পাঠশালায় আরো একটি বিশেষ দিন।

গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন
"প্রিয় শিক্ষার্থীগণ,
                             আজ তোমাদের বলবো তিনটি বিশেষ জ্ঞান কূপ সম্পর্কে। সৃষ্টির তিনটি আদি জ্ঞান হলো সত্ত্ব ,রজঃ ও তমো। গুরু পরম্পরায় প্রচলিত আছে যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল এই তিনটি গুণ কে আশ্রয় করে। সৃষ্টির প্রতিটি প্রাণে এই তিনটি গুণ বর্তমান। কিন্তু গুণগুলো সব প্রাণীতে সমান অংশে নেই। কোনো প্রাণীর মধ্যে হয়তো সত্ত্ব গুণের আধিক্য আবার কোথাও রজঃ গুণের। আবার কোনো প্রাণীর মধ্যে  তমো গুণ বেশি আছে। সেজন্য সব প্রাণীর স্বভাব এক নয়। এমনকি একই প্রজাতির প্রাণীর মধ্যেও ভিন্ন স্বভাবের হয়। এছাড়া একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে ভিন্ন আচার ব্যবহার দেখা যায়।
এসবই হয় তিনটি গুণ সমান অংশে না থাকার জন্য। যদি তিনটি গুণ সমান অংশে কারো মধ্যে থাকে তবে সে সৃষ্টির গোপন ও গুপ্ত শক্তি গুলো পাওয়ার অধিকারী হয়। এবং সেই ব্যক্তি পক্ষপাতশূন্য এবং কল্যাণকারী হয়।
এছাড়া সৃষ্টির সব জ্ঞান তার কাছে সহজলভ্য হয়।
দুই ভাবে এই তিনটি গুণের অসাম্য দূর  হয়।
প্রথমত সাধনার দ্বারা।যোগ সাধনার দ্বারা শরীরের তিনটি গুণের অসাম্য দূর হয়।

আরো একটি পদ্ধতি আছে। কিন্তু সেটা খুবই গোপন এবং ভীষণ কঠিন। এই বিশ্বে তিনটি গুণ দিয়ে তৈরী তিনটি গোপন কূপ রয়েছে।ঐ তিনটি কূপে যদি কেউ অবগাহন করে তবে তার শরীরের তিনটি গুণের অসাম্য চিরতরে দূর হয়ে যায়। কিন্তু এই তিনটি কূপের স্নান সহজেই করা যায় না। প্রতিটি কূপ নিজস্ব রক্ষাকবচ যুক্ত। এই রক্ষাকবচ সৃষ্টি হয়েছে সাধারণের কাছ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং কেবলমাত্র প্রকৃত যোগ্যতার মানুষের জন্য।
প্রথম দুটি কূপ পৃথিবীতে রয়েছে। কিন্তু তৃতীয় ও সবচেয়ে শক্তিশালী কূপটি রয়েছে বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ ইউরোপায়।

এই তিনটি জ্ঞান কূপে অবগাহন করলে সেই ব্যক্তি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র "পাশুপত "পাওয়ার যোগ্য হয়। কিন্তু সেজন্য আরো ভয়ানক পরীক্ষা দিয়ে তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়।আর এই পাশুপত রয়েছে আমাদের মার্সিয়ান জাতির অধীনে। বহুকাল পূর্বে মার্সিয়ান জাতির এক মহান জ্ঞানী তার সাধনার পূর্ণ বিকাশের পর তার অর্জিত জ্ঞান দ্বারা বিশ্বচৈতন্যর নির্দেশে এই পাশুপত ও তার রক্ষাকবচ তৈরী করেন।পাশুপতের প্রকৃত স্বরূপ কেউই জানে না।সেটি কেমন দেখতে ,কি ভাবে ব্যবহার করতে হয়, তার ক্ষমতা কতটা এগুলো কেউ জানে না।কারণ আজ পর্যন্ত তার রক্ষাকবচ ভেদ করতে সকলেই ব্যার্থ হয়েছে।
তবে  সেই জ্ঞানী পুরুষ ভবিষ্যতবাণী করে গেছেন যে যখন এই সৌরমণ্ডলে বিরাট কোনো বিপদ উপস্থিত হবে তখন এই রক্ষাকবচ ভেদন করবার উপযুক্ত ব্যাক্তি  জন্ম গ্রহণ করবেন।"

গুরুদেব তমোঘ্ন একটু সময় চুপ করে রইলেন। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্যে বললেন "আমি আশা করি যখন উপযুক্ত সময় উপস্থিত হবে তোমাদের মধ্যে কেউ একজন নিজেকে উপযুক্ত প্রমাণ করে তিনটি জ্ঞান কূপ অবগাহন ও পাশুপত অর্জন করবে।
(পরবর্তী অংশ পরের পর্বে ।)

No comments:

Post a Comment