Crss colum

Saturday, September 28, 2019

মৃত্যুর সঙ্গে কিছুক্ষণ

বিরাট সেতুটির অপর প্রান্ত দেখা যাচ্ছিল না। বেশি চওড়া সেতু নয়। খুব জোর দুই জন মানুষ পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারে। লম্বা লম্বা পাকানো দড়ি দিয়ে তৈরি সেতু। হাওয়ায় একটু দুলছে। দুটো পাহাড়ের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এই দড়ির তৈরী সেতুটা। অনেক উঁচুতে বলে চারিদিকে হালকা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে।ভারি সুন্দর মনোরম দৃশ্য। অনেক নিচে একটা পাহাড়ি নদী বয়ে চলেছে।
অনন্ত সেতুটার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো ওপারে যাবে কিনা।সে কি করে এখানে এলো ঠিক মনে পড়ছে না। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিছানায় শুয়ে ছিলো মনে পড়ছে। ঘুম আসছিলো না। বুকের ডান দিকে হালকা চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। হঠাৎ দেখলো সে এই বিশাল দীর্ঘ সেতুটার সামনে একা দাঁড়িয়ে।এতো সুন্দর জায়গায় আগে কখনো আসেনি। চারিদিকে পাহাড়ী বুনো ফুলের মেলা বসেছে। খুব সুন্দর একটা ভারি মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে। কিন্তু বডড ফাঁকা লাগছে। কেউ কোত্থাও নেই। এমনিতেই মিনতিকে ছাড়া সে কোথাও যায় না। কিন্তু এখন মিনতিকেও চোখে পড়ছে না।সবাই গেলো কোথায় ?
সেতুটির সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো ওপারে যাবে কিনা।

এমন সময় পিছন থেকে একটি খুব সুন্দর দেখতে আট নয় বছরের বাচ্ছা মেয়ে র কন্ঠস্বর ভেসে এলো "আমাকে একটু ওপারে নিয়ে যাবে গো ?"

অনন্ত বললো "কে তুমি ?"

মেয়েটি  বললো "আমি ? আমি নিয়তি। আমাকে একটু ওপারে নিয়ে চলো না।"

অনন্ত দেখলো  মেয়েটি অন্ধ। তার খুব মায়া হলো। এগিয়ে এসে মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে মেয়েটি দুই একবার হাতড়ে অবশেষে অনন্তর হাতটা শক্ত করে ধরলো।

অনন্ত বললো "ওপারে কি আছে ?"

নিয়তি বললো "ওপারে আমার বাড়ী।"

অনন্ত বললো "আচ্ছা এই জায়গাটার নাম কি ? আর আমি কিভাবে এখানে এলাম ?"

নিয়তি  হেসে বললো "তুমি কেমন মানুষ গো ? এই জায়গাটি চিনতে পারছো না ? ঐ যে নদীটি দেখতে পাচ্ছো অনেক নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে ওটা বৈতরণী নদী। একদিন সবাইকেই ঐ নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে হয়। আমিই সবাইকে এই বিরাট সেতু দিয়ে নদী পেরিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করি।"

অনন্ত ভয় পেয়ে বললো "তার মানে আমার কি মৃত্যু হয়েছে? সত্যি করে বলতো তুমি কে?"

নিয়তি বললো "তোমার এখনো মৃত্যু হয় নি। তবে মৃত্যু হতে চলেছে। তুমি এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছো।
আর আমার অপর নাম মৃত্যু ।"
অনন্ত বললো "আমায় ছেড়ে দাও । আমার অনেক কাজ বাকি আছে।"
অনন্ত হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ঐটুকু ছোট্ট মেয়ের হাতে কি জোর। বেশ কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়েও অনন্ত হাত ছাড়িয়ে নিতে পারলোনা।

অবশেষে হার মেনে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো "আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমার সঙ্গে যেতে চাই না। আমি এখনি মরতে চাই না।"
নিয়তি বললো "কেন ভয় কি ? এটাই তো সকলের আসল গন্তব্য।সব জীবিত প্রাণীই তো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে।মরণ তো জীবের স্বাভাবিক গতি।"
অনন্ত বললো "আমার অনেক দায়িত্ব পালন করার আছে। আমার একমাত্র মেয়েটি খুব ছোট্ট। ঠিক তোমার বয়সী। আমার স্ত্রী মিনতি অসুস্থ। তার সাহায্য করার কেউ নেই। তোমার পায়ে পড়ি , তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।"

নিয়তি বললো "এই জগতে কেউ কারো নয়। তুমি যাদের কথা চিন্তা করে বাঁচতে চাইছো , একদিন হয়তো তারাই তোমার কথা মনে রাখবে না। তুমি পূর্বে বহুবার জন্ম গ্রহণ করেছো আবার বহুবার মৃত্যু বরণ করেছো। প্রতি জন্মেই বহু মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলে।আজ সে সব অতীত। তুমি মিথ্যা ভ্রম বশত এসব চিন্তা করছো। কোনো কিছুই তোমার জন্য আটকা পড়ে থাকবে না। সবই মহাকালের আপন নিয়মে হতে থাকবে।যার যেটুকু পাওয়ার আছে সে শত চেষ্টা করলেও তার অধিক পাবে না।"

অনন্ত বললো "ওগো আমি যে পিতা। আমি আমার কর্তব্য ছেড়ে এভাবে যেতে পারি না। তুমি যদি জোর করে আমাকে নিয়ে যাও তবে আমার আত্মা শান্তি পাবে না। আমাকে আমার কর্তব্য পালন করতে দাও।"
নিয়তি বললো " এই জগতে সব কিছুই পরিবর্তনশীল। তুমি তোমার পরিবারের কথা চিন্তা করে মৃত্যুর হাত ছেড়ে দিতে চাইছো। কিন্তু মৃত্যু সকল জীবের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ। মৃত্যু আছে বলেই জীবন এতো মহান। এই জীবন কে ভালো কাজে ব্যবহার করা উচিত।অথচ দেখো সবাই লোভ , লালসা চরিতার্থ করতেই ব্যস্ত।আজ যে সম্পর্কগুলোর জন্য পাপকাজ করছো একদিন সেই সম্পর্ক গুলো আর মধুর থাকবে না। সেই দিন পড়ে থাকবে শুধুই কর্ম।যে কর্ম তুমি ইহজীবনে করেছো সেই কর্মই তোমার শমন রূপে তোমার সামনে উপস্থিত হবে । সেই দিন তুমি কেবল একা তোমার কর্মফল ভোগ করবে।
সেজন্য তোমাকে বলছি তুমি বিন্দুমাত্র পিছুটান অনুভব না করে এগিয়ে চলো।ঐ তোমার গন্তব্য দেখা যাচ্ছে। আমি তোমার সহায়ক মাত্র। তোমার কর্ম ভালো তাই আমি মৃত্যু তোমার কন্যা সম রূপ ধারণ করে তোমাকে নিতে এসেছি।
যাদের কর্ম ভালো নয় তাদের কাছে আমি আরো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে আসি। ঐ দূরে তোমার কর্মফল তোমার জন্য খুব সুন্দর এক জগৎ তৈরী করেছে।চলো তোমার সুন্দর কর্মফল ভোগ করবে চলো।কর্মফল ভোগ সম্পূর্ণ হলে পুনরায় নতুন কোনো গর্ভে নতুন কর্ম করার জন্য জন্ম লাভ করবে।"

অনন্ত চিৎকার করে বললো "চাই না ,চাই না তোমার স্বর্গসুখ। আমি আমার ছোট্ট মেয়েটির কাছে ফিরে যেতে চাই। আমার স্ত্রী র কাছে যেতে চাই। আমার হাত ছেড়ে দাও দয়া করে।"

এমন সময় দূর থেকে একটা বাচ্ছা মেয়ের কন্ঠস্বর ভেসে এলো "বাবা ,ও বাবা কথা বলো না।এতো ঘুমোলে হবে ?আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে তো? তুমি বলেছিলে ছুটির দিন বেড়াতে নিয়ে যাবে , আইসক্রিম খাওয়াবে।ওঠো না ,ওঠো না।
ও মা দেখো না বাবা এখনো ঘুমাচ্ছে। কত্তো ডাকছি, কিছুতেই উঠছে না।"

অনন্ত কেঁদে উঠলো ,"ও গো মৃত্যু , আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে যেতে দাও। আমি তোমার সঙ্গে এখনি যেতে চাই না। আমার অনেক কাজ বাকি আছে। যেদিন সব কর্তব্য শেষ হবে সেইদিন তুমি এসো। আমি হাসি মুখে তোমার সঙ্গে যাবো।
আজ আমাকে ছেড়ে দাও।"
মৃত্যু উচ্চৈঃস্বরে হেসে বললো "যদি না ছাড়ি তুমি কি করবে ? লড়াইয়ে আমাকে হারাবার ক্ষমতা কারো নেই।"

অনন্ত বললো "জানি তুমি আমার চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু আমি একজন পিতা। কন্যার জন্য আমি যে কোনো শক্তির সঙ্গে ই লড়তে পারি। যতক্ষণ আমার অস্তিত্ব আছে ততোক্ষণ তোমার সঙ্গে লড়বো। কিছুতেই যাবো না তোমার সঙ্গে। আমি আর এক পাও এগোবো না। তোমার পা জড়িয়ে ধরে এই  এখানে বসলাম।দেখি তোমার কতো শক্তি । আমার কর্তব্য বড়ো না তুমি বড়ো আজ তার পরীক্ষা হয়ে যাক।"

এই বলে অনন্ত মৃত্যুর পা দুটো ধরে সেতুর ওপরেই বসে পড়লো। সুন্দর আলতা পড়া দুটি রাঙা চরণ। সেই পা দুটো চোখের ফোঁটা ফোঁটা জলে ভিজিয়ে দিতে দিতে বলে চললো "আমাকে ছেড়ে দাও মা। আমার স্বর্গ চাই না। আমার পরিবারের সদস্যদের মুখের হাসি আমার কাছে স্বর্গের সমান।"

ওদিক থেকে আরো উচ্চৈঃস্বরে স্পষ্টভাবে ভেসে আসছে একটা কচি গলার আওয়াজ "বাবা , ও বাবা , কথা বলো।দেখো মাও কাঁদছে। তুমি কথা বলো।"

মৃত্যু এর আগে কখনো এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি। মৃত্যুর মন বড়ই কঠিন কঠোর।সে জন্মান্ধ।কারণ বিধাতা কখনো চায় নি সে তার শিকারের মুখের দিকে চেয়ে তাদের কষ্ট চোখে দেখে দয়া করে। কিন্তু বিধাতা তার চোখ না দিলেও কান দিয়েছে।আজ ছোট্ট একটি মেয়ের কচি কচি গলার স্বর তার মনে সব কিছুই তছনছ করে দিচ্ছে। তার কঠোরতা , তার নির্মমতা , এই সব কিছুই গলিয়ে দিচ্ছে।

আর সইতে পারলো না । শেষে অনন্তর হাত ধরে তুললো ।
মৃত্যু অনন্তর চোখের জল মুছে দিয়ে বললো "বাবা তুমি কেঁদোনা।আজ আমি তোমাদের বাবা মেয়ের ভালোবাসার কাছে পরাজিত। আমার এই পরাজয় খুশীর। তুমি যাও বাবা তোমার মেয়ের কাছে। যেদিন তোমার মেয়ের প্রতি কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে সেইদিন এই মেয়েকে ডেকো। আমি তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যাবো তোমার স্নেহের টানে। যাও বাবা যাও। আমি তোমাকে ছেড়ে দিলাম। তুমি ফিরে যাও তোমার মেয়ের কাছে।"
মৃত্যু অনন্তর হাত ছেড়ে দিতেই অনন্ত ভক্তিভরে সেই কন্যা স্বরূপ মৃত্যুর দুটি আলতা পড়া রাঙা চরণে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করলো। তারপর বললো "আসি মা।"
মৃত্যু বললো "এসো"।

ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইলো অনন্ত।দেখলো সে বিছানায় শুয়ে আছে।
স্ত্রী মিনতি বিছানার একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।আর মেয়ে তার বুকের ওপরে শুয়ে কেঁদে চলেছে। অনন্ত আস্তে আস্তে উঠে বসলো। মেয়ে বাবাকে উঠে বসতে দেখে বললো " মা দেখো বাবা উঠে বসেছে"।
মিনতি বললো " ওগো তোমার কি হয়েছিল ? আমি খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।"

অনন্ত বললো "তেমন কিছু নয়।   স্বপ্ন  দেখছিলাম।এক অতি আপনজন এসেছিলেন স্বপ্নে। আমি তাকে অনেক দিন বাদে আসতে বলেছি।সে সম্মত হয়ে চলে গেছে। "
তারপর অনন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো "চল মা তোকে নিয়ে একটু বেড়িয়ে আসি।"(শেষ)।

No comments:

Post a Comment