Crss colum

Friday, November 1, 2019

রক্ষক ৮


                     (১২)

সময় ২০৩৯ সাল।
পাঠশালা।
হিমালয়ের গোপন উপত্যকা।

গত পরশু থেকে প্রবল তুষার ঝড় শুরু হয়েছে। চারিদিকে সাদা রঙের বরফে আচ্ছন্ন। সেই প্রবল তুষার ঝড় ও সেই সঙ্গে ক্রমশ বেড়ে চলা শৈত্যপ্রবাহে পাঠশালার বাইরে কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই।

 সূর্যোদয় হওয়ার কিছু পরেই আদিত্য কে গুরুদেব তমোঘ্ন ডেকে পাঠালেন ‌। যদিও সূর্যোদয় বলতে সূর্য উঠেছে তা নয়।এই তুষারপাতের মধ্যে সূর্য ওঠা অসম্ভব। পূর্ব দিক আলোর ছটায় সাদা রঙের হওয়াকেই পাঠশালার সকলে সূর্যোদয় ধরে নিয়ে  দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু করা হয়।

'পাঠশালা' নামের এই শিক্ষায়তনটি বিশালাকায় ও বহু কক্ষবিশিষ্ট। তার মধ্যে কোন কক্ষে গুরুদেব তমোঘ্ন থাকেন সেটা আদিত্য জানতোই না।

এক শিক্ষক আদিত্য কে ডেকে নিয়ে পথ দেখিয়ে গুরুদেব তমোঘ্ন র কক্ষের সামনে পৌঁছে দিলেন।

আদিত্য দেখলো সে এক বিশালাকায় কারুকার্য খচিত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। শিক্ষকটি আগেই চলে গেছে। একটু ইতস্তত করে দরজায় ধাক্কা দিলো।অতবড় দরজাটা আদিত্যর সামান্য ধাক্কা দেওয়াতেই খুলে গেলো।

আদিত্য গুরুদেব তমোঘ্ন র ঘরে প্রবেশ করলো। বিরাট লম্বা হলঘরের মতো ঘর। চারিদিকে থরে থরে আলমারিতে ভর্তি। বেশীরভাগ আলমারিতে বই পত্র ও বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথি সংরক্ষিত রয়েছে। কয়েকটা আলমারিতে অস্ত্র শস্ত্র রয়েছে। তার মধ্যে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র আদিত্যর অজানা। আদিত্য এদিক-ওদিক তাকিয়ে অনেক অজানা রহস্যময় বস্তু দেখতে পেলো। একটা পাকানো দড়ি দেখতে পেলো। যেটা আপনাআপনি গুটিয়ে যাচ্ছে আবার কিছুক্ষণ বাদে খুলে যাচ্ছে। একটা ছোট কলসি চোখে পড়লো।যার মুখ দিয়ে গল গল করে নীলাভ ধোঁয়া বেরিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল একটা খুব সুন্দর রহস্যময় ফুলের গাছ। গাছটিতে একটিমাত্র রামধনুর মতো সাত রংয়ের পাপড়িযুক্ত ফুল ফুটে আছে। সবচেয়ে আশ্চর্য গাছের লম্বা লম্বা পাতা গুলো তার দিকে ইশারা করে কাছে ডাকছে। অনেকটা মানুষ যেমন হাতের ইশারায় অন্য মানুষকে কাছে ডাকে ঠিক তেমনি। আদিত্য আজব আকর্ষণে সেই গাছটির দিকে এগিয়ে গেলো। গাছটির কাছে যাওয়ার আগেই একটি চেনা কণ্ঠস্বর তাকে বাধা দিয়ে বললো "খবরদার গাছটিকে ছোঁবে না।"

আদিত্য চমকে গিয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো গুরুদেব তমোঘ্ন ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন।

গুরুদেব আবার বললেন "গাছটিকে ছুঁলেই তুমি ভয়ংকর বিপদে পড়বে। এটি  সম্মোহনী গাছ। সারা পৃথিবীতে এই একটিমাত্র সম্মোহনী গাছ অবশিষ্ট আছে। এই গাছকে ছোঁয়া মাত্র গাছের গায়ে অবস্থিত অতি সূক্ষ্ম রোঁয়া থেকে তীব্র বিষাক্ত রাসায়নিক তোমার ত্বকের মধ্য দিয়ে রক্তে পৌঁছে যাবে। তুমি তৎক্ষণাৎ জীবন্ত পুতুলের মত হয়ে যাবে। কোনরকম নড়াচড়া করতে পারবেনা । এমনকি তোমার কোন রকম নড়াচড়া করার ইচ্ছা পর্যন্ত থাকবে না। তারপর গাছটি তার সূক্ষ্ম রোঁয়া গুলি দিয়ে তোমার শরীরের যাবতীয় রক্ত চুষে নেবে।"

গুরুদেবের কথা শুনে আদিত্য তৎক্ষণাৎ সভয়ে পিছিয়ে এলো।

আদিত্য এরপর গুরুদেব কে প্রণাম করলো। তারপর একটু দোনা মোনা করে প্রশ্ন করলো "গুরুদেব এই পাকানো দড়ি ও কলসির রহস্য বড়ো জানতে ইচ্ছা করে।"

গুরুদেব তমোঘ্ন বলল "ওই যে দড়িটা দেখছো ওটা একটা ভয়ঙ্কর শস্ত্র। ওই দড়ি কেউ ছিঁড়তে পারে না। এমনকি কোনো অস্ত্রের সাহায্যে ওটি কাটা যায় না। ওটি কারোর দিকে ছুঁড়ে দিলে সে দড়িতে আপনা থেকেই আবদ্ধ হয়ে যায়। একটা বিশেষ মন্ত্র দ্বারা এই দড়িকে নিজের বশে রাখা যায়। নয়তো এই দড়ি তার স্বভাব বশতঃ যেকোনো জীবন্ত বস্তুকে বা প্রাণীকে আবদ্ধ করে।

আর ওই যে কলসিটা থেকে নীলাভ ধোঁয়া বেরিয়ে আছে ওইটার মধ্যে পৃথিবীর যাবতীয় লুকানো গুপ্তধন রয়েছে। একটি বিশেষ মন্ত্র আছে। এই মন্ত্রটি পাঠ করে যদি কেউ ওই কলসির মধ্যে হাত দেয় তবে পৃথিবীর যেকোনো একটি লুকানো গুপ্তধনের কিছু অংশ অবশ্যই হাতে পাবে।"

তমোঘ্ন এবার আদিত্য কে তার পিছনে পিছনে আসতে বললেন। গুরুদেব তমোঘ্ন তার ঘরের একটি বিশেষ বইয়ের আলমারির কাছে গিয়ে  আলমারি খুলে দুটি বইয়ের স্থান পরিবর্তন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটি বইয়ের আলমারি স্থান  পরিবর্তন করলো। একটা গুপ্ত দরজা প্রকাশ হলো। আদিত্য দেখল ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে । গুরুদেব তমোঘ্ন আদিত্যকে আহ্বান করলেন "এসো যাওয়া যাক ।" 

গুপ্ত দরজার মধ্যে দিয়ে আদিত্য গুরুদেব তমোঘ্নর সাথে এক নতুন কক্ষে উপস্থিত হলো।

এই কক্ষে কোনো আসবাবপত্র নেই। কক্ষের মেঝেতে এক সুন্দর আশ্চর্য নকশা করা গালিচা বিছানো। কক্ষের এক পাশে একটি সুন্দর কারুকার্যখচিত দরজা আছে। গুরুদেব তমোঘ্ন আদিত্যকে বসতে ইশারা করলেন। আদিত্য বসলে তিনিও তার সামনে বসলেন।

গুরুদেব তমোঘ্ন বলতে শুরু করলেন " প্রিয় আদিত্য, 

                     আজ তোমাকে তোমার জীবনের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানাবো। তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র। তুমি অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। তোমার ন্যায়  কুশলী যোদ্ধা এই মুহূর্তে পৃথিবী তথা সৌরমন্ডলে বিরল। এত অল্প দিনে তুমি এতকিছু শিখতে পেরেছো শুধু তাই নয় সব  রকম বিদ্যাতেই তুমি নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছো। আমি তোমার বর্তমান জন্মের প্রায় সব তথ্যই জানি। সেই সঙ্গে তুমি পূর্ব জন্মে কি ছিলে এবং কেনইবা জন্মগ্রহণ করেছো সেই সব জানি।

সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই সৌরমণ্ডলের একজন অভিভাবক আছেন। তিনি কখনো প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে এই সৌরমণ্ডলের অস্তিত্ব যাতে বজায় থাকে এবং এর প্রাণীকুলের অস্তিত্ব যাতে রক্ষা পায় সেজন্য প্রতিনিয়ত সচেষ্ট থাকেন। এই অভিভাবক রক্ষক নামে পরিচিত। যদিও বহুকাল আগেই তার দেহের বিনাশ হয়েছিলো তবু তিনি সুক্ষ্ম দেহে এই সৌরমণ্ডলের এক বিশেষ স্থানে অবস্থান করছিলেন। 

 কিছুকাল আগে তিনি জানতে পারেন বর্তমান পৃথিবীর জীবিত প্রাণীকুল এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে।এক বিশালাকায় গ্রহাণু পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়তে চলেছে।  রক্ষক এই বিষয়ে জানতে পেরে পুনরায় পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করেন।

তুমি হলে সেই রক্ষক। তোমার মা একজন মাতৃকা । পিতা ছিলেন মানুষ। তোমার মধ্যে একাধারে মাতৃকা জাতির গুণ রয়েছে তেমনি আবার মানুষের মতোই আবেগ ও ভালোবাসা রয়েছে।

বৎস, আজ পৃথিবী এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। এক বিশাল গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। সেই গ্রহাণু যদি পৃথিবীতে আছড়ে পরে তবে তৎক্ষণাৎ পৃথিবীর সব প্রাণীকুল ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমার মধ্যে সেই শক্তি বর্তমান আছে যার সাহায্যে তুমি পৃথিবীর আপামর প্রাণীকূলকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারো। পূর্ব জন্মে তুমি ছিলে এই সৌরমন্ডলে রক্ষক। বর্তমান জন্মেও তুমি পুনরায় এই সৌরমণ্ডলের রক্ষকে পরিবর্তিত হবে। সেজন্য তোমায় শক্তি অর্জন করতে হবে। এই পৃথিবীতে দুইটি জ্ঞান কূপ রয়েছে। একটি রজোগুণের কূপ অন্যটি সত্ত্বগুণের কূপ। এই দুইটি কূপে অবগাহন করার পর তুমি তৃতীয় তমোগুণের কূপে অবগাহন করার অধিকার লাভ করবে। দ্বিতীয় কূপটি রয়েছে পৃথিবীর বাহিরে বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা যেখানে তোমার মা অবস্থান করছেন। সেখানেও তোমায় নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। তিনটি কূপে অবগাহন করার পর তোমাকে এক ভয়াবহ অস্ত্র "পাশুপত " এর অধিকার লাভ করতে হবে। এই পাশুপত অস্ত্র বিনা কিছুতেই ওই বিরাট গ্রহাণুকে ধ্বংস করা যাবে না। আমি তোমায় তিনটি কূপে অবগাহন করতে সাহায্য করবো কিন্তু পাশুপত অস্ত্র সম্পূর্ণ নিজের বিদ্যা বুদ্ধি ও কৌশলের দ্বারা তোমায় লাভ করতে হবে।"

গুরুদেব তমোঘ্ন চুপ করলেন।

আদিত্য বলল " গুরুদেব আমি আপনার চরণ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করছি আমার জীবন সকলের কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করলাম। আপনি আমায় পথ দেখান আমি নিশ্চিত আমি এই সৌর মন্ডল তথা পৃথিবীকে আগত বিপদ ও ভবিষ্যতের যাবতীয় বিপদ থেকে রক্ষা করবো।"

গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন " বেশ ,সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এমনিতেই সময় আমাদের হাতে খুব অল্পই আছে। তুমি প্রস্তুত তো?"

আদিত্য বললো "আমি প্রস্তুত।"

গুরুদেব তমোঘ্ন বললেন "এসো আমার সঙ্গে।"

গুরুদেব তমোঘ্ন সেই গোপন কক্ষের যে কারুকার্যখচিত দরজাটি রয়েছে তার সামনে এলেন।

গুরুদেব তমোঘ্ন আদিত্য কে উদ্দেশ্য করে বললেন" এই যে দরজাটি দেখছো এটি আসলে একটি টাইম পোর্টাল। এটি আসলে এক জটিল যন্ত্রের প্রবেশদ্বার। এই যন্ত্রের সাহায্যে এই সৌরমন্ডলের যেকোনো স্থানে ইচ্ছা করা মাত্র নিমেষের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় এবং সেখান হতে পুনরায় এখানে ফেরা যায়। "

গুরুদেব তমোঘ্ন আদিত্যর হাতে একটি আংটি পরিয়ে দিয়ে বললেন " এই আংটি টি এই যন্ত্রটির সুইচের মতো। আংটির  উপর যে লাল রঙের পাথরটি আছে সেটিতে চুম্বন করে তুমি যে স্থানে যাওয়ার কথা ভাববে সেখানেই তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যাবে। এখন চলো তোমাকে নিয়ে প্রথমে রজোগুণের কুপে পৌঁছাবো। যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করার পর তুমি ও আমি একইসাথে নিজের নিজের আংটির পাথর চুম্বন করবো। যেহেতু আমি সেই কূপের অবস্থান জানি তাই আমি সেই স্থানের কথা চিন্তা করবো। তুমি কেবল ভাবতে থাকবে 'আমার ইচ্ছাই তোমার ইচ্ছা।'"

গুরুদেব তমোঘ্ন হাতের ধাক্কা দিয়ে সেই কারুকার্যখচিত দরজাটি খুলে ফেললেন। ভিতরে নিকষ কালো অন্ধকার ।

গুরুদেব তমোঘ্ন ও আদিত্য সেই কাল অন্ধকারাচ্ছন্ন যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করলেন। গুরুদেব তমোঘ্ন আদিত্য কে আদেশ করলেন " এবারে আংটিতে চুম্বন করো।"

দুজনে তাদের নিজের নিজের আংটিতে চুম্বন করলো। (চলবে)

No comments:

Post a Comment