Crss colum

Thursday, November 8, 2018

অলৌকিক তরবারি পর্ব 5

মহারাজ কালকেতু ও আদিত্য উত্তর দিকে রওনা দিলো। মহারাজ কালকেতু আদিত্য কে বললেন ‘ আমি তোমার   থেকে বয়সে অনেক বড়ো।তাই তোমাকে একটা উপদেশ দিচ্ছি। যে মূল্যবান বস্তুটি তুমি উদ্ধার করতে চলেছো তা খুব সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। শুধু মাত্র বীরত্ব প্রদর্শন করে সেটা উদ্ধার করা সম্ভব নয়। বীরত্ব ও বুদ্ধি উভয়ের প্রয়োজন। আমি তোমাকে সেই স্থান পর্যন্ত নিয়ে যাবো যেখানে অলৌকিক তরবারি আছে। তারপর তুমি একাকী যাবে।বস্তুর মধ্যে যে সুক্ষ্ম পরমাণু রয়েছে তা এই অলৌকিক তরবারি র শক্তি র উৎস। তোমরা মানব জাতি হয়তো আরো সহস্র বৎসর পর এই পরমাণু শক্তি ব্যবহার করতে শিখবে। কিন্তু আমরা বিদ্যাধর জনজাতি বহু বছর আগে থেকেই এই পরমাণু শক্তি র শান্তি পূর্ণ ব্যবহার জানি। অলৌকিক তরবারি তুমি পাবে মানে তুমি সেটা ব্যবহার করার অধিকার পাবে। আসলে সেটা যেখানে লুকানো আছে সেখানেই থাকবে। তুমি ব্যবহার করার অধিকার পেলে একটা বিশেষ মন্ত্রের   সাহায্য নিয়ে অলৌকিক তরবারি ব্যবহার করতে পারবে।  ’
এই সব কথা বলতে বলতে দুজনে ঘোড়ায় চড়ে এক সুন্দর উপত্যকায় হাজির হলো। সামনে একটি নীল স্বচ্ছ জলের হ্রদ। হ্রদের অপর দিকে এক বিশালাকায় গগনচুম্বী পর্বত।  এক স্থানে আদিত্য দেখলো এক একাকী শিবলিঙ্গ স্থাপিত।  সেখানে ঘোড়া থামিয়ে কালকেতু আদিত্যকে বললেন ,‘যাও এই    হ্রদের জলে স্নান করে এসো। আমি সঙ্গে করে নতুন বস্ত্র এনেছি। স্নান করে নতুন বস্ত্র পড়ো। অলৌকিক তরবারি লাভ করতে হলে প্রথমে দেহ মন শুদ্ধ করতে হয়।   ’
আদিত্য মহারাজ কালকেতুর কথা মতো স্নান করে নতুন বস্ত্র পরলো। ইতিমধ্যে কালকেতু   কিছু বনফুল সংগ্রহ করে রেখেছেন।
কালকেতু আদেশ করলেন ‘ এই শিবলিঙ্গের পূজা করো।ইনি অলৌকিক তরবারির রক্ষাকারী।এনার দয়া না হলে কেউ অলৌকিক তরবারির দর্শন পায় না।’
আদিত্য কালকেতুর কথামতো শিবলিঙ্গের পূজা করে অলৌকিক তরবারি তাকে প্রদানের আর্জি জানালো।
সব শেষে  কালকেতু তাকে এক খাড়া পাথরের দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে এক বিশেষ মন্ত্র আবৃত্তি করলো। আবৃত্তি শেষ হলে ঘরঘর আওয়াজ করে সামনে পাথরের দেওয়াল হতে এক পাথর সরে গেল।এক গুহা মুখ দেখা গেল। কালকেতু আদিত্য কে বললো এই গুহার মধ্যে রয়েছে তোমার আকাঙ্খিত দ্রব্য। এর পর তোমাকে একা গিয়ে ওটা উদ্ধার করতে হবে ।মায়া আংটি পরিহিত কোন ব্যাক্তি ছাড়া অন্য কেউ এই গুহায় প্রবেশ করলে জীবিত থাকবে না।  যিনি এই অলৌকিক তরবারি লুকিয়ে রেখেছেন তিনি এক বিশেষ সন্দেশ দিয়েছেন তোমার জন্য ।সন্দেশটি হলো ,‘ অলৌকিক তরবারি স্পর্শ করা যায় না।  মন যে কোন স্থানে পৌঁছতে পারে। নিজেকে অলৌকিক তরবারিতে রূপান্তরিত করতে হয়। তাহলে অলৌকিক তরবারির সব শক্তি নিজের অস্ত্রেই লাভ হয়।’
কালকেতু বললেন ‘ যাও বৎস, এবার ঐ গুহায় প্রবেশ করো।ঐ গুহার অপর দিকে তোমার এই উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ। তুমি অলৌকিক  তরবারি কেবল মাত্র আত্মরক্ষার ও দুর্বল কে রক্ষা ও প্রজাহিতের জন্য ব্যবহার করবে।    এই তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। তবে যদি কখনো আমার প্রয়োজন হয় তবে মায়া আংটির দিকে চেয়ে আমার কথা স্মরণ করবে । আমি তৎক্ষণাত সেকথা জানতে পারবো। এবং তোমার সাহায্য করার জন্য উপস্থিত হবো।’’
আদিত্য মহারাজ কালকেতু কে ভক্তিভরে প্রণাম করে বললো,
' আপনি আমার পিতার ন্যায়। আমি কখনো কোনদিন আপনার এই স্নেহ ভালবাসা ভুলবো না।'
কালকেতু  আদিত্য কে আশীর্বাদ করে কপালে স্নেহ চুম্বন করলেন।
আদিত্য এরপর সেই সরু ছোট গুহামুখ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।
গুহার ভেতরে অন্ধকার। আদিত্য এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। যতক্ষণ না চোখ সয়ে আসে।ক্রমশ চোখ সয়ে এলে আদিত্য লক্ষ্য করলো তীব্র আলো থেকে গুহায় প্রবেশ করে যতো অন্ধকার মনে হচ্ছিল আদৌ তা নয়। বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে। আদিত্য সামনে অগ্রসর হলে একটি দরজা চোখে পড়লো। দরজাটা পাথরের। আদিত্য দরজাটা গায়ের জোর দিয়ে ঠেললো। কিন্তু দরজা খুলল না। আদিত্য অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু কোন কিছুতেই ফল হলো না। এবার মুশকিল। আদিত্য বুঝতে পারছিলো না কি করা উচিত।যে কোন উপায়ে তাকে ভিতরে প্রবেশ করতেই হবে।

আদিত্যর মনে পড়ে গেল রাজকন্যা রত্নমালার সেই যোগিনী ধাইমা র কথা। তিনি বলেছিলেন যদি কখনো ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন হও তবে সেই লাল কাপড়ের টুকরো টি বুকে চেপে ধরে তাকে স্মরণ করতে। আপাতত এই দরজা খোলা আদিত্য র কাছে খুব জরুরি।  কোনো মানুষের পক্ষেই এই দরজা খোলা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এমন কোন কলা কৌশল আছে যার সাহায্যে এই দরজা খুলে যায়। আদিত্য মনস্থির করে নিল। যোগিনী মায়ের কাছে সাহায্য চাওয়া যাক।
আদিত্যর পোশাক এর ভিতর সেই লাল কাপড় টা রাখা আছে। সেটাই বার করে আদিত্য যোগিনী মায়ের কথা স্মরণ করলো। কিছুক্ষণ পর আদিত্য র কানে যোগিনী মায়ের কন্ঠ স্বর ভেসে এলো। যোগিনী মা বললেন ,‘ আদিত্য তুমি আমায় স্মরণ করে সঠিক কাজ করেছো। ঐ গুহায় মায়া আংটি পরিহিত মানুষ ছাড়া কেউ প্রবেশ করলে তৎক্ষনাৎ মৃত্যু হবে।তাই তোমাকে দূর হতেই পরামর্শ দিচ্ছি। এই দরজা কোনো মানুষের পক্ষেই খোলা সম্ভব নয়। কিন্তু তুমি খুলতে পারো। তুমি মায়া আংটি খানা ঐ দরজায় স্পর্শ করে গুহারক্ষক শিবলিঙ্গ স্মরণ করে তিন বার ‘ওঁ নম শিবায়’ বলো। দেখবে দরজা খুলে যাবে। কিন্তু ভিতরে যে বিপদের সম্মুখীন হবে সেখানে একমাত্র তোমার বীরত্ব ,সাহস ও বুদ্ধি কাজে লাগবে। আমি কোন সাহায্য করতে পারবোনা। ’
যোগিনী মার কথা থেমে গেল।
আদিত্য ওনার কথা মতো মায়া আংটি দরজায় স্পর্শ করে গুহারক্ষক শিব কে স্মরণ করে ওঁ নম শিবায় মন্ত্র টি তিন বার বললো।
একটা নীলাভ জ্যোতি আংটি হতে বেরিয়ে পুরো দরজা কে গ্রাস করলো। তারপর দরজাটা খুলে গেল।
আদিত্য খোলা তরবারি হাতে ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই পুনরায় দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। আদিত্য দেখলো এক বিশাল কক্ষ। অপরপ্রান্তে আরো একটি দরজা। যদিও সেই দরজাটা খোলা। কিন্তু দরজার পাশেই যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তাকে দেখে যে কোনো মানুষের বুক শুকিয়ে যাবে।এক বিরাট  একচক্ষু দানব সেই দরজা আগলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দানবের পা দরজার পাশে এক মোটা লোহার শিকল দিয়ে আটকানো। দানবের হাতে একটা পাথরের মুগুর। এই ভয়ঙ্কর দানবকে না হত্যা করে কোন ভাবেই ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করা যাবে না। আদিত্য কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর আদিত্য র মনে হলো
দানব টি চোখে কম দেখতে পায় । আদিত্য অনেকক্ষন এই কক্ষের ভেতর অবস্থান করছে কিন্তু দানব টা তাকে দেখতে পায় নি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আদিত্য এক টুকরো পাথর মেঝে হতে কুড়িয়ে দানবের দিকে ছুঁড়ে দিলো।পাথরের আওয়াজ পেয়ে দানব সেই দিকে মুগুর দিয়ে আঘাত করলো। আদিত্য পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে ঠিক করলো এই দানবকে একবার আঘাত করেই শেষ করতে হবে।আর সে বুঝতে পারলো তার তরবারি দানবের কিছুই করতে পারবে না। দানবের দুর্বল জায়গা হলো তার একমাত্র চোখ। কিন্তু দানবটির উচ্চতা যে কোন মানুষের তিনগুণ। সুতরাং তার চোখে আঘাত করতে হলে আদিত্য কে কোন উচুঁ জায়গায় উঠতে হবে। দানবের ডান দিকে একটা উঁচু পাথরের চাতাল  রয়েছে। সেই পাথরে আদিত্য এক ছুটে উঠে পড়তে পারে। কিন্তু তার আগেই দানব তার পায়ের শব্দ পেয়ে যাবে। আদিত্য হাতে এক টুকরো পাথর নিয়ে দানবের বাঁ দিকে ছুঁড়ে দিলো।দানব  বাম দিকে ফিরে যেখানে পাথরটা পড়লো সেখানে মুগুর দিয়ে আঘাত করলো। সেই সুযোগ নিয়ে আদিত্য পাথরের চাতালের উপর উঠে এক রক্ত জল করা হুঙ্কার দিলো দানবের উদ্দেশ্যে।
আদিত্যর হুঙ্কারে চমকে গিয়ে দানব আদিত্য র দিকে ফেরা মাত্র আদিত্য তার শাণিত তরবারি দানবের একমাত্র চোখে আমূল বিদ্ধ করে বার করে নিলো।দানব যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হাতের মুগুর ছেড়ে চোখ চাপা দিয়ে বসে পড়লো। ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো আদিত্য । খোলা তরবারি হাতে লাফ দিয়ে পাথরের চাতাল থেকে নেমে দানবকে পাশ কাটিয়ে এক দৌড়ে খোলা দরজা দিয়ে পরের কক্ষে  ঢুকে পড়লো।
এই কক্ষে ঢুকে আদিত্য র নজরে এলো সেই অলৌকিক তরবারি।
কিন্তু আদিত্য হতাশ হয়ে গেল।
পুরো কক্ষ টি সাদা পাথরের তৈরী।
গুহার পুরো ছাদ সাদা র উপর চকচকে নীল রত্ন আটকানো। ছাদ অনেক উঁচুতে। ছাদের প্রায় কাছে শূন্যে অলৌকিক তরবারি ঝুলে আছে। কক্ষটি শূন্য।এমন কোন কিছু নেই যার সাহায্যে আদিত্য তরবারি হস্তগত করতে পারে। একমাত্র কোন উড়ন্ত পাখি ঐ তরবারি র কাছে পৌঁছাতে পারে।
আদিত্যর নজরে এলো তরবারি র গা বেয়ে এক ফোঁটা করে জল টপটপ করে নীচে পড়ছে।
আদিত্য অনেক ক্ষণ ধরে ভাবতে লাগলো কি ভাবে ঐ তরবারি লাভ করা যায়।তার আচমকা মহারাজ কালকেতুর কথা গুলো স্মরণে এলো। কথা গুলো হলো ,‘ অলৌকিক তরবারি স্পর্শ করা যায় না।  মন যে কোন স্থানে পৌঁছতে পারে। নিজেকে অলৌকিক তরবারিতে রূপান্তরিত করতে হয়। তাহলে অলৌকিক তরবারির সব শক্তি নিজের অস্ত্রেই লাভ হয়।’
আদিত্য বুঝতে পারলো তাকে এবার কি করতে হবে।
আদিত্য অলৌকিক তরবারি র নীচে গিয়ে পদ্মাসনে বসলো। অলৌকিক তরবারি হতে ফোঁটা ফোঁটা জল তার মাথায় পড়তে লাগলো। আদিত্য চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়ে নিজেকে ই অলৌকিক তরবারি ভাবতে লাগলো। এই ভাবে কতটা সময় কেটে গেল তার হিসাব নেই। অনেক ক্ষণ বাদে আদিত্য র মনে হলো তার ডান কর্ণে কেউ যেন একটা মন্ত্র বলছে। আদিত্য মন্ত্র টিকে মুখস্থ করে নিলো।তার অনুভূতি তাকে বলে দিলো সে অলৌকিক তরবারি র শক্তি লাভ করেছে।
এবারে তাকে বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে। মহারাজ কালকেতু বলেছেন যে তার প্রবেশ পথ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে না। তাই সে পুরো কক্ষটি ভালো করে দেখতে লাগলো কোন পথ আছে কিনা।একটু পরে তার চোখে পড়লো একটা পাথরের দরজা। কিন্তু এটা বন্ধ ও প্রায় কক্ষের দেওয়ালের সাথে মিশে আছে তাই এতোক্ষণ বুঝতে পারে নি।
আদিত্য দরজা টিকে খুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পুরো গায়ের জোর লাগানো সত্ত্বেও দরজা খোলা গেল না।
আদিত্য এবার তার তরবারি বার করলো।একটু আগেই শেখা মন্ত্র টি মনে মনে পাঠ করে তরবারি টি পাথরের দরজার দিকে উচিঁয়ে ধরলো।তার তরবারি থেকে একটা ভয়ঙ্কর লাল রশ্মি বের হয়ে পাথরের দরজার গায়ে আঘাত করলো। দরজাটি টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
একটা সুড়ঙ্গ দেখা গেল।
আদিত্য সুড়ঙ্গ দিয়ে এগিয়ে চললো। কিছুটা যাওয়ার পর  এক পাহাড়ের পাদদেশে উপস্থিত হলো।
কিন্তু একি। সামনে তার অশ্ব দাঁড়িয়ে। নাগরাজ তার কথা রেখেছে।তার অশ্ব তার কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
আদিত্য অশ্বের গায়ে মৃদু আদরের চাপড় মেরে বলল ‘আমি সফল হয়েছি রে। এখন আমায় দ্রুত বিজয় গড় নিয়ে চল। সেখানে একাধিক প্রিয় জন আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
এই বলে আদিত্য অশ্বারোহণ করে দ্রুত চললো তার পরিচিত জগতে।
(ক্রমশ)(এরপর পুনরায় বিজয় গড়)

No comments:

Post a Comment