(৫)
অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেকিং রুট।
নেপাল।
সময় - ২০১৬সাল।
সোলো ট্রেকিং বা একাকী ট্রেকিং করতে সুধন্যর বেশী ভালো লাগে।
গ্রুপ ট্রেকিং এর আগে অনেক করেছে। কিন্তু সোলো ট্রেকিংয়ের রোমাঞ্চ ই আলাদা। পরিচিত এক বন্ধু র কাছে সুধন্য প্রথম অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেকিংয়ের কথা শোনে। তারপর ইন্টারনেট ঘেঁটে ডিটেইলস নিয়ে যাত্রা শুরু।
সুধন্যর মতো বাউন্ডুলে স্বভাব তাদের বাড়ির আর কারো নেই।সুধন্যরা দুই ভাই।সুধন্য ছোটো।বড়দা অরণ্য ব্যবসা ছাড়া কিছুই বোঝে না। তবে হ্যাঁ সুধন্যকে খুবই ভালোবাসে।সুধন্য যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় তখন সুধন্যর বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। সেই থেকেই সুধন্যর চেয়ে দশ বছরের বড় অরণ্য পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরে। কিছুদিন পরেই সুধন্যর মা ও মারা যায়। সেই থেকে দাদা বৌদি সুধন্যকে বাবা মায়ের স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছে।সুধন্যর আবার বেড়াবার নেশা। কিছুদিন বাড়িতে থাকলেই বোরিং লাগে।ব্যস তারপর একদিন পাততাড়ি গুটিয়ে বেরিয়ে পড়া। ভ্রমণ ছাড়া আর একটা নেশা আছে।বই পড়া।সব ধরনের বই পড়লেও সবচেয়ে ভালো লাগে ইতিহাস পড়তে।কতো রাজ রাজাদের কাহিনী , প্রাচীন কালের মানুষের কথা, পুঁথি পত্র , এই সবকিছু তাকে নস্টালজিক করে তোলে।ঐ সব প্রাচীন কাহিনী পড়ে আর মনে মনে ভাবে , যদি ঐ যুগে সে যেতে পারতো তবে কতই না রোমাঞ্চকর হতো।
সুধন্যর ঠাকুর্দার বাবা ছিলেন বিখ্যাত ইতিহাস বিদ।কতো পুঁথি পত্র ব্যাক্তিগত ভাবে সংগ্রহ করেছিলেন। ওনার মৃত্যুর আগে তার সব সংগ্রহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে দেন। শুধু একটা পুঁথি ও তার অনুবাদ তিনি সিন্দুকে রেখে দিয়েছিলেন। সেই পুঁথি ও তার অনুবাদ এখনো তাদের পরিবারে আছে। দাদার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সুধন্য একবার পুঁথির অনুবাদ টি পড়ে দেখেছে।যতোসব আজগুবি কথা লেখা আছে। লেখা আছে পৃথিবীর জীব জগত নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে।আর ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারে এক অর্ধ মানব। সেই অর্ধ মানব নাকি তিন গুপ্ত কূপে অবগাহন করে সৃষ্টির তিন তত্ত্ব থেকে শক্তিশালী হয়ে এবং এক অপার্থিব অস্ত্রের অধিকারী হবে। তারপর সেই অর্ধমানব পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবে।
যতো রাজ্যের আজগুবী কথা।সুধন্য এই সব লেখার এক বিন্দুও বিশ্বাস করে নি।
ওনার পরের প্রজন্ম অর্থাৎ সুধন্যর ঠাকুরদা ও সুধন্যর বাবা পড়াশোনার বদলে ব্যবসা করে অর্থ রোজগার করায় বেশি আগ্রহী ছিলেন।আজ তাদের দুজনের চেষ্টায় এক বিশাল জুয়েলারী কোম্পানি তৈরী হয়েছে। সারা ভারতে তাদের বিভিন্ন শাখা রয়েছে।সুধন্যর আবার পড়াশোনা ও ঘোরাঘুরি করার নেশা। সবচেয়ে ভালো লাগে পাহাড়।পাহাড়ী পথে একা একা হাঁটার মজাই আলাদা।
এই অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেকিং রুটের রোমাঞ্চকর পথের বর্ণনা শুনে মনে মনে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলো আসার জন্য।আজ এখানে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে যেটুকু বন্ধুর মুখে শুনেছিলো সেটা অনেক কম । এখানে রোমাঞ্চ আরো বেশি।
সরু পাহাড়ী রাস্তার একদিকে অতলস্পর্শী খাদ । অন্যদিকে খাড়া পাহাড় ।একটু পা ফসকালেই মৃত্যু। তার ওপর ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। বিকাল হয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগেই গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।
সুধন্য একটু দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো।
ঘটনাটা ঘটলো তার পরেই। একটা আলগা পাথরের উপর পা পড়তেই পাথরটি নড়ে উঠলো।টাল সামলাতে না পেরে সুধন্য খাদের দিকে পড়ে গেলো। হাতের কাছে থাকা দুই একটা ঝোপঝাড় ধরে নিজের পড়ে যাওয়া রোখার চেষ্টা করলো। কিন্তু বিধি বাম। নিজেকে পতনের হাত থেকে রুখতে পারলো না। আজকে মৃত্যু নিশ্চিত। কয়েক সেকেন্ড পতনের পর সুধন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগের মূহূর্তে মনে হলো কেউ একজন উড়ে এসে তার শরীর কে লুফে নিলো।
চোখের পাতাটা খুব ভারী লাগছে। তবুও ধীরে ধীরে সুধন্য চোখ মেললো। একটা সুরেলা কন্ঠ বলে উঠলো "আপনি এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন।"
তবুও সুধন্য চোখ খুললো। একটি আবছা মহিলা মূর্তি সুধন্যর দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে দৃষ্টি পরিস্কার হয়ে এলো।সুধন্য দেখলো একটা কাঠের তৈরী বাড়ীতে সে রয়েছে।তার বিছানার পাশে এক সুন্দরী কম বয়সী মহিলা বসে রয়েছে। সেই মহিলা আবার বললো "আপনি একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন।"
সুধন্য বললো "আমি কোথায় ? আমার কি হয়েছে ?"
মহিলা উত্তর দিলো "আপনি পাহাড়ের খাদে পড়ে গিয়েছিলেন। আমি আপনাকে তুলে আমার ঘরে নিয়ে এসেছি।"
সুধন্য বললো " আপনি কে ? এটা কোন জায়গা ?"
মহিলা বললো "আমি ময়ূরী । আপনি এখন মধ্য হিমালয়ের এক গোপন উপত্যকায় রয়েছেন। এখানে আমি ভিন্ন অন্য কোনো প্রাণী নেই।"
সুধন্য লক্ষ্য করলো ময়ূরীর কপালে ত্রিভুজের আকরের নীল বর্ণের কিছু একটা চকচক করছে।
সুধন্য বললো "তোমার কপালে ওটা কি চকচক করছে ?"
ময়ূরী উত্তর দিলো "ওটা শূন্য মণি। আমি তোমাদের মতো মানুষ প্রজাতির নই। আমি একজন মাতৃকা। আমাদের প্রজাতির সবার এই রূপ শূণ্য মণি আছে।এটার সাহায্যে আমরা উড়তে পারি। এবং যে কোনো মাধ্যমে এমনকি মহাশূন্যে ও বাতাসের সাহায্য ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারি । এছাড়া এই শূন্য মণি আমাদের যে কোনো প্রাণীর ভাষা বুঝতে ও বলতে সাহায্য করে। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পূর্বে আমি আপনার ভাষা জানতাম না। কিন্তু আপনাকে স্পর্শ করা মাত্রই আমি আপনার ভাষা শিখে গেছি।
যাই হোক আপনার শরীর দূর্বল।এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন। আমি আপনার জন্য কিছু খাদ্য যোগাড় করি। আমার কোনো খাদ্যের প্রয়োজন হয় না।" সুধন্য বুঝতে পারলো মহিলা টির একটু মাথা খারাপ আছে। তাই বেশি কথা না বলে চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলো।
তিন মাস পরের কথা।
সুধন্যর শরীর এখন একটু ভালো। সকালে ও বিকালে ময়ূরীর হাত ধরে এই নির্জন পাহাড়ী উপত্যকায় একটু হাঁটাহাঁটি করে। চারিদিকে তুষার ধবল শৃঙ্গ। মধ্যিখানে এই সুন্দর ছবির মতো সবুজ পাহাড়ী উপত্যকা। কতো নাম না জানা পাহাড়ী ফুলের গাছ। এতোদিনে সুধন্য বুঝতে পেরেছে ময়ূরী মিথ্যা কথা বলে নি। তাকে নিজের চোখে উড়তে দেখেছে । এমনকি একদিন ময়ূরী সুধন্যকে কোলে নিয়ে উড়ে পুরো উপত্যকা টি ঘুরিয়ে দেখিয়েছে।সুধন্য ক্রমশ ময়ূরীর সেবা যত্নের ফলে সুস্থ হয়ে আসছে। হয়তো এবার ময়ূরীকে ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন আসছে। কিন্তু ময়ূরী কে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবলেই সুধন্যর মন খারাপ হয়ে যায়। হয়তো একেই ভালোবাসা বলে।
একদিন সুধন্য ময়ূরী কে বলেই ফেললো "আচ্ছা ময়ূরী আমরা বাকি জীবন একসাথে থাকতে পারি না ?"
ময়ূরী সলজ্জ ভাবে সুধন্যর দিকে তাকিয়ে বললো "আপনি যদি সবটুকু জেনে আমায় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেন তবে আমার কোনো আপত্তি নেই।"
সুধন্য উৎসাহ পেয়ে বললো "বলো তুমি কি জানাতে চাও ?"
ময়ূরী বললো "আমরা মানুষ নই। আমাদের জাতি মাতৃতান্ত্রিক। সেখানে পুরুষের কোনো স্থান নেই। আপনার আমার মিলনের ফলে যদি কোনো কন্যা সন্তান জন্ম লাভ করে তবে জন্মের পরেই আমাকে সেই কন্যা সমেত ফিরে যেতে হবে আমার বর্তমান বাসস্থান বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ ইউরোপায়। তবে সেক্ষেত্রে প্রতি তিন মাস ছাড়া এক মাসের জন্য কন্যা সহ আপনার কাছে এসে থাকতে পারবো।আর যদি পুত্র সন্তান হয় তবে তাকে জন্মের পরবর্তী এগারো বৎসর পালন করবো এবং আপনার সঙ্গে সংসার ধর্ম পালন করবো। তারপর আমি আমার বাসস্থানে ফিরে যাবো । বৎসরে একবার এক মাসের জন্য আপনার ও পুত্রের কাছে আসবো।
এছাড়া আরো একটি শর্ত আছে , আমি এই উপত্যকা ছেড়ে লোকালয়ে যাবো না। আপনাকে যদি আমার সঙ্গে সংসার করতে হয় তবে এখানেই থাকতে হবে। এবার আপনি ভেবে বলুন আপনি আমার শর্তে রাজি কিনা ?"
সুধন্য বললো "তোমার শর্তাবলী খুবই পীড়াদায়ক। কিন্তু আমি তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অপূর্ণ। তবে আমার পরিবার আছে। তাদের সঙ্গে দীর্ঘ কাল দেখা না হলে আমি কষ্ট পাবো।"
ময়ূরী বললো "আমি লোকালয়ে যাবো না বলেছি। কিন্তু আপনার যেতে কোনো বাধা নেই। আপনার বাড়ির লোকেদের জন্য মন খারাপ লাগলে আপনি যেতেই পারেন। আমি আপনাকে সবার অগোচরে উড়িয়ে আপনার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবো। আপনার আমার বিবাহ হলে দুজনের মধ্যে এক মানসিক যোগসূত্র তৈরী হবে।ফলে আপনি যখন কোনো বিপদের সম্মুখীন হবেন বা পুনরায় আমার কাছে ফিরে আসার মনস্থির করবেন আমি এতো দূর থেকেও বুঝতে পারবো। এবং পুনরায় সকলের অগোচরে আবার এই স্বর্গীয় উপত্যকায় ফিরিয়ে নিয়ে আসবো।
সুধন্য বললো "তাহলে তো কোনো সমস্যাই নেই।বলো কবে আমাদের বিবাহ হবে?"
ময়ূরী বললো "সেজন্য আমার গুরুমাতা কে আহ্বান করতে হবে। আগামী পূর্ণিমা র দিনে আমাদের বিবাহ হবে। আশা করি আপনি ততোদিনে পুরো সুস্থ হয়ে উঠবেন।
দুই বৎসর পর।
ময়ূরী র একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। সন্তানের জন্ম দেওয়ার কিছু দিন আগে থেকেই ময়ূরী র গুরুমাতা এসে ওদের সঙ্গে ছিলেন। সন্তানের জন্মে উনি ধাত্রী মায়ের ভূমিকা পালন করলেন।
সন্তান জন্মের একুশ দিনের মাথায় উনি ময়ূরী ও সুধন্যের পুত্র সন্তানের নামকরণ করে ফিরে গেলেন।ফিরে যাওয়ার সময় ময়ূরী কে নির্দেশ দিলেন "তোমার পুত্রের এগারো বৎসর বয়স হলে তোমার কাছে ওর ভাবী শিক্ষাগুরু তমোঘ্ন আসবে। তার হাতে পুত্রের ভার তুলে দিয়ে তুমি ইউরোপায় ফিরে আসবে। পরবর্তী বছর গুলিতে কেবল এক মাসের জন্য সন্তানের কাছে আসতে পারবে।
আর তোমার পুত্রের নাম হবে আদিত্য।এ হবে আগামী পৃথিবীর রক্ষক।
(বাকি অংশ পরের পর্বে। পরবর্তী অংশের নোটিফিকেশন পাওয়ার জন্য আমায় অনুসরণ করুন।)
No comments:
Post a Comment