Crss colum

Friday, August 30, 2019

রক্ষক ৫

                (৭)

হিমালয়ের গোপন উপত্যকা।
সময় - ২০২৯ সাল।
সূর্যোদয় থেকেই ময়ূরী একটানা কেঁদে চলেছে।আজ আদিত্য র জন্মদিন।আজ আদিত্য এগারো  বছরে পড়বে।আজ ময়ূরীর আদিত্যকে ছেড়ে যাওয়ার দিন। 
আদিত্যর বাবা সুধন্য  কিছুদিন আগেই মারা গেছেন।ছেলেটা এখনো সব কথা জানে না। শুধু জানে বাবা আর কখনো দেশ থেকে ফিরবে না।
সুধন্য কয়েক দিন যাবৎ বলছিলো অনেক দিন বাড়ীর লোকজনদের সঙ্গে দেখা হয় নি। একবার দেখা করতে যাবে। বেশ কয়েকবার সুধন্য বাড়িতে যাওয়ার কথা বলায় ময়ূরী একপ্রকার বাধ্য হয়েই সুধন্যকে সকলের অগোচরে তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। কথা ছিলো দশম দিনের মাথায় রাতের অন্ধকারে আবার সুধন্য কে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।সুধন্য কে বিবাহ করার পর ময়ূরীর সঙ্গে সুধন্যর এক মানসিক যোগসূত্র তৈরী হয়েছিল।সুধন্যর কথা মনে করলে বা সুধন্যর বিপদ অথবা খুশী র মূহুর্ত গুলো ময়ূরী তার তৃতীয় নয়ন স্বরূপ শূন্য মণি তে দেখতে পেতো। সুধন্য যাওয়ার অষ্টম দিন রাত্রে ময়ূরী ছেলে আদিত্য কে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে এমন সময় হঠাত ময়ূরীর তৃতীয় নয়ন স্বরূপ শূন্য মণিতে সুধন্য ভেসে উঠলো। সুধন্য ভেসে উঠলো বলার চেয়ে বলা ভালো সুধন্য সেই মূহূর্তে যা দেখছিলো তা ভেসে উঠলো।
একটা নির্জন রাস্তা।মনে হলো সুধন্য হেঁটে চলেছে।আলো আঁধারী ভরা সেই রাস্তায় সুধন্য একা হেঁটে চলেছে। আচমকা পিছন থেকে একটা তীব্র আলো। সেই সঙ্গে জোরালো হর্ণের আওয়াজ। ময়ূরী এটুকু দেখেই চীৎকার করে বললো "সুধন্য সরে যাও।"
কিন্তু তার কথা শেষ হবার আগেই আলোটা তীব্র বেগে এসে পড়লো সুধন্যর উপর। একটা জোরসে ব্রেক মারার শব্দ।তারপরেই অন্ধকার।
সেই রাতেই ময়ূরী উড়ে গিয়েছিল সুধন্যর বাড়ি।  সূর্যোদয়ের মূহুর্ত থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলো সুধন্যর বাড়ির কাছেই।আড়াল থেকে দেখেছিলো সুধন্যর মৃতদেহ।সবার অগোচরে গুমরে গুমরে কেঁদে ছিলো। শশ্মানে চিতার আগুনে  ছাই হতে দেখেছিলো তার প্রিয় স্বামীকে।সুধন্যর বড়দা অরণ্য কাঁদছিলো আর বলছিলো "হতভাগা বিয়ে করে সংসার করেছিলো। কিন্তু একবারও তার পরিবারের ঠিকানা দিলো না।তারা হয়তো জানতেই পারবে না যে সুধন্য আর নেই।"
ময়ূরী এই সব শুনে একবার ভেবে ছিলো তক্ষুনি গিয়ে সব পরিচয় দেবে। কিন্তু না। শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়েছিলো এই ভেবে যে তার পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্য তাতে বিঘ্নিত হবে।
সেদিন অনেক রাত্রে তার বাড়িতে ফিরে আসে ময়ূরী। মাকে দেখতে পেয়ে ছোট্ট আদিত্য দৌড়ে এসে মাকে বলেছিলো "মা তুমি কোথায় গিয়েছিলে ? আমার খুব খিদে পেয়েছে।"
সেই রাতে ময়ূরী পুনরায় আদিত্য কে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলো। আদিত্য মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলেছিলো "মা , তুমি কাঁদছো কেন ? বাবা কবে আসবে ?"
ময়ূরী ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলো ,"তোমার বাবা দূর দেশে ঘুরতে গেছে।আর ফিরবে না।"
আদিত্য বলেছিলো "এটা বাবা অন্যায় করেছে।একা একা বেড়াতে গেছে। তুমি দেখো বাবা এলে আমি একটাও কথা বলবো না।"

এসব প্রায় এক বছর আগের কথা। আজ ময়ূরীর চলে যাওয়ার দিন। আদিত্য কে কয়েকদিন থেকেই বুঝিয়ে রেখেছে যে সে এবার বড়ো হয়েছে। এবার তার গুরুমহাশয়ের কাছে শিক্ষা নেওয়ার দিন শুরু। তাকে গুরু মহাশয়ের কাছে গিয়ে থাকতে হবে। প্রথমে ছোট্ট আদিত্য মাকে ছেড়ে যেতে রাজী হচ্ছিল না। শেষে মা ছেলের অনেক মান অভিমানের পর আদিত্য মাকে ছেড়ে যেতে রাজী হয়েছে।
ময়ূরী আদিত্যকে কোলে নিয়ে ঘরের সামনে খোলা উঠোনে অপেক্ষা করছিলো।এমন সময় আদিত্য দেখালো দূর হতে কি যেন উড়ে আসছে।
আরেকটু কাছে আসার পর বোঝা গেলো ওটা একটা যান। যানটি  উড়ে এসে ওদের বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় নামলো।যানটি গোলাকৃতি ।যানটি নামার পর একটি দরজার মতো অংশ দেখা গেলো। সেই অংশ দিয়ে এক সাদা জোব্বা পরিহিত বৃদ্ধ বের হয়ে এলেন।
বৃদ্ধ লোকটি ময়ূরী র সামনে এসে হাত জোড় করে নমস্কার করে বললেন "আমি তমোঘ্ন। আপনার পুত্রকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য নিতে এসেছি। উনি জন্ম গ্রহণ করার পূর্বে আমাকে তেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন।"
ময়ূরীর চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছিলো। ময়ূরী জাতিতে কঠিন হৃদয় মাতৃকা হলেও আসলে একজন মা।আর মায়ের কাছে সন্তান মানে শরীরের অংশ, হৃদয়ের টুকরো। তাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবেই। তবুও কর্তব্য আর ভবিষ্যতের চিন্তা তার মনটা শক্ত করে তুললো।
শান্ত স্বরে ময়ূরী বললো "আমি কি পুত্রের সঙ্গে একদম দেখা করতে পারবো না ।"
তমোঘ্ন উত্তর দিলো "নিশ্চয়ই পারবেন। তবে বছরে একবার। প্রতি বৎসর মাঘ মাসের পূর্ণিমা হতে চৈত্র মাসের পূর্ণিমা পর্যন্ত আপনি সন্তান কে নিজের কাছে রাখতে পারবেন। আমি  বা অন্য কোনো শিক্ষক আপনার পুত্র কে ঐ সময় আপনার কাছে পৌঁছে দেবে এবং নির্দিষ্ট দিনে আবার পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। 
মাতা , তবে আমায় অনুমতি দিন।"
ময়ূরী আদিত্য কে চুমু খেয়ে বললো "তুমি আজ থেকে ওনার কাছে থাকবে। ওনার প্রত্যেকটি আদেশ ,আমার আদেশ মনে করে শুনবে। নিজেকে উপযুক্ত করে তোলো। ভবিষ্যতে তোমাকে অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে।"
তারপর মা ও ছেলে অনেকক্ষণ গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। শেষে ময়ূরী নিজেকে অনেক কষ্টে  ছাড়িয়ে নিয়ে তমোঘ্ন কে বললো "আমি আগে চলে যাই । তারপর আপনি আমার পুত্রকে নিয়ে রওনা দেবেন।"
তমোঘ্ন বললেন "তবে তাই হোক।"
ময়ূরী ধীরে ধীরে কিছুটা উচ্চতায় নিজেকে তুলে নিয়ে আদিত্য র উদ্দেশ্যে বললো "পুত্র এখন থেকে মাকে ছেড়ে তোমার একলা চলা শুরু। ভালো থেকো। বিদায়।"
এই বলে ময়ূরী বহুদূরে উড়ে চলে গেলো।
তমোঘ্ন ও আদিত্য ময়ূরী আকাশে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেই দিকে তাকিয়ে রইলো।
অবশেষে তমোঘ্ন আদিত্যর হাত ধরে বললো "চলো বৎস ,এবারে আমরা যাত্রা শুরু করি"।


              (৮)

নিউ দিল্লী
সময় - ২০৩১ সাল
পৃথিবীর সব বিশিষ্ট বিজ্ঞানী , সামরিক উপদেষ্টা,ও সব রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণের  সম্মেলনের শেষ দিন।
সবার বক্তব্যের শেষে বিশিষ্ট মহাকাশ বিজ্ঞানী পদ্মনাভ বললেন " সব দেশ থেকে আগত বন্ধুরা,আজ পৃথিবীকে তথা প্রাণের অস্তিত্ব কে বাঁচাবার সঙ্কল্প নিয়ে আমরা একজোট হয়েছি।গত বছর জি ৮ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সরকার পৃথিবীকে রক্ষা করার উপায়  বের করতে বিজ্ঞানী দের অনুরোধ করেছিলেন। কুড়ি জন শ্রেষ্ঠ মহাকাশ বিজ্ঞানী নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়েছিল। আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানী ও মানুষ জনের কাছে মতামত ও প্রস্তাব আহ্বান করেছিলাম। আপনারা শুনলে খুশি হবেন পৃথিবীকে বাঁচাবার উপায় সম্বলিত প্রায় দশ হাজার প্রস্তাব আমাদের কাছে ই-মেইল মারফত জমা হয়।এই সব প্রস্তাবকারী দের মধ্যে বড়ো মাপের বিজ্ঞানী হতে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সকলেই ছিলো। তাদের সকলের প্রস্তাব আমরা সকলেই বিচার বিবেচনা করে তার মধ্যে থেকে আমরা দুটি প্রস্তাব কে চূড়ান্ত করেছি।এখন সময় হয়েছে এই দুটির মধ্যে থেকে যে কোনো একটাকে বেছে নেওয়ার।
আমি দুটি প্রস্তাব আপনাদের কাছে সংক্ষেপে পড়ে শোনাচ্ছি।
প্রথম প্রস্তাব টি করেছেন বিখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী বর্তমানে নাসায় কর্মরত এডুইনা ফেলিক্স।
তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন একটি ছোটো মহাকাশচারী দল পৃথিবীর দিকে আগত গোলক  SE 690A37 ,যেটাকে মিডিয়া নাম দিয়েছে " শয়তানের চোখ" সেটির ওপর অবতরণ করে  ওটার মধ্যে ২০০ ফুট ড্রিল করে একটা ১৫০ মেগাটনের পরমাণু বোমা ফিট করে বিস্ফোরণ ঘটানো।কারণ  "শয়তানের চোখের "উপরিতলে কোনো বিস্ফোরণ ঘটালে ঐ তিরিশ কিমি ব্যাসার্ধ যুক্ত গোলোকের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমরা সকলেই এই প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা করে দেখেছি এটি টেকনিক্যালি সঠিক। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের কাছে সময় খুব অল্প। এতো অল্প সময়ের মধ্যে মানুষ নিয়ে ঐ ধরনের দূরন্ত গতিতে ছুটে আসা বস্তুর উপর ল্যান্ড করা এবং পাথরের ওপর ২০০ ফুট ড্রিলিং করার টেকনোলজি প্রস্তুত করা অসম্ভব। এই ধরনের পরিকল্পনা র জন্য কম পক্ষে কুড়ি বৎসর প্রয়োজন। অথচ আমাদের কাছে সময় রয়েছে মেরে কেটে দশ বছর। এই সময়ের মধ্যেই " শয়তানের চোখ" কে ধ্বংস করে দিতে হবে। পৃথিবীর খুব কাছে চলে এলে সেটা  ধ্বংস করা অসম্ভব এবং তখন ধ্বংস করলেও তার টুকরো গুলো পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে ধ্বংস লীলা চালাবে।
তাই এই প্রস্তাব টি আমরা বাতিল করেছি।


এবার আসি দ্বিতীয় প্রস্তাবের কথায়। এই প্রস্তাব টি করেছেন বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র  রোহন।
রোহন পিওর ফিজিক্স নিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি করছে ।
রোহনের প্রস্তাব অনুযায়ী পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে ঢোকার চার লক্ষ কিলোমিটার আগে আমরা যদি  "শয়তানের চোখের "একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে একই সাথে ১০০ মেগাটন ক্ষমতার চারটি পরমাণু বোমা একই সময়ে একটি নির্দিষ্ট কোণ হতে বিস্ফোরণ ঘটাই তবে সেই বিস্ফোরণের ধাক্কায় ওটার গতিপথে পৃথিবীর সঙ্গে ছয় ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি হবে। এবং বস্তুটি পৃথিবীর উপর না এসে সোজা শুক্র গ্রহের উপর পড়বে।রোহন রীতিমতো অঙ্ক কষে বিস্ফোরণের ফলে কতটা শক্তি উৎপাদন হবে এবং কিভাবে পৃথিবীর সঙ্গে কোণ সৃষ্টি হবে এই সবের একটা কম্পিউটারে ইলাস্ট্রেশন করে পাঠিয়েছেন। যারা সেই ইলাষ্ট্রেশন টি দেখতে আগ্রহী তারা আমাদের ইসরো ও নাসার ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখে নিতে পারেন। তবে একটি সাবধান বাণী রোহন দিয়েছে।সেটি হলো চারটি পরমাণু বোমা একই সঙ্গে বিস্ফোরিত হওয়া চাই ।নচেৎ "শয়তানের চোখের " গতিপথের কোনো পরিবর্তন হবে না। সামান্য আগুপিছু হলে এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে।

এই পরিকল্পনা টি বিভিন্ন দেশের সরকার  , স্পেস এজেন্সি ও সামরিক উপদেষ্টা মন্ডলীর সঙ্গে আলোচনা করে রূপদান করতে ব্রতী হয়েছি।
আমেরিকান সরকার ,ভারত সরকার, রাশিয়ার সরকার ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন আলাদা আলাদা ভাবে চারটি পরমাণু বিস্ফোরক বহনকারী দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সক্ষম রকেট সরবরাহ করবে। সমগ্র কর্মকাণ্ড টি এই কুড়ি জনের  বিজ্ঞানী দল ও রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষ থেকে পরিচালিত হবে।২০৪০ সালের জানুয়ারি মাসে এই কর্মসূচি রূপায়িত হবে। এই কর্মকান্ডের ব্যয়ভার সব দেশই বহন করবে।
এই কর্মকাণ্ডের নামকরণ করা হয়েছে  "মিশন লাইফ"


(বাকি অংশ পরের পর্বে।পরের পর্বের নোটিফিকেশন পেতে আমায় অনুসরণ করুন।)

No comments:

Post a Comment