Crss colum

Sunday, March 12, 2017

রহস্যময় কালচক্র (দ্বিতীয় ,তৃতীয় ও অন্তিম পর্ব )

ঘুটঘুটে অন্ধকার.আস্তে আস্তে মৈনাকের চোখ সয়ে এলো .দেখলো সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানটা  ঘাসজমি . হঠাত্ সামনে মনে হলো ঘাসগুলো একটু নড়ছে .মৈনাক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো . দেখলো একটা মোটা মত লোক টলতে টলতে আসছে .মৈনাক একটু খুশিই হলো .লোকটা যখন  কুড়ি ফুট দূরে আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়ল তার দিকে চেয়ে হঠাত্ মৈনাকের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেলো . ওটা  সে লোক ভাবছিল কিন্তু ওটা একটা মোটা ভাল্লুক . ভাল্লুকটা আর একটু কাছে এগিয়ে আসতে মৈনাকের মনে হলো ওর শরীরের চারপাশে এক অদৃশ্য বলয় রয়েছে . এবারে ভাল্লুকের ধারালো চকচকে দাঁত ও নখ গুলো চোখে পড়লো .মৈনাক কাঠের পুতুলের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো .কিন্তু ভাল্লুকটা একেবারে ওর গায়ের কাছ দিয়ে চলে গেলো যেন ওখানে একজন কেউ দাঁড়িয়ে ছিলো  তার নজরেই আসেনি. মৈনাকের মনে পড়লো কালচক্র দিয়ে আসার আগে সন্ন্যাসী বলেছিলো কালচক্র তোমায় সর্বদা রক্ষা করবে.এখন মৈনাক বুঝতে পারলো সন্ন্যাসীর কথাটা সত্যি .কালচক্র তার চারদিকে অদৃশ্য বলয় গড়ে তোলায় ভাল্লুকটা তার উপস্থিতি টের পায় নি .বেশ কিছুক্ষণ পর আকাশ ফরসা হয়ে এলো.মৈনাক এতক্ষণ ঘাসজমি তেই বসে ছিলো.অন্ধকারে কোথায় বা যাবে ? এবারে আলো ফোটবার পর চলতে আরম্ভ করলো একটু পরেই ঘাসজমি শেষ হয়ে গেল তারপরে একটা উঁচু নিচু উপত্যকা .মধ্যিখান দিয়ে পায়ে চলা পথ .মৈনাক হাঁটতে লাগলো. খুব সুন্দর মনোরম প্রকৃতি .মৈনাক হাতঘড়িতে দেখলো সকাল ছটা বাজে . আধা ঘণ্টা হাঁটার পর দেখতে পেল বহু দূরে একটা মানুষ উবু হয়ে কি যেন করছে .মৈনাক দ্রুত পা চালালো .কিছুক্ষণ পর লোকটার কাছে পৌঁছে গেলো .দেখল লোকটা একটি খুরপি জাতীয় যন্ত্র নিয়ে একটি ছোট গাছের গোড়া সমেত তোলার চেষ্টা করছে.মৈনাক তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো .ততক্ষণে তার গাছটি তোলা হয়ে গেছে .মৈনাক প্রশ্ন করলো এটি কোন জায়গা ?এখন কত সাল ?আপনি কে ?মৈনাক হড়বড় করে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো.লোকটি কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো.তারপরে তাকে ইশারা করে পেছনে আসতে বললো . তারা পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চললো .লোকটি মাঝপথে কোন কথা বললো না . মৈনাক ও চুপচাপ রইলো.দুজনে একটি কটেজ টাইপের বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালো. বাড়ীটা কাঠ বা সিমেন্ট বা অন্য চেনা কোন বাড়ী বানানোর মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরী নয় .অচেনা কিছু দিয়ে তৈরী . বাড়ীর ভেতরে  আসবাব পত্র খুব কম . চার পাঁচটি ঘর .বেশিরভাগ ঘর বন্ধ .লোকটা মৈনাককে একটি ঘরের ভিতর নিয়ে গেলো. এখানে একটি শোবার খাট ও একটি বসবার জন্য চেয়ার আছে .দুটোই মনে হলো প্লাস্টিক জাতীয় স্বচ্ছ মেটেরিয়াল দিয়ে তৈরী .লোকটা মৈনাককে বসবার ইশারা করল.মৈনাক চেয়ারে বসলে লোকটা খাটে বসলো .এবারে লোকটা কথা বললো কথাটা বাংলা হলেও যেন মনে হয় এই ভাষা লোকটার নিজের ভাষা নয় .লোকটা বলল ‘আপনি যে ভাষায় কথা বললেন তা খুবই প্রাচীন ভাষা .এখন আর  কেউ এই ভাষায় কথা বলে না তাই আমি খুবই অবাক হয়ে গেছি . আমি একজন শিক্ষক .আমার নাম সুজিত 1050 . আপনার নাম কি ? মৈনাক উত্তর করলো ‘মৈনাক রায় ‘. মৈনাক প্রশ্ন করলো  আপনার নামের পর 1050 সংখ্যাটি র অর্থ কি ? বর্তমানে কোন সময়ে আমি অবস্থান করছি ? সুজিত উত্তরে বলল ,এখন 605 বিশ্বাব্দ . আমাদের জানা রেকর্ড অনুযায়ী 2000 সাল থেকে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ,হিংসা ইত্যাদি বাড়তে থাকে  যা 2020 সালে চরমে পৌঁছায়.এবং সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী এক ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হয় .এবং পরিণামে 2030 নাগাদ পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োগ হয় .যার ফলে সেই সময়ের জনসংখ্যার পঁচানব্বই শতাংশ ধ্বংস হয় .জীবনধারণের উপযোগী ভূমির নব্বই শতাংশ তেজস্ক্রিয় হয় .সামান্য কিছু মানুষ বেঁচে যায় .তারপরে পুনরায় সকলে মিলে এক সমগ্র পৃথিবীব্যাপী একটাই শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে .এই ঘটনা পৃথিবী ধ্বংসের একশো বত্সর পরে হয়.এই সময় ঠিক হয় বিশ্ব ধ্বংসকে শুরু ধরে একনতুন সময় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে .যার নাম দেওয়া হয় বিশ্বাব্দ .অর্থাত্ 605 বিশ্বাব্দ মানে তোমার 2635 সাল .আর তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো ,এখন আর ধর্ম  ,উপাধি , ইত্যাদি মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই .মানুষের জন্ম থেকে কুড়ি বত্সর বয়স পর্যন্ত শুধু নাম ধরে ডাকা হয়.সঙ্গে জোড়া হয় 1000 সংখ্যা .তার অর্থ শিক্ষার্থী .এরপর তার কর্ম অনুযায়ী নামের সাথে সংখ্যা জোড়া হয় .আমি শিক্ষক তাই আমার সংখ্যা 1030 .বুঝতে পেরেছো? তুমি এখানে এইসময়ে কি ভাবে এলে ?তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি সময়যাত্রী .মৈনাক বললো ,আমি এক আশ্চর্য্য কালচক্রের সাহায্যে এখানে এসেছি .আমি 2016 সাল থেকে এসেছি . আমি একজন কলেজ ছাত্র .আপনি কোন বিষয়ের শিক্ষক . সুজিত বললো এখন আগেকার মতো শিক্ষণ পদ্ধতি  নেই .আগে তোমরা সব শিক্ষার্থী এক জায়গায় জড় হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে ,এবং মান অনুযায়ী তাকে বিদ্যালয় ,উচ্চ বিদ্যালয় ,মহা বিদ্যালয় ,ও বিশ্ব বিদ্যালয় বলা হতো .কিন্তু এখন শিক্ষার্থী আপনার নিজের জায়গায় থাকে আর শিক্ষক তার নিজের জায়গায় .বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্যে গোটা বিশ্বের সব পড়ুয়া  একসঙ্গে শিক্ষা লাভ করে .আমি ইতিহাস ও বিজ্ঞানের শিক্ষক . ভাষা সবচেয়ে দ্রুত পরিবর্তন হয় .বর্তমানে আপনার পরিচিত ভাষায় কেউ কথা বলে না .আজ থেকে তিনশো বছর  আগে সব মানুষ যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে এক নতুন ভাষাকে বেছে নেয় যা প্রাচীন ইংরেজি ,চাইনিজ, ও হিন্দি ভাষার মিলিত রূপ .আমরা যারা প্রাচীন ভাষা চর্চা করি একমাত্র তারাই তোমার বাংলা বুঝতে পারবো.এখন তোমার নিশ্চয় ক্ষিদে পেয়েছে.তুমি আগে খাও .এই বলে সে ঘরের এক জায়গার একটা সুইচ টিপতে  ঘরে র দেওয়ালে একটি চারকোণা খোপ দেখা গেলো .তাতে অনেক ছোট ছোট পাত্র রাখা .তার মধ্যে থেকে একটা  নিয়ে মৈনাককে দিলো .মৈনাক দেখল পাত্রে সবুজ শেওলা জাতীয় একরকম খাবার আছে .  মৈনাক খেয়ে দেখলো বেশ সুস্বাদু .এত অল্প খাবারেই পেট ভরে গেলো .সুজিত বললো ,’আজকাল চাষবাস হয় না .শুধু এই পাহাড়ী অন্চলে কিছু গাছপালা হয় যা থেকে ঔষধ তৈরী হয়.সকল খাদ্যই আসে সমুদ্র থেকে.আমরা যারা পাহাড়ী অন্চলে থাকি তারা সারা বত্সরের খাবার মজুত করে রাখি .এখন পৃথিবীর মাটি বসবাসের উপযোগী নেই তাই পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ সমুদ্রে কৃত্রিম দ্বীপ গড়ে রয়েছে .সেখানেই কৃত্রিমভাবে এই জলজ উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ শেওলার চাষ হয় .এই খাবার একবার খেলে এক সপ্তাহ ক্ষিদে পাবে না বা খাবার প্রয়োজন পড়বে না . এখন আমার সাথে চলো তোমার ব্যাপারে প্রথমে আমায় প্রশাসনিক ভবনে রিপোর্ট করতে হবে .তারপরে তাদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবো .মৈনাক ও সুজিত  ঘরের বাইরে এলো .মৈনাকের পরনে জিন্সের পেন্ট ও সুতীর শার্ট ও সোয়েটার  .সুজিতের পরনে সিন্থেটিক জাতীয় পোশাক  কিন্তু অনেক পকেট যুক্ত . মৈনাক প্রশ্ন করলো সুজিতকে  ,’আপনার এই পাতলা পোশাকে ঠাণ্ডা লাগছে না ?’সুজিত উত্তর দিল ‘এই পোষাক তৈরী হয় জলের তলার এক প্রকার স্পন্জ থেকে .এটি চরমতম ঠাণ্ডা ও গরমে পরবার উপযোগী .এখন চলো যাওয়া যাক .’সুজিত পকেট থেকে একটি টিভির রিমোট কন্ট্রোলের মতো সুইচ বার করে টিপতেই বাড়ীর ছাদের ওপর হতে একটি ভাসমান গাড়ী নিশ্বব্দে নেমে এল. গাড়ীটি গোল .গাড়ীটা পুরো মাটিতে ঠেকলো না মাটির এক ফুট উঁচুতে ভেসে রইলো.গাড়িতে চালক ছাড়া  চারজন বসবার ব্যবস্থা আছে . মৈনাক ও সুজিত গাড়িতে বসলো . সুজিত চালকের আসনে বসলো .সামনে কন্ট্রোল পেনেল .স্ক্রীনে অনেক তথ্য দেখা যাচ্ছে.সুজিত মৈনাককে বললো ,’প্রশাসনিক ভবন এখান থেকে 100 কিমি দূরত্বে .যেতে দশ  মিনিট লাগবে .’ মৈনাক বলল ‘আপনারা দূরত্ব বোঝাতে আমাদের মতো একক ব্যবহার করেন ?সুজিত হেসে বলল ‘আমরা আপনাদের ভবিষ্যতের মানুষ.আমাদের যাবতীয় শিক্ষা আপনাদের কাছ থেকেই অর্জন করেছি .’ কিছুক্ষণ যাবার পর অল্প কিছু পাহাড়ের কোলে ঘরবাড়ী নজরে এলো.তার মধ্যে একটি বেশ বড় বাড়ীর সামনে তাদের গাড়ী এসে দাঁড়ালো. দুজনে বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করলো .এবারে মৈনাক বেশ কিছু লোক দেখতে পেল সকলে অবাক চোখে মৈনাকের পোশাকের দিকেই চেয়ে আছে.সুজিত মৈনাককে নিয়ে একটি ঘরে গেলো .সেখানে এক জন মধ্যবয়স্ক লোক টেবিলের সামনে কাজ করছিল.তাদের দুজনকে দেখে বিশেষ করে মৈনাককে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তারপর তাদের বসতে বললো.দুজনে বসবার পর সুজিত লোকটার সাথে কথা বলতে লাগলো.মৈনাক তাদের ভাষা একবর্ণ ও বুঝতে পারছিল না তবে কিছু শব্দ চেনা লাগছিলো .লোকটা কথা বলবার সময় বারবার মৈনাকের দিকে তাকাচ্ছিল .এবারে লোকটা  একটা টেবিলের ওপরের সুইচ টিপতেই টেবিলের কিছুটা অংশ কম্পিউটারের মতো হয়ে গেলো এবং তাতে এক মহিলার ছবি ভেসে উঠল. লোকটি তাকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কি সব বললো .কম্পিউটারের স্ক্রীনটা আপনা থেকেই ঘুরে ঘুরে মৈনাক ও সুজিতকে দেখতে  লাগলো .তারপর মহিলা সুজিতকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলো .অবশেষে মহিলা টি মৈনাকের দিকে মুখ করে পরিস্কার বাংলায় বললো ‘হে অতীতের অতিথি আমার নমস্কার নেবেন .আমি তানিয়া 6501 .আমি বিজ্ঞান , ইতিহাস ,ও চিকিত্সা বিভাগের মুখ্য প্রশাসক .আমি আপনাকে আমাদের মূল রাজধানী ‘ ফিনিক্স’ দেখার আমন্ত্রণ জানালাম . আপনার সাথে আপনার বন্ধু সুজিতকে ও আমন্ত্রণ জানালাম .আপনারা এখনই রওনা দিলে চার ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন .ধন্যবাদ.’ এরপর তারা বাইরে এলো.এতক্ষণ যে লোকটার সাথে সুজিত কথা বলছিলো সুজিত বললো তার নাম ‘নিলয় 1975 .’ নিলয় বাইরে এসে একটা বড় গাড়ীর ব্যবস্থা করল.তাতে  চালক ছাড়া দশ জনের বসার ব্যবস্থা .এই গাড়ী টিও গোল পুরোটা স্বচ্ছ কাঁচ জাতীয় প্লাস্টিকে ঘেরা .এবারে চালকের আসনে অন্যজন .পিছনের আসনে সুজিত ,মৈনাক.আর তাদের দুপাশে আরো ছয়জন রক্ষী সহ নিলয় বসলো .গাড়ী সোজা উপরে উঠলো তারপর সোজা দক্ষিণ দিকে রওনা দিলো .দুই পাশে রক্ষী দের দিকে চেয়ে মৈনাক ভাবতে লাগলো সে এদের অতিথি নাকি বন্দী ???মৈনাক  চুপচাপ বসেছিল. গাড়ী হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছে .হঠাত্ মৈনাক  সুজিতকে প্রশ্ন করল ‘আমরা যেখানে যাচ্ছি সেটি কোথায় ?’ সুজিত উত্তর দিলো ‘আমরা এখন রাজধানী শহর ফিনিক্স এ যাচ্ছি . এটি ভারত মহাসাগরের উপর অবস্থিত একটি কৃত্রিম দ্বীপ .এটির জনসংখ্যা দশ লক্ষ . বিশ্বধ্বংসের আগে টেকনোলজির খুব দ্রুত উন্নতি হয় .বিশেষ করে প্লাস্টিক টেকনোলজি .এইসময়ে মানুষ পরিবেশে নির্দিষ্ট সময় পরে মিশে যাবার মতো অথচ খুব শক্ত ও অত্যধিক হালকা প্লাস্টিক আবিষ্কার করে .পরমাণু যুদ্ধের পর  পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গা বসবাসের অযোগ্য বলে বিবেচিত হয় .বিশ্বধ্বংসের একশো বছর পর অবশিষ্ট  মানুষ যখন জোট বাঁধলো তখন তারা একটি নতুন রাজধানী স্হাপন করার কথা ভাবলো .যেহেতু পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য তাই স্বাভাবিকভাবেই জলে বসবাসের কথা চিন্তা করে .তারা বিরাট বিরাট প্লাস্টিকের ব্লক তৈরী করে যেগুলি জলে ভাসে .এরকম অনেক ব্লক সংযুক্ত করে সমুদ্রে এক ভাসমান দ্বীপ তৈরী করে . প্রায় একশো বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে থাকা এই দ্বীপ স্বয়ং সম্পূর্ণ . সমুদ্রের ঢেউ থেকে উত্পন্ন বিদ্যুতের সাহায্য আলোকিত .খাদ্যের জন্য  সমুদ্রের বিশাল অংশজুড়ে চৌবাচ্ছা তৈরী করে তাতে জলজ শেওলার চাষ করা হয় . সমুদ্রের জল শোধন করে পানীয় হিসাবে  মিষ্টি জল তৈরী করা হয় . এছাড়া এখানে  রয়েছে শিল্প ,কলা ,ইতিহাস ,বিজ্ঞান ,প্রভৃতি চর্চার জন্য বিশেষ কেন্দ্র . বর্তমানে  এই ধরণের স্বয়ংসম্পূর্ণ  দ্বীপ প্রায় সব মহাসাগরেই রয়েছে .তাদের মধ্যে ‘ ফিনিক্স’ সবথেকে বড় . সমগ্র বিশ্বের প্রায় কুড়ি হাজার স্বয়ংসম্পূর্ণ দ্বীপ ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাহাড়ী অন্চলের মানুষ নিয়ে মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি.’  মৈনাক একটা প্রশ্ন করলো ‘আপনি বলেছিলেন পরমাণু যুদ্ধের পর পাঁচ শতাংশ মানুষ বেঁচে গিয়েছিলো  তাহলে  তো আরো জনসংখ্যা হবার কথা !’ সুজিত একটু ম্লান হেসে উত্তর দিলো ‘তোমার হিসাব ঠিকই .বিশ্বধ্বংসের পরেও প্রায় তিরিশ কোটির বেশী মানুষ বেঁচে গিয়েছিল . কিন্তু তার পরের দূর্ভিক্ষ  ও মহামারীতে বহু লোক মারা যায় .যারা বেঁচে যায় তাদেরও আরো অনেক বত্সর তেজস্ক্রিয়তা জনিত রোগ ভোগ করতে হয়.সবথেকে বড় ব্যাপার এই যে মানুষের জন্মহার বিপদজনক ভাবে কমে যায় .সেই সব কারণে আজ জনসংখ্যা এত কম .’এর মধ্যেই তাদের যান ভূভাগ ছেড়ে মহাসাগরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে .কিছুক্ষণের মধ্যেই বহুদূরে সাগরের মধ্যে একটা কিছু দেখা গেলো .যত কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো ততই একটি দ্বীপের চেহারা স্পষ্ট হতে লাগলো . আস্তে আস্তে বাড়ী ঘর লোকজন সব স্পষ্ট হতে লাগলো .সুজিত বললো ‘ এই আমাদের রাজধানী ফিনিক্স .গাড়ী গিয়ে নামলো এক বিশাল বাড়ীর ছাদে .নামতেই মৈনাক দেখলো সেই মহিলা যার নাম তানিয়া , তিনি আরো কয়েকজন লোকের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন. তানিয়া এগিয়ে এসে মৈনাকের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো ‘সুস্বাগতম’ .তারা সকলে লিফটের সাহায্যে নিচে বাড়ীর একটি মধ্যবর্তী তলায় নামলো . একটি সুন্দর সুসজ্জিত ঘরে তাদের দুজনকে নিয়ে এসে তানিয়া বললো ‘আপনারা আপাতত বিশ্রাম করুন . কিছুক্ষণ পরে আপনাদের ইতিহাস ঘরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে .’ তানিয়া চলে যাবার পর মৈনাক সুজিতকে প্রশ্ন করলো ‘কি ব্যাপার ?ঠিক বুঝতে পারলাম না .’  .সুজিত উত্তর দিলো ‘ইতিহাস ঘর একটা তথ্যের ভাণ্ডার .পৃথিবীর মানুষ সৃষ্টি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সব তথ্য সেখানে রাখা আছে.’বেশ কিছুক্ষণ বাদে একজন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো ইতিহাস ঘরে .চারিদিকে অনেক যন্ত্রপাতি .বিশাল মনিটর .তিনজন বয়স্ক লোক তাদের অপেক্ষায় বসে ছিলো.তাদের একজনকে সুজিত চেনে বলল.বিখ্যাত ইতিহাসবিদ.তারা মৈনাকদের যথেষ্ট বিনয়ের সাথে বসতে বলল .প্রথমে একজন সুজিতকে প্রশ্ন করলো তার সাথে মৈনাকের দেখা হলো কিভাবে ?সুজিত সবকিছু যা যা ঘটেছিল সবই বলল.সে পাহাড়ে ঔষধী গাছ খুঁজতে গিয়েছিল.সেখানে মৈনাকের সাথে দেখা .মৈনাকের মুখে প্রাচীন ভাষা শুনে সে অবাক হয়ে যায় .সে মৈনাককে নিজের বাড়ী নিয়ে যায় .সেখানে মৈনাকের কাছ থেকে সব জানতে পারে .তারপর উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে তারা এখানে আসার আমন্ত্রণ জানায় .এবং আজ সকালে তারা ফিনিক্সে পৌঁছায়.এবারে সেই বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মৈনাককে বললো ‘তুমি কোন  সময়ের এবং কোন দেশের লোক ?’মৈনাক বললো ‘আমি 2016 সাল থেকে এই সময়ে এসেছি. আমি ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ নামের অঙ্গরাজ্যের লোক .’    মৈনাক যখন এইসব বলছিলো সামনের মনিটরে ভারতবর্ষের মানচিত্র এবং তাতে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান দেখাচ্ছিল . এরপর বহু সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল .বিশেষ করে তারা কালচক্রের সম্পর্কে খুঁটিয়ে জানতে চাইছিল .  বিশেষ করে কোন মন্ত্রের সাহায্য নিয়েছিল মৈনাক তা জানতে চাইছিল .মৈনাকের সন্দেহ হওয়ায় এই ব্যাপারটা চেপে গেল শুধু বললো সন্ন্যাসীর নিষেধ আছে . এর পর তারা মৈনাককে একটি অজানা মেশিনের ভিতর শুইয়ে দিল সম্পূর্ণ পরীক্ষা করার জন্য .কিন্তু তারা  অনেক চেষ্টা করেও কোন ছবি তুলতে পারলো না .শেষে বললো আপনাকে ঘিরে এক অজানা  অদৃশ্য রশ্মির বলয় রয়েছে . যা আমাদের সব কিছুকে বাধা দিচ্ছে .আপনারা এখন যান আমরা আপনাদের কাছে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করবো .পুনরায় আপনাদের প্রয়োজন মতো ডেকে পাঠাবো .দুজনে ঘরে চলে এলো.মৈনাক চুপচাপ ছিলো .সুজিত বললো ‘এদের মতলব কি বলতো ? তোমার সেই কালচক্রের ব্যাপারে এরা খুব আগ্রহী মনে হলো .কিন্তু কেন ?তুমি আমার বন্ধু তাই তোমায় একটা পরামর্শ দিচ্ছি ,তুমি এদের ঐ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলো না .’ মৈনাক কোনো উত্তর করলো না . কয়েক দিন তারা ফিনিক্সের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে লাগলো .একদিন তারা গাড়ী চেপে  খাদ্যের জন্য যে জলজ শেওলার চাষ হয় তা দেখতে গেল.বিশাল বিশাল অগভীর চৌবাচ্ছা .সমুদ্রের জলে ভর্তি .তিনটি স্তরে চাষ হয় .প্রথমে সমুদ্রের জলকে চাষের উপযোগী করার জন্য উপকারী ব্যেকটেরিয়া ছড়ানো হয় .কয়েকদিন পর তাতে এক বিশেষ রাসায়নিক দেওয়া হয় যাতে শেওলার দ্রুত বৃদ্ধি হয় .এরপর দ্বিতীয় স্তরে শেওলা ছড়ানো হয়.এই ছড়ানো বা রোপণের বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয় .প্রথমে অল্প একটু জলে শেওলা দেওয়া হয় .একদিন পর সেই শেওলা ভর্তি জল পুরো জল সমগ্র চৌবাচ্ছায় ছড়িয়ে দেওয়া হয় .তৃতীয় স্তরে এই জলজ শেওলাকে মানুষের খাদ্যের উপযোগী করার জন্য বিভিন্ন খাদ্যগুণ যোগ করা হয় .অবশেষে এই শেওলাকে সংরক্ষণ করে বিভিন্ন মানুষের বসতিতে রপ্তানি করা হয় . এই জলজ শেওলার চাষের অনুমতি সামান্য কয়েকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দ্বীপের আছে.বাকিরা সম্পূর্ণভাবে আমদানি করা খাদ্যের উপর নির্ভরশীল. অনেকটা সময় কাটিয়ে মৈনাকরা ফিরে এলো .যাওয়া আসার সময় মৈনাক গভীর মনোযোগের সাথে এই উড়ুক্কু গাড়ী চালানোর পদ্ধতি লক্ষ্য করছিল.বেশ কয়েকবার দেখার পরে পুরো চালানোর পদ্ধতি মৈনাক বুঝে গেলো .কিছুটা আবার সুজিতের কাছে যেন জানার আগ্রহে প্রশ্ন করছে ,এইভাব দেখিয়ে প্রশ্ন করে জেনে নিলো .মৈনাকের মনে কি আছে তা একমাত্র মৈনাক -ই জানে.       আরো একদিন কেটে গেল.সকালে মৈনাক একটু ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করছিল এমন সময় একজন এসে খবর দিল আজ তাদের আবার ইতিহাস ঘরে ডাকা হয়েছে. কিছুক্ষণ বাদে মৈনাক গিয়ে দেখলো আগের তিনজন ইতিহাসবিদ ও আরো একজন আজ উপস্থিত .আজ সুজিত আসেনি .নতুন ব্যাক্তি নিজেই পরিচয় দিলেন যে তিনি রিচার্ড .একজন বিজ্ঞানী . রিচার্ড বললো ‘আমরা আপনার দেওয়া সব তথ্য বিশ্লেষণ করে জেনেছি আপনার দেওয়া তথ্য পঁচাশি শতাংশ নির্ভুল .বাকি পনেরো শতাংশ সম্পর্কে আমরা হয়তো সঠিক জানি না . এখন একটা বিশেষ ব্যাপারে আপনার সহযোগিতা ও দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আপনাকে আজ এখানে ডেকেছি .আশা করি আপনি আমাদের হতাশ ও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবেন না .’ রিচার্ডের ঠাণ্ডা আওয়াজ মৈনাকের বুকে হালকা কাঁপন ধরাল. মৈনাক আস্তে আস্তে বলল ‘বলুন আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি ?’ রিচার্ড কোনো ভণিতা না করে বললো ‘আজ আমাদের জনপদগুলি দেখছেন পৃথিবীর মাটি ছেড়ে মহাসাগরে আশ্রয় নিয়েছে .আজ কয়েকশো বত্সর নিরলস প্রচেষ্টার ফলে আমরা স্বাবলম্বী স্বনির্ভরশীল হয়েছি. কিন্তু ভয়ংকর পরমাণু যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর মাটি আজো জীবনধারণের অনুপযুক্ত ও বিপদজনক .এতদিন মানুষের জন্মহার খুব কমে গিয়েছিল.বেশ কয়েক শতাব্দী জন্মহার মৃত্যুহারের থেকেও কম ছিলো .যার জন্য জনসংখ্যা কমতে কমতে পঁয়ত্রিশ কোটি থেকে মাত্র দুই কোটিতে নেমে আসে .আমাদের বিজ্ঞানীরা এর কারণ খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে পরমাণু যুদ্ধের ফলে মানব শরীরে এক বিশেষ জিনের বিকৃতি ঘটে .যা জন্ম দেওয়ার পক্রিয়াকে আভ্যন্তরীণ ভাবে বাধা দেয় .খুশীর কথা এই যে আজ থেকে পন্চাশ বত্সর আগে এক বিজ্ঞানী এই জিনকে রোধ করার ঔষধ আবিষ্কার করে.  আজ যার ফলে পুনরায় মানুষের জন্মহার বাড়ছে.’ জন্মহার বাড়ার সঙ্গে অন্য একটি সমস্যার আমরা সম্মুখীন হয়েছি .এতদিন আমাদের কাছে যে সীমিত সম্পদ ছিলো আমরা তা পরিপূর্ণ ভাবে কাজে লাগিয়ে এই দুইকোটি মানুষের জীবনধারণের ব্যবস্থা করছিলাম .কিন্তু এখন প্রতিদিন চাহিদার বৃদ্ধি হচ্ছে এবং সম্পদের ঘাটতি হচ্ছে . এই সমস্যা নিয়ে আমাদের প্রশাসনিক মন্ডলি খুবই চিন্তিত ছিলো .এমন সময়ে আপনি অতীত পৃথিবী থেকে হাজির হলেন .আপনার সম্পর্কে সব তথ্য আমরা বিশ্লেষণ করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি আপনি প্রকৃতই অতীতের অতিথি. আমরা চাই আপনি কালচক্রের সব রহস্যভেদ করতে আমাদের সাহায্য করুন.আপনি বলছেন এক সন্ন্যাসী আপনাকে কালচক্রের সাহায্যে এই ভবিষ্যতের পৃথিবীতে পাঠিয়েছে .তাহলে তিনি নিশ্চয় আপনার পুনরায় অতীতে ফেরত যাবার কোনো উপায় আপনাকে বলে দিয়েছেন.আমরা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আপনাদের থেকে এগিয়ে থাকলেও এখনো ‘ সময়ভ্রমণ’ এর রহস্য আবিষ্কার করতে পারিনি . আমরা চাই আপনি ঐ রহস্যময় কালচক্রের আহ্বান করুন. আমরা কালচক্রের পরীক্ষা করার পর আপনি আপনার সময়ে ফেরত যেতে পারেন .’  মৈনাক এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে ওনার কথা শুনছিলো .এবারে বললো ‘আপনারা আমাকে কয়েকদিন সময় দিন এই সম্পর্কে ভাবার জন্য.তারপরে আমি আমার মতামত জানাবো .রিচার্ড বললো ‘আমি আপনাকে তিনদিন সময় দিলাম .তিনদিন পর আপনাকে পুনরায় ডাকা হবে .আশা করি আপনার সিদ্ধান্ত আমাদের অনুকূল হবে.নতুবা আমরা কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবো’. মৈনাক নিজের ঘরে চলে এলো.এসে দেখলো সুজিত ঘুমিয়ে পড়েছে.সে নিজের বিছানায় চুপচাপ শুয়ে পড়লো.পুরো দিনটা কোথাও বেরোল না .বিকালে সুজিত কোথায় যেন গেলো.অনেক রাতে ফিরে এলো.রাতে আর কোনও কথা হলো না .সারা রাত  মৈনাক ঘুমোতে পারলো না .বিছানায় ছটফট করলো.একবার মৈনাকের মনে হলো সুজিতও জেগে আছে .ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়লো.ঘুমিয়ে পড়ার আগে মনে মনে ভাবলো যেভাবেই হোক এদের খপ্পর থেকে পালাতে হবে .                    সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে .সুজিত বাথরুমে .মৈনাক পাশের বাথরুমে গেলো . বেরিয়ে এসে দেখলো সুজিত জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে.মৈনাকের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকালো. মৈনাক দেখলো সুজিতের চোখে জল .মৈনাক বললো ‘কি হলো তোমার চোখে জল ?’ সুজিত ধরা ধরা গলায় উত্তর দিলো ‘বন্ধু তোমার খুব বিপদ .তুমি যে কোন ভাবে এখান থেকে পালাও’.মৈনাক প্রশ্ন করলো ‘কেন কি হয়েছে ?’ সুজিত উত্তর না দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মৈনাকের একেবারে কাছে এসে ফিসফিস করে বললো ‘কাল আমাকে তানিয়া ডেকে পাঠিয়ে ছিলো.সেখানে রিচার্ড নামে আরো একজন ছিলো .ওরা যে কোন ভাবে কালচক্রের দখল চায়.  কালচক্রের সাহায্যে অতীতে গিয়ে নিজেদের ভবিষ্যত্ অনুকূল করার জন্য যে কোন রকম কাজ করার জন্য ওরা প্রস্তুত’ .মৈনাক বললো  ‘ঠিকমত বুঝতে পারলাম না’.সুজিত বুঝিয়ে বললো ‘মনে করো বর্তমানে কেউ একজন তানিয়ার শত্রু ও প্রতিপক্ষ .তানিয়া চায় কালচক্রের সাহায্যে বিনাশক দল পাঠিয়ে তাকে শৈশবেই বিনাশ করতে . তারপর মনে কর অতীতের বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী হস্তগত করতে .এখন ওরা আমাকে প্রস্তাব দিয়েছে যে কোনও ভাবে আমি যদি এই ব্যাপারে সাহায্য করি তবে আমায় চুরির ভাগ দেবে .মৈনাক তুমি বিশ্বাস করো আমি একজন শিক্ষক .আমার পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের মতো আমি সততার পথে  জ্ঞানের  পথেই চলতে চাই . তুমি আমার বন্ধু .তোমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারবো না’  . মৈনাক বলল ‘কাল আমাকে ডেকে তিনদিনের সময় দেওয়া হয়েছে .বলেছে এই তিনদিনের মধ্যে আমি যেন কালচক্র ওদের হাতে পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য তুলে দিই . নাহলে ওরা কঠোর ব্যবস্থা নেবার হুমকি দিয়েছে . আমি এখান থেকে পালাতে চাই , তুমি আমায় সাহায্য করো’  . সুজিত বললো ‘পালাতে হলে প্রথমেই একটি গাড়ীর দখল নিতে হবে .আমরা দুই প্রকার গাড়িতে ঘোরাফেরা করি . একটি দূরভ্রমণের জন্য .এগুলি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় . এগুলো এই দ্বীপের সীমার বাইরে যেতে পারে .দ্বিতীয় প্রকার গাড়ী কেবল এই দ্বীপের মধ্যে যাতায়াতের জন্য .এগুলি সমুদ্রের এক কি.মি.র মধ্যে এলেই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রকের দ্বারা স্বয়ংক্রিয় ভাবে মাটিতে নেমে আসে .যাতে সমুদ্রের জলে না পড়ে যায় .দুই প্রকার গাড়ী  বাইরে থেকে প্রায় একই প্রকার  দেখতে.কেবল ভিতরে গিয়ে চালু করলে দূর ভ্রমণে র গাড়িতে ‘স্বনিয়ন্ত্রন’ ও সাধারণ গাড়িতে  ‘কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ’ এর চিহ্ন ফুটে ওঠে. আপনাকে পালাতে হলে দূর ভ্রমণের গাড়িতে পালাতে হবে .আজ বিকালে আমাদের এখানে এক উতসব আছে . রক্ষীর সংখ্যা খুব কম থাকবে  . আমি যে কোনও ভাবে আমাদের ঘরের বাইরের দুজন রক্ষী অন্যমনস্ক করবো.আপনি সেই সুযোগে লিফটে উপরে উঠে ছাদে  দাঁড়িয়ে থাকা যে কোনো একটি গাড়ী দখল করে পালিয়ে যাবেন’  . সেই কথামতো বিকালে রক্ষীর সংখ্যা একটু কম হতেই সুজিত হঠাত্ পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো.প্রথমে মৈনাক মনে করছিল এটা সত্যি .কিন্তু সুজিত যখন চোখের ইশারা করে রক্ষীদের ডাকতে বললো ,তখন বুঝতে পারলো এটি মৈনাককে পালাতে সুযোগ করে দেবার জন্য অভিনয়. রক্ষীরা এসে সুজিতকে চিকিত্সার জন্য নিয়ে গেলো .এই সুযোগে মৈনাক দেখলো লিফট ফাঁকা .মৈনাক লিফটে  উঠে ওপরে যাবার বোতাম টিপে দিলো . ছাদে উঠে দেখতে পেল দুটি গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে .একজন রক্ষী অন্যদিকে মুখ করে পাহারা দিচ্ছে . মৈনাক কিছু না ভেবেই সামনের গাড়ীটায় উঠে পড়ে চালু করে দিলো.আকাশে ওঠার পর মৈনাক লক্ষ্য করলো গাড়ীর মনিটরে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের চিহ্ন রয়েছে .তারমানে মৈনাক এই গাড়ী করে এই দ্বীপের বাইরে যেতে পারবে না . কিন্তু মৈনাক ঠিক করলো সে কিছুতেই ওদের হাতে ধরা দেবে না .এদিকে মৈনাকের গাড়ী আকাশে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্ষীরা টের পেয়েছে মৈনাক পালিয়েছে .তারা অপর গাড়ীটা করে মৈনাককে ধাওয়া করলো .’ মৈনাক দ্রুত এগিয়ে চললো . পিছনের গাড়ীটাও এগিয়ে আসছে . হঠাত্ মৈনাকের গাড়ী নিচের দিকে  নামতে লাগলো .মৈনাক বুঝলো সামনেই সমুদ্র ,তাই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের সাহায্যে গাড়ী নেমে যাচ্ছে . সন্ধ্যে হয় হয়. মৈনাক গাড়ী থামতেই নেমে সামনের দিকে দৌড়তে শুরু করলো .পিছনের গাড়ীটাও ততক্ষণে নেমে পড়েছে . রক্ষীরা বেরিয়ে মৈনাককে ধরবার জন্য আসতে লাগলো .মৈনাকের সামনে ফাঁকা জায়গা ,তারপর দূরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে .মৈনাক দৌড়তে দৌড়তে ‘ওম নম শিবায়্’ জপ করতে লাগলো .দ্বীপ ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে .এবারে মৈনাককে গভীর সমুদ্রে গিয়ে পড়তে হবে . মৈনাক জপ থামায় নি .সমুদ্র যখন একেবারে কাছে ঠিক তখন দ্বীপের সীমার দুই হাত দূরে কালচক্র আবির্ভুত হলো .মৈ দেখলো উর্ধ্বদিকে তিনটি মেষ রাশির চিহ্ন একত্রিত হলো .আর মাঝের ফাঁকা অংশ অসচ্ছ হলো . মৈনাক মনে মনে  369 সংখ্যা জপ করতে করতে কালচক্রের মধ্যবর্তী ফাঁকা অংশের মধ্যে দিয়ে লাফ দিলো .                        মৈনাক তাকিয়ে দেখলো সে একটা পাহাড়ী রাস্তার মধ্যে শুয়ে আছে . রাস্তাটি দূরে একটা গ্রামের মধ্যে গেছে. উল্টোদিকে কিছু লোক এগিয়ে আসছে .  কাছে আসতে দেখলো ভিড়ের মধ্যে তার চার বন্ধুই আছে .প্রবাল দূর থেকে মৈনাককে দেখে চিনতে পেরে  চেঁচিয়ে উঠলো ‘ঐ যে মৈনাক’ .সবাই হৈ হৈ করে  এগিয়ে এসে মৈনাককে ঘিরে ধরলো .প্রবাল বললো ,’তুই কাল হারিয়ে গিয়েছিলিস .কাল সারা রাত তোর জন্য চিন্তা করেছি .আজ সকালে সোটাং গ্রাম থেকে লোকজন নিয়ে তোকে খুঁজতে গিয়েছিলাম .না পেয়ে ফিরে আসার পথে তোকে দেখতে পেলাম .তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলিস  ?’ মৈনাক বুঝতে পারলো ভবিষ্যতে তার বেশ কয়েক দিন কেটে গেলেও বর্তমানে তার মাত্র একদিন কেটেছ. প্রবালের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু বললো ‘এখন বাড়ী চল. পরে বলবো’  . (শেষ )

No comments:

Post a Comment