Crss colum

Friday, March 31, 2017

স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা

সুমন ছুটির দিনে একটু বেলা করে উঠতে ভালোবাসে .কিন্তু আজ সকাল সকাল উঠতে হল .সকাল বেলায় মা ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বললো ‘বাবু ,তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে চা খেয়ে ফুলের দোকান থেকে ফুল এনে দে .’ আজ লক্ষ্মী পূজো .সকালে না গেলে ফুল  নাও পেতে  পারে .তাই তাড়াতাড়ি উঠতে হলো .কিন্তু রেডি হয়ে  যেতে বেশ দেরি হয়ে গেলো . ফুলের দোকান পাড়ার শেষ মাথায় . গিয়ে দেখলো বেশ ভিড় .সকলের বাড়ীতেই আজ পুজো .সুমন ক্রমশ ভিড় ঠেলে একেবারে দোকানের সামনে চলে এলো .দোকানি সুমনের  ফুল মালা একটা পলিথিনে রাখছে ঠিক তখন একটা সুরেলা গলা সুমনের পাশ থেকে বলে উঠল ‘আমাকে একটা রজনী গন্ধার মালা দেবেন .সাথে দুটো গাঁদার মালা দেবেন .’ সুমন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো একটি বছর কুড়ি বয়সী মেয়ে .ফর্সা ,রোগা ,কিন্তু মুখশ্রী অপূর্ব .মেয়েটি সুমনের দিকে তাকাতে সুমন চোখ নামিয়ে নিল .কোনো অজানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা ঠিক নয়.তারপর সারাদিনের ব্যাস্ততার মাঝে  মেয়েটির কথা আর মনে এলো না .রাত্রে শুয়ে পড়লেই সাথে সাথে ঘুম আসে না .এটা ওটা চিন্তার মধ্যে হঠাত্ মেয়েটির কথা মনে এলো .কে মেয়েটি ? বেশ সুন্দর দেখতে .আগে কখনো এই পাড়ায় দেখেনি সুমন .মনে হয় নতুন এসেছে . এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম এসে গেলো .সকালে উঠে অফিস যাবার তাড়াহুড়োয় সুমনের কিছুই মনে রইলো না . সুমন পড়াশোনায় বরাবর খুব ভালো ছেলে বলেই পরিচিত. ক্লাসে কখনো সেকেণ্ড হয় নি .এম এসসি পাশ করার পর মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই  বোস ইন্সটিউটে জুনিয়ার রিসার্চারের পদে যোগ দিয়েছে. ছোটোবেলা থেকেই ক্রিকেটের ভক্ত .নিজেও ভালো ক্রিকেট খেলে .লম্বায় প্রায় ছ ফুট হওয়ায়  ফাস্ট বোলিং করে.এখনো ছুটির দিনে মাঠে নেমে পড়ে .  কয়েকদিনের মধ্যে কালীপূজো চলে এলো .সুমনদের পাড়ায় একটাই কালী পূজো হয় .কালী পূজো উপলক্ষে প্রতি বছর বিচিত্রানুষ্ঠান হয়.বাইরের ভাড়া করা শিল্পী দের সাথে পাড়ার প্রতিভাবান দের সুযোগ দেওয়া হয় .ঐ দিন খুব হৈ চৈ হয় .সুমন এই দিনটা কখনো মিস করে না .এ বছর ভাই ফোঁটার দিন বিচিত্রানুষ্ঠান হবে .সকালে বোন সুমতি ফোঁটা দেবার বললো ‘দাদা ,আজ সন্ধ্যাবেলায় ফাংশান .আমাকে নিয়ে যাবি কিন্তু .’আজ অফিস ছুটি .সন্ধ্যা হতে দু ভাইবোনে সেজে পূজো তলায় গেলো.যেতেই ক্লাবের ছেলেরা ওদের সামনের সারির চেয়ারে বসালো .সুমন এই পাড়ার গর্ব .তাছাড়া ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলেছে দীর্ঘকাল. অনুষ্ঠান শুরু হলো .প্রথমে উদ্বোধনী সঙ্গীত .তারপর এটা ওটার পর ঘোষক বললো এবার রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনাবেন শ্রেয়সী মিত্র. যে মেয়েটি মঞ্চে উঠল তাকে দেখে সুমন চমকে গেলো .সেই মেয়েটি.সবাইকে প্রণাম জানিয়ে  গান শুরু করলো . “‘বধু কোন আলো লাগলো চোখে .”অপূর্ব সুরেলা গলা .সুমতি বললো ‘দাদা এইটি আমার প্রিয় বান্ধবী .’ বাড়ী আসার পর সারাক্ষণ একটা সুরেলা স্মৃতি কানে অনুরণন হয়ে চললো .এক অদ্ভুত ভালোলাগা .কয়েকদিন পরের কথা,বাবা সকালে মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে সুমনের উদ্দেশ্যে বললো ‘খোকা  ,আজ মিত্র বাবু বলছিলেন ওনার মেয়ে বি এসসি সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ে .পড়াশোনায় খুব ভাল.এই নতুন জায়গায় এসে  ভাল টিউশন  মাস্টার পাচ্ছে না .তুই তো একটু দেখিয়ে দিলে পারিস .’  সুমন বললো ‘আমার সময় কোথায় ? সেই সন্ধ্যা সাতটায় বাড়ী ফিরি .’ বাবা বললো ‘রাত আটটা থেকে নটা ,একঘন্টা দেখিয়ে দিতে পারিস .আর রবিবার যখন হোক একঘন্টা দেখিয়ে দিবি .তাছাড়া সুমতিও এবারে অঙ্কের অসুবিধে বলছিলো .মিত্র বাবুর মেয়ে আর সুমতি  দুজনে খুব বন্ধু হয় .দুজনে একসঙ্গে তোর কাছে অঙ্কটা দেখে নিতে পারবে .’  বাবার কথা সুমন ফেলতে পারলো না .তাই মত দিতেই হলো .রবিবার সকালে মিত্র বাবুর মেয়ে শ্রেয়সী পড়তে এলো .সুমতি তো খুব খুশি.এতদিন বন্ধুর কাছে নিজের দাদার পড়াশুনার খ্যাতি করেছে .সুমন পড়ার ঘরে দুজনকে পড়াতে বসলো .কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলো মেয়েটি পড়াশোনায় খুব ভালো .আর খুব লাজুক .কয়েক সপ্তাহ পড়াবার পর সুমন মেয়েটির প্রতি একটু দুর্বলতা অনুভব করলো.কিন্তু সুমতি থাকে বলে কিছু বলতে পারছিলো না .একদিন সুমতি জ্বর হওয়ায় পড়তে বসলো না . সেদিন শ্রেয়সী একাই পড়তে বসেছিল .সুমন পড়াতে পড়াতে মনের কথা প্রকাশ করতে না পেরে শেষে শ্রেয়সীর গান তারপর সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেমের প্রকাশ নিয়ে কথা শুরু করে দিলো .শ্রেয়সী চুপচাপ সুমনের কথা শুনছিলো .সুমন আচমকা শ্রেয়সীকে প্রশ্ন করলো ,তার জীবনে কখনো প্রেম এসেছে কিনা . শ্রেয়সী এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে ,সুমনের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো ‘আমার বাবা খুবই কড়া প্রকৃতির মানুষ .আমার এক পিসি প্রেম করে বিয়ে করেছিলো .পিসেমশাই মারা গেছে .তবুও বাবা আজ পর্যন্ত পিসির সাথে সম্পর্ক রাখেন নি .আমাদের বাড়ী প্রেমের প্রবেশ নিষেধ .’ সুমন তার জবাব পেয়ে গেলো .

কিছুদিন হলো মা সুমনকে বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছিলো .সুমন এতদিন গা করেনি .শ্রেয়সীর কাছ থেকে পরোক্ষ ভাবে না শোনার পর একদিন মাকে বলেই দিলো তার বিয়ের ব্যাপারে কোন আপত্তি নেই .শ্রেয়সী এখনো পড়তে আসে .সুমন নিরাসক্তভাবে পড়ায়. কয়েকদিন পর মা একটা ছবি দিয়ে গেলো সুমনের ঘরে .ছবির মেয়েটি বেশ সুন্দর ,শিক্ষিত .সুমন রাজী হয়ে গেলো  .দেখা শোনা কমপ্লিট হয়ে গেলো . কেবলমাত্র বিয়ের দিনটা ঠিক হতে বাকী .আচমকাএকদিন সকালে বাবার কাছে একটি ফোন এলো  .বাবা ফোনের কথাগুলো শুনে ‘ঠিক আছে ‘  বলে ফোন রেখে দিলো .মা বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলো .বাবা বললো ওরা বিয়ে দেবে না .কোনো এক জ্যোতিষি নাকি বলেছে এই বিয়ে সুখের হবে না .  কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর আবার দেখাশোনা চলতে লাগলো .এক জায়গায় আবার কথাবার্তা ফিক্সড হলো .কিন্তু এবারেও তারা তুচ্ছ বাহানা করে  বিয়ে কেটে দিলো . এবার বাবা মা দুজনেই চিন্তা করতে লাগলো .প্রতিবার সুমনের বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে কেন ?এবারে সুমনের অফিসের অজিতদা  ওনার একটি আত্মীয়ের মেয়ের জন্য সম্বন্ধ আনলেন .কথাবার্তা ,দেখাশোনা ফাইনাল হয়ে গেলো .কিন্তু আগের দুবারের মতো এবারেও শেষ মুহূর্তে সামান্য ছুঁতোনাতা দেখিয়ে বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো .আসল খবরটা কয়েকদিন বাদে অজিতদা দিলো .একটি ফোন এসেছিল মেয়েটির বাড়ী .একজন মেয়ে ফোন করে পরিস্কার জানিয়েছে সুমনের সাথে তার অনেকদিনের প্রেমের সম্পর্ক . অজিতদাকে অনুরোধ করতে  ফোন নম্বরটা এনে দিলো . সুমনের এক বন্ধু শচীন কোলকাতা পুলিশে ডি এস পি .সুমন তার কাছে গিয়ে সব জানিয়ে সাহায্য চাইলো . শচীন পরের দিন ফোন করে বললো  ‘নম্বরটা ট্রেস করেছি .বালিগঞ্জে বাড়ী .কাল রবিবার সকালে চল .খোঁজ খবর নিয়ে আসি .’ পরের দিন   সকালে দুজনে যেতে যেতে কথাবার্তা হলো .শচীন বললো ‘ ফোনটি মনোরমা বসুর নামে. উনি বিধবা .বিশাল বাড়ীতে একাই থাকেন .একটি ছেলে আমেরিকায় চাকরি করে .  ওনার ফোন থেকে তোর বিয়ের ভাংচি যাবে এটা অবাক লাগছে .’ কিছুক্ষণের মধ্যে মনোরমা দেবীর বাড়ী চলে এলো .বাড়ীর চাকর ওদের দুজনকে বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বললো ‘আপনারা বসুন .মামণি পূজোয় বসেছেন .এখনই আসবেন .’ ওরা দুজনে বসে রইলো .ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো . বিভিন্ন ছবি দিয়ে সাজানো .সব পারিবারিক ছবি .হঠাত্ একটা ছবির দিকে সুমনের নজরে এলো .সুমন ছবিটার কাছে গিয়ে একমনে দেখতে লাগলো .কিছুক্ষণ দেখার পর সুমনের মুখে হাসি ফুটলো .পুরো ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেছে .শুধু কয়েকটা জায়গা ক্লিয়ার হওয়া দরকার .মনোরমাদেবী আসলে দুজনেই নমস্কার জানালো.শচীন  নিজের পরিচয় দিয়ে জানালো সে একটা জালিয়াত চক্রের তদন্ত করছে .তারা বিভিন্ন মানুষের ফোন নম্বর হ্যাক করে ফোন করছে .সম্ভবত তারা মনোরমা দেবীর ফোন হ্যাক করেছে .তাই তাদের ধরার জন্য মনোরমা দেবীর সাহায্য চাই . মনোরমা দেবী বললেন ‘কি সাহায্য করতে পারি বলুন  ?’ শচীন মনোরমা দেবীকে ইন্টারোগেশন করতে লাগলো  .হঠাত্ সুমন মনোরমা দেবীকে প্রশ্ন করলো  ‘ আচ্ছা ,নিউ টাউনে কি আপনার কোনো আত্মীয় থাকেন ?’ মনোরমা দেবী উত্তর দিলেন ‘আমার দাদা কুণাল মিত্র থাকেন . আমি ভালোবেসে বিয়ে করায় দাদা আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন নি .তবে ভাইঝি মাঝে মাঝে আসে .’ সুমন প্রশ্ন করলো আপনার ভাইঝির নাম কি শ্রেয়সী  ? সে কি আপনার ফোন ব্যবহার করে .মনোরমা দেবী চমকে গিয়ে উত্তর দিলেন ‘ হ্যাঁ ,আপনি জানলেন কি করে ?সে মাঝেমাঝে এসে আমার সাথে সময় কাটিয়ে যায় .তখন হয়তো ফোন করে থাকবে .’ আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথাবার্তার পর দুজনে চলে এলো .সুমন শচীন কে বললো ‘তোকে অনেক ধন্যবাদ .আমি সব বুঝতে পেরেছি .আর এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে হবে না .’ ……

তার কয়েক দিন পরে সুমন মাকে জানিয়ে দিলো সুমতি পাশ করার আগে সে বিয়ে করবে না .সুমতি ,শ্রেয়সী দুজনেই খুব ভালোভাবে একদিন পাশ করলো .আরো কিছুদিন বাদে সুমনের বাড়ী থেকে সুমনের বাবা কুণাল বাবুর কাছে শ্রয়সী র সাথে সুমনের বিয়ের প্রস্তাব দিলো .কুণালবাবু রাজী হলেন .একদিন  ধুমধাম করে দুজনের বিয়ে হয়ে গেলো .বিয়েতে শচীন এসে ছিলো .সুমন শ্রেয়সীকে দেখিয়ে শচীনকে চুপি চুপি বললো ‘ এই হলো তোর ফোন কান্ডের আসামী .’ মধুচন্দ্রিমায় সুমন তাদের তদন্তের কাহিনী শ্রেয়সীকে বললো .শ্রেয়সী চুপ করে শুনলো .সুমন বললো একটাই  খটকা আছে ‘ তুমি জানতে কি করে কোথায় আমার দেখাশোনা হচ্ছে ? আর ফোন নম্বর জানতে কি করে ?’ শ্রেয়সী লাজুক মুখে উত্তর দিলো ‘সুমতি সব জানিয়ে দিতো .’ সুমন ফের প্রশ্ন করলো ‘আমি যখন প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ছিলাম  তখন না করে দিয়েছিলে কেন ?’ শ্রেয়সী জবাব দিলো ‘আমি তো আগেই বলেছি আমার বাবা খুব কড়া .আমাদের বাড়ী প্রেম নিষিদ্ধ . এছাড়া আমার কিছু করার ছিলো না .’ সুমন  খোলা জানালা দিয়ে দূর আকাশে চাঁদের দিকে তাকাল .তারপর শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে  ভাবলো ‘ ঐ চাঁদ যেন আজ তার ঘরে চলে এসেছে.’ (শেষ).

No comments:

Post a Comment