Crss colum

Thursday, May 25, 2017

সত্যিকারের ভালোবাসা

নিশা যখন হাওড়া স্টেশনে ঢুকলো তখন ঘড়িতে দশটা বাজে   |  নয় নম্বর প্লাটফর্মে এসে দেখলো রনির বাবা মা দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে   |  নিশাকে দূর থেকে আসতে দেখেই রনির বাবা এগিয়ে এলো  | এক গাল হেসে নিশাকে বললো ‘তুমি আসার একটু আগেই ঘোষণা করলো রাজধানী এক্সপ্রেস দুই ঘণ্টা লেটে আসছে   | তার মানে  বারোটা নাগাদ আসবে   |  আমি আর তোমার মাসীমা একটু কফি খেতে যাবো  | তুমি কি যাবে আমাদের সাথে ?'  নিশা মাথা নেড়ে না বললো | রনির বাবা মা চলে যেতেই নিশা একটা ফাঁকা বেঞ্চি দেখে বসে পড়লো |
আজ রনির জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে মনে পড়ছে একদিন রনি তার জন্য অপেক্ষায় থাকতো | সময় কত দ্রুতগামী | এই তো সব কিছু মনে হচ্ছে গত কালকের কথা  |কলেজে প্রথম বর্ষে যে কটি মেয়ে ভর্তি হয়েছিল তাদের মধ্যে নিশাই ছিলো সবচেয়ে সুন্দরী  |তাই তার পেছনে ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলে লাইন দিয়ে পড়েছিলো |   কয়েকজন তো আকারে ইঙ্গিতে এমনও জানিয়ে ছিলো নিশার কথায়  প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারবে   |  শুধুই পরীক্ষা প্রার্থনীয়   | প্রথম প্রথম কিছুদিন নিশার  অসস্তি লাগতো   |কিন্তু ক্রমে ক্রমে নিশা বেশ উপভোগ করতো   |
একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে  | নিশা যাবো না যাবো না করেও শেষ পর্যন্ত সেদিন কলেজে গিয়ে দেখলো আট দশ জন মাত্র ক্লাসে এসেছে  | প্রফেসাররা ও সবাই আসেন নি  | তাই দুটো ক্লাসের পর ছুটি হয়ে গেলো | তখন মুসলধারে বৃষ্টি হচ্ছে |  কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি  একটু ধরতেই সবাই  এক এক করে হাওয়া হয়ে গেলো | নিশা দেখলো সে আর একটা ফর্সা রোগা পটকা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে | নিশা সেদিন ছাতা আনতে ভুলে গিয়েছিলো   | তাই বৃষ্টি পুরোপুরি না থামা পর্যন্ত  বেরোতে পারছিলো না | এদিকে বৃষ্টি ধরার কোনো লক্ষণ নেই |  ছেলেটি  কিন্তু ছাতা এনেছিলো  |তবুও সে ছাতা খাটিয়ে চলে যাচ্ছিল না | সবাই চলে গেলে ,ছেলেটি গলা খাঁকারি দিয়ে বললো ‘কিছু যদি মনে না করেন ,তবে একটা কথা বলবো ?’ নিশা তার দিকে চেয়ে বললো ‘বলুন  ’ |  ছেলেটি বললো ‘বৃষ্টি তো এক্ষুণি থামবে বলে মনে হচ্ছে না ,চলুন না কলেজের  ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ করে চা খাওয়া যাক | এই বৃষ্টির দিনে ভালোই লাগবে | ’ নিশা ছেলেটির সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলো | সে কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ,আর তাকে অবলীলায় সরাসরি চা খাওয়ার প্রস্তাব ! তবুও নিশা এই একঘেয়ে বৃষ্টির দিন বলে বোধহয় রাজী হয়ে গেলো | ক্যান্টিনটা কলেজের মূল বিল্ডিং এর সামনে খেলার মাঠের একপাশে | বৃষ্টি তখনো পড়ছে | নিশা বললো ‘কি করে যাবো  ? ’ ছেলেটি তখন ছাতা খাটিয়ে বললো 'এই ছাতায় চলে আসুন  | এইটুকু তো রাস্তা !'
অতঃপর দুজনে ক্যান্টিনে গিয়ে দেখলো বৃষ্টির দিন বলে বোধহয় ক্যান্টিন প্রায় ফাঁকা | শুধু কয়েকটি জোড়া কপোত কপোতি এক সাইডের টেবিলে বসে আছে | ছেলেটি দুটি ছোটো কাঁচের গ্লাসে চা আর একটা প্লেটে দুটি ভেজিটেবল চপ নিয়ে একটা  টেবিলের দু সাইডে মুখোমুখি বসলো | বসেই বললো ‘নিন খাওয়া শুরু করুন | ’ নিশা একটা ভেজিটেবলে একটু কামড় দিয়ে বললো ‘আপনার নাম ?’ ছেলেটি বললো  'একই কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে আপনি কথাটা আপত্তিজনক | আমি রনিত | সবাই আমায় রনি বলেই ডাকে | বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র | ' নিশা বললো ‘আমি নিশা | ’রনি মুচকি হেসে বললো ‘জানি | তোমাকে  কলেজের সব ছেলেই চেনে | সবার হার্টথ্রব | ’ নিশা এই কথায় একটু লজ্জা পেয়ে বললো  ‘ওসব ছাড়ুন |তুমি তো ছাতা নিয়েই এসেছিলে  ,তাহলে চলে গেলে না কেনো ?’ রনি ভেজিটেবলটা শেষ করে চায়ে একটা মৌজ করে চুমুক দিয়ে বললো ‘ফাঁকা কলেজ বিল্ডিং এ একটা মেয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকবে এটা ভাবতে খারাপ লাগছিলো ,আর তোমার সাথে আলাপ করার লোভ তো ছিলোই | ’
কিছুদিন পরের কথা কলেজের এখানে সেখানে রনি আর নিশাকে দেখে সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে [Link](http://ashwadimba.wordpress.com) সবাই ভাবতে শুরু করেছে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়েছে |  রনি সত্যি সত্যি নিশাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে  | কিন্তু নিশার দিকে ব্যাপারটা ছিলো অন্য | রনিকে নিশার ভালো লাগতো কিন্তু নিশার কাছে তার চেয়ে বড় ছিলো তার কেরিয়ার |  ছোটোবেলা থেকেই নিশা শুনে আসছে সে সুন্দরী | একটু বড় হতেই দেখেছে ছেলেরা তার জন্য পাগল | এজন্য নিশার মনে ভীষণ গর্ব ছিলো | আর তাই তার মনে জেগেছিলো নামী মডেল হওয়ার বাসনা |  কলেজে পড়ার সময়েই এক নামী প্রতিষ্ঠানে মডেল হওয়ার কোর্সে ভর্তি হয়েছিলো | এই উঠতি সময়ে  রনির ভালোবাসার মতো তুচ্ছ সেন্টিমেন্টের জন্য নিশার জীবন নষ্ট করার মানে হয় না | একদিন রনি নিশাকে বলেই ফেললো কথাটা | সেদিনটাও ছিলো বৃষ্টিঝরা দিন | কলেজে ছাত্রছাত্রী কম | ক্লাসে ষ্টুডেন্ট কম থাকায় দুটি ক্লাস হওয়ার পর বাকি ক্লাস বাতিল হয়ে গেলো | সবাই চলে গেলেও নিশারা কয়েকজন বসে গল্প করছিলো | রনির ক্লাসও বাতিল হয়ে গেছে তাই রনিও এসে নিশাদের সাথে যোগ দিলো | প্রায় সব বন্ধুবান্ধব মনে করতো রনি আর নিশা পরস্পরকে ভালোবাসে | তাই রনি আসায় কেউ কিছু মনে করলো না | [Link](http://ashwadimba.blogpot.in ) একটু ভিড় পাতলা হতেই রনি ও নিশা বিরাট ক্লাসরুমের এক কোণে সরে বসলো |  বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে |  সেই বৃষ্টির দিকেই নিশা তাকিয়ে ছিলো | রনি হঠাত নিশার বাম হাত ধরে নিশার দিকে গাঢ় স্বরে বললো ‘নিশা তোকে একটা কথা বলার ছিলো | ’ নিশা আনমনেই উত্তর দিলো ‘বল | ’ রনি চাপা গলায় বললো ‘নিশা আমি তোকে ভালোবাসি | আমি জানি তুইও আমায় ভালোবাসিস | ’ নিশা রনির কথায় চমকে উঠলো | নিশা আন্দাজ করেছিলো এমন দিন একদিন আসবে | কিন্তু সেই দিনটা যে আজই তা ভাবতে পারে নি | মুহূর্তের মধ্যে নিশা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো | এই ব্যাপারটা কোনোভাবেই বাড়তে দেওয়া যাবে না | সামনে নিশা নিজের উজ্জ্বল কেরিয়ারের হাতছানি দেখতে পাচ্ছে | কোনো ভাবেই তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে ম্লান হতে দেওয়া চলে না | নিশা চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো কেউ রনির কথা শুনতে পায় নি | সবাই নিজেদের গল্পে মশগুল | নিশা প্রথমে নিজের হাতটা রনির হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো | তারপরে গলা নামিয়ে রনিকে বললো ‘আমরা দুজনে শুধুই বন্ধু |  আমি তোকে জীবনসঙ্গী হিসাবে ভাবতেই পারি না | আর তুই যেটাকে ভালোবাসা বলছিস সেটা আসলে তোর মোহ | আশা করি  তোর “সত্যিকারের ভালোবাসার” সন্ধান একদিন পাবি | সেদিন যেনো আমায় ধন্যবাদ জানাতে ভুলিস না | ’
রনি নিশার কথাগুলো চুপচাপ শুনলো | হয়তো নিজের কান কেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না |  এরপর কয়েকদিন রনি কলেজে এলো না | নিশা একদিন ফোন করে জানলো রনির শরীর খারাপ |  আরো কয়েকদিনের পর রনি কলেজে এলে নিশার সাথে দেখা হলো | রনি কেমন যেন নিশাকে এড়িয়ে গেলো | তার কয়েকদিনের মধ্যেই পরীক্ষা চলে এলো | সকলেই ব্যাস্ত হয়ে পড়লো |  পরীক্ষার পর কলেজে যাওয়া বন্ধ | নিশা রনিকে কয়েকবার ফোন করলো কিন্তু প্রতিবারই রনির মা বললো রনি বাড়ী নেই |
পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেলো রনি খুবই ভালো রেজাল্ট করেছে | নিশা রনিকে কনগ্রাচুলেশন জানাতে গেলে রনি বললো ‘কয়েকদিনের মধ্যেই দিল্লী চলে যাচ্ছি | ওখানে হায়ার ষ্টাডি করবো | তোকে আর জ্বালাবো না | ’ নিশা উত্তরে বললো ‘তুই আমায় জ্বালাস একথা কি কোনোদিন বলেছি ? ফালতু সেন্টিমেন্টের পিছনে না দৌড়ে নিজের কেরিয়ারে মন দে | আশা করি একদিন তুই “সত্যি ভালোবাসা” কাকে বলে অনুভব করবি | ’
সেই শেষ দেখা রনির সাথে |
রনির সাথে দেখা না হলেও নিশার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি | হোয়াটস এপের সাহায্যে প্রায়ই খবরের আদানপ্রদান চলে | নিশা জেনেছে রনি এখন  বিশাল বড় মাল্টিনেশানাল কোম্পানীতে অফিসার | দিল্লিতে নিজস্ব ফ্ল্যাট ,গাড়ী সবকিছুই রয়েছে | আর নিশা র নিজের জীবন আগের মতো নেই | মডেলিং করতে গিয়ে নিশা জেনেছে ‘যা কিছু চকচক করে তাহাই সোনা নয় ’ | প্রথমদিকে এই জগতের সব কিছুই মনোমুগ্ধকর মনে হলেও পরে দেখেছে এর কদর্য রূপ | এ জগতে প্রতিভার কোনো দাম নেই | এখানে মেয়েদের উপরের দিকে উঠতে গেলে এমন কিছু দিতেই হয় যেটা নিশা কখনই পারবে না | নিশা উচ্ছাকাঙ্খী বটে কিন্তু খারাপ নয় | তাই আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে | আজ নিশার প্রায়ই মনে পড়ে রনির কথা | সেই মুহূর্তে উচ্ছাকাঙ্খার ভূত যদি মাথায় না চাপতো তবে নিশা হয়তো এতদিনে রনির ঘরণী হতো | হয়তো চুটিয়ে সংসার করতো | কিন্তু রনি সেই যে গেছে প্রায় তিন বছর হতে চললো একবারো বাড়ী আসেনি | নিশা কতোবার ভেবেছে হোয়াটস এপে নিজের মনের কথা লিখে পাঠাবে | কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করেছে  | নিশা বুঝেছে সেদিনের সেই আঘাতের ক্ষত রনির বুকে শুকিয়ে যায়নি | সেই আঘাতের উপর ভালোবাসার প্রলেপ দিতে হলে নিশাকে রনির সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে হবে | তাই দিন তিনেক আগে রনির মেসেজটা পেয়ে নিশা উতফুল্ল হয়ে উঠলো ,এতদিনে রনি বাড়ী ফিরছে | এবারে আর নিশা ভুল করবে না , প্রথম সুযোগেই ক্ষমা চেয়ে নেবে |  মেসেজে রনি জানিয়েছে নিশার জন্য নাকি সারপ্রাইজ আছে | পাগলটা নিশ্চয়ই কোনো দামী গিফট আনছে |
  ' ডাউন রাজধানী এক্সপ্রেস নয় নম্বর প্লাটফর্মে আসছে ' ঘোষণায় নিশার সম্বিত ফিরে এলো | রাজধানী ঢুকছে | কুলীরা দৌড়াদৌড়ি করছে | ঐ তো সবাই নামছে | ঐ তো রনি | নিশার মনে হলো একছুটে গিয়ে রনিকে জড়িয়ে ধরে | কিন্তু রনির আশেপাশে অনেকগুলি মানুষের ভিড় | রনির বাবা  মা এগিয়ে গেলো |  রনি ঝুঁকে প্রণাম করলো ওদের | রনির বাবা রনিকে কিছু যেন বললো   | রনি এদিকে ওদিকে তাকাতে রনির বাবা নিশার দিকে আঙুল দেখালো | নিশা হাত নাড়লো | রনি মালপত্র বাবার কাছে রেখে নিশার কাছে এগিয়ে এসে বললো ‘কেমন আছিস ? ’নিশা হেসে বললো ‘ভালো | ’রনি বললো ‘তোকে একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার আছে | আয় আমার সাথে | ’ এই বলে রনি নিশার হাত ধরে নিয়ে চললো ট্রেনের কাছে | নিশা মনে মনে ভাবলো  'পাগলটা একইরকম আছে | সারপ্রাইজ তো পরে দিলেও চলতো | ' তখনো সবাই ট্রেন নামেনি | রনি সেই জটলার দিকে উদ্দেশ্যে ডাকলো ‘সোমা  ,সোমা | ’ একটা হলুদ চুড়িদার পরা মেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এলো | রনি বললো ‘তোমায়  বলেছিলাম না  আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের কথা | এই হলো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নিশা  | ’ তারপরে নিশার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো ‘একদিন তুই বলেছিলিস আমি আমার “ সত্যিকারের ভালোবাসা ” খুঁজে পাবো | আজ পেয়েছি | ধন্যবাদ তোকে |  এ হলো সোমা কোলকাতার মেয়ে | দিল্লিতে কাজ করে  | আগামী মাসে আমাদের বিয়ে | তোকে কিন্তু আসতেই হবে | ’ নিশা র চোখটা বড় কড়কড় করে উঠলো | চোখের জল কোনোরকমে লুকিয়ে  কাঁপা কাঁপা গলায় বললো ‘আমার ভবিষ্যতবাণী ফলেছে দেখে ভারী খুশী হলাম | আজ আসি রে | অনেক কাজ বাকী আছে | তুই আসছিস বলে সব ফেলে তোর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম | চলি ….. | ’
অনেক রাত্রে বিছানায় শুয়ে বালিশে চোখের জল ফেলতে ফেলতে নিশা বলে চললো “হে ঈশ্বর ……কেন ? …….কেন ? …কেন ? ……” | (শেষ)

No comments:

Post a Comment